Written by bourses
[৩২] পাড়ি (ক)
এবারে পুরো চৈত্রমাসটায় একটাও ঝড় বৃষ্টি হলো না… অন্যান্য বার এই মাসের মধ্যে কতগুলো কাল বৈশাখী বয়ে যায় আমাদের এই কলকাতা শহরের উপর দিয়ে… কিন্তু এবারে যেন সমস্ত কিছুই কেমন উল্টে গিয়েছে… যার ফলে গরমটাও বেড়ে চলেছে অসহ্য ভাবে… সুনির্মল অবস্য এবারে অনেক বলার পর ঘরে একটা এয়ার কান্ডিশনর লাগিয়েছে… তবে ওকেও দোষ দেওয়া যায় না… এই কোভিডের মহামারীর ফলে অর্থনীতি এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নতুন কিছু ঘরের জন্য করতে বলা মানে বেচারীর উপরে চাপ সৃষ্টি করা… কিন্তু তাও… এখন তো এসি আর বিলাশিতার পর্যায়ে পড়ে না… এটা এখন অত্যাবসকিয়ে প্রয়োজনে এসে ঠেঁকেছে… তাই এই দুপুরে এসিটা চালিয়ে একটু আরাম করে বসতে বেশ ভালোই লাগে… মনে মনে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে চন্দ্রকান্তার ডায়রিতা হাতে নিয়ে উঠে আস বিছানায় সে… এটা তার পাওয়া তৃতীয় খন্ড… আগের ডায়রিগুলোর থেকে এটা অনেকটাই ভালো অবস্থা রয়েছে… একদম প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করে পর্ণা… বালিশের উপরে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে পাতা ওল্টায়…
৩১শে ডিসেম্বর, শনিবার…
বাইরে রীতিমত বরফ পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে… চতুর্দিকটা একটা সাদা চাঁদর দিয়ে যেন কেউ মুড়ে দিয়েছে… বাইরে বেরোনো একটা রীতি মত আতঙ্ক যেন… তবুও… যেতে তো হবেই… এতো আর ছুটি কাটানো নয়, যে ইচ্ছা হলো, আর বেরুলাম না… গাড়িটাকে গ্যারেজে ঢুকিয়ে রেখে ঘরে ঢুকেই একটা হাল্কা ড্রিঙ্ক বানিয়ে ফায়ার প্লেসের সামনে এসে বসে পড়তে হয়েছে তাই… এ ছাড়া সম্ভব না এত ঠান্ডায় সামলানো…
ড্রিঙ্ক এর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আবার ডায়রি খুলে বসলাম আজকে… প্রায় অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে এর মধ্যে… আমার সর্বশেষ ডাইরি লেখার পর থেকে… এই মুহুর্তে আমি লন্ডনে… ক্যাটফোর্ডএ… আমার মায়ের ফ্ল্যাটএ… কালকেই ফ্রান্স রওনা হবো… ব্যাগ পত্তর মোটামুটি সবই গোছানো হয়ে গিয়েছে… এখন হাতে একটু সময় আছে, তাই ডায়রিটা নিয়ে বসলাম… আবার কবে সময় পাবো কে জানে…
হটাৎ করে কি করে লন্ডনে এসে হাজির হলাম? হু… প্রশ্নটা মনের মধ্যে আসাটা খুবই স্বাভাবিক… ছিলাম কলকাতায়… আর হুট করে একেবারে লন্ডনে… মায়ের ফ্ল্যাটে এসে বসে রয়েছি শহরের এক বরফমোড়া সন্ধ্যায়… আবার চলেও যাচ্ছি ফ্রান্স… বেশ… সেটাই বলি তাহলে…
ঘটনাটা যবে শুরু, ততদিনে আমার ডাক্তারি পড়া শেষ… প্রায় মাস সাতেক পার হয়ে গিয়েছে ডাক্তারী ডিগ্রি পাওয়ার পর… বেশ ভালোই রেসাল্ট করেছি… হাউসস্টাফ হিসাবে ওই কলেজেই জয়েন করে গিয়েছি… সারাদিন হস্পিটালে ডিউটি… আর থাকা হোস্টেলের রুমে… যে হেতু হাউসস্টাফ, তাই ডিউটির কোন ঠিকঠিকানা নেই… এক একদিন তো এমনও গিয়েছে যে টানা আট-চল্লিশ ঘন্টাও ডিউটি করতে হয়েছে… হয়তো কোন রকমে স্টাফ রুমে একটু টেবিলের উপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিয়েছি… আবার কোন কেস এলে দৌড়াতে হয়েছে তৎক্ষনাৎ… তবে সত্যি বলতে একটু ক্লান্ত লাগতো ঠিকই, কিন্তু খারাপ লাগতো না… ইমার্জেন্সিতে রুগি বা তাদের বাড়ির মানুষগুলোর অসহায়তা দেখে নিজের ক্লান্তি তখন আর গায়ে লাগতো না যেন… কিই বা করার আছে আমাদের মত জুনিয়র ডাক্তারদের? একে তো ডাক্তারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্টই কম… তার উপরে আমাদের রোস্টারও পড়তো সেই ভাবেই… অবস্য এর ফলে মানসিক দিক দিয়ে নিজেদের অনেক বেশি শক্ত সমর্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে… আর যত কেস হ্যান্ডেল করেছি, ততই আমাদের জ্ঞানএর সমৃদ্ধতা বৃদ্ধি পেয়েছে… ভবিষ্যতের জন্য… খুব ক্রিটিকাল কেস হলে তো সিনিয়ররা বা বড় ডাক্তাররা ছিলই, আমাদের গাইড করে দেবার জন্য…
আমার রুমমেট… সুজাতা বা সুচরিতার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে… তারা কেউই আর এই হস্পিটালএ জয়েন করেনি… ওরা ফিরে গিয়েছিল তাদের শহরে… ডাক্তারি শেষ করার পরেই… ওখান থেকেই সম্ভবত কোন সরকারি হস্পিটালএর সাথে অ্যাটাচড্ হয়ে গিয়েছিল… আমার সাথে আর তেমন যোগাযোগ থাকেনি… অবস্য থাকাটাও অস্বাভাবিক… প্রত্যেকেরই তো নিজের নিজের চাপ রয়েছে… তাই প্রথম দিকে চিঠিতে যোগাযোগ থাকলেও, আস্তে আস্তে তা ফিকে হয়ে এসেছিল… শেষের দিকে একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে… তবে নন্দ মানে সেই হোস্টেলের ছেলেটি ছিল বলে আমার কোন অসুবিধা হয় নি কখনও… ডাক্তার দিদি ডাক্তার দিদি বলে বেশ একটা আত্মীয়তা জমিয়ে নিয়েছিল ছেলেটা… আমারও বেশ লাগতো ওকে… যেদিন আমার ডিউটি থাকতো না… টুকটাক ফাইফরমাস খেটে দিত… আর সেটা বিনা পারিস্রমিকেই… অন্যদের জন্য কিছু এনে দিলে এক পয়সাও ছাড়তো না ব্যাটা… কিন্তু আমার প্রতি কি যেন কেন ওর অন্য রকম একটা টান ছিল… হাজার বললেও কিছুতেই হাতে কিছু নিতো না… তাই শেষে আমি প্রায় লুকিয়েই ওর পকেটে কতদিন টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছি… পরে টাকা পেয়ে ফিরে এসেছে হয়তো… জিজ্ঞাসা করেছে… “ডাক্তার দিদি… তুমি এই টাকাটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলে… তাই না?” আমি হেসে বলেছি… “বয়েই গেছে তোর পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিতে… ওটার বোধহয় ইচ্ছা হয়েছিল তোর পকেটে ঢোকার, তাই ঢুকে গিয়েছে…” জবাবে আর কিছু বলে নি… নাচতে নাচতে ফিরে গিয়েছে সে…
এই ভাবেই বেশ কাটছিল দিনগুলো… মোটামুটি একটা ঠিক করে রেখেছিলাম এখানের পালা শেষ করে বড় কোন হস্পিটালে আপ্ল্যাই করবো বলে… কিন্তু সব ছন্দের পতন ঘটল হটাৎ করে সমু এসে হাজির হতে আমার হোস্টেলে সেদিন…
সে দিনটাও ছিল শণিবার… রোস্টার হিসাবে আমার অফ ডিউটি ছিল সেদিন… আগের রাতের নাইট ডিউটি শেষ করে হোস্টেলে ফিরে একেবারে স্নান সেরে নিয়ে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম… তখনই ঘরের ভিজিয়ে রাখা দরজায় টোকা… মেয়েদের হোস্টেল… তাই বাইরে না বেরোলে আমরা সচারাচর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করি না কখনও… এক রাত ছাড়া… শুধু মাত্র ভিজিয়ে রেখেই থাকি যদি একান্তই প্রাইভেসি চাই… তো!… তবে আমি দরজাটা ভিজিয়ে রেখে দেওয়াই পছন্দ করি… একটু নিজের মত করে ঘরের মধ্যে থাকা যায়… এই আর কি… তা না হলে বাইরের অলিন্দ দিয়ে যাতায়াত করার সময় ভেতরে অটমেটিক্যালি সবার চোখ পড়েই… তাই…
সেদিনও তাই-ই করেছিলাম… কিন্তু ঘরের দরজায় টোকা শুনে শুয়ে শুয়েই ডাক দিয়েছিলাম আমি… কারন সেই মুহুর্তে ঘরে আমি একাই ছিলাম… আমার তখনকার রুমমেট শ্রীতমার আবার মর্নিং ডিউটি পড়েছিল…
