লেখিকা- মিম
পর্ব-৩১
———————————–
মায়ার মাথায় পানি ঢালছে সোহান। ঘুমানোর সময় তো ঠিকই ছিলো। জ্বরটা এসেছে ঘন্টাখানেক হবে হয়তো। জ্বরটা কখন এসেছে সেটা জানে না সোহান। খাওয়া শেষে মায়াকে রুমে পাঠিয়ে সালমান আর সোহান মিলে ম্যাচ দেখছিলো টিভিতে। ম্যাচ শেষে রুমে এসে মায়ার মাথার বালিশটা ঠিক করতে গিয়ে ওর কপালের স্পর্শ লেগেছিলো সোহানের হাতে। তখনই টের পেয়েছে মায়ার জ্বর এসেছে। মায়া কি যেনো বিড়বিড় করছিলো। কিছুই বুঝতে পারেনি সোহান। দেরী না করে বাথরুম থেকে আধা বালতি পানি ভর্তি করে নিয়ে এসে মায়ার মাথায় ঢালছে৷ চোখ বন্ধ করে রেখেছে মায়া। কাঁপা গলায় সোহানকে ডাকছে ও।
– এই…..
– খুব কষ্ট হচ্ছে মায়া?
– এই…..
– হুম, শুনছি তো।
– কোথায় আপনি?
– এইতো তোমার মাথার কাছে।
মাথার ওপাশে হাতড়িয়ে সোহানকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে মায়া। সোহানের গেঞ্জির গলায় হাত ঠেকলো। গেঞ্জিতে খামচে ধরে সামনের দিকে টেনে আনলো ও।
– অ্যাই…..
– হুউউম?
– চুমু খাবো।
– হ্যাঁ দিবো। আগে মাথায় পানি ঢালি।
– না। এখনি।
মায়ার কপালে চুমু খেলো সোহান। চোখ মেলে তাকালো মায়া। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। ঠিকমতো চোখ মেলতে পারছে না। তবুও বহু কষ্টে সোহানের দিকে আধখোলা চোখে তাকালো ও।
– চোখ জ্বালা করছে খুব।
– দাঁড়াও পানি দিয়ে দিচ্ছি।
– উহুম। পানি না। চুমু খাবো।
– চুমু খেলে চোখের জ্বালা কমবে?
– হুউম। কমে যাবে।
মনে মনে হাসলো সোহান।
মায়ার চোখজোড়ায় চুমু খেলো সে। সোহানের গেঞ্জি এখনো খামচে ধরে রেখেছে মায়া। গেঞ্জি ধরে ফের টানাটানি করছে।
– আরো চুমু খেতে চাও?
– না। ঘুমাবো।
– আচ্ছা ঘুমাও। আমি মাথায় পানি ঢালি।
– ঢালতে হবে না। খাটে আসেন।
– তারপর?
– আপনি বসে থাকবেন। আমি আপনার কোলে বসে ঘুমাবো।
মায়ার আবদারে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে সোহানের। সেই সাথে ভালোবাসাটাও বাড়ছে। সত্যিই মেয়েটা ছোট। প্রচন্ড আহ্লাদী। এত আহ্লাদী তো ছিলো না। গত একমাস যাবৎ আহ্লাদটা বাড়ছে ওর। ভালোই লাগে সোহানের। খুব উপভোগ করে ব্যাপারটা।
-গেঞ্জিটা ছাড়ো। তোমার মাথাটা মুছে দিতে হবে।
– না, মুছবো না৷ কোলে ঘুমাবো।
– মাথা না মুছলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
– ওহ তাইতো। আপনি মুছে দিবেন?
– আমি ছাড়া আর কে মুছে দিবে?
– হুম। তাও কথা।
– এখন ছাড়ো।
গেঞ্জিটা ছেড়ে দিলো মায়া। বালতিটা বাথরুমে রেখে বারান্দা থেকে মায়ার তয়লাটা নিয়ে আসলো সোহান। মায়াকে ধরে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসালো৷ চুলগুলো খুব যত্ন নিয়ে মুছে দিচ্ছে সে।
– আমাকে কোলে নিবেন না?
– নিবো তো।
– কখন?
– এইতো এখনি।
সোহানের বুকে গা এলিয়ে দিলো মায়া। মায়ার ভেজা চুলের পানিতে সোহানের গেঞ্জি একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে৷ ভেজা চুলে নাক ডুবালো সোহান। এক হাতে চুলের গোঁড়ায় হাতাচ্ছে সে৷ অন্য হাতে মায়াকে জড়িয়ে ধরেছে। মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সোহান। দু’বাহুডোরে মায়াকে বন্দী করে ফেলেছে৷ মায়ার ঠোঁটজোড়া প্রবলভাবে টানছে সোহানকে। মায়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করতেই মনে পড়লো মায়া অসুস্থ। মেয়েটার আজ জ্বর এসেছে৷ খুব দ্রুত সরে এলো সোহান। খাটের বাম পাশের বালিশটাতে মায়াকে শুইয়ে দিলো সোহান। ডান পাশের বালিশে নিজে শুয়ে মায়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সোহান।
পর্ব-৩২
———————————–
সোহানের ঘুম ভেঙেছে সেই অনেক্ষণ আগেই। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না, এপাশ ওপাশও হতে পারছে না। ওর শরীরের উপর উপুর হয়ে ঘুমুচ্ছে মায়া। ওকে দুহাতে শক্ত করে আগলে রেখেছে সোহান। গায়ের জ্বরটা আপাতত নেই। তবু মায়ার রেস্ট নেয়াটা জরুরী। তাই ওকে জাগাচ্ছে না। তবে কারন অবশ্য আরেকটা আছে। মায়াকে এ মূহূর্ত্বে একদম ছোট বাচ্চার মতো লাগছে। এভাবে আগলে রাখতে ভালো লাগছে সোহানের।
জানালার ধারে বসে আছে আলিশা। ঘুম হয় না আজকাল ওর। একদমই হয় না। সোহানের বিয়ে মেনেই নিতে পারছে না ও। সোহানের ভালোবাসা কেমন তা খুব ভালো করেই জানে আলিশা। ব্রেকআপের এত বছর পরও সোহানের ভালোবাসাটা ওর শরীরের লোমে লোমে মিশে আছে। সেই ভালোবাসা এখন অন্য কেও ভোগ করছে। যতটা ভালোবাসা আলিশাকে সোহান দিয়েছিলো তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে মায়াকে। মায়ার অনুভূতিটা কেমন হতে পারে সেটা বেশ বুঝতে পারছে আলিশা। এত সুখ! এত ভালোবাসা! আজ যদি সোহানের বউ হতো তাহলে……. ব্যাপারটা কি আদৌ মেনে নেয়ার মতো? এমন কেনো হলো? হওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিলো?
-আলিশা….
রুপমের গলার আওয়াজ পেলো আলিশা। পিছন থেকে ডাকছে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না আলিশা। এই মানুষটার ছায়া থেকে সরে যেতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচে ও। সহ্য হয়না। একদম সহ্য হয় না এই লোকটাকে।
– আলিশা… নাস্তা খাবে এসো।
-………….
– কি বলছি? শুনছো না?
– পরে খাবো।
– না, আমার সাথে খাবে।
– ক্ষিদে নেই।
– গতকাল রাতেও কিছু খাওনি।
– ক্ষিদে লাগেনি তাই।
– একটা মানুষ এভাবে না খেয়ে কিভাবে থাকতে পারে আলিশা?
– ক্ষিদে না লাগলে কি করবো?
– ঘুমাও না। খাও না। কোথাও যাও না। সারাটাদিন এইরুমে বসে থাকো। কেনো আলিশা? তোমার কি স্বাভাবিক হতে ইচ্ছে হয় না?
– কি হবে স্বাভাবিক হয়ে?
এগিয়ে এসে আলিশার পাশে বসলো রুপম। ওর হাতের উপর হাত রাখলো। ঘাড় ফিরিয়ে ডানে তাকালো আলিশা। রুপম ওর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।
– সোহান আমাকে খুব ভালোবাসতো। ও আমাকে ভুলে গেলো কি করে?
– আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?
– জানি না।
– আমিও তোমাকে ভালোবাসি। সোহান তোমাকে কতটা ভালোবাসতো আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ওর চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসি। একটাবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তো। তোমার বাবা সোহানের নামে মামলা করার পর ও তোমাকে ফেলে চলে গেলো। তুমি ওকে কতবার রিকুয়েস্ট করলে তোমার কাছে ফিরে আসার জন্য। ও কি এসেছিলো? মামলা তোমার বাবা করেছে, তুমি তো করোনি। ও যদি তোমাকে এতই ভালোবাসবে তাহলে ও তোমাকে এমন শাস্তি দিবে কেনো যেটার উপযুক্ত তুমি না?
– ওর রাগ খুব বেশি। তাই ও ব্রেকআপ করেছে।
– আমার কি রাগ নেই। তুমি যেসব কাজ করো তোমার উপর কি আমার রাগ হয় না? আমি কি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছি?
– তুমি তোমার ছেলের জন্য আমাকে ডিভোর্স দাও না।
– আফিফকে কি তুমি দেখাশোনা করো? ওর দেখাশোনা আমি আর ঝর্নাই তো করি। তোমার তো কোনো প্রয়োজন নেই। তবু তোমাকে আমার ঘরে রেখে দিয়েছি। কেনো বলতে পারো?
– তুমিই তো বলো আমাকে সেই কবেই তুমি ডিভোর্স দিয়ে দিতে। শুধু ছেলের জন্য দাও না।
– আমার মনের কথাগুলো কবে বুঝবে তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি আলিশা। তাই তোমার সমস্ত পাগলামী সহ্য করেও তোমাকে আমার পাশে রাখতে চাই। ডিভোর্স দেয়ার শখ থাকলে কবেই দিতাম। তুমি ভার্জিন না এটা আমি বিয়ের পরই টের পেয়েছি। এমনকি সোহানের সাথে তুমি রেগুলার ইন্টিমেট হতে সেটাও বুঝেছি। আমি কি চাইলে তখন পারতাম না তোমাকে ডিভোর্স দিতে। বিয়ের দু সপ্তাহ পর থেকেই শুরু করলে সোহানের কাছে যাবে। আমি যেনো তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। তখন কি আমি পারতাম না তোমাকে ডিভোর্স দিতে? তোমার প্রেগন্যান্সির টাইমে কি যন্ত্রনায় আমাকে তুমি রেখেছিলে মনে আছে? তবু তোমাকে আমি ছাড়িনি। দিন দিন সোহানের জন্য তোমার পাগলামি বেড়েই যাচ্ছিলো। তবু আমি তোমাকে ছাড়িনি। আমি তোমার হাজবেন্ড আলিশা। তোমার সন্তানের বাবা। আমার ওয়াইফ সর্বক্ষণ তার এক্স বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ডুবে থাকে সেটা জেনেও আমি তোমাকে নিয়ে ঘর করছি। এরপরও তুমি আমাকে বলছো আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না তুমি জানো না? মায়া সোহানের ওয়াইফ। ওকে পাগলের মত ভালোবাসাটা খুব স্বাভাবিক। প্রেমিকা আর বউ তো এক হয় না। তুমি ওর প্রেমিকা ছিলে আর মায়া ওর বউ। ওর সাথে নিজেকে কেনো মিলাচ্ছো? অহেতুক হিংসার আগুনে নিজে তো জ্বলছোই সেই সাথে আমি আর আমাদের সংসারটাকেও জ্বালাচ্ছো। ওরা তো সুখে আছে আলিশা। তাহলে শুধু নিজের সুখে আগুন ধরাচ্ছো? আমি মানুষটাকে কেনো এভাবে কষ্ট দিচ্ছো। সোহানের চেয়ে অারো অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে। একটাবার… জাস্ট একটাবার ভালোবাসাটা অনুভব করার চেষ্টা করো আলিশা। সংসারটাকে আগলে ধরো। আমাকে, আমাদের ছেলেটাকে আগলে ধরো। মায়াকে দেখেছো? অতটুকু একটা মেয়ে। অথচ নিজের হাজবেন্ড আর সংসারের ষোলো আনা বুঝে। কতটা সুন্দর করে আগলে রাখে। তোমার মত মেয়ে ওর সাথে কথা বলে পেরে উঠতে পারো নি। ভেবে দেখো ও ওর হাজবেন্ড আর সংসার নিয়ে কতটা প্রোটেক্টিভ।
– তুমি মনে হয় ঐ মেয়ের প্রশংসা করছো?
– হ্যাঁঁ করছি। প্রশংসা করার মতো কাজ করেছে তাই করছি।
– হাত ছাড়ো।
– কেনো?
– আমি খারাপ। মায়া ভালো। সোহান ওর প্রেমে মজেছে। এখন তুমিও ওর প্রেমে ডুবে মরো।
– আমি তোমার মাঝে ডুবে মরতে চাই। আমি চাই তুমি মায়ার মতো আমাকে সংসারটাকে আগলে ধরো।
– আমার সাথে ওর তুলনা করতে এসো না রুপম। আমি ওর চেয়ে হাজারগুনে ভালো করে আগলে রাখতে জানি। দেখো না সোহানকে আজও ভুলতে পারি না। ভালোবাসা আজও আগলে বসে আছি।
– তুমি সোহানকে ভালোবাসো। আমাকে না। তাহলে বুঝবো কিভাবে তুমি কতটা আগলে রাখতে জানো।
– কি চাচ্ছো তুমি? বুঝিয়ে বলো।
– কিছু না। নাস্তা খাবে চলো।
-পরে খাবো।
– আমি এখন নাস্তা করবো। নাস্তা খাও আর না খাও আমার সামনে বসে থাকবে। চলো।
– ভালো লাগছে না। যাবো না।
– প্লিজ….
– রুপম তোমার বিরক্ত লাগে না আমার পিছন পিছন ঘুরতে?
