Written by bourses
[২৩] স্বভিমানিনী
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় ফিরে এসে একবার শায়নের দিকে তাকায় পর্ণা… ছেলে তখনও ঘুমে কাদা… মুখ তুলে দেওয়াল ঘড়িতে দেখে সবে মাত্র তিনটে বাইশ… মানে এখনও প্রায় হাতে ঘন্টা দুয়েক রয়েছে বাবুর ঘুম থেকে উঠতে… আর তাছাড়াও সুনির্মল আসতে আসতে সেই ছয়টা সাতটা… খানিক ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে… ডায়রির পাতাগুলো যেন তাকে নেশার মত আকর্ষণ করছে… এক পা দু পা করে ফের আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় পর্ণা, তারপর আলমারি খুলে ডায়রিটাকে তাক থেকে টেনে নেয়… বিছানায় উঠে এসে ছেলে পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে খুলে ফেলে ডায়রিটাকে… শেষ যেখানে কাগজের টুকরো গুঁজে রেখেছিল, সেটা বের করে তারপর থেকে আরো কয়একটা পাতা উল্টে এগিয়ে যায় পেছন দিকে…
.
.
.
২৪শে ডিসেম্বর, রবিবার
বাঁধনহারা লাগামছাড়া চঞ্চল এক মন,
ভালোবাসা ঘোরে হয়ে যাই আমি আপন ।
স্বার্থান্বেষী মানুষের আমি যে কেউ নই,
কল্পনার মৃত্যুতে আকাশে উড়িয়ে খই ।
ছুটে চলে যাই দূর বলাকার ঐ দেশে,
লাল মাটির ঠিকানাকে ভালোবেসে ।
স্বার্থের গণ্ডি পেরিয়ে এগোই চিরকাল,
রক্তিম আভায় দেখি সোনালী সকাল ।
আপনভোলা মেজাজে ছুটে চলে যাই,
রূপালী বীথির জলে সাথী খুঁজে পাই ।
ভবঘুরে মন নিয়ে ছুটে যাই অচেনায়,
পিছুটান ভুলে গল্প লিখি নব ভাবনায় ।
জটিলতা ভুলে হারিয়ে যাওয়া পলাতক,
স্বার্থের কুটিরে থাকি না অহেতুক আটক ।
বিস্মৃতির খেলায় যদি হারিয়ে যায় কেউ
ডায়েরির পাতায় মুছে দিই অধ্যায়ের ঢেউ ।
প্রকৃতির টানে ছুটে যাই ফেলে আপনঘর,
অর্থ ক্ষমতা নেশায় বাড়াই না নিজ দর ।
প্রকৃতির খামে খুঁজে বেড়াই শান্তির নাম,
হাসি আর সুখের প্রশস্তিতে জীবনের দাম ।
নদীতীরে লালমাটিতে একতারাতে সুর,
উদাস বাউলের গান ভেসে ওঠে বহুদূর ।
প্রকৃতি দিচ্ছে সেখানে ছন্দের সুরে উঁকি,
উদাস মনটা আমার সেই ঠিকানায় সুখী ।।
.
.