আমার গলা পেয়ে দরজা ঠেলে দেখি নন্দ ঢুকলো… অন্য ঘরে ঢোকার সময় কারুর অনুমতির তোয়াক্কা করে না ছেলেটা… কিন্তু আমার ব্যাপারটা বরাবরই একটু স্বতন্ত্র ওর কাছে… দরজা ভেজানো দেখলে টোকা দেয় আগে…
সে যাই হোক… ঘরে ঢুকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ও বলে উঠল… “আর শুয়ে থাকতে হবে না… তলব এসেছে… চলো দেখি দিদি…”
‘তলব’ এসেছে শুনে মনটা একটু খিঁচড়ে যে যায় নি, সেটা অস্বীকার করবো না… আগের রাত্রে বেশ চাপ গিয়েছে আমার… অনেক গুলো অ্যাক্সিডেন্ট কেস এসেছিল পরপর ইমার্জেন্সিতে সে রাতে… তাই শরীর আর যেন চলছিল না… তাও… নিজের বিরক্তিটাকে চেপে রেখেই তাকাই নন্দর দিকে… “আবার কি হলো?” কিন্তু পরক্ষনেই খেয়াল করি, যে ডিউটি চেঞ্জ হলে বা এমার্জন্সি কোন কল থাকলে তো নন্দ আসবে না ডাকতে… তার জন্য তো রাধিকাই আছে আমাদের ডিউটি কোঅর্ডিনেটর… ও তো জীবনকেই পাঠাবে আমায় ডাকতে… এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই নন্দর দিকে… “কিসের তলব রে আবার নন্দ?” প্রশ্ন করি ওকে বিছানার উপরে উঠে বসতে বসতে…
“আরে… নীচে অফিস ঘরে তোমার সাথে দেখা করতে একটা লোক এসেছে… তাই তোমায় ডাক দিতে বলল…” উত্তর দেয় নন্দ…
“লোক?” অবাক হই একটু… “বয়স্ক?” প্রশ্ন করি ফের নন্দকে… বোঝার চেষ্টা করি কে হতে পারে বলে… কারন এখানে মানে হস্পিটালে এসে আমার সাথে দেখা করার লোক খুব একটা নেই সেই রকম… ভাবার চেষ্টা করি বাড়িতে কারুর কিছু হলো কি না ভেবে…
“না না… বয়স্ক নয় গো… বরং একদম ছোকরা মত… তোমার থেকে অনেক ছোট… কিন্তু বেশ বড়লোক… একটা এত্ত বড়ো গাড়ি করে এসেছে…” উত্তর দেয় নন্দ আমার প্রশ্নের…
শুনে বেশ অবাকই হলাম বলা চলে… আমার সাথে দেখা করতে মাঝে মধ্যে যে কাকা আসে না তা নয়… কিন্তু কাকা এলে তো পুলিশ জিপে আসে… এদিকে নন্দ যা বলল, তাতে ছোকরা মত ছেলে কে হতে পারে? তাও আবার নন্দর বর্ণনায় বড়লোক ছেলে… গাড়ি নিয়ে এসেছে… ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি… তারপর নন্দর দিকে পেছন ফিরে পরনের গোল গলা টি-শার্টটা মাথা গলিয়ে খুলে ফেললাম… এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়… নন্দ ঘরে থাকলেও আমার খুব সহজেই জামা কাপড় বদলাই… শুধু যা ওর দিকে পেছন ফিরে থাকি… ব্যস… এর বেশি কিছু না… আর নন্দও আমাদের দেখে দেখে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে… ওরও এ সব নিয়ে কোন বিকার নেই… স্বাভাবিক ভাবেই অপেক্ষা করে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে…
ঘরে আন্লা থেকে ব্রা নিয়ে পড়ে নিই… তারপর পা গলিয়ে ঢোলা প্যান্টটা খুলে ছুঁড়ে দিই বিছানার উপরে… প্যান্টি আমি সচারচর পড়ি না… একান্ত শরীর খারাপের দিনগুলো ছাড়া… আন্লা থেকেই ছাড়া জিন্সটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে আর একটা টি-শার্ট টেনে পড়ে নিই… তারপর নন্দর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়ে স্যান্ডেলটা গলাতে গলাতে বলি… “চল… তোর ছোকরার সাথে গিয়ে দেখা করে আসি…”
ঘাড় নেড়ে এগিয়ে যায় নন্দ… আমি আমার চুলটাকে পেঁচিয়ে একটা হাত খোঁপা করে বাঁধতে বাঁধতে ওকে অনুসরণ করতে থাকি সিড়ি দিয়ে নেমে অফিস রুমের দিকে…
অফিস রুমে ঢুকে ছেলেটিকে দেখে তো একেবারে অবাক আমি… এতো সমু… আমার ভাই… আমার জেঠু মানে বিপ্রনারায়ণ চৌধুরীর বড় ছেলে সমরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী…
এখানে একটু ছোট করে পরিচয় দিয়ে রাখতে চাই… আমার বাবা, মানে সূর্যনারায়ণ চৌধুরী, রুদ্রনারায়ণ চৌধুরীর মেজ ছেলে হলেও, আমি বাড়ির প্রথম সন্তান হওয়ার ফলে আমাদের জেনেরেশনের সবার মধ্যে বড় আমি… আমার জন্মের অনেক পরে রুদ্রনারায়ণের বড় ছেলে বিপ্রনারায়ণের সন্তান হয়… সমরেন্দ্রনারায়ণ আর সৌমেন্দ্রনারায়ণ… তাই এরা জেঠুর সন্তান হলেও আমার চেয়ে অনেকটাই বয়েসে ছোট… এবং আমার ভিষন আদরের… বিশেষ করে এই সমু… আমার ভিষন ভাবে পেটোয়া যাকে বলে আর কি… যখন আমি বাড়িতে থাকতাম, সর্বক্ষণ আমার পায়ে পায়ে ঘুরতো… আর এখন দেখা হয় না ঠিকই, কিন্তু তাও… মাঝে মধ্যেই এই হোস্টেলের ফোনে ফোন করে কথা বলে ও… ওর থেকেই বলতে পারা যায় আমি ও-বাড়ির সমস্ত খবরাখবর পাই প্রতি নিয়ত…
কিন্তু… ও তো কখনও এখানে আসে না চট করে… তাই ওকে দেখে খুশি হলেও, চিন্তাটাও মাথার মধ্যে চেপে বসে আমার… তবে কি বাড়ির কারুর কিছু হলো? তাই কোন ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্ন করি ওকে আমি… “কি রে সমু? হটাৎ? সব ঠিক আছে তো? নাকি…”
আমায় দেখেই ওর চোখদুটো আনন্দে চকচক করে ওঠে যেন… দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে আমায়… “কি রে দি-ভাই… কেমন আছিস…”
অনেক দিন পর ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে আমারও ভেতরটা যেন হু হু করে ওঠে… শক্ত করে ভাইকে জড়িয়ে ধরি আমিও আমার বুকের মধ্যে… বুকের মধ্যে একরাশ ভালোলাগার প্রজাপতি যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে থাকে… ওর মুখের খুশি দেখে নিশ্চিন্তও হই যে কোন বিপদের খবর নিয়ে ও আসেনি আজ…
একটু ধাতস্থ হলে ওকে একটা চেয়ারে বসতে বলে আমি মুখ তুলি… কারণ আমি জানি নন্দ তখনও অপেক্ষা করছে ঘরের মধ্যে… আমি কিছু আনতে দেবো কিনা সেটা জানার জন্য…
এই সময় চৌধুরী বাড়ির কেউ চা খায় না… আমার ব্যাপার আলাদা… আমার সব কিছুই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বাড়ির বাইরে থাকতে থাকতে… কিন্তু ভাইদের সে অভ্যাস যে নেই, সেটা আমি জানি… তাই নন্দর দিকে তাকিয়ে বলি, “একটা কাজ করনা… ভাইয়ের জন্য একটু লস্যি নিয়ে আয় না…”
নন্দ কিছু বলার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে সমু… “না না দি-ভাই… এখন ও সব খাবার সময় নেই আমার… আমি কলেজ যাব… তোকে একটা জিনিস দেবার জন্য এসেছি…”
আমি আর জোর করি না ওর কথা শুনে… নন্দও বোঝে যে এখন ওর এখানে থাকার আর কোন কারণ নেই, তাই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে আমাদের ছেড়ে দিয়ে… আমি সমুর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করি… “আমার জন্য আবার কি দিতে এসেছিস?”
আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সমু ওর পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে… “এই নে… এটা তোর নামে এসেছে… বাড়ির ঠিকানায়…”
“আমার নামে চিঠি?” একটু অবাকই হলাম বলা চলে… আমায় চিঠি পাঠাবে… এমন তো কেউ নেই… জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়েই তাকাই সমুর বাড়িয়ে ধরা খামটার দিকে…
সাদা খাম… খামের চার ধারে নীল আর লালএর দাগ ছাপানো… বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার… এই রকম খাম এ-দেশের নয়… তার মানে বিদেশ থেকে কেউ লিখেছে… কিন্তু কে?