– বউ কি আমার দশটা? একটাই তো। তোমার পিছন ঘুরবো না তো কার পিছনে ঘুরবো। এত ঘুরি তবু তো সোহানকে ভুলতে পারো না।
– ওকে ভুলে যাওয়া এতটাও সহজ না।
– এত কঠিনও না।
আলিশা জানে রুপম ঘ্যানরঘ্যানর করতেই থাকবে। ভালো লাগছে না রুপমের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে। এরচেয়ে ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ ওর সামনে বসে থাকা ভালো। মাথার চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে খাট ছেড়ে নেমে এসেছে আলিশা।
জোনাকির ঘরে বসে সিগারেট ফুঁকছে ইমন।
– মায়া এখন তার বিয়া করা বউ। আমাগো সামনেই বিয়া করছে। ওর দিকে আর নজর দিয়েন না স্যার। আরো বহু মাইয়্যা আছে। আমি আইনা দেই। যেইটারে ভাল্লাগবো খালি ইশারা করবেন। রুমে সাজায়া গুজায়া পাঠায়া দিমু।
– মায়াকে লাগবে।
মনে মনে ইমনকে বকছে জোনাকি।
শালায় পাইছে কি? মায়াকে লাগবে, মায়াকে লাগবে। তামশা শুরু করছে। কইতাসি বিয়া হয়া গেছে ছেমড়ির। তবু কথা শুনে না।
ঠোঁটে মিথ্যে হাসি এনে জোনাকি বললো
– এইডা কেমনে সম্ভব। আরেক লোকের বউরে কেমনে আইনা দিমু?
– যেভাবে আমার মায়াকে অন্য লোকের হাতে দিয়েছো, সেভাবেই আমার কাছে আবার ফেরত এনে দিবে।
– স্যার আরো মাইয়্যা আছে তো। মায়ার মতই আছে। আমি আনতাছি।
হাতে থাকা মোবাইলটাতে ভিডিও প্লে করলো ইমন। কারো চিৎকারের আওয়াজ আসছে মোবাইলটা থেকে।
– ব্যাথা পাচ্ছি। ছেড়ে দিন।
ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে ইমন। বারবার ঐ চিৎকারের অংশটুকু টেনে টেনে দেখছে সে। ইমনকে এই মূহুর্তে বিশাল বড় মসিবত মনে হচ্ছে জোনাকির। যাওয়ার নাম তো নিচ্ছেই না।, উল্টো এক চিৎকার শুনিয়ে শুনিয়ে কানটাকে পঁচিয়ে ফেলছে। বিশ্রি অবস্থা।
– মেয়েটা কে জানো?
– না।
– মায়া। কত সুন্দর করে চিৎকার করে। ব্যাথা পাচ্ছি, ছাড়ুন। উফফ!! শুনলেই ইচ্ছে হয় আরো জোরে কামড় দেই। দাঁত শিরশির করছে খুব। ওকে আনার ব্যবস্থা করে দাও না জোনাকি। আর সহ্য হচ্ছে না।
ইমনের মতিগতি বেগতিক মনে হচ্ছে জোনাকির। এখান থেকে লোকটাকে বের করতে হবে। ও চায়নি সোহানের কাছে এই মানুষটার খোঁজ দিতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খোঁজ দেয়াটা অতি জরুরী। আর নয়তো কেলেঙ্কারি ঘটতে পারে৷ সামনের আটখানা দাঁত বের করে হাসলো জোনাকি।
– মায়ারে খুব মনে ধরছে না স্যার? আইচ্ছা স্যার আইনা দিমু। তবে আপাতত সম্ভব না। জামাইর লগে বিদেশ গেছে হানিমুনে। দেশে আইলেই ওরে ধইরা আনার ব্যবস্থা করুম। তবে চার্জ একটু বেশি লাগবো।
– এডভান্স দিয়ে যাবো?
– না স্যার। কাম সাড়ার পর দিয়েন।
পর্ব-৩৩
———————————–
ইমন বের হয়ে যাওয়া মাত্রই সোহানের নাম্বারে কল করলো জোনাকি। মাথার বালিশের কাছে মোবাইলটা বাজছে। একহাত বাড়িয়ে মাথার কাছ থেকে ফোনটা নিলো সোহান। স্ক্রিনে জোনাকির নাম দেখাচ্ছে।
– হ্যাঁ জোনাকি বলো।
– স্যার, ইমন আইছিলো।
– এরপর?
– মায়ারে খুঁজে। মায়ারে তার লাগবোই। কইলাম বিয়া হয়া গেছে। সে মানে না। মায়ার ভিডিও ছাইড়া আমার সামনে বইসা দেখতাছিলো। আর খবিশের মত হাসতাছিলো। মায়া চিল্লাইতাসে ভিডিওতে আর খবিশটা কইতাসে মায়ার চিল্লানি শুইনা নাকি আরো জোরে কামড়াইতে মন চাইতাসে তার। দাঁত বলে শিরশির করতাছে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে সোহানের। নোংরা মেন্টালিটির মানুষ। মানসিক রোগী একটা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিটালেই কামড়ানোর শখ মিটে যাবে।
– তুমি কি বলেছো?
– ভুলভাল বুঝাইসি। কইসি মায়ারে আইনা দিমু৷ তবে এখন না। আরো পরে। আপনে মায়ারে নিয়া বিদেশ ঘুরতে গেছেন।
– আচ্ছা। ভালো করেছো।
– তারে এখন কি করবেন স্যার? সে তো পিছ ছাড়বো না।
– ছাড়বে কি ছাড়বে না সেটা তো বুঝবোই।
– আইচ্ছা স্যার। আমার কিছু করতে হইলে জানাইয়েন।
– হুমম জানাবো।
মায়া এখনও ঘুমে। ওকে এক হাতে জড়িয়ে অন্য হাত মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে সোহান। কি করা যায় ভাবছে সে। সবার আগে ভিডিওগুলো সরাতে হবে। ভিডিওর কপি কোথায় কোথায় আছে সব বের করতে হবে।
নড়েচড়ে উঠলো মায়া। মুখটা তুলে কোনোমতে একচোখ মেলে সোহানের দিকে তাকালো।
– গুড মর্নিং প্রিন্সেস।
-হুমমমমম।
আবার সোহানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো মায়া। সোহানের বুকে নাক মুখ ঘষছে ও।
– উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না?
– উঠবো।
– কখন?
– একটু পর।
– নাস্তা কি খাবে?
– বিস্কিট খাবো। চায়ে ডুবিয়ে।
– ডক্টর গতকাল কি বলেছে শুনোনি?
– শুনেছি।
– বিস্কিট খেলে হবে? তুমি অনেক উইক হয়ে গেছো। হেলদি খাবার খেতে হবে৷
– আবার ডিম?
– হুম ডিম। সাথে একগ্লাস দুধ। রুটি বা পরোটা।
– ডিমে গন্ধ লাগে।
– কিচ্ছু করার নেই। খেতে হবে।
– খাইয়ে দিবেন আমাকে?
– হুম দিবো।
সোহানের গায়ের উপর থেকে বিছানায় নেমে এলো মায়া। ঝিম মেরে বসে আছে খাটে৷ মায়ার পিঠে হাত বুলাচ্ছে সোহান।
– খারাপ লাগছে মায়া?
– মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে।
– ঠিকমতো খাও কিছুদিন। ঠিক হয়ে যাবে।
খাট ছেড়ে নেমে গিয়ে ওয়াশরুমে গেলো মায়া। সোহান গিয়েছে কিচেনরুমে। রতন পরোটা বানাচ্ছে। সালমান গতকাল রাতে বলেছে মাংস দিয়ে পরোটা খাবে। সোহান বললো চুলায় ডিম সিদ্ধ বসাতে। সেই সাথে দুধটাও জ্বাল দিতে বলে এসেছে।
– ভাইয়া…
– হুম?
– মায়ার অবস্থা কি এখন?
– এইতো। জ্বরটা নেই। শরীর এখনও দুর্বল।
– রাগটা কমাও৷ যখন তখন এভাবে ক্ষেপে যাওয়ার মানে হয় না।
– মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ওকে এখানে এনে বলেছি এটা ওর সংসার। সংসার ফেলে চলে গেলো কেনো?
– ছোট একটা মেয়ে৷ বাবার কথাগুলো ও মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া ওর মনেও হয়তো এই কথাগুলো বারবার ঘুরে ও কোন জায়গা থেকে এসেছে। তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। তাই বাবার কথাগুলো খুব গায়ে লেগেছে ওর।
– হুমম। রিএ্যাক্টটা একটু বেশিই করে ফেলেছি। মাথা ঠিক থাকে না। বুঝলি?
– জানি ঠিক থাকে না। তাই বলে এতটাও রিএ্যাক্ট করা ঠিক না।
– মাথাটা ঠান্ডা করতে চাই। কিন্তু হয় না।
– কখনো ট্রাই করেছো বলে তো মনে হয় না।
– উনাকে কিচ্ছু বলবে না। উনি খুব ভালো মানুষ।
কথাটা বলতে বলতে ডাইনিং রুমের দিকে আসছে মায়া।
– ভালোবাসা কত্ত! এতবড় ধোলাই খেয়েও বলছো উনি খুব ভালো মানুষ।
– হুম ভালোই তো। ভালো কে ভালো বলবো না?
– বুঝলি সালমান? যে আমাকে ভালোবাসবে সে আমার ভালোকেও ভালোবাসবে মন্দকেও ভালোবাসবে। আমি একটা খারাপ কাজ করলেও বুঝার চেষ্টা করবে আমি কেনো খারাপ কাজটা করলাম।
অফিসে যাবেন বলে তৈরী হচ্ছেন নজরুল সাহেব। খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে সোহানের মা রিমা। ফোনে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা দেখছেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড পর নজরুল সাহেবের দিকে হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– নজরুল, দেখো তো একটু।
– কি দেখবো?
– ফোনটা হাতে নাও আগে।
কিছুটা বিরক্ত হলেন নজরুল সাহেব। অফিসে যাওয়ার সময় হলেই এই মহিলার এটা সেটা দেখাতে হয়। না দেখলেও বিপদ। ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলবে। বাধ্য হয়েই ফোন হাতে নিলেন তিনি।
একটা মেয়ের ছবি। চেহারা তেমন ভালো না। তবে বেশ স্মার্ট। স্মার্টনেসের আড়ালে চেহারার কমতিগুলো আড়াল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ভালোই।
– কে এটা?
– সোহানের জন্য দেখেছি। আমার বান্ধবীর ভাইয়ের মেয়ে। ভালো না?
মোবাইলটা খাটের উপর রেখে আবার অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হওয়ার কাজে লেগে পড়লেন। কোনো উত্তর দিচ্ছেন না।
– নজরুল কিছু একটা জানতে চেয়েছি আমি। উত্তর দিচ্ছো না কেনো?
– কি বলবো?
– কেমন লেগেছে?
– সোহান বিয়ে করে ফেলেছে।
তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলেন রিমা। মনে হলো মাথায় বাজ পড়েছে তার। ঠিকঠাক শুনেছে কিনা সেটা জানার জন্য আবার নজরুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন
– কে বিয়ে করেছে?
– সোহান।
– কাকে?
– একজনের সাথে এ্যাফেয়ার ছিলো।
– তুমি জানতে সব?
– হ্যাঁ।
– আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলে না?
– বললে কি হতো?
– কি হতো মানে? আমি কেও না?
– সেটা তুমি তোমার ছেলের সাথে বুঝে নাও। তোমার ছেলে কেনো তোমাকে জানায়নি সেই যুক্তি ও ভালো জানে।
– তুমি কেনো বলোনি?
– বিয়ে তো আমি করিনি৷ করেছে সোহান। ওর বিয়ের খবর ও না বললে আমি বলার কে?
নজরুল সাহেবের এ ধরনের অযৌক্তিক কথাবার্তা বরাবরই অসহ্য লাগে রিমার। এই লোকটাকেও অসহ্য লাগে। ছেলেগুলোও হয়েছে এই লোকের মতই। বিশেষ করে বড়টা। চরম বেয়াদব। আজকাল তো সে মা বলে ডাকাই ছেড়ে দিয়েছে। বিয়ে করেছে সেটা তো এটলিস্ট বলতে পারতো।
বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে নজরুল সাহেব। আর দশমিনিট বাদে সোহানকে কল করবে রিমা। তুমুল ঝগড়া হবে মা ছেলের মধ্যে। বাবাকে যেভাবে উত্তর দিয়েছে ঠিক সেভাবে মা কেও উত্তর দিয়ে দিবে৷ একদম গা জ্বালানো উত্তর। ভাবতেই পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেন নজরুল সাহেব। ছেলের উত্তর পেয়ে নিজে পুরো একটাদিন জ্বলেছেন। এবার নাহয় রিমাও একটু জ্বলুক।
পর্ব-৩৪
———————————–
আজ অফিস যাবে না সোহান৷ মায়া অসুস্থ। অসুস্থ বউকে ঘরে ফেলে অফিসে যাওয়ার মানুষ সে না। সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরেই সময় কাটাবে। ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে মায়া আর সালমান। ফোনে একটু জরুরী কথা বলার আছে, এটা বলে সেখান থেকে সরে বেডরুমে এসে দরজা আটকালো সোহান। জাহিদের নাম্বারে ডায়াল করেছে সে।
– জ্বি স্যার।
– স্বপনের কথা মনে আছে?
– ঐ যে সোনারগাঁ থাকে সেই ছেলেটা?
– হ্যাঁ।
– জ্বি স্যার আছে তো।
– নাম্বার আছে ওর?
– আছে।
– এস এম এস করো তো একটু।
– এক্ষুনি করছি স্যার।
জাহিদের কলটা কাটতেই সোহানের মায়ের কল চলে এলো। সামান্য ভ্রুঁ কুঁচকালো সোহান। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া তো উনি ফোন করেন না। নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন পড়েছে তাই ফোন করেছে।
– হ্যালো…..
– ভালো আছো সোহান?
– হ্যাঁ আছি। তুমি ভালো আছো?
– এইতো। তারপর খবর কি তোমার? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
– হঠাৎ আমার দিনকালের খবর নিচ্ছো?
– নিতে পারি না বুঝি?
– কখনও তো নাওনি। এজন্য একটু অবাক হলাম আর কি।
– বউ কেমন আছে?
– ওহ! বুঝেছি। আসল কথা হচ্ছে বৌয়ের কথা বিস্তারিত জানার জন্য কল করেছো। দিনকাল কেমন যাচ্ছে সেটা জানার জন্য না৷ আমিও তো বলি, কি ব্যাপার হঠাৎ আমার মায়ের কি হলো? ফোন দিয়ে সোহানের খোঁজ নিচ্ছে!
– সবসময় রুডলি কথা বলাটা কি জরুরী?
– আমি এমনই। ছোট থেকেই এমন। সমস্যা হচ্ছে ছোট থেকে তুমি তো আমাকে বড় করোনি। আমার সাথে তেমন একটা মিশে দেখোনি। তাই আমার কথার ধরন তোমার কাছে বাজে মনে হয়।
– বিয়েটা করেছো আমাকে জানালে না কেনো?