নাহঃ, হলো না… এ ভাবে আমার অন্তত থাকা সম্ভব নয় কোনো মতেই… এই সিদ্ধান্তটা নিতেই হতো, তবে আমার দিক থেকে সেটা নেওয়ার জন্য কোন আফসোস নেই… যেটা করে এসেছি, এটাই হবার ছিল… আমি হারতে শিখিনি কখনো… শিখিনি কারুর অনাধিকার চর্চা মেনে নিতে… মেনে নিতে কারুর বশ্যতা… আমি এমনই… আমাকে এমন করেই গ্রহণ করতে যদি কেউ পারে, তো বেশ, নচেৎ কোন প্রয়োজন নেই আমার সাথে মিলে মিশে থাকার… অন্তত আমি তো সেটা পারবো না… এই ভাবে কারু কাছে মাথা নত করে সব কিছু মেনে নিয়ে থাকতে… আমার রক্তে নেই সেটা… এমনটাই আমি… আর এই আমিটাই নিজে চলতে চাই সারাটা জীবন… এই ভাবেই… মাথা উঁচু করে… কারুর কাছে কোন বশ্যতা স্বীকার না করে…
এখন আমি মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে এসেছে উঠেছি… প্রায় বেশ অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে… এর মধ্যে আর ডায়রি নিয়ে বসার সময় বের করে উঠতে পারিনি… মনের অবস্থাও ছিল না সেটার… আজকে একটু আলিস্যি লাগছে বেরুতে, আগামীকাল ছুটিও, তাই ভাবলাম আমার মনের কথাগুলো একটু লিখে রাখতে ক্ষতি কি…
ঘটনাটা শুরুটা হয়েছিল জুন মাস নাগাদ… হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে জয়েন্টএ বসেছিলাম… ছাত্রী হিসাবে আমি বরাবরই ভালো, তাই মেডিক্যালে চান্স পেতে কোন অসুবিধা হয় নি… রাঙ্কও যথেষ্ট ওপর দিকেই ছিল আমার… আমার ইচ্ছা ছিল দিল্লিতে গিয়ে ভর্তি হওয়ার, কিন্তু দাদু বাধ সাধল… কাউন্সেলিংএ ডাক পেয়েছিলাম অনেকগুলো কলেজ থেকেই, কিন্তু দাদুর ইচ্ছা আমি বাড়ি থেকেই পড়ি, মা মারা যাবার পর থেকে দাদুর আমার প্রতি ভালোবাসা আরো যেন বেড়ে গিয়েছে ভিষন ভাবে… প্রতিটা মুহুর্তে সেটা আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না… আর তাই মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেতে দাদুর কথা মত এখানেই ভর্তি হয়ে গেলাম… আমিও ভাবলাম, দাদু যখন চাইছে, তখন আর কেন শুধু শুধু জেদ করি? তাছাড়া বাপি বা জেঠুরও মত ছিল আমি বাড়ি থেকেই মেডিক্যালটা কমপ্লিট করি… কারন ততদিনে কাকুমনি আইপিএস ট্রেনিংএ বাইরে চলে গিয়েছে… দাদুরও বয়েস হয়েছে… এখন আর আগের মত দৌড়ে বেড়াতে পারে না…
সব ঠিক ছিল… কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও যেন সব সময় একটা ছন্দপতনের সুর বাজতো আমাদের পরিবারের মধ্যে… আর সেটা আমার বাপিকে ঘিরে… মায়ের মৃত্যুটা যেন বাপি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না… আর সেটা না পেরেই ধীরে ধীরে কেমন অদ্ভুত ভাবে একেবারে বদলে যাচ্ছিল… এখন আর আগের মত কথা বলে না… পাঁচটা কথা জিজ্ঞাসা করলে হয়তো একটার উত্তর দেয়… সেটাও যেন কোন রকমে, কর্তব্যের খাতিরে… সারাক্ষণ শুধু নিজের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে মনে হয়… বিষয় আশয় দেখার কোন ইচ্ছা কোনদিনই ছিল না… ব্যবসাটার দিকেও আগে তাও বা একটু দেখা শুনা করতো জেঠুর সাথে… মায়ের চলে যাওয়ার পর থেকে তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে সে সব… ছবি আঁকাটাও বন্ধ করে দিয়েছে… মা নেই এত গুলো বছর পেরিয়ে গিয়েছে… কিন্তু যে বাপি রঙ তুলি কে এত ভালোবাসতো… মায়ের মতই একটা মুহুর্ত রঙতুলি ছাড়া থাকতে পারতো না, সেই বাপিকে একটা দিনও দেখিনি ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে… মায়ের না থাকাটা বাপির ভেতর থেকে একেবারে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছিল যেন… একটা একাকী জীবন্ত শবের মত জীবন যাপন করে চলেছিল… খেতে হয় তাই খাচ্ছে, ঘুমাতে হয় তাই ঘুমাচ্ছে… এর পর যেন জীবনে আর কোন চাহিদা আর অবষ্টি পড়ে নেই বাপির… চেহারাও আগের থেকে ভেঙে গিয়েছে ভিষন ভাবে… যে বাপি আগে রোজ দাড়ি শেভ করতো, সেই বাপি সপ্তাহে যে ক’বার দাড়ি কামায়, সেটাই ঠিক নেই… কখনো কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ এক গাল দাড়ি নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে… এই ভাবে চললে বেশি দিন বাপিকে যে বাঁচানো যাবে না, সেটা বাড়ির সবাইই বুঝতে পারছিল… কিন্তু তার সমাধান কি?