দ্বিধাভরা মনে খামটা ওর হাত থেকে নিয়ে উল্টে পালটে দেখি আমি… উপরে পরিষ্কার হাতে গোটা গোটা ইংরাজি হরফের আমার নামই লেখা – চন্দ্রকান্তা চৌধুরী… ঠিকানা, আমাদের বাড়ির… ডাক টিকিটার উপরে নজর পড়তে বুঝলাম ওটা এসেছে ইয়ু কে থেকে… কেন জানি না… হটাৎ করে মনের ভেতরটা দুলে উঠল আমার… ইয়ু কে… আমার মায়ের দেশ…
আমি বাস্তববাদী… আমি অনুভূতিপ্রবণহীন… আমার মনটা নাকি পাথর দিয়ে গড়া… চট করে আমার মন কেউ নাড়া দিতে পারে না… আমি স্পষ্টবক্তা… আমি সোজা কথাটা সোজা বলতেই পছন্দ করি সব সময়… এমনটাই আমার চেনাশোনা সবাইএরই বিশ্লেষণ… আমিও সেটাই রক্ষা করার চেষ্টা করি সর্বদা… চেষ্টা করি নিজের ব্যক্তিত্বটাকে এমন ভাবে তুলে ধরতে যাতে সকলের মনে হয় আমার চার পাশে একটা পাথরের প্রাচির রয়েছে… যেটা লঙ্ঘণ করে আমার মনের গভীরে পৌছানো সম্ভব নয় কিছুতেই… বা বলা যায় দুঃসাধ্য… এহেন দি-ভাইকে খামটা হাতে নিয়ে অমন ভেবলে যেতে দেখে বোধহয় সমুও অবাক হয়ে গিয়েছিল…
চুপ করে খানিক খামটা হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইলাম… গলার মধ্যে একটা কেমন দলা পাকিয়ে উঠেছিল… মনে হচ্ছিল যেন খাম নয়… আমি আমার মায়ের কোমল হাতটাকে হাতের মধ্যে ধরে বসে রয়েছি… মায়ের স্নেহের পরশ আমার সারা শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে…
সম্বিত ফেরে সমুর কথায়… “কি রে? খুলে দেখ কার চিঠি…”
“অ্যাঁ… হ্যাঁ… এই তো… দেখছি…” মুখ তুলে একবার ক্ষনিকের জন্য ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ নামাই… চোখের কোলে গড়ে উঠতে থাকা কান্নাটাকে কোন রকমে সামলে নিয়ে… আলোর দিকে চিঠিটাকে তুলে দেখে নিই ফাঁকা দিকটা… তারপর সেই অংশটাকে ছিঁড়ে বের করে আনি ভেতরে থাকা সযত্নে মোড়া কাগজটাকে… খামটার উপরেই খুলে মেলে ধরি ঝরঝরে হাতে ইংরাজিতে লেখা চিঠিটাকে চোখের সামনে…
“প্রিয় চন্দ্রকান্তা,
আমি স্যামুয়েল, অলিভীয়ার বড় দাদা, সম্পর্কে তোমার মামা হই… অনেক আশা নিয়ে তোমায় এই চিঠিটি লিখতে বসেছি… জানি না, কবে তুমি এই চিঠি পাবে… খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে কি না… তবে যখনই পাও… আমার অনুরোধ, একবার অন্তত ব্রাডফিল্ডস্এ আসার চেষ্টা কোরো…
তোমার মা এই বাড়ি যেদিন ছেড়ে চলে যায়, সেদিন আমি বা আমার ভাই, রিচার্ড, কেউই উপস্থিত ছিলাম না… জানি না থাকলেও কিছু করতে পারতাম কি না… কারণ তুমি কতটা জানো জানি না, কিন্তু আমাদের মা, মানে দ্য কাউন্টেস অফ ব্র্যাডফিল্ডস্… খুবই প্রভাবশালিণী ব্যক্তিত্ব… এবং আমাদের মাথার উপরে ওনার ছায়া এমন ভাবে মেলে ধরে রেখেছেন, যে ওনার নেওয়া কোন সিদ্ধান্তকে অসন্মান জানানো আমাদের কারুর পক্ষ্যেই সম্ভব নয়… আগেও ছিল না… আজও বলতে পারো নেই… কিন্তু সেই সাথে আমার বোন, মানে তোমার মা, অলিভীয়াও তো একই রক্তে গড়া… তার শরীরের শিরায় আমাদের মায়ের রক্তই ছিল… তাই তারও জেদ বলো আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার ক্ষমতা বলো, সেটা একই… আর তাই আমরা চিরতরে আমাদের আদরের বোনটাকে হারিয়ে ফেললাম… শুধু মাত্র আমার মায়ের কিছু চটজলদি আর মাথা গরম করে নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য… এখন… এতদিন পর সে নিয়ে কোন কাটাছেঁড়া করতে বসতে চাই না… যেটা ঘটার সে তো ঘটেই গিয়েছে বহুদিন আগে… আর আমাদের বোনটাও হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে… তাকে আজ আর হাজার চাইলেও ফিরিয়ে আনতে পারবো না…
আমাদের বোনটাকে হারিয়েছি… কিন্তু তার দেহের অংশে গঠিত আমাদের একমাত্র ভাগনীটাকে হারাতে চাই না কোন মতেই…
তুমি হয়তো জানোই না, যে আমরা এখানে বসে তোমাদের সমস্ত খবর রেখে চলেছিলাম প্রতিনিয়ত… অলিভীয়ার ওখানে গিয়ে থাকা, সূর্যর সাথে ওর বিয়ে… তোমার জন্ম… তারপর অলিভীয়ার মৃত্যু… এভাবে হটাৎ করে আমাদের বোনটা যে হারিয়ে যাবে, সেটা কল্পনাও করতে পারিনি কখনও… খুব ইচ্ছা করেছিল, একবার গিয়ে তোমাদের পাশে দাঁড়াই… কিন্তু পারি নি… পারি নি মায়ের কথা ভেবে… পারি নি অলিভীয়ার সিদ্ধান্তের সন্মান জানাতে… কারণ সেদিন যে ভাবে বড় মুখ করে সে এই বাড়ি ছেড়েছিল… তাতে তার সিদ্ধান্তের সন্মান করি আমরা… আমি এবং রিচার্ডও… তাই হাজার কষ্ট হলেও যাইনি ভারতবর্ষে…
এরপর শুনেছি সূর্যের পরবর্তি কালে ফের বিবাহে আবদ্ধ হওয়াও… ভালোই করেছে সে… যে ভাবে ও অলিভীয়াকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিল, তাতে ওর ক্ষতিই হচ্ছিল… অলিভীয়াও নিশ্চয়ই চাইতো না তার আদরের সূর্যকে এই ভাবে একটু একটু করে শেষ হয়ে দিতে… কিন্তু যখন জানতে পারলাম যে তোমার সাথে তোমার সৎ মায়ের মনের অমিল হচ্ছে, তখন খুব খারাপ লেগেছিল… কারণ এটা জানতাম, তুমি তোমার বাড়ির খুবই আদরের সন্তান… প্রত্যেকের চোখের মণি… সেখানে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছ জেনে খারাপ লেগেছিল… কিন্তু এটাও বুঝেছিলাম… এখানেও সেই একই রক্তের উপস্থিতির ফল… যে জেদ ছিল তোমার মায়ের মধ্যে… সেই একই জেদের প্রতিফলন তোমার প্রতিটা আচার ব্যবহারের মধ্যে… আর তার উপরে আবার তুমি নিজেই রাজ বংশের মেয়ে… সেই মত তোমার নিজস্ব স্বভিমানের পরিমাণ আরো বেশি… আরো দৃঢ়… তুমি আজ ডাক্তার হয়েছ… তাতে আমরাও গর্বিত বোধ করছি… অলিভীয়ার মেয়ে ডাক্তার… এটা ভিষন ভালো একটা খবর… আমাদের আশির্বাদ সব সময় তোমার মাথার উপরে থাকবে…
সবই ঠিক ছিল… আমরাও হয়তো তোমায় কখনই বিরক্ত করতাম না… কিন্তু আজকে তোমায় প্রায় বাধ্য হয়েই চিঠিটা লিখছি… আমার মায়ের মানে তোমার দিদিমার কথা রাখতে গিয়ে…
তোমার দিদিমা খুবই অসুস্থ… বলতে পারো উনি মৃত্যুসজ্জায়… কতদিন উনি বাঁচবেন জানি না… তাই উনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান, অলিভীয়ার উত্তরসুরিকে একবার চোখের দেখা দেখতে চান… এটা তার শেষ ইচ্ছা… অলিভীয়া চলে যাবার পর উনিও যে খুব ভালো ছিলেন তা নয়… কিন্তু নিজের সন্মানের কথা ভেবে… নিজের সিদ্ধান্তের কথা মাথায় রেখে… পারিবারিক দাম্ভিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে হয়তো মুখ ফুটে কোন দিন সে কথা বলতে পারেন নি ঠিকই… কিন্তু মনে মনে নিজের মেয়েকে হারিয়ে ফেলার শোক কখনই ভুলতে পারেন নি… আর যেদিন অলিভীয়া হারিয়ে গেলো চিরতরে… সেদিন থেকেই তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন… একের পর এক রোগে আক্রান্ত হতে থাকলেন… ভেঙে পড়তে থাকলো স্বাস্থ… সেদিনের কাউন্টেস আর আজকের কাউন্টেসের মধ্যে যেন যোজন ফারাক… নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধে যাচ্ছেন প্রতি দিন… তাই, আমার একান্ত অনুরোধ… একবার… শুধু মাত্র একবার এখানে এসো তুমি… এসে দাঁড়াও তোমার দিদিমার পাশে… হয়তো তোমায় একবার চোখের দেখা দেখলে শান্তিতে মৃত্যুকে বরণ করতে পারবেন… অলিভীয়াকে হারিয়ে যে আফসোস হয়েছে ওনার, সেটা কিছুটা পূরণ হবে তোমার উপস্থিতিতে…
আমি জানি, এত দিন পর হটাৎ করে এই রকম একটা অনুরোধ করা আমার উচিত হচ্ছে না… হয়তো ভাবছ আমি আমার শুধু মাত্র মায়ের কথা ভেবে তোমার স্বভিমানের কোন গুরুত্বই দিচ্ছি না… প্লিজ… সেটা ভেবো না… আমি জানি কি পরিমাণ পাহাড় প্রমাণ অভিমান আর যন্ত্রণা তোমার মনের মধ্যে পুষে রেখেছ… সেটা বুঝেও আমার একান্ত অনুরোধ… মৃত্যু পথযাত্রী একটি মানুষের শেষ ইচ্ছাটুকু যদি রাখতে পারো, তাহলে সারা জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো…
তুমি সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছ… এখন তোমার সামনে প্রচুর সম্ভাবনা পড়ে রয়েছে… এই সময় যদি তুমি তোমার পড়াশুনাটা এখানে থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও… তাহলে তার সমস্ত কিছুর আয়োজন করে দিতে পারলে নিজের খুব ভালো লাগবে আমাদের… অন্তত নিজের মায়ের কথা মাথায় রেখেও যদি সেই ইচ্ছাটুকুর মর্যাদা দাও, তাহলে আর কিছু চাইবো না তোমার কাছে…
আশা করি তোমায় আমাদের মনের অবস্থাটা তুলে ধরতে পেরেছি… এবার তোমার নিজের সিদ্ধান্তের উপরে সব কিছু নির্ভর করছে… একটু মরণাপন্ন মানুষের শেষ ইচ্ছাটুকু তুমি রাখবে কি না ভেবে দেখো…
ভালো থেকো…
তোমার বড় মামা
স্যামুয়েল…
পাড়ি (খ)
চিঠিটা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি আমি… তারপর সেটা হাতে ধরে চুপ করে বসে থাকি বেশ খানিকক্ষন সমুর সামনে, চেয়ারের উপরে… ও বোধহয় বুঝেছিল যে সেই মুহুর্তে কিছু না বলাই উচিত… তাই কোন কথা বলে না… হয়তো ওর ফেরার দেরী হয়ে যাচ্ছিল, তাও… তাও চুপ করে আমার সামনে বসে থাকে… আমার মনের মধ্যে বয়ে চলা ঝড়টাকে একটু সামলাতে সময় দিয়ে…
একটু বেশিই সময় নিলাম নিজেকে সামলাতে… ততক্ষনে মনস্থির করে ফেলেছি… ডাক্তারি পরীক্ষায় বেশ ভালোই রেসাল্ট করেছিলাম… আর তাই তখনই ভেবে নিয়েছিলাম এফআরসিএস করতে আমায় লন্ডন যেতেই হবে… সেই মত ওখানকার কলেজের সাথে যোগাযোগও করছিলাম… একটা সম্ভাবনার কথাও উঠে আসছিল… এখন হাতে এই চিঠি… যদি ওখানে যেতেই হয়, তাহলে এখনই বা নয় কেন? আমার যা রেসাল্ট, তাতে ডাইরেক্ট অ্যাডমিশন হয়ে যেতে পারে… আর যদি না হয়… তাহলেও কুছ পরোয়া নেই… এন্ট্রান্স এক্স্যামে বসবো… ক্র্যাকও করে যাবো নিশ্চয়ই সে পরীক্ষায়… তার জন্য আর একটু কষ্ট করতে হবে… হয়তো কোথাও একটা ছোট খাটো চাকরী জুটিয়ে নিতে হবে… হয় কোন পাবএ… বা কোনো রেস্তোরায়… তাতে হাতে কিছু পয়সা আর মাথা গোঁজার একটা জায়গা জুটিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না… কিন্তু… এখানে একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে… যাবার ভাড়া… সেটা জোগাড় করাটাই আসল… কারণ বাড়িতে যদি জানতে পারে, তাহলে যাওয়াটা কোন সমস্যাই নয়… কিন্তু সেটা তো আমি কোন মতেই জানাবো না… ওবাড়ির কারুর কাছে আমি হাত পাতা তো দূর অস্ত এক কানাকড়ি সাহায্যও নেবো না কোন মতেই… তাতে একটাই বিকল্প খোলা আছে… এখান থেকে মাদ্রাস… সেখান থেকে সমুদ্র পথে লন্ডন… তাতে সময় বেশি লাগবে ঠিকই কিন্তু ভাড়া অনেকটাই কম হবে…
এদিকে চিঠি পড়ে যা বুঝলাম, তাতে দিদিমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়… মামা লিখেছেন যে উনি মৃত্যুশয্যায়… তার মানে হাতে সময় খুবই কম… এই সময় যদি জাহাজে যাই, তাতে সময়ের অপচয় অনেকটাই হবে… ভাবতে ভাবতে তাকাই মুখ তুলে… আর তখনই সমুকে দেখেই মাথার মধ্যে একটা সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে… ইয়েস… সম্ভব… টাকা যোগাড় হয়ে যাবে… যদি সমু আমায় একটু সাহায্য করে… ভাবতে ভাবতে চিঠিটা সমুর দিকে এগিয়ে দিলাম আমি…
“কি?” চিঠিটা হাতে নিয়ে তাকায় আমার দিকে সমু…
“কি আবার? পড় চিঠিটা…” উত্তর দিই আমি…
“পড়বো?” পরের চিঠি পড়তে গিয়ে একটু কুন্ঠিত বোধ করে ভাই… সেটা বুঝতে পারি আমি…
“পড়ার জন্যই তো বাড়িয়ে দিলাম… পড়ে দেখ… তারপর বলছি…” বলে উঠি আমি…
আর কোন দ্বিরুক্তি করে না ভাই… চিঠিটাকে চোখের সামনে মেলে ধরে পড়তে থাকে মন দিয়ে… আমি শান্ত মনে অপেক্ষা করি ওর পড়া শেষ হওয়া অবধি…
পড়া হয়ে গেলে মুখ তোলে সমু…
“কি বুঝলি?” জিজ্ঞাসা করি আমি…
“তোর দিদিমা খুব অসুস্থ!” আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় সমু…
“হু… মামা তো তাইই লিখেছেন…” জবাব দিই…
“কি করবে ভাবছিস? যাবি?” ফের প্রশ্ন করে ভাই…
মাথা নাড়ি আমি ওর কথায়… “যাবো…” তারপর একটু থেমে বলি, “দেখ… এফআরসিএসটা করতে তো এমনিতেই আমি ভেবেছিলাম যাবো লন্ডনে… তাহলে এখন নয় কেন? তাই না? আমার কলেজে জয়েন করাও হবে, আবার দিদিমার শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করা হবে… তুই কি বলিস?” ফিরিয়ে প্রশ্ন করি ভাইকে…
“হ্যা… এটা তো বেশ ভালো কথা… তাহলে আমি বাড়ি গিয়ে বলি কাকান কে!” উৎসাহিত স্বরে বলে ওঠে সমু…
কাকান মানে আমার বাবা… ও আমার বাবাকে কাকান বলে… আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারি না ওর কথায়… “কাকান কে বলবি মানে?”