– জানালে কি হতো?
– কি হতো মানে? আমি কি কেও না?
– কখনো কেও ছিলে নাকি?
– তুমি বুঝতে পারছো সোহান? তুমি এভাবে বিয়ে করে সংসারদারী শুরু করে ফেলেছো এখানকার লোকজন জানাজানি হলে কি পরিমান সমালোচনা হবে?
– হ্যাঁ জানি৷ একটা ঘটনা নিয়ে সোসাইটির মানুষরা কতটুকু সমালোচনা করতে পারে তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? তোমার আর বাবার পরকীয়া নিয়ে তো কম সমালোচনা শুনিনি। বলতে পারো সমালোচনা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আর আমি মায়াকে বিয়ে করেছি। পরকীয়া করছি না। আমাদেরকে নিয়ে যেটা হবে সেটা হলো আলোচনা। সমালোচনা না।
– তোমার আমার কি সম্পর্ক ভুলে গেছো?
– নাহ ভুলিনি তো।
– তাহলে এসব ব্যাপার নিয়ে কথা কেনো বলছো।
– খুব গায়ে লাগছে?
– বেয়াদবির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছো।
– সেটা তো কবেই পৌঁছেছি।
– হ্যাঁ জানি। খুব ভালো করেই জানি তুমি যে কতটা বেয়াদব।
– জেনে শুনে কেনো এসেছো আমার সাথে কথা বলতে?
– নিজের সন্তানের কাছ থেকে জুতার বাড়ি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। তাই তোমাকে ফোন করে জুতার বাড়ি খেলাম।
– সন্তান সন্তান করো না তো। তোমার মুখে সন্তান শব্দটা মানায় না। তুমি দুই ছেলের মা সেই কথা একটা সময় বলতে লজ্জা পেতে। এমনও সময় গেছে দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে আমাকে আর সালমানকে তুমি বোনের ছেলে বলে পরিচয় করিয়েছো।
– ওগুলো যাস্ট ফান ছিলো।
– ফান ছিলো না কি ছিলো সেগুলো বুঝার মত যথেষ্ট বয়স তখন আমার হয়েছিলো।
– তুমি তোমার ওয়াইফের সামনে এসব বলছো?
– হ্যাঁ বলছি। বউকে আগে ভাগেই সব জানিয়ে রেখেছি। প্রেম করা তো এখনও ছাড়োনি। চট্টগ্রামে কোনো পার্টিতে গেলেই তো তোমার আর বাবার পরকীয়া নিয়ে কানাঘুষো চলে। সেসব আমার বউয়ের কান পর্যন্ত আসতে কতদিন? তাই আগে ভাগেই বউকে শুনিয়ে রাখছি।
– শুনাও। যত পারো বাপ মায়ের বেইজ্জতি করো৷ অমানুষ হয়েছো একটা। নূন্যতম রেসপেক্ট আমরা কেও তোমার কাছ থেকে পাইনা। এখন এসব বউকে শুনিয়ে ওকেও বেয়াদব বানাচ্ছো। আজ তুমি বেয়াদবী করছো। কাল থেকে তোমার বউও যোগ হবে তোমার সাথে। দুইজনে মিলেমিশে আমাদের ইনসাল্ট করো। বেয়াদব কোথাকার।
শেষের কথাগুলো প্রচন্ড চিৎকার করে বললেন রিমা। পুরো শরীরে মনে হচ্ছে কেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। ছেলের অপমানের কথা নজরুল সাহেবকে জানানোর জন্য কল করেছেন। ফোনের স্ক্রিনে রিমার নাম দেখে মিটমিটিয়ে হাসছেন নজরুল সাহেব। গায়ে জ্বালা উঠেছে রিমার। ভুলেও কল রিসিভ করা যাবে না। আর নয়তো বিষ ঝাড়বে উনার উপর। বিষটা ঝেড়ে ফেললে তো রিমার গায়ের জ্বালা মিটে যাবে৷ কোনোমতেই মিটতে দেয়া যাবে না। নিজের জ্বালা নিজেই নিয়ে ঘুরেছেন পুরো একটাদিন। কাওকে সেই যন্ত্রণার কথা বলতে পারেননি। রিমাকেও সেই সুযোগ দিবেন না। যেমন উনি জ্বলেছেন তেমনি রিমাকেও জ্বলতে হবে।
মায়ের কলটা কাটার পর স্ক্রিনে দেখলো জাহিদের নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। স্বপনের ফোন নাম্বারটা এস এম এস করেছে জাহিদ। নম্বরটায় কল করলো সোহান। চারবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো স্বপন।
– আসসালামু আলাইকুম ভাই।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম। ভালো আছো স্বপন?
– এইতো ভাই। আপনি ভালো আছেন?
– হ্যাঁ। তারপর দিনকাল কেমন যায়?
– আপনাদের দোয়ায় যাচ্ছে ভাই। হঠাৎ আমাকে স্মরন করলেন যে। কোনো দরকার?
– একটা কাজ করে দিতে হবে।
-কি কাজ?
-জানি ওসব ছেড়ে দিয়েছো। তবু আমার রিকুয়েস্ট কাজটা করে দিতেই হবে। তোমাকে ছাড়া বিশ্বস্ত কাউকে পাচ্ছি না।
– আরে ভাই, আপনার সাথে আমার হিসাব আলাদা। আপনি শুধু বলেন কি করতে হবে।
– একটাকে তুলে আনতে হবে৷ আমার বাসায় আটকে রাখবে দুইদিন। সারারাত টর্চার করবে। খবরদার মেজর ইনজুরড যেনো না হয়। কিন্তু মরনের ভয় এমন ভাবে ভেতরে ঢুকাবে যাতে মায়া নামের কেও এই পৃথিবীতে আছে সেটা ভুলে যায়। আর ওর কাছে কয়েকটা ভিডিও ক্লিপ আছে। কোথায় কোথায় রাখা আছে জানি না। ওর কাছ থেকে ওর বাসার চাবি নিয়ে ল্যাপটপ, পেন ড্রাইভ, মেমোরী কার্ড যা পাও সব নিয়ে আসবে। একটাও যেনো বাদ না যায়।
– মায়া কে ভাই?
– আমার ওয়াইফ।
– ওহ! ভাবীর সাথে উনার কি সম্পর্ক?
– কোনো সম্পর্ক নেই। আগে এ্যাফেয়ার ছিলো। এখন আমার ওয়াইফকে কন্টিনিউ ব্ল্যাকমেইল করছে৷ যা তা অবস্থা। মজা লাগছে না এই ছেলের তামাশা। এটার একটা দফারফা করা জরুরী।
– বুঝেছি ভাই। কাজ হয়ে যাবে।
– কিভাবে কি করবে সামনা সামনি দেখা করে ডিটেইলস বলবো। ঠিকাছে?
– জ্বি ভাই। কবে আসবো?
– আগামীকাল সন্ধ্যার পর আসো।
– আচ্ছা।
মাথা থেকে অর্ধেক চিন্তা দূর হয়েছে। বাকিটা কাজটা হয়ে গেলে এরপর দূর হবে। উফফ! কোথাকার ইমন! মাথাটা হ্যাং করে দিচ্ছে একদম। সামনে পেলে একটা হলেও দাঁত ভাঙবে এই ব্যাটার। কামড়ানোর শখ চিরতরে মিটাবে এবার।
পর্ব-৩৫
———————————–
বিকেলের দিকে মায়াকে নিয়ে শপিং করতে এসেছে সোহান। কোনো কিছু না দিয়েই বিয়ে করেছে ওকে। ব্যাপারটা মনের মধ্যে মধ্যে বারবার খচখচ করছিলো সোহানের। তাই ওকে নিয়ে এসেছে কিছু গোল্ডের জুয়েলারি আর শাড়ি কিনে দেয়ার জন্য। শাড়ি কেনার পালা শেষ করে স্বর্নের দোকানে গলার নেকলেস দেখছে ওরা। গলায় নেকলেস ট্রায়াল দিয়ে দেখছে মায়া৷ সোহান খুব মনোযোগ মায়ার গলার দিকে তাকিয়ে দেখছে। অপর পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে আলিশা। সোহানের দিকে তাকিয়ে আছে ও। কত মনযোগ দিয়ে মায়াকে দেখছে মানুষটা৷ মায়ার গলায় স্পর্শ করছে কিছুক্ষণ পরপর৷ একটার পর একটা নেকলেস পাল্টে যাচ্ছে মায়া। কোনোটাই সোহানের পছন্দ হচ্ছে না৷ নিজের বউয়ের কোনো জিনিস কেনার ব্যাপার সোহান কতটা যত্নশীল সেটা দেখতেই পাচ্ছে আলিশা। এতটা ভালোবাসে মায়াকে! কান্নাটা বহু কষ্টে চেপে রেখেছে আলিশা। কন্ঠনালীর ঠিক মাঝখানটাতে তীব্র চাপ অনুভব করছে সে।
মায়ার জন্য একসেট গহনা কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। কসমেটিকস শপ থেকে কিছু কসমেটিকস আর জুতার দোকান থেকে জুতা কিনে ফুড কোর্টে বসেছে খাওয়ার জন্য। এতক্ষণ আলিশা ওদের পিছন পিছন ঘুরেছে। দূর থেকে দুজনকে দেখেছে। মায়াকে নিয়ে সোহান বেশ সুখে আছে৷ মায়ার দিকে সোহানের তাকিয়ে থাকা। মায়ার কাঁধ জড়িয়ে হাঁটা। সোহানের হাসি। প্রতিটা ব্যাপার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছে আলিশা। এই ব্যাপারগুলো আলিশাকে প্রতি সেকেন্ডে জানান দিচ্ছিলো সোহান কতটা সুখী। সোহানের সাথে প্রেম চলাকালীন সময়ে কখনো সোহানকে এভাবে হেসে হেসে কথা বলতে দেখেনি। ওর দিকে এভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়েও থাকতে দেখেনি। তাকিয়ে থাকতো না ঠিক তা না। ওর দিকেও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। তবে মায়ার ব্যাপারটা আলাদা। সোহানের চোখের ভাষা পাল্টে যায় মায়ার দিকে তাকালে। মনে হয় যেনো সমস্ত ভালোবাসা ঐ দু’ চোখের মাঝেই ভিড় জমাচ্ছে। আর মায়া……… চেহারা থেকে বাচ্চা ভাবটা এখনো কেটে উঠেনি৷ আদুরে একটা ভাব আছে চেহারার মাঝে৷ হাসেও বাচ্চাদের মতই। খিলখিল শব্দ করে। প্রচন্ড বাধ্য স্বভাবের বউ। সোহান যা পছন্দ করে কিনে দিয়েছে তাই চুপচাপ নিয়েছে। নিজের পছন্দ প্রকাশ করতে দেখেনি ওকে। সোহান যা পছন্দ করে দেখাচ্ছে তাতেই মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। বোধহয় সোহান এমন একটা বউয়ের শখ করেছিলো।
আজ ওদেরকে দেখার আগ পর্যন্ত সোহানের প্রতি ভীষন ক্ষোভ কাজ করছিলো মনের ভিতর। কিভাবে পারলো সোহান ওকে ভুলে যেতে? ভালোবাসায় কি কমতি ছিলো? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কমতি সত্যিই ছিলো। সোহান যেভাবে আশা করেছিলো সেভাবে হয়তো ও সোহানকে ভালোবাসতে পারেনি। আজ সকালে রুপমও তো বলে গেলো। মায়া স্বামী সংসার আগলে রাখতে জানে। এই গুনটাতো ওর মাঝে নেই। শুধু ভালোবাসাতে কি হয়? ভালোবেসে আগলে রাখতে পারলে তবেই না ভালোবাসার মানুষ আমার বাহুবন্দী হয়ে থাকবে। আমার অস্তিত্বের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকবে। নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে আলিশার। নিজের কমতির কথাগুলো মাথার ভিতর নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে৷ সোহানকে ভালোবেসেছে ঠিকই কিন্তু আগলে রাখতে পারেনি। তাইতো ভালোবাসা ছুটে গিয়ে অন্যের বাহুবন্দী হয়েছে৷ সেই ভালোবাসা নিজের বাহুবন্দী করার মিথ্যা প্রয়াস চালাতে যেয়ে রুপমকে এতগুলো বছর ধরে কষ্ট দিয়েই গিয়েছে। আর সে…….. লাগাতার ভালোবাসি ভালোবাসি বলেই গিয়েছে। পরম যত্নে আগলে রেখেছে। কখনো মানুষটার ভালোবাসায় ডুব দিয়ে গভীরতা মাপতে ইচ্ছে হয়নি আলিশার। ডুব দেয়া থাক দূরের কথা কোনোদিন পা ভিজিয়ে উষ্ণতাটুকুও মাপতে ইচ্ছে হয়নি ওর। কেনো ইচ্ছে হয়নি সে কারনটা জানে না আলিশা।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আলিশা। আজ মনে হচ্ছে একটাবার রুপমের ভালোবাসায় ডুব দেয়ার চেষ্টা অন্তত করা উচিত। যে চলে গেছে তাকে আর ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে না। সে তার আপন জগত নিয়ে দিব্যি আছে৷ আর যে ওর জীবনে বর্তমান তাকেই আগলে ধরাটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে আগলে তো রেখেছে রুপমই। এখন শুধু আলিশার এক ধাপ এগিয়ে রুপমের বাহুবন্দী হওয়া বাকি।
গাড়ি নিয়ে সোজা চলে এসেছে রুপমের অফিসে। আজ পর্যন্ত কখনো রুপমের অফিসে আসা হয়নি আলিশার। এইবারই প্রথম। নিচতলায় রিসিপশনে রুপমের খোঁজ করতেই রিসিপশনিস্ট বললো,
– স্যার তো মিটিংরুমে।
– ওহ। কখন মিটিং শেষ হবে জানেন?
– ঠিক বলতে পারছিনা।
– আচ্ছা ওর পারসোনাল কেবিনটা কোন দিকে?
– ম্যাম আপনি এখানে ওয়েট করুন। মিটিং শেষ হলে স্যারের পারমিশন নিয়ে আপনাকে উনার কেবিনে পাঠানো হবে।
– আচ্ছা।
সোফায় বসে আছে আলিশা। মোবাইলে নিউজ ফিড স্ক্রল করছে। মনোযোগ সেদিকে নেই। ঘোরের মাঝে পড়ে আছে সে। রুপমকে কি বলবে? কিভাবে বলবে? নিজের কমতিগুলো কিভাবে ঢাকবে?