সমাধানটা দাদুই বাতলে দিয়েছিল… বাপিকে আর একবার ছাদনাতলায় দাঁড়াতে হবে…
কিন্তু বাপি তো আর সেই বয়সি ছেলে নয়, যে বাবা বলল আর সেও বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো… এক বয়সে এসে, এই মন নিয়ে কি কেউ পারে এটা করতে? বাপিও সেটা শুনে এক বাক্যে না বলে উঠে গিয়েছিল খাবার টেবিল থেকে… বাড়ির সকলে চুপ করে মাথা নিচু করে বসেছিল উপায়ন্ত না দেখে… কিন্তু এ ছাড়া আর কোন উপায়ও তো কারুর তখন মাথায় আসছে না… এর আগে জেঠু জেম্মা অনেক করে বাপিকে বলেছে, কোথা থেকে একটু ঘুরে আসার জন্য… সেখানেও না… গ্রামের বাড়িতেও আজকাল আর যায়না বাপি… তাও আগে একটু আধটু যেতো, ব্যবসাটা দেখার জন্য… কিন্তু আজকাল সেটাও ছেড়ে দিয়েছে একেবারেই…
সেদিন আমি ঘরে বশে নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, দেখি জেঠু, জেম্মা আর দাদু এসে ঢুকলো ঘরের মধ্যে… এই ভাবে তিনজনকে এক সাথে আমার কাছে আসতে দেখে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম… এই ভাবে সাধারনতঃ তো কেউ আসে না আমার কাছে কোন বিশেষ অভিপ্রায় না থাকলে… আমি চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলাম তিনজনের মুখের দিকে…
জেঠু জেম্মা ইতঃস্থত করছিল কথাটা পাড়তে… দাদু এসে আমার পাশে বিছানায় বসে আমার মাথায় হাত রেখে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল, “পড়াশুনা কেমন চলছে দিদিভাই?”
আমার পড়া কেমন চলছে, সেটা জানার জন্য নিশ্চয় এরা তিনজনে মিলে এক সাথে আমার কাছে আসে নি… আমি হাতের বইটা বন্ধ করে ঘুরে বসি দাদুর দিকে মুখ ফিরিয়ে, বলি… “কি বলতে এসেছ, সেটাই বল পরিষ্কার করে…”
দাদু মুখ তুলে একবার বড় ছেলের দিকে তাকায়, তারপর ফের গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, “আসলে দিদিভাই, তোমার বাপিকে নিয়ে আমরা বড়ই চিন্তিত… তুমি তো দেখছো, তোমার বাপি দিন দিন কেমন অদ্ভুত মন মড়া হয়ে যাচ্ছে… এর তো একটা উপায় বের করতেই হবে… তাই না?”
আমি চুপ করে দাদুর কথা শুনতে থাকি, কোন মন্তব্যে যাই না…
আমায় চুপ থাকতে দেখে এবার জেম্মা এগিয়ে আসে… আমার কাছে এসে মাথা হাত দিয়ে আদর করে বলে, “দেখ তিতাস, তুই তো বড় হয়েছিস… এখন পরিস্থিতি বোঝার বয়স তোর হয়েছে… তাই বলছিলাম যে…” বলতে বলতে থমকায় জেম্মা… বুঝতে পারি, যেটা বলতে চায়, সেটা আমার সামনে নির্দিধায় বলে উঠতে পারছে না কিছুতেই…
গত রাতের কথা আমি ভুলিনি তখনও… খাবার টেবিলে আমার সামনেই দাদু কথাটা পেড়েছিল বাপির সামনে, সেটা শুনে বাপির কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটাও দেখেছি… আর এদের কথার ভনিতায় আমার বুঝতে বাকি থাকে না যে সেই ব্যাপারেই এসেছে এরা তিনজনে মিলে আমার কাছে আর্জি নিয়ে… যতই হোক, আমি বাপির আত্মজা… তাই যতটা না বাপির সিদ্ধান্তের ওপরে এটা নির্ভর করছে, তার অনেকটা আমার নিজের নির্ণয়ের ওপরেও নির্ভরশীল…
আমি জেম্মা থামতে মুখ তুলে তাকাই জেম্মার দিকে… জেম্মার চোখে তখন এক রাশ আশা মেখে রয়েছে যেন… আমি হাত তুলে রাখি জেম্মার হাতের ওপরে… তারপর ধীর গলায় বলি, “আমার কোন আপত্তি নেই… বাপির ভালো যদি এতে হয়, তাহলে আমি কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবো বলে তোমাদের মনে হচ্ছে?”