“না… মানে তুই বিদেশ যাবি, তার জন্য তো টাকার প্রয়োজন… তাই আমি গিয়ে…” ওর কথাটা শেষ করতে দিই না আমি… ঝাঁঝিয়ে উঠি ওর কথার মাঝেই…
“তুই এই চিনেছিস আমায়?”
আমার ঝাঁঝানোতে মিইয়ে যায় ভাই… আমতা আমতা করতে থাকে… কিছু বলতে যায় সে… আমি হাত তুলে থামিয়ে দিই তাকে…
“তুই থাম… অনেক ভেবেছিস… এখন আমার কথাটা আগে মন দিয়ে শোন…” তারপর একটু থেমে বলতে থাকি… “তোর কি মনে হয় আমি আমার বিদেশ যাত্রার জন্য বাড়িতে হাত পাতবো?”
“আহা… হাত পাতার কথা কোথা থেকে আসছে দি-ভাই?” প্রতিবাদ করে ওঠার চেষ্টা করে সমু…
আমি দৃঢ় স্বরে বলে উঠি… “ও বাড়িতে টাকা চাওয়া মানে হাত পাতাই হলো… আর যেখানে আমি সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, সেখানে আবার গিয়ে টাকা চাইবো! ভাবলি কি করে?”
“না সেটা নয়… আমি সে ভেবে বলতে চাই নি… আমি বলছিলাম যে…” মিনমিনিয়ে বলতে শুরু করে সে…
আমি ফের তাকে তার কথার মাঝেই থামিয়ে দিই… “তোকে আমার হয়ে শুধু একটা কাজ করতে হবে… সেটা কি পারবি?”
সোজা হয়ে বসে বলে ওঠে সমু… “হ্যা হ্যা… তোর জন্য সব করতে পারবো দি-ভাই… শুধু বল একবার… কি করতে হবে…”
“হু… বেশ…” ওর কথায় নিশ্চিন্ত হই… “শোন… আমি ভেবে দেখলাম এই মুহুর্তে ওদেশে যেতে হলে যে পরিমাণ টাকার দরকার, সেটা আমার হাতে নেই…” আমার কথার মধ্যে কোন কথা বলে না সমু… চুপ করে তাকিয়ে শুনতে থাকে… “এখন এতগুলো টাকা জোগাড় করতে একটাই কাজ করা যেতে পারে… সেটা হলো আমার নিজস্ব ও-বাড়িতে যা যা গয়না আছে… আর আমার মায়ের যা আছে… তা মিলিয়ে বিক্রি করলে অনেকগুলো টাকাই হয়ে যাবে… আর যে হেতু এ সবই আমার আর মায়ের… তাই আর কারুর কিছু বলার অধিকার নেই…” বলতে বলতে আমি থামি… তাকাই ওর মুখের দিকে… বোঝার চেষ্টা করি যেটা বলছি সেটা ওর বোধগম্য হচ্ছে কি না… “কিন্তু আমি ও বাড়ি যাবো না… অথচ গয়না আছে মায়ের আলমারীতে… আর ওটার চাবি আছে আমার কাছে…”
আমার কথার মাঝেই প্রায় তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ভাই… মুখের অভিব্যক্তিতে প্রায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা ওর… “আমায় তোর আলমারী খুলে গয়না আনতে হবে?”
“ঠিক তাই… আমি তোকে আমার আলমারীর চাবি দিয়ে দেবো… তুই ওটার লকার খুলে গয়না নিয়ে এসে আমায় দিবি… ব্যস… আমার যাওয়ার টাকার যোগাড় হয়ে যাবে…”
অন্ধকার নেমে আসে ওর মুখে… “কিন্তু দি-ভাই… যদি কেউ বলে কিছু… মানে বাড়ির গয়না… তুই বেচে দেবি…”
“আরে! অদ্ভুত তো!… আমার গয়না আমি রাখি না বেচি তাতে কার কি বলার আছে?” ওর দ্বিধায় আমি একটু রেগেই যাই… “আর আমি তো আর গয়না বেচে ফুর্তি করতে যাচ্ছি না…”
ঢকঢক করে মাথা হেলায় ভাই… “না না… তা তো বটেই… ঠিক আছে… তুই বলছিস যখন… আমি এনে দেবো তোর গয়না… তুই চিন্তা কোরিস না…” কথাটা বলে ঠিকই, কিন্তু সেটা যে একান্তই বাধ্য হয়ে, সেটা বলার প্রয়োজন থাকে না… এক দিকে ওর বাড়ি… অন্য দিকে ওর দি-ভাই… ওর তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা… বুঝে উঠতে পারে না সে কি করবে বলে…
আমি সেটা বুঝে ওকে আস্বস্থ করি… “অত চিন্তা করিস না… কিচ্ছু হবে না… তবে একটা কথা মাথায় রাখবি… কেউ যেন জানতে না পারে… চুপচাপ কাজটা সারবি…” বললাম বটে, কিন্তু কতটা ওকে বোঝাতে পারলাম সেটা বুঝলাম না… যতই হোক… এতো এক প্রকার চুরিই… নিজের জিনিস নিজেই চুরি করার মত…
“দাঁড়া… চাবিটা এনে দিই তোকে…” বলে ওকে অফিস রুমে রেখেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই আমি… চাবি আনতে…
.
.
.
গাধা আর কাকে বলে… আলমারী খুলে গয়না বের করতে গিয়ে ভাই একেবারে পিমার হাতে ধরা পড়ে গেলো… ব্যস… আর তারপর যাকে বলে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে গেলো বাড়িতে… ভাইকে ধরে জেরার পর জেরা… ও তিতাসের আলমারীর চাবি কোথায় পেলো? কেনো খুলেছে? কি নেবার জন্য খুলেছে… এ বাড়িতে এ ধরণের ঘটনা কোন দিন ঘটেনি… ও এ বাড়ির ছেলে হয়ে কোন সাহসে সেটা করতে গিয়েছে!… তিতাস যদি কোন দিন জানতে পারে, ওর মুখ কোথায় থাকবে!… কি করে এ দুঃসাহস করলো ও… ইত্যাদি ইত্যাদি…
ও যত বোঝায় যে দি-ভাই ওকে চাবি দিয়েছে একটা দরকারী জিনিস নেবার জন্য… কিছুতেই কেউ বোঝে না সে কথা… কেউ বিশ্বাসই করে না ওর কথা কিছুতেই… বাড়ির সবার বক্তব্য হলো যে তিতাস এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙায় নি প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেলো, সেই তিতাস ওকে চাবি দিয়েছে… এটা হতেই পারে না… ও নির্ঘাত কোন ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে তিতাসের আলমারী খুলে কিছু নিতে গিয়েছিল…
শেষে আমার হোস্টেলে ফোন… দুপুরে আমার ডিউটি ছিল, তাই আমায় সেই সময় ফোনে পায় নি… কিন্তু আমি হোস্টেলে ফিরতেই খবর পেলাম যে বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল নাকি… যোগাযোগ করতে বলেছে… আমি সেই শুনে ফোন করলাম বাড়িতে… ফোনটা ওঠালো পিমাই… আমি বলছি শুনেই প্রথম প্রশ্ন… “হ্যা রে… সমু বলছে যে তুই নাকি ওকে তোর আলমারীর চাবি দিয়েছিস? এটা সত্যিই?” আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই শুনলাম আরো বেশ কিছু লোকের গলার স্বর… বুঝলাম ভাই নির্ঘাত ধরা পড়ে গিয়েছে… আর সেটা নিয়েই কোন ঝামেলা হচ্ছে বাড়ির মধ্যে… দুপুরে ফোন এসেছিল, আর এখন প্রায় রাত আটটা… মানে সেই থেকে চলছে বাড়ির মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে… কানে এলো সমুর গলা… একটু তফাৎ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে দেখি, “দেখ দি-ভাই… এরা সবাই আমায় চোর ভাবছে… বলছে যে আমি নাকি তোর আলমারী খুলে চুরি করতে গিয়েছিলাম…”
আমি শান্ত ধীর গলায় বললাম পিমাকে… “হ্যা… আমিই দিয়েছি ভাইকে চাবিটা…”
আমার উত্তরটা শুনে পিমা কাউকে সেটা বলল বুঝলাম… এরপরেই বাবার গলা ফোনে… পিমার হাত থেকে ফোনের রিসিভারটা নিয়ে আমায় বলে উঠল, “ওরে… তোর কি দরকার আমায় তো বলতে পারতিস… শুধু শুধু সমুকে কেন চাবি দিতে গেলি?”