বিশ-বাইশ মিনিট পর মিটিং শেষে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো রুপম। উপর থেকে দেখতে পেলো আলিশা নিচতলায় বসে আছে৷ আলিশাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো রুপম। এই মেয়ে এখানে বসে আছে কেনো? সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে রুপম। আলিশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো
– তুমি এখানে কি করো?
রুপমের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো আলিশা।
– মিটিং শেষ তোমার?
– হ্যাঁ৷ কিন্তু তুমি এখানে?
– তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।
– আমার জন্য?
– হুম।
– তো এখানে কেনো বসে আছো? আমার রুমে চলে যেতে।
– তোমার রিসিপশনিস্ট বললো তুমি মিটিংয়ে। তাই এখানে বসে ছিলাম।
– তোমার হাজবেন্ডের অফিস এটা। যখন খুশি তখন আমার রুমে চলে আসবে। নিতু, তুমি ওকে আমার রুমে পাঠাওনি কেনো?
– স্যার উনি তো আমাকে বলেননি যে উনি আপনার ওয়াইফ।
– না, রুপম। ওর দোষ নেই। আমি ওকে আমার পরিচয় দেইনি।
– আচ্ছা তাহলে উপরে আসো।
– তোমার আর কোনো কাজ আছে।
– না তেমন কোনো কাজ নেই।
– তাহলে বাসায় চলো।
– কোনো সমস্যা আলিশা?
– কিছু বলার ছিলো।
আলিশার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কিছু ঘটেছে৷ আর নয়তো এই মেয়ে অফিসে আসার কথা না। রুপম আর কিছু জিজ্ঞেস না করে আলিশাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে।
পর্ব-৩৬
———————————–
নিজের বেডরুমে মুখোমুখি বসে আছে আলিশা রুপম। প্রচন্ড মনোযোগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে রুপম তাকিয়ে আছে আলিশার দিকে। কোত্থেকে কথা শুরু করবে খুঁজে পাচ্ছে না আলিশা। অহেতুক নিজের গাল চোখ হাত চুলকাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর।
-কি না বলতে চেয়েছিলে?
-হুমমম।
– তোমার তো শরীর চুলকাচ্ছে না। কেনো শুধুশুধু শরীর চুলকাচ্ছো?
– কিভাবে বুঝলে?
– তোমার সাথে সংসার করছি বহুদিন৷ এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝবো না?
– আমাকে এত ভালোবাসো কেনো?
– জানি না তো।
– আমি খুব পাগলামি করি তাই না?
আলিশার কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো রুপম।
– হ্যাঁ পাগলামি তো করো। কিন্তু তোমাকে আজকে সুস্থ মনে হচ্ছে।
– মজা করছো?
– নাহ আমি সিরিয়াস। সত্যিই একটু অন্যরকম লাগছে তোমাকে। ভালো লাগছে খুব।
নিজের হাত বাড়িয়ে রুপমের হাতটা ধরলো আলিশা। চোখে পানি ছলছল করছে ওর।
– তোমার কি মন খারাপ আলিশা?
– রুপম,, আজকে সোহানকে দেখেছি মায়ার সাথে। অনেকটা সময় নিয়ে ওদের দেখেছি। খুব সুখে আছে সোহান। ওর জীবনটা মায়া গুছিয়ে নিয়েছে। মায়াকে ও প্রচন্ড ভালোবাসে। ওর চোখ দেখলেই বুঝা যায়। সোহানের হাসির আওয়াজ কানে লাগছিলো খুব। এভাবে কখনো ওকে হাসতে দেখিনি জানো। মায়া নিজের ভালোবাসা আদায় করে নিতে জানে। সত্যিই ও ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রাখতে জানে৷
– এজন্য মন খারাপ?
– না। মন খারাপ অন্য কারনে।
– কি কারন?
– নিজেকে খুব হীন মনে হচ্ছে।
– কেনো?
– আমি খুব খারাপ। খুউউব বেশি। ভালো সন্তান হতে পারিনি। ভালো ওয়াইফ হতে পারিনি৷ ভালো মা হতে পারিনি। কোনো সম্পর্কের মূল্যায়ন আমি করতে জানি না রুপম। সম্পর্কে বিষ ঢেলে ঢেলে একদম শেষ করে ফেলেছি। বাবা মা ভাইয়া কেও আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না। আফিফ আমাকে দেখলে যতটা সম্ভব লুকানোর চেষ্টা করে। আমার কাছে ঘেষতে চায় না। সোহান আমাকে ফেলে চলে গেছে। তোমার ফ্যামিলির মানুষও আমাকে দেখতে পারে না। বাকি আছো শুধুমাত্র তুমি। সবাই আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আমি তোমাকেও হারাতে চাই না৷
ঠোঁট ভেঙে কাঁদতে লাগলো আলিশা। খানিকটা সামনে এগিয়ে এসে আলিশাকে জড়িয়ে ধরলো রুপম।
– আমি কোথায় যাবো?
– দূরে।
– যাওয়ার হলে তো অনেক আগেই যেতে পারতাম। গিয়েছি আজ পর্যন্ত?
– যদি চলে যাও?
– মরন ছাড়া কোথাও যাবো না। পুরো পঁচিশ লাখ টাকা খরচ করে পনেরো লাখ টাকা দেনমোহর পরিশোধ করে বিয়ে করেছি। আপনাকে আমি ছাড়ছি না৷ বহু পরিশ্রম করে টাকা কামাই করি। চল্লিশ লাখ টাকা উসুল না করেই কি চলে যাবো নাকি?
রুপমের কথায় ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো আলিশার। রুপমের বুক থেকে মাথা তুলে বললো,
– তুমি না বলেছিলে সাইকাআট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে আমাকে,?
– তুমি ডক্টরের কাছে যাবে?
– হুম যাবো। যাওয়াটা দরকার।
– কালকেই নিয়ে যাবো।
– রুপম আমি ভালো থাকতে চাই।
– অবশ্যই থাকবে। তুমি জাস্ট নিজেকে একটু চেঞ্জ করো। দেখবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
– আর আমাদের সম্পর্কটা?
– মানে?
– আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না কেনো?
– তুমি কখনো আমার ভালোবাসাটা রিয়েলাইজ করতে চাওনি। তোমার মাথায় সোহানকে পাওয়ার ভূত চেপে ছিলো এতদিন। আমার ভালোবাসা অনুভব করার মতো সময়ই তো ছিলো না।
– সরি,,,,,, সম্পর্কটা কি সুন্দর করা যায় না?
-অবশ্যই যায়। আমি তো হাত বাড়িয়েই রেখেছি। এখন শুধু তোমার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়া বাকি।
রুপমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আলিশা। মুখ ফুটে কিছু বলেনি ও। আলিশার স্পর্শের গভীরতায় রুপম যতটা বুঝার বুঝে নিয়েছে।
দুইদিন পর………
মায়াকে নিয়ে সকালের ফ্লাইটে কক্সবাজার গিয়েছে সোহান। বাসায় কেও নেই৷ কাজের লোক দুটোকে ছুটি দিয়েছে দুইদিনের। ওরা যে যার মতো গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। সালমান ওর কোন এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছে। সোহান ঢাকা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত বন্ধুর ওখানেই থাকবে।
রাত পৌনে একটা। সোহানের ফ্ল্যাটের স্টোর রুমে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে ইমনকে। জোনাকি দশটার দিকে খবর দিয়েছিলো ঐ পাড়ায় যাওয়ার জন্য। মায়া অপেক্ষা করছে ওর জন্য। কারা যেনো ঐ গলির সামনে থেকে ওকে তুলে এনেছে। অন্ধকারে কারো চেহারা দেখতে পায়নি। সরু গলিটার কাছে যেতেই ৮-৯ জন মিলে একটা জটলা পাকালো। কেও একজন ওর নাকে কাপড় চেপে ধরলো। এরপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করলো এই রুমে। ডিম লাইট জ্বলছে বাম পাশের দেয়ালটাতে। দেখে মনে হচ্ছে স্টোর রুম। কিন্তু পুরো রুম ফাঁকা। কয়েকবার চিৎকার করেছে কারো সাহায্য পাবার আশায়৷ কেউই ওর ডাকে সাড়া দেয়নি।
থাইগ্লাসের দরজাটা কেও খুলছে। একজন পুরুষ মানুষ ছোট একটা বস্তা মতন দেখতে ব্যাগ এনে রুমের ভিতর রেখেছে। মুখটা অর্ধেক ঢেকে রেখেছে। তাই চেহারা বুঝা যাচ্ছে না৷ অদ্ভুত শব্দ করে হাসছে লোকটা।
– কি রে শালা, তুই নাকি ইন্দুররে জমের মতো ভয় পাস। নে, আজকে রাতে তোরে ইন্দুর দিয়া নাচামু।
লোকটা কথাটা বলেই ব্যাগের মুখ খুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে থাই গ্লাসটা আবার আটকে দিলো। ইমন লোকটার কথা কিছু বুঝে উঠার আগেই ডিম লাইটের আবছা আলোতে দেখতে পেলো ব্যাগের ভিতর থেকে একের পর এক ইঁদুর বের হতে শুরু করেছে। শরীর সর্বশক্তি দিয়ে সেখান থেকে ছুটে যাবার চেষ্টা করছে সে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে,
– সরাও এগুলো। আমার সহ্য হয় না। আমাকে যেতে দাও।
পুরো রুমে ইঁদুর ছুটোছুটি করছে। তিন চারটা ইঁদুর ইমনের শরীরে বেয়ে উঠা নামা করছে। ভয়ে পুরো শরীর ঘেমে ভিজে গেছে ইমনের। ফর্সা মুখে রক্ত জমে লাল হয়ে গেছে। গলায় তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। তবু থেমে নেই সে। চিৎকার করেই যাচ্ছে
– আমাকে এখান থেকে বের করো। যা চাও তাই দিবো।
পর্ব-৩৭
———————————–
দীর্ঘ পয়ত্রিশ মিনিট যাবৎ গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছে ইমন। বারবার একটা কথাই বলছে,
– যা চাও সব দিবো। আমাকে এখান থেকে বের করো।
মাঝে দুইবার এসে ইমনের হাল দেখে গেছে স্বপন। এই ডোজে অবস্থা নাজেহাল হয়েছে নাকি আরও ডোজ বাড়াতে হবে সেটাই দেখে গেলো। হাল দেখে যা বুঝা গেলো যেকোনো মূহুর্তে জ্ঞান হারাবে৷ একটা মানুষ ইঁদুরকে এতটা ভয় পায় ইমনকে না দেখলে বোধহয় স্বপন কখনো টেরই পেতো না৷ ইমনের হাল দেখে মনে হচ্ছে ভিডিও ক্লিপের কথা জিজ্ঞেস করলে এখনই বলে দিবে। তবুও একটাবার সোহানের অনুমতি নেয়াটা জরুরী মনে করছে স্বপন। এখনই ভিডিওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে কি না জানার জন্য ফোন করলো সোহানকে।
সমুদ্রের পাড়ে মায়ার হাত ধরে খালি পায়ে হাঁটছে সোহান। বাচ্চাদের মতো কিছুক্ষন পরপরই সমুদ্রের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে মায়া। পানিতে নেমে লাফালাফি করে আবার দৌঁড়ে এসে সোহানের হাত ধরে হাঁটছে। শরীরের অর্ধেক ভিজে গেছে মায়ার। অন্য কোনো সময় হলে এভাবে ভিজা কাপড়ে সোহান কখনোই ঘুরতে দিতো না ওকে। কিন্তু আজ বাঁধ সাধছে না। ওকে ওর মতো করে উপভোগ করতে দিচ্ছে।
পকেটে থাকা ফোনটা বাজছে সোহানের। ফোন বের করে দেখলো স্বপন কল করেছে।
– হ্যাঁ স্বপন, খবর কি?
– ভাই, ইঁদুরকে একটা মানুষ এত ভয় পায়?
– সে পায়।
– বলছে তো যা চাই দিয়ে দিবে। ভিডিওর কথা জিজ্ঞেস করবো?
– এখনই না। আরো ভয় দেখাও৷ ভয়ের জন্য যাতে মাথা থেকে অন্য সব কিছু বেরিয়ে যায়। তাহলেই ভিডিও কোথায় কোথায় আছে স্বীকার করবে। আর নয়তো এক দুই কপি নিজের কাছে রেখে বাকিগুলোর কথা বলবে।
– আচ্ছা ভাই।
– স্টোর রুমের উল্টোদিকে যে রুমটা আছে সেটাতে ঢুকো। বড় একটা স্যুটকেস দেখতে পাবে। ওটার ভিতর অনেক কিছু আছে৷ চাইলে সেখান থেকে কিছু কাজে লাগাতে পারো।
– জ্বি ভাই।
পানিতে নেমে লাফাচ্ছে মায়া। সোহানের কথা কিছুই শুনেনি সে৷ ইমনের ব্যাপারে আরেকটু জানতে পারলে ভালো ছিলো। মায়াকে এই মূহূর্ত্বে জিজ্ঞেস করাটা কি উচিত হবে? ইমনের কথা জিজ্ঞেস করলেই তো মনটা খারাপ করে ফেলবে। না জিজ্ঞেস করলেও হচ্ছে না। দুইদিনের বেশি এখানে ইমনকে আটকে রাখা যাবে না। যা করার দুদিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। মায়া এসে সোহানের হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগলো। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মায়াকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো সোহান।
– মায়া…..
– হুউউম…
– মন খুব ভালো?
– অন্নেএএএক।
– একটা কথা জানার ছিলো।
– জিজ্ঞেস করে ফেলুন।
– ইমন আর কি ভয় পায়?
সোহানের প্রশ্নে থমকে দাঁড়ালো মায়া। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো মূহুর্তে। সোহানের দিকে বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
– এই মানুষটাকে স্মরণ করা কি খুব জরুরী?
– হ্যাঁ জরুরী। তাই তো জিজ্ঞেস করছি।
– আপনি কি আমার সাথে ভালো সময় কাটাতে এসেছেন নাকি আমার অতীত নিয়ে টানাটানি করতে এসেছেন?
– এটা কেমন প্রশ্ন মায়া? কখনো দেখেছো প্রয়োজন ছাড়া তোমার অতীত নিয়ে ঘাটাতে?