পাশ থেকে দাদু বলে ওঠে, “না দিদিভাই… সেটা কথা নয়… তুমি বিচক্ষণ, তোমার বুদ্ধিমত্তার ওপরে আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে, আমি জানি তুমি সব দিক বিবেচনা করেই কোন সিদ্ধান্ত নাও… কিন্তু সেটা তোমার বাপি তো বুঝতে চাইছে না… এখানে তোমাকেই এগিয়ে আসতে হবে… তোমার বাপিকে রাজি করাতে হবে তোমাকেই…”
জানি… সবই বুঝতে পারছি… কিন্তু মায়ের স্থানে অন্য কাউকে বসানো? এদের সামনে সেটা মুখে না বললেও, মনে মনে যে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি… এখন শুধু নয়, গতকাল রাতে খাবার টেবিলে কথাটা শোনার পর থেকেই… সেখানে বাপির সিদ্ধান্ত শুনে মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলাম আমি, হয়তো শ্বার্থপরের মত, কিন্তু খুশি সত্যিই হয়েছিলাম…
তখন খুশি হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এখন তো দাদুরা আমার ওপরেই দ্বায়িত্ব বর্তে দিতে চাইছে… আমাকে দিয়েই রাজি করাতে চাইছে বাপিকে… এখন কি বলব আমি? মেনে নাই নিতে পারি এদের কথা… স্বভাবসিদ্ধ ঢংএ ফোঁস করে উঠতে পারি, যা করে থাকি আমি সাধারতঃ কোন কিছু নিজের পছন্দ না হলে… কিন্তু বাপি? আমার নিমরাজিতে বাপির কি কোন ভালো হবে? বাপি আবার আগের বাপি হয়ে উঠবে? বুঝে উঠতে পারি না আমি কিছুতেই… সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে মাথার মধ্যে… আমি চুপ করে আছি দেখে জেঠু বলে ওঠে, “তিতাস… আমি বুঝতে পারছি, তোর মনের মধ্যেও একটা দোটানা চলছে… হয়তো আমাদের কথা ফেলতে পারছিস না, কিন্তু একবার তোর বাপির কথাটাও ভেবে দেখ… তোর মায়ের পর তুইই কিন্তু বাপির কাছে সব … তাই তোরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাপিকে কি ভাবে আগের মত করে তোলা যায় ভেবে নিয়ে…”
আমি মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, “আমায় একটু ভাবতে সময় দাও… আমি কাল সকালে তোমাদের সাথে কথা বলছি…”
রাত্রে বিছানায় শুয়ে ভেবেছি… অনেক ভেবেছিলাম আমি, চেষ্টা করেছিলাম দাদুর বলে যাওয়া পরিস্থিতিটাকে যতটা সম্ভব বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়… তাতে আমার কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, যে বাপির যা মনের অবস্থা মায়ের অবর্তমানে তৈরী হয়েছে, সেখানে সত্যিই একজন সঙ্গীর ভিষন ভাবে প্রয়োজন… যে বাপিকে বুঝবে… বুঝবে আমাকেও… হয়তো মায়ের স্থান সে কখনই নিতে পারবে না… অন্তত আমার কাছে তো নয়ই… কিন্তু তাও… মায়ের স্থানটা না নিলেও এমন একজন মানুষের প্রয়োজন পড়ে জীবনে, যার কাছে নিজের বুকের ভেতরে জমানো কষ্টটাকে কিছুটা হলেও ভাগ করে নেওয়া যায়… সেক্স কি সেটা আমিও জানি… কিন্তু সেটাই তো মানুষের জীবনে শেষ কথা নয়… একটা মুহুর্ত, একটু ভরসা, কিছুটা ভালোবাসা বা ভালো লাগাও বলা যেতে পারে… এই গুলো খুব ছোট আকারে ঘটলেও, প্রয়োজন… বেঁচে থাকতে গেলে… বাঁচার মত বাঁচতে চাইলে…
“দাদু… আমি বাপির সাথে কথা বলছি… তুমি দেখো এদিকটা…” সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে দাদুর উদ্দেশ্যে বললাম আমি… “চিন্তা করো না, বাপি আমার কথা ফেলতে পারবে না…”
শুধু দাদু নয়, দাদুর সাথে জেঠু, জেম্মাও খুশি হয়েছিল ভিষন ভাবে… জেম্মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠেছিল, “আমি জানতাম… তিতাস খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে… ও ঠিক বুঝবে ঠাকুরপোর কষ্টটা…”
বাপি প্রথমে আমার মুখে প্রস্তাবটা শুনে বিশ্বাসই করতে চাইছিল না… কথাটা আমি বলছি বলে… অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ফ্যাল ফ্যাল করে… আমি বাপিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “হ্যা বাপি, তুমি ঠিকই শুনছো… আমিই তোমায় বলছি আর একবার বিয়ে করতে… তোমার জীবনে আর একজনকে নিয়ে আসতে… বিশ্বাস করো…” বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু কথাটা বলতে বলতে গলা ধরে এসেছিল আমার… বুকের মধ্যে কেন জানি না একটা ভিষন কষ্ট হচ্ছিল… বার বার চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠছিল… তাও… তাও আমি নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলাম… বাপিকে এতটুকুও উপলব্ধি করতে দিই নি আমার মনের মধ্যের ঝড়টাকে…
বাপি আমার গাল দুটোকে হাতের তালুতে আঁজলা করে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুই? তিতাস তুই বলছিস এ’কথা? পারবি মা আর কাউকে সে ভাবে গ্রহণ করতে?”