আমি বললাম… “আমি মায়ের কিছু জিনিস নেবো, আমার দরকার, তাই চাবিটা সমুকে দিয়েছিলাম ওগুলো আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য…”
বাবা কিছু বলার আগেই শুনি পাশ থেকে নতুন মা বলে উঠল… “চাবি ও নিজের কাছে রেখে দিয়েছে মানেই কি ফ্যামিলির প্রপার্টি ওর একার হয়ে গেছে নাকি? ইচ্ছা হলেই বের করে নিয়ে যেতে চাইছে?”
কথাটা কানে যেতেই ব্যস… দুম করে আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো যেন… আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম বাবাকে… “বাপি… আমি আসছি বাড়িতে… তারপর যা করার করছি…” বলে আর কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুম করে ক্র্যাডেলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম… তারপর নিজের রুমে গিয়ে ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা তুলে নিয়ে একটা ছোট হাত ব্যাগে পুরে ওই সারাদিনের হস্পিটালের ড্রেস পড়া অবস্থাতেই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা বাড়ি… অন্য সময় হস্পিটালের ডিউটি থেকে ফিরে বেরুবার হলে সারা দিনের পড়া ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিই সাধারনত… কিন্তু সেই সময় মাথার মধ্যে দাবানল জ্বলছে…
বাড়ির সদর দরজা পেরোবার সময়ই বেশ অনেক গুলো গলার সমষ্টি কানে এলো আমার… বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বৈঠকখানার ঘরে এই মুহুর্তে এখন প্রায় বাড়ির সকলেই উপস্থিত… মানে তখনও ব্যাপারটা নিয়ে সকলের মধ্যে একটা গজল্লা চলছে… আমি ঘরে ঢুকতেই নিমেশে সকলের গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেলো… উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের চোখে দরজার দিকে… আমার উপরে… প্রত্যেকেই যেন আমায় দেখে কেমন থমকে গিয়েছে মনে হলো… হয়তো মনে মনে তৈরী হতে শুরু করে দিয়েছিল কে কি ভাবে আমার ঝড় সামলাবে ভেবে… আমি ঘরের প্রত্যেকের মুখের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম… কে নেই?… বাপি, জেঠু, পিমা, সৌমো মানে সৌমেন্দ্রনারায়ণ, আমার ছোট ভাই… সেই সাথে জ্যেম্মা আর আমার বাপির দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, সৌরিমা… আর সবার মাঝে, একটা চেয়ারে মাথাটা নীচু করে বসে সমু… আমার পায়ের শব্দ সে মাথা তুলে তাকায়… তারপর প্রায় ছিলে ছেঁড়া তিরের মত রীতিমত দৌড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায় সে…
প্রায় কেঁদে ফেলে স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে… “দি-ভাই… বল তুই এদের… চাবিটা তুইই দিয়েছিলিস… তাই না রে?… তুইই বলেছিলিস তোর আলমারী খুলতে…”
আমি ঠান্ডা গলায় বলে উঠি… “সেটা আমি ইতিমধ্যেই জানিয়েছি…” তারপর থেমে বলি, “চাবিটা দে আমায়…” বলে ভাইয়ের সামনে হাত পাতি…
ভাই নিজের পকেট থেকে চাবিটা বের করে তুলে দেয় আমার হাতের মধ্যে… এই একটা কাজ ও বুদ্ধি করে করেছে দেখলাম… হাজার অশান্তির মধ্যেও, কারুর হাতে ও চাবিটা তুলে দেয় নি… ওর থেকে নাকি চাবি চেয়েছিল সৌরিমা, মানে আমার সৎ মা, কিন্তু ও জবাবে বলেছিল যে দি-ভাই আমায় দিয়েছে, আমি দি-ভাইকেই ফেরৎ দেবো… ভালো লাগলো ওর বুদ্ধিমত্তায়…
কয়েক পা পিমা এগিয়ে এলো আমার দিকে… “আচ্ছা তিতাস… হটাৎ করে কেন তোর আলমারী খোলার দরকার পড়লো? কি হয়েছে? কিসের কি দরকার পড়লো তোর এই এতদিন পরে?”
পিমার সাথে ঘরের অন্য বড়রাও গলা মেলায় সাহসে ভর করে… “হ্যা তিতাস… কি দরকার তোর? কি হয়েছে এমন কি যে এই ভাবে ভাইকে দিয়ে আলমারী খোলানোর দরকার পড়ে গেলো?”
ভেবে দেখলাম সত্যি কথাটাই বলে দেওয়া ভালো… শুধু শুধু সকলের মনের মধ্যে একটা সংশয় তৈরী করার কোন প্রয়োজন নেই… আর তাছাড়া আমি যখন আলমারী খুলে মায়ের গয়না বের করবো তখন আরো এক ঝাঁক প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তেই হবে… হয়তো উত্তর দেবার কোন দায় নেই আমার… তাও… যতই হোক, সকলেই বয়ঃজেষ্ঠ আমার কাছে… এঁদের অসন্মান করার কোন অধিকার আমার নেই… প্রত্যেকেই আমায় যথেষ্ট স্নেহ করে, ভালোবাসে… হয়তো সহ্যও করে এরা আমার এই ধরনের জেদ আর রাগটাকে… সেটা জানি আমি… আমার তো এক মাত্র দ্বন্ধ তো শুধু মাত্র নতুন মায়ের সাথে… বাকি বাড়ির কারুর সাথেই নেই কিছু…
আমি শান্ত গলায় বললাম তাদের… “আমি লন্ডন যাচ্ছি… টাকা লাগবে… তাই আমি ভেবে নিয়েছি যে আমি আমার আর আমার মায়ের গয়নাগুলো নেবো…”
শুনে প্রায় হাঁ হাঁ করে ওঠে বাপি… “সেকি তিতাস… তোর টাকার দরকার, তাতে গয়না নিয়ে কি করবি? আমরা বেঁচে থাকতে… কত টাকা লাগবে তোর? সেটা তো তুই আগে বললেই পারতিস… বোস মা বোস… একটু শান্ত হয়ে বোস তো এখানে… আমি এখুনি টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি…”
পেছন থেকে ঘাড় নাড়ে জ্যেঠুও… “হ্যা… ঠিকই তো… তোর টাকার দরকার, সেটা একবার ফোন করে বলে দিলেই তো হয়ে যেতো… এত কিছু ঝামেলাই হতো না… কেন ওই সব বের করবি আলমারী থেকে… ও তো তোর মায়েরই স্মৃতি… তোরই তো জিনিস… একবার গেলে আর কি ফিরে আসবে বল? আর আমাদের পরিবারে কি টাকার অভাব? যে এই ভাবে গয়না বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে হবে?”
আমায় বলে বটে কিন্তু আমি চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকি সোজা হয়ে… তাদের কথার কোন উত্তর দিই না… যত যাই হোক… দূরে থাকা আর সামনে এসে দাঁড়ানো… দুটোর মধ্যে তো একটা পার্থক্য থেকেই যায়… তাই তখন মায়ের গয়না বেচে দেবো ভেবে নিলেও এখন বাবা বা জ্যেঠু জ্যেম্মার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরই যেন কেমন অস্বস্থি হয় এই ভাবে ওদের চোখের সামনে দিয়ে গয়না গুলো নিয়ে বেরিয়ে যাবো ভেবে… হয়তো আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে গয়না গুলোর উপরে… তাও… সেটাও তো এই বাড়িরই… কিন্তু আবার এটাও ভাববার… এটা যদি না করি, তাহলে আমার লন্ডন যাওয়াটা কি ভাবে সম্ভব? কারণ এরা বললেও, এটা সুনিশ্চিত যে আমি এদের কারুর দেওয়া টাকা হাত পেতে নেবো না… সেটা আমার জেদ… আর আমার জেদ মানে ব্রহ্মান্ড উল্টে গেলেও সে কথার নড়চড় হবে না কোন মতেই… কি যে করি… বুঝে উঠতে পারি না… মনে মনে ফিরে যাবো কি না, সেটাও ভাবতে শুরু করে দিয়েছি ততক্ষনে… না হয় অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখতে হবে… এই আর কি… কিন্তু সত্যিই তো… বাড়ির জিনিস বিক্রি করে দেওয়াটা ঠিক সমুচিন হবে না এখন বুঝতে পারছি… বাপি বা জেঠুর খারাপ লাগতে পারে তাতে… অন্তত যে ভাবে ওরা আমায় বারণ করছে, সেটা আমারও বোঝা উচিত…
ভাবতে ভাবতেই ফিরে যাবো বলে ঘুরতে যাবো, সৌরিমা বলে উঠল… “তোমার আলমারীতে আছে মানেই কি ওগুলো তোমার সম্পত্তি হয়ে গেলো নাকি?”