– ঘাটাননি। তবে এই মূহুর্তে কেনো? অন্য কোনো সময়ও তো জানতে চাইতে পারতেন?
সোহানের হাতটা ছেড়ে নিজের মতো হেঁটে চলছে মায়া। পিছন পিছন আসছে সোহান। মায়া রাগ করেছে। মায়াকে ইমনের ব্যাপারে কিছু জানাতে চাচ্ছে না সোহান। পুরো ব্যাপারটা মায়ার কাছ থেকে চেপে যাবে। কয়েক মিনিট এভাবেই হেঁটে চলছিলো ওরা দুজন। কিছুক্ষণ পর মায়া এসে মুখ গোমড়া করে সোহানের হাত জড়িয়ে ধরলো।
– ঐ লোকটা উপর থেকে নিচে তাকাতে ভয় পায়। লোকটার নাকি মাথা ঘুরে। বমি হয়।
– তুমি জানো কিভাবে?
– একবার এক হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলো। নয়তলায় একটা রুম বুক করেছিলো। রুমে যেয়ে দেখি একপাশের জানালার পর্দা খোলা। আমাকে বললো জলদি পর্দাগুলো আটকে দিতে। আমি যখন পর্দা আটকাচ্ছিলাম তখন আমাকে বলেছিলো উনি নাকি খুব বেশি উপর থেকে নিচে তাকাতে পারে না। বুক ধরফর করে। দম বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরায়। বমি হয়।
– রাগ হয়েছো খুব?
– হ্যাঁ।
– আসো আদর করে দেই।
– লাগবে না।
– সত্যি লাগবে না?
খিলখিল করে হেসে উঠলো মায়া। সোহানের হাত ছেড়ে ফের দৌঁড়ে চলে গেলো সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাতে।
রতনের রুমে ফ্লোরে পড়ে থাকা স্যুটকেসটা খুললো স্বপন। অনেক কিছুই আছে এটাতে। স্ক্রু ড্রাইভার, ড্রিল মেশিন আরো অনেক কিছু। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে ড্রিল মেশিনটা হাতে নিলো। এটা নিয়ে এখন ইমনের রুমে যাবে সে। এখানে সঙ্গে করে আরো পাঁচজনকে এনেছে স্বপন। বাসার ড্রইংরুমে তারা টিভি দেখছে। সেখান থেকে বাশার কে ডেকে নিয়ে এসে স্টোর রুমে গেলো। দরজা খুলে ইমনের মুখোমুখি দাঁড়ালো স্বপন আর বাশার। ইঁদুরগুলো তখনও ছুটাছুটি করছে। বাশারের হাতে একটা মোটা লাঠি। এটা দিয়ে ইঁদুরগুলোকে রুম থেকে সরাচ্ছে সে।
প্রচন্ড রকমে হাঁপাচ্ছে ইমন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেনো শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ।
– ভাই, একগ্লাস পানি হবে?
– বাশার, এই শালারে ফুটা করমু কই? বুকে নাকি মাথায়?
– ফুটা করবেন মানে? এই,,,,, এই আপনারা ড্রিল মেশিন কেনো এনেছেন?
-তোরে ফুঁটা কইরা ঝাঁঝরা বানামু।
– ভাই মুখটা ভালো কইরা ডিজাইন কইরেন। যাতে লাশ কেও চিনতে না পারে।
বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করেছে ইমন।
– ভাই, আমি কি করেছি ভাই?
– তুই ভিডিও করছোস।
– আমি কিচ্ছু করিনি ভাই। আমাকে যেতে দিন।
– দিমু তো। তোরে আগে ছিদ্র করি। এরপর।
– বিশ্বাস করেন ভাই। আমি কিচ্ছু করিনি। আমাকে এভাবে মারবেন না প্লিজ।
– মায়ার ভিডিও করোস নাই?
কান্না থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো ইমন। মায়া,,,,,, হ্যাঁ মায়ার ভিডিও ক্লিপ আছে ওর কাছে। তার মানে এরা মায়ার লোক। না না, মায়া না। বোধহয় মায়ার হাজবেন্ডের লোক। তার বউয়ের পিছু নেয়ার অপরাধে লোক পাঠিয়েছে ওকে খুন করার জন্য।
– ভাই, ভিডিও ক্লিপ আমি দিয়ে দিবো। আমাকে ছেড়ে দিন।
– তোরে দিয়া ভরসা নাই। নিজের কাছে এক দুই কপি রাইখা বাকি কপি আমারে দিবি। এরপর আবার ঐ ভিডিও নিয়া তামশা করবি৷ দুইদিন পরপর বায়োস্কোপ দেখার টাইম নাই। এরচেয়ে ভালো তোরেই শেষ কইরা দেই। ঐ বাশার মেশিন চালু কর। আগে কপালের মাঝখান বরাবর দিবি।
প্রচন্ড শব্দ করতে থাকা ড্রিল মেশিনটা ইমনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইমনের মনে হচ্ছে যেনো এই মেশিন কপালে ঠেকার আগেই ওর দম আটকে মরে যাবে। চিৎকার করে বলছে আমি সব ক্লিপ দিয়ে দিবো৷ আমাকে মেরো না। ড্রিল মেশিনের আওয়াজে সেই চিৎকারের আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে।
– শালার পোলা, করছোস কি?
ড্রিল মেশিন বন্ধ করে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ইমনকে প্রশ্ন করলো বাশার।
– কি রে? সমস্যা কি?
– ভাই, শালায় মুতছে।
ফ্লোরে তাকালো স্বপন। গলা ফাটিয়ে হো হো করে হাসছে সে৷
– কি রে ব্যাটা? কি করলি তুই? মরনরে এতো ভয় পাস। আকাম করার সময় হুঁশ থাকে না?
– ধুর,,,,, এইডা কিছু হইলো? এগুলা পরিষ্কার করবো কে এখন?
– ঐ টুনু,,,,,,, টুনুউউ,,,,
স্বপনের আওয়াজ পেয়ে ড্রইংরুম থেকে ছুটে এলো টুনু।
– কি ভাই?
– রান্নাঘরে গিয়া দেখতো ত্যানা ট্যানা কিছু আছে কিনা?
– খাঁড়ান। দেখি।
চেয়ারে মাথা ফেলে চোখ বন্ধ করে রেখেছে ইমন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। স্বপন আর বাশারের হাসি কোনোভাবেই থামছে না৷ পাগলের মতো হেসেই যাচ্ছে ওরা। রান্নাঘর থেকে ফ্লোর মুছার কাপড় নিয়ে এলো টুনু। কাপড় হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি করুম এটা দিয়া?
– ফ্লোরটা মোছ।
– পানি ফালাইলো কে?
– পানি না ব্যাটা। শরবত।
– লেবুর শরবত?
– নাহ, লবনের।।
ফ্লোর মোছার জন্য নিচে বসতেই মৃদু বাজে গন্ধ নাকে এসে ঠেকলো টুনুর। ফ্লোরে পড়ে থাকা পানির দিকে নাক খানিকটা এগিয়ে নিলো ভালোভাবে বুঝার জন্য গন্ধটা কিসের। সাথে সাথেই মাথা ঝাড়া দিয়ে সেখান থেকে সরে এলো টুনু।
– ঐ মিয়া, এটাতো মুত। আমারে শরবত কইলেন ক্যা?
পর্ব-৩৮
———————————–
সমুদ্রের মাতাল হাওয়ায় জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। জানালার পাশেই দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়া৷ পড়নে কালো রঙের নেটের শাড়ি৷ এখানে আসার আগে মায়ার লাগেজে শাড়িটা রেখে দিয়েছিলো সোহান। শাড়ির উপরে ছিলো ছোট্ট একটা চিরকুট।
” আজ রাতে পরীটাকে কালো শাড়িতে দেখতে চাই।”
সমুদ্র পাড় থেকে ফিরেই কালো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে হাল্কা সেজে নিলো মায়া। রুমের দরজার বাইরে সোহান দাঁড়িয়ে ছিলো। সে অনেকটা সময় দরজার বাইরে অপেক্ষা করেছে কালো শাড়ীতে একটা পরীকে দেখার জন্য।
মানুষটা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। চোখে মাদকতা চিকচিক করছে মানুষটার। হৃদস্পন্দন বাড়ছে মায়ার।
– দেখো ভাই, ভিডিও ক্লিপ চেয়েছিলে দিয়ে দিয়েছি। সব দিয়েছি। তোমার লোকরা তো আমার বাসা পুরাটা খুঁজে দেখেছেই। আর কোথাও নেই। বিশ্বাস করো। আমাকে যেতে দাও প্লিজ।
– হ দিমু তো। এখন তোরে সোজা উপরে পাঠামু।
– ভাই, আমি আর জীবনেও মায়ার পিছু নিবো না। আমাকে আমার মত যেতে দাও।
– তোরে দিয়া ভরসা নাই৷ ঐ মানিক শালার মুখটা বাঁধ। কোলে নে। ছাদের উপরে যামু।
– এই না,,,,, না,,,,, ভাই টাকা লাগলে বলো আমি দেই। আমার যা আছে সব দিয়ে দিবো আমাকে যেতে দাও।
বিশালদেহী মানিক হাসতে হাসতে ইমনের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে তাকে বড় একটা ড্রামের ভিতর ঢুকিয়ে নিলো। টুনু আগে ভাগে যেয়ে সিঁড়ির লাইট অফ করে দিয়েছে। টুনু আর মানিক ড্রামটা নিয়ে লিফটে উঠে গেলো। বাকিরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। টুনু আর মানিক ধরাধরি করে ড্রামটা ছাদে নিয়ে এসেছে। ইমনকে ড্রামের ভিতর থেকে টেনে বের করছে ওরা।
– ঐ বিল্লাল তুই এইটারে আয় তুই আমি মিলা ধইরা নিচে ফালাই। ইমনের মুখটা এখনও খোলা হয়নি৷ দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝড়ছে তার। চোখে বেঁচে থাকার আকুল আবেদন দেখা যাচ্ছে । খুব করে কিছু বলতে চাচ্ছে সে৷ কিন্তু সামনে থাকা লোকগুলো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর দু পায়ে দুজন ধরে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিলো ছাদের রেলিংয়ের বাইরে। নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না৷ বুকে পিঠে চাপ লেগে গেছে বাজেভাবে। ইমন বুঝে গেছে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গেছে সে। এইতো আর কিছু মূহুর্ত। এরপর সে আর এই দুনিয়ার বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হবে না। জীবনের সমস্ত পাপগুলো যেনো একের পর এক সারি বেঁধে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
– ভাই, তারে একটা সুযোগ দেন।
রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো টুনু৷ এ মূহূর্ত্বে টুনুকে ফেরেশতা মনে হচ্ছে ইমনের। মনে হচ্ছে একদম কলিজার ভিতর টুনুকে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখতে।
– এটা হইলো ভাইরাস। বাঁচায়া রাখলে অসুবিধা আছে।
– তবু ভাই। শুধরানোর একটা সুযোগ অন্তত দ্যান।
– যদি আবার কোনো কাহিনী করে?
– তখন না হয় মাইরা ফালায়েন। তারে আমরা চোখে চোখে রাখমু৷ উল্টাপাল্টা কিছু করলে ঐদিনই শ্যাষ কইরা দিমু।
– দেখ আমি রিস্ক নিতে চাই না।
– ভাই ক্যান জানি মায়া লাগতাসে৷ ছাইড়া দেন ভাই।
– তুই এমন করতাসোস ক্যান একটু কইবি? এত পিড়িত জাগতাছে ক্যান?
– জানি না ভাই।
– কেমনডা লাগে? কি রে বিল্লাল কি করমু?
– সোহান স্যাররে কি কইবেন?
– সেটাই তো কথা।
– ভাই, সোহান স্যাররে বলমু তারে মাইরা ফালাইসি।
– বেকুবের মত কথা কইস না তো৷ এই বেটারে রাস্তাঘাটে দেখলে আমাগোরে শ্যাষ কইরা ফালাইবো।
– সে অন্য কোথাও চইলা গেলেই তো হইবো।
ইমনকে আবার টেনে উপরে তুললো স্বপন আর বিল্লাল। ফ্লোরে দু পা ছড়িয়ে বসে আছে ইমন। মুখ থেকে স্কচটেপ খুলে দেয়া হয়েছে। মাথা ভীষনভাবে ঘুরাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। খানিক বাদেই বমি করতে লাগলো ইমন।
– শালায় কি শুরু করছে। একটু আগে মুতলো। এখন আবার বমি করতাসে। খবীশ একটা।
ভ্রুঁ কুঁচকে ইমনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো বাশার।
– ঐ, তোর বমি করা হইছে?
উপরে নিচে মাথা নাড়লো ইমন।
– দ্যাখ সোহান স্যার কইছে তোরে মাইরা ফালাইতে। টুনুর মায়া লাগতাছে দেইখা তোরে ছাড়তাসি। কথা হইলো তুই এই দেশে থাকতে পারবি না৷ তোর দেশ ছাইড়া যাইতে হইবো। সোহান সয়ার যদি দেখে তুই বাইচা আছোস তাইলে তোরে তো মারবোই সাথে আমাগোরেও শেষ করবো।
– আমি চলে যাবো ভাই। আমি থাকবো না এখানে। মায়ার কাছ থেকে বহুদূর চলে যাবো।
– ঠিক কইতাসোস?
– সত্যি ভাই।
হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ইমন। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না ওকে ছেড়ে দেয়া হবে।
– ঐ মানিক যা গাড়ি নিয়া যা। বাসায় দিয়া আয় এইটারে।
ঐ উঠ। যা, ওর লগে যা। আর যা কইসি তা যেনো মনে থাকে।
ইমন উঠে টুনুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে ভেবে পাচ্ছে না। তাই চুপ করে ওকে জাপটে ধরে রেখেছে।
– হইছে, হইছে ছাড়েন আমারে। ভালা হইয়া যাইয়েন। মাইয়্যা মানুষের পিছনে ঘুরা ভালা না। মন্দ কাম। এইসব কাম আর কইরেন না।
ইমন কিছু বললো না। টুনুর দিকে একবার কৃতজ্ঞতা ভরা নজরে তাকিয়ে মানিকের পিছু পিছু চলে গেলো। মানিকের সাথে বাশারকেও পাঠিয়েছে স্বপন।
ইমন যাওয়া মাত্রই সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। টুনু বললো,
– সোহান স্যার এটারে বাঁচায়া রাখতে কইলো ক্যান। মাইরা ফেললেই ভালো হইতো।
– নাহ্। সোহান ভাই এসব ক্যাচালে জড়াইবো না। খুন করলে ক্যাচাল সামাল দিতে কষ্ট হয়া যাইতো।
– সোহান স্যাররে ফোন কইরা বলেন খেল খতম।
– হ দেই।
ভোর হয়ে আসছে৷ হেলান দিয়ে বসে আছে সোহান। ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে মায়া। কল এসেছে স্বপনের। এতক্ষণ যাবৎ এই কলটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো।
– কাজ হয়েছে?