আমি বাপিকে অভয় দিয়েছিলাম… বলেছিলাম, “পারবো বাপি, দেখে নিও… আমি ঠিক পারবো…”
না! পারিনি… সত্যিই পারিনি আমি মেনে নিতে… কিন্তু আমার তরফ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমার… চেষ্টা ছিল না অপর দিক থেকে এতটুকুও… আর তাই আমার মত জেদি বুনো ঘোড়াকে বশে আনতে গিয়ে ভিষন বড় ভুল করে বসেছিলো মহিলা… বাপির নতুন জীবনসঙ্গীনি…
বাপির থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে এক দন্ডও দেরী করে নি দাদু… নিজের তো যোগাযোগের কোন কমতি নেই… প্রায় দিন দশেকের মধ্যেই মেয়ে স্থির হয়ে গেলো বাপির জন্য… বাপি দোজবর, তাই গ্রাম থেকেই মেয়ে পছন্দ করে নিয়ে আসা হলো… আমাদের গ্রাম নয়, এটা আর একটু দূরের… গরীব ঘরের মেয়ে, তবে সত্যিই সুন্দরী… মুখটা বেশ গোলগাল… গায়ের রঙও বেশ ফর্সা, আমার মায়ের মত অতটা না হলেও, বাপির পাশে বেশ মানিয়েছিল ওনাকে… হাইটটা একটু চাপা, কিন্তু শরীর স্বাস্থ বেশ ভালো…
মায়ের বিয়ের সময় দাদু দাঁড়ায়নি এসে, হয়তো মায়ের ওপরে রাগ করে, শুনেছিলাম পরে জেম্মার কাছ থেকে, কিন্তু এবারে দাদু নিজের থেকে দাঁড়িয়ে থেকে বাপির বিয়ের সমস্ত তদরকি করেছে… কিন্তু মায়ের সময় যে আনন্দ সবার হয়েছিল, যে রকম ধূমধাম করে বাপি আর মায়ের বিয়ে হয়েছিল, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল এবারে… কোন রকমে একটা নমো নমো করে সারা হয়েছে বিয়ের পুরো পর্বটা, যদিও সমস্ত আচার অনুষ্ঠানের কোন কিছুরই কম হয়নি, যার বিয়েই হোক, চৌধুরী বংশের বিয়ে বলে কথা, আচার অনুষ্ঠানের প্রতিটা খুটি নাটি একেবারে পুঁথিগত ভাবে সমস্ত কিছু মেনেই হয়েছে… কিন্তু ওইটুকুই… সেই আনন্দ, সেই উচ্ছাস কারুর মনেই ছিল না, বাপির মনে তো ছিল নাই… এটাই তো স্বাভাবিক… আর আমি… আমি ইচ্ছা করেই বেলাডাঙায় চলে গিয়েছিলাম ওই ক’টা দিনের জন্য… দাদুর পার্মিশন নিয়েই… কারন আমি কিছুতেই মায়ের জায়গায় আর কারুর আসাটাকে সচক্ষে দেখতে চাইনি… সহ্যই করতে পারতাম না হয়তো… উল্টে কি উল্টো পাল্টা ঘটিয়ে ফেলতাম মাথার ঠিক না রাখতে পেরে… তার থেকে এই ভালো… সামনেই রইলাম না, সমস্যারও কোন সৃষ্টি হলো না …
আমায় দেখে নতুন মার বোধহয় ঠিক মনে ধরে নি… কারণ আমি বাড়ি ফিরতে জেম্মা আমায় নিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল আমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দিতে… আমি হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম ওনার দিকে… কিন্তু উনি কেমন একটা ব্যাজার মুখে একটা ছোট হাসি টেনে কাজ সারলেন… যতই হোক… নিজেও তো মেয়ে… তাই ওনার ঐ টুকু ব্যবহারেই আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে উনি আমায় ঠিক সেই অর্থে আপন করে নিতে পেরেছেন বলে… আমিও তাই আর কথা না বাড়িয়ে বাপির ঘর থেকে চলে এসেছিলাম কিছু না বলেই… বাপির স্ত্রী, বাপিই ভালো বুঝবে… এখানে আমার কিছুই আসে যায় না…