থমকে গেলাম আমি… চোখ সরু করে মুখ তুলে তাকালাম আমি সৌরিমার দিকে… দাঁতে দাঁত চেপে বসে গেলো… চোয়াল শক্ত করে প্রশ্ন করলাম আমি… “কি বলতে চাইছ? স্পষ্ট করে বলো…”
“এর থেকে আর কি স্পষ্ট করে বলবো বাবা… হটাৎ করে একদিন উদয় হলে… তারপর বলে উঠলে যে বাড়ির গয়না নাকি তোমার একার… সেটা আবার হয় নাকি? ওতে কি শুধু তোমার একার অধিকার আছে নাকি?” একেবারে চোখ ঘুরিয়ে কথাগুলো বলে উঠল সৌরিমা…
কথাটা শুনে বাপি তাড়াতাড়ি কিছু বলতে গিয়েছিল নতুন মাকে… সম্ভবতঃ এর পর কি ঘটতে পারে তার আঁচ করে নিয়েই… কিন্তু সেটাও উনি বড় দেরি করে ফেলেছিলেন… তার আগেই যা বিস্ফোরণ ঘটার আমার মাথার মধ্যে ঘটে গিয়েছে… পা থেকে মাথা অবধি আমার জ্বলে উঠল কথাগুলো শুনেই… “চোওওওওওওপ…” প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি… “এক দম চুপ… এই ব্যাপারে তুমি আর একটা কথা বললে আমার থেকে খারাপ মানুষ তুমি দেখবে না…” বলতে বলতে হাঁফাতে থাকি আমি প্রচন্ড উত্তেজনায়… রক্ত যেন তখন আমার মাথার মধ্যে ফুটছে… তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নতুন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি আমি… “আমায় অধিকার দেখাচ্ছ? প্রপার্টি? জানো প্রপার্টি কাকে বলে? শোনো… ফ্যামিলি প্রপার্টি কাকে বলে সেটা তোমার হাজবেন্ডের থেকে জেনে নাও আগে… তারপর আমার সামনে এই ধরণের কথা উচ্চারণ করতে এসো… আমি আমার আলমারী থেকে যেটা বুঝবো সেটা বের করে নেবো… যদি তোমার ক্ষমতা থাকে… আমায় আটকাও…” বলে আর দাঁড়াই না আমি… দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাই বৈঠকখানার ঘর ছেড়ে সিড়ি বেয়ে আমার ঘরের দিকে…
প্রথমে আমার রুদ্রানী মূর্তি দেখে তো খানিক থতমত খেয়ে গিয়েছিল ঘরের উপস্থিত সবাই… তারপরই হুস ফিরতে তাড়াতাড়ি আমার পেছন পেছন প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয় আমার ঘরের মধ্যে…
আমি ঘরে ঢুকে একবার চোখ বোলাই নিজের ঘরের মধ্যে… একই রয়েছে… একদম যে ভাবে ছেড়ে গিয়েছিলাম আমি… সমস্ত কিছু সেই ভাবেই পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা… ঘরের কোন কিছুই এতটুকুও সরানো হয় নি… আমার খাট, চেয়ার, আলমারী… স-অ-ব… দেখে ভালো লাগল আমার… অন্তত বাড়ির লোকের কাছে এখনও যে আমি ব্রাত্য হয়ে যাই নি… এতদিন না থাকার পরেও… সেটা প্রমাণ করে… আমি আলমারীর সামনে দাঁড়িয়ে পাল্লা খুলে লকারের চাবি ঘোরাই…
ততক্ষনে ঘরে এসে গিয়েছে সকলে… পিমা তখনও আরো আর একবার বলার চেষ্টা করে, “তিতাস… কথা শোন মা… শুধু জেদ করিস না… টাকাটা না হয় আমি দিয়ে দিচ্ছি… তোকে বাপি বা তোর জেঠুর কাছ থেকে নিতে হবে না…”
আমি পিমার কথার কোন উত্তর দিই না… লকার খুলে ঝুঁকে তাকাই ভেতরের দিকে… সত্যি বলতে আমিও আজ পর্যন্ত এই আলমারী খুলি নি… এটা আসলে আমার মায়ের আলমারী ছিল… পাশের আলমারীটাতে আমার জিনিস থাকতো… তাই, ভেতরে কি আছে বা নেই, সেটা আমিও সঠিক জানি না… শুধু যখন এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, তখন কি মনে করে যাবার সময় দুটো আলমারীর চাবি সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম… কিছু না ভেবেই… ভবিষ্যতে যে এখানে আবার ফিরে আসবো বা এই আলমারী খোলার কোন প্রয়োজন হতে পারে, সেটা ভেবে দেখিনি আগে কখন…
লকার খুলতে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম বলতে গেলে… ভেবেছিলাম লকারে মায়ের আর আমার গয়নাই আছে হয়তো… কিন্তু সেটা ছাড়াও যা দেখলাম, তা যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না… ভেতরে বেশ কয়েক তাড়া নোটের বান্ডিল… লকারের ভিতরে একটা পাশ করে বেশ যত্ন করে সাজিয়ে রাখা… হয়তো মাই রেখেছিল… তারপরই তো দুম করে অমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো… মা সুযোগই পেলো না কিছু বলে যাওয়ার… আর বাবা কখনই কোনদিন বিষয় আশয় নিয়ে মাথা ঘামায় নি… তাই মায়ের আলমারীতে কি আছে কি নেই, তা সে নিশ্চয়ই ভাবেও নি কখনও…
টাকার বান্ডিল দেখে বুঝে গেছি ততক্ষনে যে আমার সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে… বান্ডিলগুলো বের করে বিছানার উপরে রাখলাম… তারপর ভালো করে মন দিয়ে গুনলাম… দেখলাম যা আছে, তা যথেষ্ট… শুধু লন্ডন যাওয়াই নয়… ওখানে গিয়েও বাকি কিছু খরচ খরচা সামলে দিতে পারবো প্রাথমিক ভাবে… তারপর না হয় ভেবে দেখা যাবে’খন…
সব কটা টাকা আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে নিয়ে ফের আলমারীর লকারে চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলাম… তারপর ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম… কাউকে একটাও কোন কথা না বলে…
নীচে আসতে দেখি আমার নতুন মা, সৌরিমা দাঁড়িয়ে রয়েছে তখনো… আমি সোজা এগিয়ে গিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম… তারপর ঠান্ডা গলায় মুখ তুলে বললাম… “শোনো… তিতাস নিজের অধিকার খুব ভালো করে জানে… আর তিতাসের শিরায় শিরায় দর্পনারায়ণের রক্ত বইছে… তাই আর এ ভূল ভবিষ্যতে কখন করতে যেও না… দু-বার ভাববো না যে তুমি আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী… তোমার দেওয়ের থেকে শুনে নিও আমার সম্বন্ধে…” বলে আর দাঁড়াই না আমি… বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসি… পেছন হতদ্যম মানুষগুলোকে রেখে দিয়ে…
পাড়ি (গ)
চলে এলাম লন্ডন…
আমি টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছিলাম মামাকে আমার আসার খবর… সেই মত এয়ার পোর্ট থেকে বেরিয়ে একটু এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম একটি ছেলে… এই বছর এগারো বারো হবে, আমার নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে… বুঝলাম আমার জন্যই এসেছে আমায় নিতে… একটু খেয়াল করতে ছেলেটির সাথে দেখলাম আরো বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে… দু-জন পুরুষ, দুজন মহিলা, আর তাদের সাথে আরো দুটি মেয়ে, আমারই বয়সি হবে মোটামুটি… বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার, যে এরা আমার দুই মামা, দুই মামী আর তাদের ছেলে মেয়েরা… সবারই প্রায় সোনালী চুল… নীল চোখের তারা… আর সেই সাথে মায়ের মতই গায়ের রঙ… মামাদের মুখে মায়ের আদলের বেশ মিল… সকলেই এসেছে আমায় নিতে… দেখে সত্যি বলতে ভিষন ভালো লাগলো ওদের এই আতিথেয়তায়… আমি ওদের লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম…
আমায় দেখতে পেয়ে হই হই করে এগিয়ে এলো মেয়েদুটি… জড়িয়ে ধরল আমাকে… ওরাও আমায় প্রথম দেখছে… আমিও ওদের… কিন্তু ওদের ব্যবহারে সেটা মনেই হোল না আমার… যেন কতদিনের পরিচয় আমাদের মধ্যে… কি নির্ভেজাল স্বাভাবিক ব্যবহার প্রত্যেকের… আমি হাসি মুখে তাকালাম মামা মামীদের দিকে… ওরাও এগিয়ে এসে আমার পীঠে হাত রাখল… কুশল জিজ্ঞাসা করল বাড়ির সকলের… খোঁজ নিল বাবার… তারপর আমায় নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ি রাখার জায়গার দিকে… দেখি একটা বিশাল নীল রঙের ভোক্স দাঁড়িয়ে রয়েছে… আমাদের আসতে দেখে সসব্যস্ত হয়ে একজন স্যফয়র এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরল… আমরা উঠে বসলাম গাড়িতে… রওনা হলাম ব্র্যাডফিল্ডস্ এর দিকে…
সারা রাস্তা কলকলিয়ে কথা বলে গেলো আমার তিন মামাতো ভাই বোনেরা মিলে… রাস্তায় তাই একঘেয়েমি লাগলো না এতটুকুও…
বাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে গাড়ি থামতে নেমে তো আমি রীতিমত তাজ্জব… অট্টালিকাসম বাড়ি দেখে… এই বাড়ির মেয়ে আমার মা? এত বড় বিশাল সাম্রাজ্যের রাজকন্যা ছিল আমার মা? ভাবতে গিয়ে আমার চোখের কোলে জল চলে এসেছিল… কি ভিষণ ভাবেই না নিজের স্বামীকে মা ভালোবাসত, যে এই এত বিত্ত সম্পত্তি আর প্রাচুর্য এক কথায় ছেড়ে দিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল… ইচ্ছা করছিল সেই মুহুর্তে মা কে পেলে জড়িয়ে ধরতে… আদরে আদরে পাগল করে দিতে…
আমার পীঠের উপরে সস্নেহের হাতের পরশ পেতে সম্বিত ফেরে আমার… বড়মামা গাঢ় স্বরে বলে, “লেটস্ গো ইন্সাইড… মম্ ইজ ওয়েটিং টু সি হার গ্র্যান্ডডটার… কাম ডার্লিং… লেটস্ গো…”
কোন রকমে চোখ মুছে মাথা ঝাঁকাই স্মিত হেসে… তারপর বড়মামার সাথে পা মেলাই বাড়ির পথে… মোরাম বেছানো পথ বেয়ে… আমার আগেই বাকিরা ততক্ষনে ঢুকে গিয়েছে বাড়ির মধ্যে… দিদিমাকে খবর দিতে আমার আগমনের…
দিদিমার দরজার সামনে এসে দাঁড়াই আমরা… দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল… মামা দুবার নক করতে দেখি দরজা খুলে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন… মামাকে আমাকে দেখে সসভ্রমে পাশে সরে দাঁড়ালেন… দরজাটা খুলে মেলে ধরে… পোষাক দেখে বুঝলাম ইনি নিশ্চয়ই দিদিমার অ্যাটেন্ডেন্ট হবেন… বেশ সুন্দরী… পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন…