– হ্যাঁ ভাই। খুব ভয় পেয়েছে। ক্লিপগুলো ওর ফোনের মেমরি আর দুইটা পেনড্রাইভে ছিলো। সব পুঁড়ে ফেলেছি।
– পুরো বাসা ভালোভাবে চেক করেছো তো?
– হ্যাঁ চেক করেছে। ওর কাছে আর কোনো কপি নেই।
– দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্ত দিয়েছো?
– হ্যাঁ দিয়েছি। রাজি হয়েছে। দেশ ছেড়ে দিবে এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আর যদি না যায় তখন অন্য কোনো স্টেপ নিবো।
– আচ্ছা,,, স্বপন থ্যাংকস। থ্যাংকস এ্য লট।
– ভাই যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকবেন। যতটা সম্ভব হেল্প করার চেষ্টা করবো।
– ঠিকাছে। রাখি। ঘুমাবো এখন।
– আচ্ছা।
সোহানের এ মূহূর্ত্বে মনে হচ্ছে মাথা থেকে এক মন ওজনের পাথর সরেছে৷ প্রচন্ড রিল্যাক্স লাগছে। এবার একটু শান্তিমতো ঘুম দেয়া যাবে। মায়ার মাথাটা খুব সাবধানে বালিশে রেখে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো সোহান। মায়াকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো সোহান। সব ধরনের অতীত থেকে আগলে রাখতে চায় মেয়েটাকে। এতটুকু বয়সে অনেক সহ্য করেছে মেয়েটা। আর না। এবার ওকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাতে হবে।
পর্ব-৩৯
———————————–
রাত ১২:১০।আজ মায়া,সোহানের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী।পাশাপাশি চেয়ারে এপার্টমেন্টের ছাদে বসে আছে দুজন।রেলিং এর উপরে রাখা কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে।
-দুই বছর কেটে গেলো!তাই না?
-হুম!দুই বছর।
-ভালো সময় হয়তো খুব দ্রুত চলে যায়।টেরই পাইনি কোথা থেকে দুবছর চলে গেলো।প্রতিটা সময়,প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে স্বর্গীয় ছিলো।
নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছি।কখনো ভাবিনি জীবনটা এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।যখনি আয়নার সামনে দাঁড়াই তখনই মনে হয় নতুন কেউ।এই আমি তো সেই আমি না।আয়নার সামনে এখন যে দাঁড়িয়ে আছে সে সোহানের মায়া।তার নিজের মনমতো সাজানো কেউ।
-চেয়ার নিয়ে আরো খানিকটা মায়ার গা ঘেষে বসল সোহান।১হাতে শক্ত করে মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো,অন্য হাত হাত বাড়িয়ে কফির মগটা হাতে নিলো সোহান।কফির মগে চুমুক দিয়ে মায়ার কানে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
ভালোবাসি…..
আজ কলেজ যায়নি মায়া।সারা রাত ছদে কাটিয়ে এসে ভোরের দিকে সোহানের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়েছে।আজ গোটা দিনটা সোহানের জন্য বরাদ্দ রাখবে।
বেলা সাড়ে ৯টা বাজে,বালিশের কাছে রাখা মায়ার ফোনটা বাজছে।ঘুমের ঘোর কাটতে কাটতে রিসিভ করার আগেই কলটা কেটে গেলো।দ্বিতীয়বারের মত ফোনটা আবার বাজছে।হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে “হ্যালো”বলল মায়া।
ওপাশ থেকে কারো ফুঁপিয়ে কাঁদার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
-তুমি কি জানো আনিকার কি হয়েছে?
-চমকে গিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো মায়া,কে ফোন করেছে?স্ক্রিনে আনিকার মায়ের নম্বরটা ভেসে উঠেছে।তড়িঘড়ি করে আবার কানে ফোনটা লাগালো ।
-জ্বী আন্টি,কি বলছিলেন?
-গতকাল রাত থেকে আনিকা রুমের দরজা লক করে বসে আছে।ভোরের দিকে ওর রুম থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।ও চিৎকার করে কাঁদছিলো আর কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো।ও খুব করে কাওকে রিকুয়েস্ট করছিলো”আমার সাথে এরকম করো না,আমাকে ছেড়ে যেও না।আমাদের সম্পর্ক কতটা গভীর সেটা বোঝার চেষ্টা করো”।
-তুমি কি কিছু জানো ওর কি হয়েছে?
মায়া শোয়া থেকে উঠে বসল ।বললো,
-আন্টি আপনি আগে কান্না বন্ধ করুন।আমি ওকে ফোন দিয়ে দেখি,ওর কি হয়েছে।
-ও কোন ধরনের রেসপন্স করছেনা।সকালবেলা চেঁচামেচির পর থেকে বিগত ১ঘন্টা ধরে ওর কোন সাড়াশব্দ নেই।অনেক ডেকেছি,আমার বড় মেয়েকে দিয়ে ফোন করিয়েছি কোন লাভ হয়নি।ওর আমার বড় মেয়ের ফোন রিসিভ করেনি।এমনকি ভেতর থেকে ১টা আওয়াজ ও পাচ্ছিনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে আন্টি।আমি আপনাদের বাসায় আসছি।
-তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো মায়া।সোহানকে কিছু না জানিয়ে আনিকার বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো।
মাঝপথে যাওয়ার পর ফের আনিকার মায়ের ফোন এলো।ফোনটা কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
আমার মেয়েটা শেষ।
-আঁৎকে উঠল মায়া!কি বলেন আন্টি?
ওপাশ থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া গেলো না,শুধুমাত্র কান্নার আওয়াজ ছাড়া।প্রচন্ড চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে ওপাশ থেকে।
১০-১৫ সেকেন্ড পর কলটা কেটে গেলো।
কলটা কেটে যাওয়ার পর আরো ৫বার ট্রাই করল মায়া কিন্তু ওপাশ থেকে ফোনটা কেউ রিসিভ করেনি।
আনিকার বাসায় গিয়ে দেখল দরজায় তালা লাগানো,বাসায় কেউ নেই।পাশের ফ্ল্যাটে নক করলো আনিকাদের খবর নেওয়ার জন্য।দরজা খুলে একজন মাঝবয়সী মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকালো।
-জ্বী!কাকে চাচ্ছেন?
-পাশের ফ্ল্যাটের আনিকা…..ওরা কোথায়?কিছু জানেন?
-হ্যাঁ!এইতো ৭-৮ মিনিট আগে দেখলাম ধরাধরি করে ওর বাবা-ভাই আর আমাদের বাসার দারোয়ান ওকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে।ওর নাক থেকে ব্লিডিং হচ্ছিলো।বোধ হয় সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে।
-আন্টি?আন্টি কোথায়?
-উনিও ওদের সাথেই গিয়েছে।
-কোন হসপিটাল?জানেন কিছু?
-নাহ,এই ব্যাপারে তো আমি কিছু জানিনা।<br>
ভালো হয় যদি আপনি ওদেরকে ফোন করে জানেন।
-আমি তো ওর নম্বরে অনেকবার ট্রাই করেছি কিন্তু উনি ফোনটা পিক করছেন না।আপনি কি আনিকার ভাই অথবা বাবা কারো নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবেন?
-আচ্ছা!তুমি দাঁড়াও আমার ফোনটা নিয়ে আসছি।
খুব দ্রুত গতিতে ঢাকা মেডিকেলের দিকে ছুটছে মায়ার গাড়ি।নি:শব্দে চোখের পানি ফেলছে ও।
১৫মিনিট আগে আনিকার ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আনিকাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হচ্ছে।
পর্ব-৪০
———————————–
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আনিকা। মাথার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আনিকার পরিবারের সদস্যরা। ঘন্টা দেড়েক আগে জ্ঞান ফিরেছে ওর। পুরো তিনঘন্টা পর মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে৷ ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলো৷ কেনো খেয়েছিলো সে ব্যাপারে কিছু জানা নেই পরিবারের সদস্যদের। রুমের বাহিরে বসে আছে মায়া৷ মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসে আছে সোহান। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়াকে যখন বাসার কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন শামীম এসে জানালো মায়া ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না করেই কোথাও তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেলো। কোথায় গেছে সে ব্যাপারে জানা নেই শামীমের। অবশেষে মায়াকে ফোন করে জানতে পারলো আনিকার কথা। খবরটা পেয়েই হসপিটাল চলে এলো সোহান। প্রিয়তমা স্ত্রীর পরম প্রিয় বান্ধবী হলো আনিকা। নিশ্চয়ই এতক্ষণে মায়ার হাল বেহাল হয়ে গেছে৷ তাই ওকে সঙ্গ দিতে সোহানের এখানে আসা। আপাতত দুজনই চুপচাপ বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়ালো আনিকার ভাই। বললো,
– মায়া,,,,
– জ্বি ভাইয়া?
– এক কাজ করো তুমি বাসায় চলে যাও। অনেকক্ষণ হলো এখানে এসেছো। ভাইয়াও কাজ ফেলে এখানে বসে আছেন৷ তাছাড়া আনিকা এখন ভালো আছে। শুধুশুধু কষ্ট করে এখানে বসে থেকো না।
– কিসের কষ্ট! কি যে বলেন না! আমি থাকি এখানে। সমস্যা নেই।
– আমরা আছি তো। তুমি চিন্তা করো না।
– না ভাইয়া। আমি…..
– তোমাকে যেটা বলি সেটা শুনো। আনিকাকে বোধহয় কাল রিলিজ করে দিবে। তুমি কাল বাসায় চলে এসো। দুই তিনদিন আনিকার সাথে সময় কাটিয়ে যেও। ওর ভালো লাগবে। তাছাড়া তোমার সাথে ওর ব্যাপারে কথাও আছে। তুমি বাসায় আসলে ঠান্ডা মাথায় সেসব শুনবো।
– জ্বি।
– ভাইয়া আপনার কোনো আপত্তি নেই তো মায়া যদি দুই তিনদিনের জন্য আমাদের ওখানে থেকে আসে?
– আরে নাহ, সমস্যা হবে কেনো? মায়ারও অনেকদিন হয় কোথাও গিয়ে একটু বেড়ানো হচ্ছে না৷ পড়া বিজনেস সংসার সব মিলিয়ে বেচারী একদম হাঁপিয়ে যাচ্ছি। একটু ব্রেক দরকার। ভালোই হবে দুই তিনদিন আপনাদের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসলে। মায়ার মাইন্ড রিফ্রেশ হবে আনিকাও সঙ্গ পাবে।
– তাহলে মায়া আনিকাকে রিলিজ করে বাসায় নেয়ার পর তোমাকে ফোন করে জানাবো।
– জ্বি। আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।
– হুম, হুম যাও।
কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে গেলো মায়া। আনিকা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে৷ আনিকার কপালে হাত রাখলো মায়া।
– আনিকা, আমি আসি। কাল তোর সাথে দেখা হবে।
চোখ বন্ধ রেখেই মায়ার হাতের কব্জি চেপে ধরলো আনিকা। ফোঁপাচ্ছে সে। চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরছে।
– কাঁদবি না তো। তোকে কাঁদতে দেখলে কষ্ট হয়।
-…………….
– এই তোকে না করেছি কাঁদতে।
– ও কিভাবে পারলো?
– চুপ। শুনবো। সব শুনবো। এখন না। কাল যাবো তোর বাসায়। তিন চারদিন থাকবো তোর সাথে। তখন সব শুনবো।
– সত্যিই আসবি তো?
– হ্যাঁ আসবো।
রেস্টুরেন্টে চুপচাপ বসে খাবার খাচ্ছে মায়া আর সোহান। এভাবে চুপ করো বসে থাকতে ভালো লাগছে না সোহানের। মায়াকে স্বাভাবিক ভাবপ কথা না বলতে দেখলে ভিতরে উশখুশ চলতে থাকে। নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করলো সোহান।
– খাবারটা বেশ ভালো। তাই না?
– হুম।
– আরো কিছু অর্ডার করবো?
– আরে নাহ। পাগল নাকি? কে খাবে এত খাবার?
– আমার গিফট কোথায়?
– বাসায়। আলমারিতে আছে।
– কি কিনেছো?
– বাসায় যেয়ে দিয়ে দিবো। তখন দেখে নিবেন।
– শুনো না….
– হুম।
– মনটা খারাপ করে রেখো না তো। ভালো লাগে না তোমাকে এভাবে দেখতে। জানি তোমার মনটা খারাপ। তবুও ভালো লাগছে না তোমাকে এমন মনমরা দেখতে।
– হাসি না আসলে কি করবো?
– ঠিকাছে হাসি আসছে না। কিন্তু কথা তো বলতে পারো। কথা বলো আমার সাথে।
– ভালো আছেন?
– খুব প্রিয় কেও যখন ভালো থাকে না তখন আমি কি করে ভালো থাকি?
– আসলে ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে।
– আচ্ছা ও এমন করলো কেনো?
– পুরো ঘটনা জানি না। তবে আন্দাজ করতে পারছি।
– কি?
– একজনের সাথে প্রেম চলছে তিনবছর যাবৎ। নাম শোভন। সিরিয়াস পর্যায়ের প্রেম। এতদিন শোভন ভাই বিয়ে করবো বিয়ে করবো বলে পাগল করে ফেলেছিলো। আনিকাও সেসব শুনে একদম আহ্লাদে গদগদ।
– হুম। তারপর?