গ্রামের মেয়ে, তাই মনের দিক থেকে সহজ সরল হবে, এটাই তো আশা করে সকলে… কিন্তু ভদ্রমহিলার রূপ আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে যত দিন পেরোয়… চৌধূরী বংশের এত ঐশর্য, বৈভবের মধ্যে এসে উনি হয়তো মাথার ঠিক রাখতে পারলেন না… ধীরে ধীরে নিজের কতৃত্ব বাড়াতে শুরু করলেন সকলের ওপরে… বাপিও আজকাল দেখলাম একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে কেমন… আগের মত উদাস থাকে না বাপি, বরং ধীরে ধীরে যেন তার বক্তব্যগুলোও ওই ভদ্রমহিলার সাথেই সামাঞ্জস্য হয়ে উঠছে… আর আমি একটু একটু করে সরে যেতে থাকলাম বাপির কাছ থেকে… পরিবারের থেকে… একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম নিজের মধ্যে… নিজের চার ধারে একটা অদৃশ্য গন্ডি টেনে দিলাম, যার ওপারে সচরাচর ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টাও করতাম না আর…
এই ভাবেই ভেবেছিলাম কাটিয়ে দেব যতদিন আছি লেখাপড়া নিয়ে… তারপর মেডিকালটা ক্লিয়ার করে নিয়ে একটা চাকরি নিয়ে অন্য কোন রাজ্যে পাড়ি দেবো… সেই মতই নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম আমি…
কিন্তু ভুলটা করে বসলেন বাড়িতে আসা ওই নতুন ভদ্রমহিলা… উনি ভাবলেন ওনার স্বামীকে যে ভাবে নিজের বশবর্তি করে ফেলেছেন, সেই ভাবেই আমার ওপরেও সকল কর্ত্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবেন… আর সেখান থেকেই বাধলো মতান্তরটা… আমার মত একটা বুনো ঘোড়াকে কি লাগাম পড়ানো যায়? আর সেই ভুলটাই উনি করে বসলেন এসে… যে তিতাসকে ভালোবাসা দিয়ে যে কোন কিছু করানো সম্ভব, সেই তিতাসের ওপরে জোর খাটাতে এসেই সকল বিপত্তির সূত্রপাত শুরু হয়ে গেলো… তাও আমি প্রথম দিকে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আমার চুপ করে থাকাটা উনি আমার দূর্বলতা ভেবে নিলেন… যার ফল স্বরূপ আমার গৃহত্যাগ… এক কথায়, এক বস্ত্রে, একটা সিদ্ধান্তে বাড়ি ছাড়লাম আমি… এসে উঠলাম কলেজ হোস্টেলে… এমনিতে চট করে জায়গা পাওয়া যায় না, কিন্তু এখানেও দাদুর একটু প্রতিপত্তি খাটাতে হলো, আর সেই জন্য রুম পেতেও আর কোন অসুবিধা হলো না আমার…
.
.
.
পাশ থেকে শায়ন উঠে বসেছে দেখে আর এগোয় না পর্ণা… ডায়রির ভাঁজে কাগজ গুঁজে উঠে পড়ে সেও… কখন ঘরটা আঁধার করে এসেছে, খেয়ালই করেনি সে, তাড়াতাড়ি ডায়রি তুলে রেখে হাত পা ধুতে যায় সন্ধ্যেটা দেবার জন্য…