আমি ঘরে ঢুকলাম… বিশাল ঘরটা… চারিদিকের দেওয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র দিয়ে সাজানো… ঘরের মধ্যে ছাদ থেকে একটা বেশ বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে… তখন দিনের বেলা, তাই নেভানো… ঘরের দেওয়াল জোড়া বড় জানলা দিয়ে বাইরের আলো ভরে রয়েছে ঘরটায়… আর ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা কাঠের পালঙ্ক… রীতিমত কাজ করা… অবস্য আমি এই ধরণের পালঙ্ক দেখে অভ্যস্থ… কিন্তু আমাদের বাড়ির পালঙ্কর সাথে বেশ অমিলও আছে, এটার গড়ণে… আর সেই পালঙ্কে চিৎ হয়ে শুয়ে এক শীর্ণকায়া ভদ্রমহিলা… গলা অবধি চাঁদর দিয়ে ঢাকা… সাগর নীল চোখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন… আমায় দেখেই তাড়াতাড়ি চাঁদরের ভিতর থেকে হাত বের করে বাড়িয়ে দিলেন… হাতছানি দিয়ে ডাকলেন আমায় ওনার দিকে…
সত্যি কথা বলতে এখানে এই ভাবে দিদিমার দরজায় এসে দাঁড়ানো আগের মুহুর্ত অবধি আমার দিদিমার প্রতি মনে মনে একটা বিতৃষ্ণা ছিলই… আর সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যে ভাবে উনি আমার মাকে ত্যাজ্য করেছিলেন, যে ভাবে আমার মাকে অপমান করে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন… আমার মাকে তার পাওনা সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন… যার কারণে হয়তো মায়ের মনের মধ্যে একটা দুঃখ, একটা ক্ষোভ থেকেই গিয়েছিল শেষ দিন অবধি… সেখানে সেই মায়ের মেয়ে হয়ে এই রকম একজন কঠিন মনোভাবাপন্ন মহিলার প্রতি বিতৃষ্ণা না জন্মানোটাই তো বিষ্ময়ের… আর ঠিক সেই মনভাবটাই গড়ে উঠেছিল আমার মনের মধ্যে… তিল তিল করে… তাই লন্ডন আসাটা মামার চিঠি পাওয়ার পরেও আমার উদ্দেশ্য ছিল না দিদিমার ডাকে সাড়া দেওয়া… উদ্দেশ্য ছিল এখানে আমার ডাক্তারি পড়াটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার… সাথে… হ্যা… স্বীকার করবো, যে মামার ডাকটাও উপেক্ষা করতে পারিনি… ভেবেছি সেই যখন লন্ডন আসবই, তবে কেন না একবার এসে দাঁড়াবো একজন মৃত্যুপথযাত্রীর পাশে… তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে… আর সেই ভেবেই এসে দাঁড়ানো আমার…
ভেবে এসেছিলাম যদিও সেটাই… কিন্তু সব কেমন গোলমাল হয়ে গেলো ওই অদূরে শায়িত শীর্ণকায়া মানুষটার হাতছানি দেখে… মনের ভেতরটা কেন জানি না হু হু করে উঠল… শুনেছি আমার দিদিমার বড় আদরের ছিল নাকি আমার মা… আর সেই মানুষটা আমাকে ডাকছেন… কাছে যেতে বলছেন… মুহুর্তের মধ্যে আমার মত এক পাষান হৃদয়ের মেয়েরও সমস্ত অভিমান, রাগ, বিতৃষ্ণা যেন গলে জল হয়ে গেলো… আমি এক দৌড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম দিদিমার শয্যার পাশে… জড়িয়ে ধরলাম শীর্ণ দেহটাকে তাঁর… আমার বুকের মধ্যে… দুটো হৃদয় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো আমাদের সেই মুহুর্তে…
আমার জন্যই বোধহয় দিদিমার প্রাণটা দেহের মধ্যে আটকে ছিল… তারপর আর মাত্র দুটো দিন… তারপরেই সব শেষ… যে ক’টা দিন পেয়েছিলাম, অনেক রাত অবধি দিদিমার পাশে বসে থাকতাম আমি… ওনার হাতটা আমার হাতের মধ্যে ধরে নিয়ে… মনে হতো যেন মায়ের হাতটাই ধরে রয়েছি… ওই শির্ণ হাতগুলোর মধ্যে দিয়ে ওনার ভেতরের সমস্ত ভালোবাসাগুলো আমার শরীরের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে… তারপর… এক ভোর বেলা মামার ডাকে ঘুম ভাঙে… দৌড়ে যাই দিদিমার ঘরে… দেখি শান্ত শরীরে শুয়ে আছেন উনি… বিছানার উপরে… সারা মুখে যেন এক কি প্রশান্তি ছেয়ে রয়েছে… চোখ দুটি বন্ধ… নিশ্চল দেহে… চিরনিদ্রার জগতে চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে…
সেদিন আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি আর… মা’য়ের মৃত্যুতে নিজেকে সামলে রাখতে হয়েছিল, বাপির জন্য… পরিবারের অন্য সকলের জন্য… কিন্তু মাত্র দুটো দিন মানুষটা যেন আমার মধ্যে কি এক জাদু করে দিয়েছিল… ওনার দিন ঘনিয়ে এসেছে, সেটা আমরা সকলেই জানতাম… ওটাই আমাদের শেষ দেখা হবে, সেটাও আশ্চর্যের কিছু নয়… তাও!… তাও ওনাকে চলে যেতে দেখে ভেতরটা যেন আবার নতুন করে ভেঙে দুমড়ে গেলো আমার… মায়ের অনুপস্থিতিটাকে আবার যেন নতুন করে উপলব্ধি করলাম সেই মুহুর্তে… যেন বড়ই তাড়াতাড়ি ওনাকে হারালাম আমি… আরো অনেক… অনেক গুলো দিন ওনাকে কাছে পেলে বড় ভালো হতো… মায়ের অভাবটা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারতাম… কিন্তু সেটা তো হবার নয়… নিজেকে যেন আবার নতুন করে বড় বেশি অসহায় মনে হচ্ছিল… মাতৃ বিয়োগের ব্যথা… ভিতর থেকে কয়েক শো কোটি যন্ত্রণা নিষ্ঠুরের মত মাথা খুঁড়ে পাগলের মত বুক-চিরে বেরিয়ে আসতে চায়… কিন্তু সেই চিৎকার আশে পাশে থাকা কোন মানুষ টের পায় না… তারা ঝাঁকিয়ে চলে… কথা বলে চলে… কিন্তু তারা চিৎকার শুনতে পায় না… ব্যাথা গুলো তখন “নড়ে চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনম ঘর মেলে না, কি কথা কয়-রে, দেখা দেয় না”… দেখা দেয় না…
দিদিমার পারলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সারা হলে আমি বড় মামার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম একদিন… শান্ত গলায় বললাম তাকে, “মামা… এবার তো আমায় যেতে হবে… যার জন্য আসা, সেই যখন আর থাকলো না, তখন আমার এখানে আর থাকার কোন কারণ দেখছি না… এবার আমি যেতে চাই…”
শুনে প্রথমেই মামা আমায় কিছু বলল না… খানিক কি ভাবলো, তারপর বলল যে, “দাঁড়াও… তোমার সাথে আমাদেরও কথা আছে… তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি…” বলে আমায় ওই বসার ঘরে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলো…
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম, তারপরও আসছে না দেখে উঠে দাঁড়ালাম আমি… ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম দেওয়াল জোড়া বিশাল জানলাটার সামনে… বাইরে তখন বসন্তের আগমনী সুর প্রকৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে… গাছগুলোর পাতায় মন ভালো করে দেওয়া নবীনতার ছোঁয়া…
জানলা থেকে সরে এসে দাঁড়াই ঘরের মধ্যে… দাদু অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন… তার বিশাল একটা তৈল্যচিত্র স্থান পেয়েছে দেওয়ালের উপরে… পরিবারের অন্য আর সব অতীত হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষদের ছবির পাশে… আর দাদুর ছবির পাশে নতুন করে টাঙানো হয়েছে দিদিমারও একটা ছবি… আমি মহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ছবিটার দিকে… কি অপূর্ব তুলির টান সেখানে… যেন দিদিমার সজীব চোখে আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছেন এক রাশ স্নেহ ভরা চোখে… এই শৈল্পকর্মের জন্যই বাবাকে অবজ্ঞা, মায়ের সাথে মনমালিন্য… অথচ সেই শিল্পীর ছোঁয়াতেই মৃত্যুর পরেও জীবন্ত উপস্থিতি ওনার…
“ইয়েস ইয়েস… শী ইজ হেয়ার… আই হ্যাভ আস্কড হার টু ওয়েট…” মামার গলার স্বরে মুখ ফিরিয়ে তাকাই আমি দরজার দিকে… দেখি মামা শুধু একা নয়… তার সাথে ছোট মামা আর দুই মামীও এসে ঢুকেছেন ঘরে… মামার পেছন পেছন… আমায় চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে মামা, “বোসো কান্টা… তুমি বোসো… তোমার সাথে আমাদের কিছু খুব জরুরী কথা আছে…”
মামা প্রথম দিনেই বলেছিল যে তার পক্ষে আমার পুরো নাম নিয়ে ডাকা সম্ভব নয়… ওটা বড়ই খটমট নাকি, তাই… আর সেই জন্যই আমায় কান্তা বা কান্টা বলেই ডাকতে শুরু করেছিলো… আর সেই শুনে বাকিদের কাছেও আমি কান্টাই হয়েই গিয়েছি…
“আমার সাথে আবার কিসের জরুরী কথা?” অবাক গলায় চেয়ারে বসতে বসতে বলি আমি… বিশ্মিত চোখে তাকাই ঘরের বাকি সবার দিকে… আমার বিশ্ময়ের উত্তর কেউ দেয় না… সকলেই চুপ করে মিটিমিটি হাসে দেখি… বড় মামা আমার উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসে আমার দিকে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে… “আমি তোমায় অপেক্ষা করতে বলেছিলাম এটার জন্য… নাও এটা… এটা তোমার…”
“কি এটা?” অবাক চোখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে প্রশ্ন করি আমি…
আমার প্রশ্ন হাসে মামা… “এটা আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা বলতে পারো…” তারপর একটু থেমে বলে, “মা নিজের উইল করে দিয়ে গিয়েছেন অনেকদিন আগেই… যদি তুমি না আসতে, তাহলে আমরাই কিছু একটা ব্যবস্থা করতাম এটা তোমার কাছে পৌছে দেবার জন্য… তা যাই হোক… তুমি যখন নিজে স্বশরীরে এসেছ… তখন সে হ্যাপা আমাদের আর পোহাতে হলো না… এটা ভগবানের অশেষ করুণা বলা যেতে পারে…”
আমার বিশ্ময় যেন তখনও যায় না… “উইল? দিদিমার?” আমি ফের আরো একবার নজর করি কাগজের মোড়কটার দিকে… তারপর মামার দিকে তাকিয়ে বলি… “কি আছে এ’তে?”