– মাস তিনেক আগে শুনেছিলাম উনি আনিকাকে প্রস্তাব দিয়েছে ফিজিক্যালি ইনভলভ হওয়ার জন্য। আনিকা দোটানায় ভুগছিলো ব্যাপারটা নিয়ে। আমার সাথে শেয়ার করলো। আমি ওকে কড়া গলায় না করেছি এমন কিছু যেনো না করে৷ আমার না শুনে জিজ্ঞেস করলো বা করছি কেনো? শোভন ভাই তো ওকে বিয়ে করবেই। তাহলে অসুবিধা কোথায়? তখন ওকে বুঝালাম এই লোকের সাথে বিয়ে হবেই তার গ্যারান্টি কি? নাও তো হতে পারে। লোকটা যে দুদিন পর পরিবর্তন হবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? আর ভাগ্য নামে কিছু আছে। ভাগ্যে যদি বিয়েটা না লিখা থাকে তাহলে কি বিয়ে সম্ভব? ভাগ্যে কি আছে তা তো আর ও জানে না।
– এরপর কি ও তোমার কথা মেনে নিয়েছে?
– হুম মেনেছিলো তো। আমি ওকে কয়েকদফা জিজ্ঞেস করেছি এ ব্যাপারে। ও প্রতিবারই বলেছে ওরকম কোনো সম্পর্কে ও জড়ায়নি। তবে মাসখানেক যাবৎ লক্ষ্য করছি শোভন ভাইয়ের সাথে ওর বেশ ঝামেলা যাচ্ছে। মন মেজাজ বেশ খারাপ থাকে। পুরো ঘটনা বলে না উনার সাথে সমস্যা কি হয়েছে।
– পুরো ঘটনা হলো তোমার বান্ধবী মিথ্যা বলেছে। ছেলে মজা নিতে এসেছে৷ মজা পেয়েছে। এখন তোমার বান্ধবীর আর কোনো প্রয়োজন নেই তাই ব্রেকআপ করতে চাচ্ছে অথবা করে ফেলেছে।
– আমারও তাই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা আরো আগেই সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু ও স্বীকার না করলে কি করবো বলো?
– সেটাই৷ অস্বীকার করলে তো আর কিছু করার নেই। টেনশন নিও না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
– আজ আমাদের এ্যানিভারসারি। অথচ আমি অন্য চিন্তায় ডুবে আছি। সরি। আসলে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝাঁড়তে পারছি না।
– তুমি তো এই স্বভাবেরই। মাথায় কোনো পোকা ঢুকলে সেই পোকা মাথার মধ্যে নড়াচড়া করতেই থাকে।
পর্ব-৪১
———————————–
আনিকার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটা দক্ষিণমুখী। প্রায় সারাটাদিন ধরেই মাতাল হাওয়ার আনাগোনা থাকে এই বারান্দাটাতে৷ বিশেষ করে রাতের বেলায়। রাতের খাবার সেড়ে বারান্দায় বসে আছে আনিকা আর মায়া। খুব মনোযোগ দিয়ে আনিকার কথাগুলো শুনছে মায়া।
– বিশ্বাস করেছিলাম ওকে। এতটা করেছি যে নিজের সম্মানটুকু ওর হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করিনি। কতটা বিশ্বাস করলে একটা মেয়ে মানুষ তার প্রেমিকের সামনে নগ্ন হতে পারে ভেবে দেখতো? আর ও কি করলো? বিশ্বাসটাকে পা দিয়ে পিষে ফেললো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মায়া। চাইলে এই মূহুর্তে আনিকাকে কড়া গলায় বলতে পারতো, তোকে না করেছিলাম। কেনো গেলি?
এধরনের প্রশ্ন করাটা মায়ার কাছে অদ্ভুদ এবং অহেতুক মনে হয়। যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো সম্ভব না। তাছাড়া তার কর্মফল তো সে ভুগছেই। নতুন করে তার কর্ম মনে করিয়ে দেয়ার কি আছে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো আনিকা।
– ওর সাথে যতবার রুমডেটে গিয়েছি প্রতিবারই ওর কোনো না কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়েছি। ওর বন্ধুরা জানতো ওর সাথে আমি……
জানিস সে মূহুর্তে এই কথাটা একটাবারের জন্যও মাথায় আসেনি বদ্ধরুমে আমি আমার প্রেমিকের সাথে কি করছি সেটা তো ওর বন্ধুরা জেনে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে হয়তোবা আলোচনাও করছে। আমার আড়ালে হয়তোবা আমাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করছে। আমার প্রেমিককে হয়তোবা জিজ্ঞেস করছে রুমডেট কেমন ছিলো? কেনো মাথায় আসেনি আমি জানিনা। সত্যি জানিনা৷ লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বসেছিলাম একদম। আর এখন…. মনে হলেই গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। কিভাবে পারলাম ওর বন্ধুদের সামনে দিয়ে ঐ রুমে যেতে? ওর বন্ধুরা জানতো কি কাজ করতে ঐ ঘরটাতে আমি যাচ্ছি। অনেক মানুষই হয়তো আমার নিকৃষ্ট কাজের গল্পটা জানে। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাই তখন হয়তো আমার আড়ালে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলে। গা ঘিনঘিন করছে খুব। মনে হচ্ছে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেই। কি করলাম আমি এটা? কেনো করলাম?
এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদছিলো আনিকা। শেষের কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো৷ মনে হচ্ছে যেনো চাপা কষ্ট আর অপরাধবোধটা ওর ফুসফুসটাকে দখলে নিয়ে নিয়েছে। কোনোভাবেই নিঃশ্বাসটা ফুসফুস অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
রুমে যেয়ে পড়ার টেবিলের উপর থাকা পানির বোতলটা নিয়ে এলো মায়া। আনিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
– একটু পানি খা। গলাটা বোধহয় শুকিয়ে এসেছে।
ধীরে ধীরে পানি খাচ্ছে আনিকা। গলাটা সত্যিই শুকিয়ে এসেছিলো। পানি খাওয়া শেষে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলো সে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসটা ফুসফুস অব্দি একটু হলেও পৌঁছেছে।
– শোভন ভাই ব্রেকআপ কেনো করতে চায়? কিছু বলেছে?
– হুম।
– কেনো?
– আমাকে নাকি আর ভালো লাগছে না। আমার সবকিছুতেই নাকি বিরক্ত লাগে। আগের মত ম্যাজিক নাকি আর খুঁজে পায়না।
– আর?
– আমি আনস্মার্ট। ওর ভার্সিটিতে নাকি অনেক সুন্দর মেয়ে আছে। সেক্সি ফিগার। দেখলেই নাকি চোখ জুড়িয়ে আসে৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকলেও একঘেয়েমি আসবে না। বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডগুলো নাকি আমার চেয়ে হাজারগুনে ভালো। তাদের সামনে আমাকে পরিচয় করাতে লজ্জা লাগে।
– তুই সুইসাইড করতে চাচ্ছিলি কেনো?
– কারনগুলো কি যথেষ্ট মনে হচ্ছে না? সারা শরীরে ঐ মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে। অবৈধ সম্পর্কের নোংরা স্পর্শ। মনে হলেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। সেইসাথে কিছু মানুষের নজরে আমি “ইউজড মাল” নামে পরিচিত হয়ে গেছি। আমার ভবিষ্যত কি বলতে পারবি? বাবা মা কি আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবে? কোনোদিনও না। পাঁচ ছয় বছর পর ঠিকই বিয়ে দিবে। ততদিনে নিশ্চয়ই ঐ নোংরা স্পর্শ মুছে যাবে না। গায়ে লেগেই থাকবে। সেই সাথে ইউজড মাল তকমাটাও। আমার পরিবারের রক্ষণশীলতা দেখে আমার হাজবেন্ড হয়তোবা ভাববে আমি অতি মাত্রার সতী মেয়ে। আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে৷ রাস্তাঘাটে আমার সেই নোংরা ঘটনার সাক্ষ্যীরা আমাদের দেখবে। নোংরা হাসি হাসবে আর বলবে, আরে এই মালটারে তো আমার বন্ধু কবেই খায়া দিছে। আর সেই মানুষটা যদি কখনো জানে আমি তো সতী না। মিথ্যা ভ্রমে সংসার করে গেছে উনি। তখন কি হবে বল তো? ভবিষ্যত অন্ধকার। নূন্যতম আলা আমি দেখতে পাইনা। যত ভাবি ততই মনে হয় অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি। এমন মানুষের বেঁচে থাকার কি আদৌ কোনো মানে আছে?
– ভবিষ্যত কি হবে তা তুই জানিস না আমিও না৷ সেটা তো ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। তোর স্বামী মানুষটা কেমন হবে তা আমি জানি না। তবে এটা কি জানিস মানুষরুপি কিছু ফেরেশতা আছে। ফেরেশতাগুলো আমাদের জীবনে আসে একরাশ স্নিগ্ধ আলো নিয়ে৷ এমনও তো হতে পারে এমন একজন ফেরেশতা তোর জন্যও অপেক্ষা করছে।
– মিথ্যা আশায় আমি দিন কাটাতে রাজি না। এগুলো নেহায়েৎ মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না।
– গল্প শুনবি আনিকা? আমার গল্প?
-কি গল্প শুনবো তোর? তুই যে কতটা সুখী তা আর নতুন করে কি শুনবো?
– সুখের আড়ালের ভয়ংকর সত্যিটা শুনবি না?
– মানে?
খানিকটা নড়েচড়ে বসলো মায়া। নিজের অতীতটাকে কখনো কারো সামনে মেলে ধরে না। মায়ার চকচকে দুনিয়ার সাথে পরিচিত মানুষগুলো জানেই না ওর অতীত কতটা কালো ছিলো। আজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই কালো অতীতকে নাড়া দিতে হবে। কাছের মানুষটাকে যে সেই কালো অতীত থেকে অনেক কিছু শিখানোর আছে। খোলা চুলগুলো খোপা করে নিলো মায়া। বারান্দার বাহিরে তাকিয়ে বললো,
– আনিকা আমি একজন প্রস্টিটিউট ছিলাম। জন্মসূত্রে। আমার মাও ছিলো এই পেশায়।
আনিকার ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকালো। একরাশ বিস্ময় আর প্রশ্নের ছোটাছুটি করছে ওর চোখে। মায়ার মাত্র বলা কথাগুলো বড্ড দোটানায় ফেলে দিয়েছে ওকে৷ কথাগুলো কি সত্যি নাকি বাজে কৌতুক ছিলো সে হিসেব মিলাতে পারছেনা আনিকা। হুট করেই যেনো মনে হচ্ছে কান্নাটা আটকে গেছে। কষ্টের চাপ কমে গেছে। কি বললো মায়া এটা?
– অবাক হচ্ছিস খুব তাই না রে?
– কেমন কথা বললি এটা?
– সত্যি বলেছি। আমার ঝলমলে দুনিয়াটা দেখলে কেও বিশ্বাস করবে না আমার অতীত কতটা ফ্যাকাশে ছিলো।
– সিরিয়াসলি তুই…….
– নিজেকে নিয়ে, নিজের মা কে নিয়ে নিশ্চয়ই কেও এমন নোংরা মজা করবে না।
– সোহান ভাই কি জানে এসব?
– হুম। ঐ মানুষটা আমাকে ঐ পাড়া থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। নিজের স্ত্রীর সম্মান দিয়েছে। আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার বউ একজন প্রস্টিটিউট জানা সত্ত্বেও কোনো স্বার্থ ছাড়া অকারনে ভালোবেসেছে৷ আগলে রেখেছে। কখনো আমাকে নিয়ে এমন চিন্তা করেনি আমার শরীরে এর আগেও বহু পুরুষের হাত পড়েছে। সেই প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত মানুষটা যতবার আমার দিকে তাকায় ততবার সেই একই মুগ্ধতা খুঁজে পাই৷ তার চোখে তিল পরিমান মুগ্ধতা বা ভালোবাসা কোনোটারই ঘাটতি হতে দেখিনি।
প্রায় আড়াই বছর আগে গল্পটা শুরু হয়েছিলো। তখন ঐ পাড়াতে আমার চাহিদা আকাশচুম্বী৷ আতিপাতি কাস্টমারদের কাছে আমাকে নেয়া হতো না। মোটা অংকের টাকা যারা দিতে পারবে শুধু মাত্র তাদের কাছেই আমাকে পাঠানো হতো। একদিন এই মানুষটা এলো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলো৷ উনার দেখা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ধারনা ছিলো পুরুষ হলো মাংসখেকো৷ কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিলো আমি কোনো পুরুষের ঘরে আসিনি৷ আমি একজন মানুষের ঘরে এসেছি। সেই রাতে মানুষটা আমাকে বলেছিলো ঐ ঘরটা আমার ঘর। আমার সংসার। নিজের মতো করে যেনো আগলে রাখি। যত্ন করি। কথাগুলো কানের মাঝে ঘন্টার মতো বাজছিলো। একে তো জ্বর ছিলো। তার উপর এসব কথা। দুটো মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো আমি আর এই জগতে নেই৷ বোধহয় স্বপ্নের রাজ্যে ভাসছি। ঘুমটা ভাঙলে বা জ্বরটা কমলেই একদম মুখ থুবড়ে এসে সেই নোংরা জগতে পড়বো।
পর্ব-৪২ (শেষ পর্ব)
———————————–
– মানুষটা আমার শরীরের লোভ করেনি। আমার ভালোবাসা আর একটু যত্নের লোভ করেছিলো। উনি আমার কাছে আসেনি। আমি উনাকে কাছে টেনেছি। উনার সংস্পর্শে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানতাম মেয়ে মানুষ জাস্ট একটা মাংসের দলা। পুরুষ যেভাবে খুশি সেই মাংসের দলাকে কামড়াবে নখের আঁচড় দিবে। উনার কাছে যাওয়ার পর জানলাম মেয়ে মানুষ সবার কাছে মাংসের দলা না। কারও কারও কাছে মেয়েরা খুব যত্নের। খুব ভালোবাসার। পরম স্নেহে বুকে আগলে ধরার মতো।
– উনার ফ্যামিলি জানে?
– হুম জানে।
– উনারা এক্সেপ্ট করে নিলো তোকে?
– নাহ্।
– দেবর আর দেবরের বউ খুব স্বাভাবিক মেনে নিয়েছে। ওরা এমন ভাব নিয়ে আমার সাথে মেলামেশা করে মনে হয় যেনো কিছুই জানে না। শ্বশুড় অনেকটা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। আর শ্বাশুড়ী আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। আমার শ্বশুড় দেবর আগে থেকে জানতো আমি কে? আমার অতীত কি? আমার শ্বাশুড়ী জানতেন না। উনাকে বলা হয়েছিলো আমার সাথে সোহানের এ্যাফেয়ার ছিলো৷ নিজেরা বিয়ে করে নিয়েছি।এটা নিয়ে ছেলের সাথে মায়ের বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। দেড় বছর আগে আমার দেবরের বিয়ের জন্য চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো শ্বশুড়বাড়ি যাই। গায়ে হলুদের দিন আমার এক কাস্টমার আমাকে দেখে ফেলে। উনি আমার শ্বশুড়ের বন্ধুর ছেলে ছিলো। উনি যখন জানতে পারে আমি সোহানের বউ তখন সাথে সাথে সবার কাছে ছড়াতে লাগলো সোহান একটা প্রস্টিটিউট ধরে এনেছে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো তুমুল সমালোচনা৷ আমার শ্বাশুড়ি তো কোমড় বেঁধে লাগলেন আমাকে ঘর থেকে তাড়াবেন৷ কত কি যে শুনেছি! ভিতর থেকে একদম দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো আমার। এত সমালোচনা নিতে পারছিলাম না। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার এখনও মনে আছে আমার দেবরের সাথে উনি একদিন রাতে বসে বলছিলো, কত চেষ্টা করলাম ওর অতীত ধামাচাপা দেয়ার। ওর সমস্ত রেগুলার কাস্টমারের মুখ বন্ধ করালাম। কোনো কাজ হলো না৷ কোন ফাঁকে এই একটা পিস রয়েই গেলো। ছোট্ট একটা মেয়ে। এত প্রেশার ও নিতে পারছে না। ওকে এভাবে চুপচাপ সারাদিন এক কোনায় পড়ে থাকতে দেখে মনে হয় বুকের হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাচ্ছে।
সেদিন উনার কথাগুলো শুনে আড়ালে যেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। মানুষটা আমাকে এনেছিলো একটু সুখের আশায়। অথচ আমি উনাকে সুখী করতে পারছি না। প্রায় পনেরোদিন ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলাম। এই কোনায় ঐ কোনায় পড়ে থাকতাম। ব্যবসায়ের দিকে কোনো নজর নেই। পড়ালেখা সব বন্ধ। নীরবে কান্নাকাটি করতাম। একদিন উনি এসে আমার পাশে বসলো। আমার ডানহাতটা খুব শক্ত করে ধরলো। বললো,
– আমার কতগুলো কথা শুনবে।
আমি বললাম হ্যাঁ শুনবো।
উনি আমার চোখে চোখ রেখে কথা গুলো বলতে লাগলো,
কেনো মন খারাপ করছো? কার কথায় মন খারাপ করছো? সমাজের লোক কি বললো সেসব শুনে? যারা তোমাকে নিয়ে সমালোচনা করছো তারা ভালো? তাদের সন্তানরা ভালো? জগতে কেও ফেরেশতা না মায়া৷ প্রতিটা মানুষের ত্রুটি আছে। আর আমাদের সোসাইটির তোমার বয়সি কয়টা ছেলে মেয়ে একদম ফুলের পবিত্র আছে দেখাও তো? স্কুলে থাকতেই তো মেয়েগুলো নিজের ভার্জিনিটি বিসর্জন দিয়ে আসছে প্রেমিকের কাছে। তোমার কি ধারনা কার ছেলে মেয়ে কখন কি করে সেসব আমাদের কানে আসেনা? আসে। কয়েকদিন তুমুল আলোচনা সমালোচনা হয়৷ এরপর সব শেষ। কে কি বললো সেসব নিয়ে মাথা কেনো ঘামাও? তুমি নিজে কেমন তা তো তুমি জানো। তুমি সেঁধে সেঁধে তো আর ঐ লোকদের সাথে শুতে যাওনি। তুমি পরিস্থিতির শিকার ছিলে। তুমি জানো তুমি ভালো। আমি জানি আমার বউ ভালো৷ দুনিয়ার সবাই তো এক মেন্টালিটির না। দুনিয়াতে যদি আমি সালমান শিমুর মতো মানুষ থেকে থাকে যাদের একজন প্রস্টিটিউটের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তাহলে ধরে নিও আমাদের মতো আরও দশটা মানুষ সোসাইটিতে আছে যাদের তোমাকে নুয়ে কোনো মাথাব্যাথা থাকবে না। সমাজের একশটা লোকের মাঝে নব্বইজন তোমার বিপক্ষে কথা বলবে আর দশটা লোক তোমার পক্ষে কথা বলবে। তুমি সেই দশটা মানুষ নিয়েই নিজের একটা জগত তৈরী করে নিবে। দরকার নেই সেই নব্বই জনের। যারা তোমাকে বুঝে না কি দরকার তাদেরকে নিজের জগতে রাখার? আর কি কিছু প্রয়োজন? মাথা উঁচু করে হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকতে কি তোমার এর চেয়ে আরো কিছু দরকার? এ ধরনের মানুষ প্রতিনিয়ত একটা মুখরোচক টপিক খুঁজে যেটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা যায়। আজকে সমালোচনার শীর্ষে তুমি আছো কাল আরেকজন থাকবে। নিজেকে গড়ে তুলো মায়া। নিজের পায়ের তলা মাটিটাকে শক্ত করো। লোকে যখন তোমার যোগ্যতা দেখবে তখন আপনা আপনিই সবাই মুখে কুলুপ এঁটে রাখবে। তোমাকে হুজুর হুজুর করবে। ইটস অল এ্যাবাউট মানি এ্যান্ড পজিশন। তুমি সোহানের ওয়াইফ। সোহানের ওয়াইফ মাথা নিচু করে কেনো বাঁচবে? তোমার গায়ে লেগে থাকা ময়লাটা তোমাকে ঘষে মেজে উঠিয়ে ফেলতে হবে। উত্তর দিতে শিখো মায়া। সবসময় আমি থাকবো না তোমার হয়ে মানুষকে উত্তর দেয়ার জন্য৷ নিজের লড়াই নিজে লড়তে শিখো৷ মানুষ যখন দেখবে তুমি তোমার জায়গায় শক্ত আছো, তোমাকে কাবু করা এতটাও সহজ না তখন মানুষ চুপ হয়ে যাবে। তোমাকে নিয়ে আর এতটা মাতামাতি করবে না। তোমাকে কিছু বলার আগেও দশবার ভেবে চিন্তে এরপর বলবে। দুনিয়া উল্টেপাল্টে যাক একটা কথা মাথায় রাখবে জগতে এখনো একজন আছে যে তোমাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসে। তুমি ছাড়া মানুষটা নিঃশ্বাস নিতে পারে না। তুমি আছো তো সে আছে, তুমি নেই তো সেও নেই।
শেষের দুটো লাইন বলার মূহূর্ত্বে উনার চোখে পানি ছলছল করছিলো। উনি প্রচন্ড স্ট্রং একজন মানুষ। শত কষ্টেও উনি কখনো কাঁদে না। বা আমি কখনো উনার চোখে পানিও আসতে দেখিনি। সেদিনই প্রথম আর সেদিনই শেষবারের মতো উনার চোখে পানি ছলছল করতে দেখেছিলাম। পানি গড়িয়ে চোখের বাহিরে আসার আগেই উনি সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো। হয়তোবা আমার সামনে বসে থাকলে কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারতো না।
– এরপর?
– প্রায় পনেরো মিনিট ধরে উনার কথার প্রতিটা লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাইয়েছি। ঠিকই তো ছিলো উনার কথাগুলো। একটা কথাও অযৌক্তিক ছিলো না। উনি যদি একটা প্রস্টিটিউটকে নিয়ে ঘর বাঁধার তাকে ভালেবাসার দুঃসাহস দেখাতে পারে তাহলে কেনো আমি এই লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবনটা খুশি খুশি কাটাতে পারবো না? ছুটে গিয়েছিলাম উনার কাছে। খুব শক্ত করে উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম৷ কতক্ষণ ওভাবে উনাকে ধরে রেখেছিলাম জানি না। মুখ ফুটে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম,
আপনাকে ভালোবাসি। আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সব করতে পারি।
উনি প্রতিউত্তরে কিছু বলেননি। আমার মাথার উনার থুঁতনিটা রেখে আমাকে আরও যত্নে আগলে ধরেছিলেন। এরপর থেকে কেও কিছু বলতে আসলে একদম মুখের উপর উত্তর দিয়ে দিতাম। কিছুদিন বেশ চড়াই উতরাই দেখতে হয়েছে৷ এরপর সব স্বাভাবিক। তেমন ভাবে সমালোচনা কাওকে কখনো করতে শুনিনি। সমালোচনা হয় না ঠিক তা না। হয়। তবে আগের মতো না। আমি থাকি ঢাকায়। তাই এখানে অতটা ঝামেলা হয় না। প্রত্যেক ঈদে চট্টগ্রামে গেলেই গুনগুন শোনা যায় । যার যার উত্তর তাকে দিয়ে দেই। পারি না শুধু শ্বাশুড়ীর সাথে। শত হোক এমন একটা সন্তানকে জন্ম দিয়েছে যে আমার নজরে ফেরেশতা। তার সাথে খারাপ আচরন করি কি করে? আসলে ভিতর থেকে উনাকে উত্তর দেয়ার ব্যাপারটা আসে না। দেখা যায় ঐ বাড়িতে গেলে উনি রুম থেকেই বের হোন না। আমিও যতটা সম্ভব উনার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। ঐ ঘটনার পর উঠেপড়ে লাগলাম ব্যবসা আর পড়ালেখার পিছনে। দুইবছরে ব্যবসা কতটুক টেনে এনেছি তা তো জানিসই। এর কিছুদিন পর আম্মাকেও উনি নিয়ে আসলো ঐ পাড়া থেকে। অন্য একটা ফ্ল্যাটে আম্মাকে রাখলো। সাথে দুটো কাজের মেয়ে দিয়ে দিলো৷ আম্মা হাতের কাজ খুব ভালো জানতো। তবুও আম্মাকে আবার নতুন করে ট্রনিং সেন্টারে ভর্তি করালো। আরও ভালোভাবে কাজ শিখলো। একদিন হুট করে আম্মাকে আর আমাকে ছোট একটা কারখানায় নিয়ে গেলো। সেখানে যেয়ে আম্মাকে বললো,
এটা আপনার কারখানা। বিশজন কর্মীও এপোয়েন্ট করা হয়েছে। দুইটা বুটিক হাউজের সাথে কথা হয়েছে। ওরা আপনাকে শাড়ী, সালোয়ার কামিজের ডিজাইনসহ অর্ডার করবে। আপনি সেগুলো তৈরী করে সাপ্লাই দিবেন।
আম্মা সেদিন একটা কথাও কারো সাথে বলেনি। পরদিন সকালে আমার বাসায় এসে উনার হাত ধরে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলো৷ আম্মার কারখানা এখন দিব্যি যাচ্ছে।
– রুপকথার গল্পের মতো লাগছে।
– হ্যাঁ অনেকটা এরকমই। উনি আমার জীবনে আসার আগ পর্যন্ত কল্পনা করিনি আমি কোনোদিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। কোনো পুরুষ তার সবটা উজাড় করে দিয়ে আমাকে ভালোবাসবে। আমার মাথায় হাত রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখাবে। উনি এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা অসম্ভব। সম্মানটা আপনা আপনি একদম মনের ভিতর থেকে চলে আসে। কখনো উনি আমার অতীত নিয়ে ঘাটাননি। সেদিন মাত্র কয়েকটা মূহূর্ত্বে আমার জীবনটা ঘুরে গিয়েছিলো। মাত্র কয়েকটা মূহূর্ত্ব……
জীবনে জোয়ার ভাটা থাকে। একটা ভুলকে কেন্দ্র করে গোটা জীবনটাকে আমি বলি দিয়ে দিবো তা কি ঠিক? কেনো আমি ধরে নিবো আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। ভালোও তো হতে পারে। অন্ধকারের কথা ভেবে যদি জীবনটাকে শেষ করে দেই তাহলে আলোর দেখা মিলবে কিভাবে?
দীর্ঘশ্বাস নিলো আনিকা। গল্পটা অক্সিজেনের মতো ওর মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে গায়ে যেনো স্বস্তির শীতল বাতাস লাগছে৷ প্রতিটা রাতের ভোর হয়। ওর জীবনের ভোরটাও বোধহয় সুন্দর স্নিগ্ধ আলোতেই হবে। হোক বা না হোক আলোর আশা করতে দোষটা কোথায়? ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে তো আলোর আশা করতেই হবে। আর নয়তো জীবনটা অন্ধকারের মাঝেই থমকে দাঁড়াবে।
মুচকি হাসছে আনিকা। মায়ার হাত ধরে বললো,
– এত ভালোবাসিস। তবুও আপনি করে বলিস?
– হা হা হা,,,,,, আপনি বা তুমি তে কি আসে যায়? ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে কি তুমি করে বলাটা খুব জরুরী?
– তোর এ্যানিভারসারি ছিলো গতকাল। আমার জন্য ঠিকমতো সেলিব্রেটও করতে পারলি না।
– ধুর, বাদ দে৷ উনার সেলিব্রেশন সারাবছর ধরে লেগেই থাকে।
– কিছু গিফট করিসনি?
– হুম করেছি তো।
– কি?
– মোবাইল। যেটা হাতে নিয়ে উনি এখন গেমস খেলছে।
– তুই জানিস কিভাবে?
– আমার চোখের সামনেই বসে আছে।
– মানে?
– বারান্দার বাহিরে কাকে দেখছি এতক্ষণ ধরে? উনি সামনের বিল্ডিং এর বারান্দায় বসে আছে। ঐ যে দেখ মোবাইলের স্ক্রিনের লাইট জ্বলছে।
– উনি এখানে?
– হুম। উনার বন্ধুর ফ্ল্যাট। কি যেনো মনে হলো কে জানে? সাড়ে দশটার দিকে ফোন করে বললো আনিকার সাথে যদি গল্প করো তাহলে বারান্দায় বসে গল্প করবে৷ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে সারারাত তোমাকে দেখবো। একরাতের জন্য প্রেমিক হবো। পাশের বিল্ডিংয়ের প্রেমিক।
মায়ার কথায় সজোরে হাসছে আনিকা। যে ভালোবাসার সে এমনিই বাসবে। শত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মানুষটার ভালো দিকগুলোই দেখবে। যে ভালোবাসবে না তাকে হাজারটা গুন দেখিয়েও লাভ হবে না। ত্রুটি সে বের করবেই। সোহান প্রথম শ্রেণীর আর শোভন দ্বিতীয় শ্রেণীর। কেউ পতিতার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে আর কেও ভালোবাসার মাঝে পতিতা…..।
***সমাপ্ত***