মামা বলে, “মায়ের ইচ্ছা অনুসারে আমাদের এই সমস্ত প্রপার্টি তিনটি সমান ভাগে ভাগ হয়েছে… একটা ভাগ পেয়েছে রিচার্ডস… এক ভাগ আমি… আর তৃতীয় ভাগ অলিভীয়া… কিন্তু যেহেতু অলিভীয়া আর ইহজগতে নেই, তাই মা তার মেয়ের ভাগটা তার নাতনীর নামে লিখে দিয়েছেন… তাই এই কাগজটি সেই উইলেরই কপি… আমরা তোমার হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এবার… এটাই মায়ের ইচ্ছা ছিল…”
মামার কথা শুনে খানিকটা বাকরূদ্ধ হয়ে বসে রইলাম আমি চুপ করে… তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম সোজা হয়ে… শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম মামার দিকে… ওনার হাতে কাগজের বান্ডিলটা তুলে দিয়ে গাঢ় স্বরে বললাম… “আমি দিদিমার ইচ্ছার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েই বলছি মামা, এটা আমি নিতে পারবো না… আমি একান্ত দুঃখিত…”
আমার কথাটা প্রথমে বোধহয় বুঝে উঠে পারে না কেউ… তারপর যখন বোঝে, তখন প্রায় হাঁ হাঁ করে ওঠে ঘরে উপস্থিত দুই মামা আর মামী… ওরা তো কিছুতেই মানবে না আমার সিদ্ধান্ত… আমাকে নিতেই হবে এ সম্পত্তির ভাগ… এটা দিদিমার আদেশ…
ওরাও মানবে না, আর আমিও নেবো না… এই নিয়ে বেশ খানিকক্ষন টানা পড়েন চলল… তারপর আমি শেষে বললাম, “বেশ… আমি নিচ্ছি… কিন্তু আমি নিয়ে তারপর আমি কি করবো সেটা হবে আমার সিদ্ধান্ত… সেটা নিয়ে কারুর কোন দ্বিমত থাকবে না আশা করি…”
আমার কথাটা ঠিক বোধগম্য যে হলো না ওদের, সেটা ওদের মুখ দেখেই বুঝতে পারি আমি… তাই হেসে ওদের বুঝিয়ে বলি, “দেখো মামা… দিদিমা চেয়েছে, তাই আমি গ্রহণ করলাম তোমাদের এই বিশাল ঐশর্যের ভাগ… কিন্তু সেটা আমি নিজে ভোগ করবো না কোন ভাবেই… কারণ যেখানে মা নিজের সম্পত্তি উপভোগ করতে পারলো না, সেখানে সেই সম্পত্তির অধিকারিনী আমি হতে চাই না… তাই দিদিমার ইচ্ছানুসারে আমি এই সম্পত্তি নিয়ে আমার দুই মামী আর তাদের তিন সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই… এবারে আশা করি তোমরা আর কিছু বলবে না…”
আমার কথা শুনে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মামারা… তারপর ছোটমামা এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “দিস ইজ ইট… তুমি সত্যিই প্রকৃত আমাদের বোনের মেয়ে… আজ আরো একবার প্রমাণ করে দিলে…” তারপর একটু থেমে বলল, “বেশ… যখন এটাই চাইছ, আমরা তোমার সে ইচ্ছার সন্মান করবো… কিন্তু সব নয়… তুমি যেমনটা চাইবে তেমন ভাবেই তোমার অংশ তুমি ভাগ করে দিতে পারো… এতে পরিবারের মধ্যেই সব কিছু থেকে যাবে… আর এর পর থেকে এই প্রপার্টির যা কিছু টাকা পয়সা আছে, তার অর্ধেক তোমার থাকবে… যখন খুশি তুমি তখন সেখান থেকে তোমার নিজের জন্য নিয়ে নিতে পারো… আমরা কখনও কেউ কোনদিন সে ব্যাপারে কোন কথা বলবো না… আর শুধু আমরা নই… আমাদের উত্তরসুরিরাও সেটা সসন্মানে মেনে চলবে… এ ছাড়াও… তোমার থাকার বা পড়াশুনার সমস্ত খরচ এই ব্র্যাডফিল্ডস্ এস্টেট বহন করবে… এবার রাজি তো?”
সত্যি… এরপর আর কোন কথা চলে না… আমি মাথা নীচু করে ঘাড় হেলাই… মেনে নিই মামাদের কথা…
বড় মামা এরপর বলে, “আর শুধু তাই না… এতদিন অলিভীয়ার লন্ডনের যে ফ্ল্যাট ছিল, সেটা আমি দেখাশুনা করতাম, আজ থেকে সে ফ্ল্যাট তোমার… তুমি সেখানে থেকেই তোমার পড়াশুনা চালাবে… অন্য কোথাও তোমার থাকার চিন্তা করতে হবে না… কারণ আমরা জানি, লন্ডনে থেকে পড়াশুনা করার খরচ অনেক, তাই সেটা নিয়েও তোমায় কখনও ভাবতে হবে না… আমি কালকেই ওই ফ্ল্যাট তোমার নামে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি…”
মামাদের কথায় সত্যিই আমার মাথা থেকে একটা বিরাট চিন্তার বোঝা নেমে গেলো যেন… এটা তো ঠিকই যে আমি কোথায় থাকবো, কি করবো, সেটা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই… সেটা এই ভাবে এত সহযে মিটে যাবে, সত্যি ভাবি নি… আমি স্মিত হেসে মাথা হেলাই… “বেশ… তাই হবে…”
তারপর যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে গেলো… আমার রেসাল্ট ভালোই ছিল, তাও, যেহেতু দিদিমা কাউন্টেস ছিলেন, তাই সহজেই লন্ডনের কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম আমি… মায়ের ফ্ল্যাটে থেকেই শুরু করলাম আমার ডাক্তারী পড়ার দ্বিতীয় অধ্যায়… শেষ করলাম কলেজ… নিউরোলজি নিয়ে স্পেশিয়ালাইজেশন… কিন্তু শুধু মাত্র নিউরোলজি নিয়ে পাশ করে মন ভরল না যেন… মামাদের সাথে কথা বলে এবার সার্জারির উপরেও মেজর করলাম… তাতে টপ করলাম পরীক্ষায়… ফার্স্ট গ্রেড নিয়ে পাশ করলাম…
চিন্তায় পড়লাম এবারে… এবার তাহলে কি? এবার কি আবার দেশেই ফিরে যাবো? কিন্তু এখনই দেশে ফিরে যাতে মন চাইল না… একবার যখন দেশের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি তখন আর সেখানে, ওই নতুন মায়ের সামনে গিয়ে আর দাঁড়াতে মন শায় দিল না কিছুতেই… হয়তো ওই বাড়িতে উঠবো না আমি কিছুতেই… কিন্তু তাও… দেশ তো সেই একই… আমার মন যেখানে একবার বিষিয়ে গিয়েছে, সেখানে আবার ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতি আমি নই… তাই ভাবতে থাকলাম এই লন্ডনেই থেকে যাবো? নাকি অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করবো বলে… তারপর ভাবলাম লন্ডন তো বেশ কিছুদিন হলো… তাহলে এবার একবার ইয়ুরোপের অন্য দেশে চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? যদি হয়ে যায় ভালো, না হলে তো লন্ডন আছেই… আমার মায়ের দেশ… এখানে কোন হস্পিটালে জয়েন করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না একেবারেই… আর সেই সাথে আমার রেসাল্টও যথেষ্ট ভালো…
ভাবতে ভাবতে কয়েকটা দেশের একটা লিস্ট বানালাম… প্রথমে রাখলাম জার্মানী… কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে জার্মানীর সমস্ত হস্পিটাল যথেষ্ট হাই এন্ড… সেখানে আমার রেসাল্ট ভালো হলেও আমি একেবারে ফ্রেশার… সবে সার্জারীতে পাশ করেছি, ওখানে আমায় খুব একটা এন্টার্টেন নাও করতে পারে… ওখানে চট করে কিছু সুবিধা করা যাবে না… পরে না হয় একটু হাত পাকিয়ে নিলে আবার জার্মানীতে অ্যাপ্লাই করে শিফট করার কথা ভাবব… তাই ইচ্ছা থাকলেও জার্মানীর কথাটা সেই মুহুর্তের জন্য তুলে রাখলাম শিকেয়… এর পর বাকি দেশ গুলোতে অ্যাপ্লাই করতে শুরু করলাম… ফ্রান্সএর হস্পিটালে দুটো… ইতালীতে একটা আর স্পেনে একটা… কয়েক দিনের মধ্যেই দেখি চারটে হস্পিটাল থেকেই কল এসে হাজির… আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি যে চারটের থেকেই কল আসবে বলে… তাতে পড়লাম মুস্কিলে… কোনটাতে যাবো?
মামাদের সাথে আলোচনা করলাম… কারন ওদের গাইডেন্স এখানে বিশেষ প্রয়োজন… আমি লন্ডনে কাটিয়েছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে ঠিকই… কিন্তু বাকি দেশ? তাই মামাদের শরণাপন্ন হলাম গিয়ে… বড় মামা প্রথমেই ইতালীকে ক্যান্সেল করে দিলো… কারন ওদের অফার প্রাইস এই চারটের মধ্যে সব চেয়ে কম ছিল… মামা বলল যে প্রথমেই যদি কম অফারে শুরু করো তাহলে পরে সেটা বাড়াতে অসুবিধা হবে… ঠিক… মেনে নিলাম মামার কথা… সে দিক দিয়ে সব চেয়ে অফার দিয়েছিল স্পেনএর থেকে… কিন্তু সেখানেও একটা বিশাল কিন্তু রয়েছে… অ্যাপ্লাই তো করেছিলাম ঠিকই… তবে স্প্যানিশ তো আমি বুঝিই না বিন্দু বিসর্গ… আর বলা তো অতি দূর অস্ত… সেটা শিখতে শিখতেই যা সময় লেগে যাবে ততদিনে নির্ঘাত আমায় দূর করে দেবে স্পেন থেকে… হি হি… অতঃকিম স্পেনও বাদ… হাতে রইল ফ্রান্সের দুটো হস্পিটাল… আমি ততদিনে লন্ডনে থাকতে থাকতে ফ্রেঞ্চ ভাষাটা বেশ ভালোই শিখে নিয়েছিলাম… জার্মানটাও অল্প বিস্তর চালিয়ে নিতে পারি… তাই ফ্রান্সএ যেতে আমার খুব অসুবিধা হবার নয়… তাই বসলাম দুটো হস্পিটালের অফার লেটার নিয়ে… সেখানে দেখলাম যে মার্সেইএর সেন্ট ক্লেয়ার হস্পিটাল বেশ ভালো অফার করেছে, অন্তত অন্যরটা থেকে অনেক বেশি… তাই আর দ্বিতীয়বার ভাবলাম না… রিপ্লাই করে দিলাম এখানেই…
তার মানে এবার ফ্রান্স…
.
.
.
ডায়রি নিয়ে খানিক থম হয়ে বসে থাকে পর্ণা… এই ভাবে এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে যেন সেও হাঁফিয়ে উঠেছে… চোখের সামনে তখনও যেন পরতে পরতে দৃশ্যগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে তার… যেন একটা সিনেমা দেখে উঠল সে…