Written by Pinuram
নতুন দিনের আগমন কিন্তু ভীষণ মলিন দিনের আগমন। নতুন দিন নাকি নতুন সূর্য নতুন দিগন্ত মেলে দাঁড়ায়, কিন্তু এই মলিন দিন ওদের জীবনের এক বিভীষিকা ময় দিনের করুন সুর বাজিয়ে দিয়েছে। ওয়েব চেক ইন করেই দিয়েছিল রিশু, তাই ওদের সিট নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। এক সারির তিনটে পাশাপাশি সিট ছিল ওদের। ঝিনুকের পা যেন আর চলছিল না একদম। সিকিউরিটি চেক পর্যন্ত তিন মেয়ের মুখে কোন কথা ছিল না। ঝিলিক আর দিয়ার মধ্যে তাও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস, কারণ রিশু আসল ঘটনার কিছুই জানায়নি দিয়ার মাকে। কিন্তু ঝিনুক কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে বিয়ের পরে প্রথমবার বাড়ি একা একা এই দুরাবস্থা নিয়ে ফিরবে। কার কাছে কি মুখ দেখাবে ঝিনুক? ফিরে কোথায় যাবে? সল্টলেকে নিজের বাড়িতে নাকি ঢাকুরিয়ায় রিশুর বাড়িতে? মা বাবা যদি কোন রকমে এই কথা কোনদিন জানতে পারে তাহলে ওর বিষ খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর কি মুখ নিয়ে মামনির সামনে দাঁড়াবে ঝিনুক? যে ভাবে ঝাঁঝিয়ে রিশুর মুখের ওপরে মামনির নামে ওই বাক্য উচ্চারন করেছে তারপরে কোন মুখে দাঁড়াবে? ঠান্ডায় নয়, এক অজানা আশঙ্কায় ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
সিকিউরিটি চেকের পরে ফ্লাইটের ওয়েটিং এরিয়ার দিকে হাঁটতে হাঁটতে দিয়া আর ঝিলিককে জিজ্ঞেস করে ঝিনুক, “তোরা কি কিছু খাবি?”
এতক্ষন পরে দিদির গলার আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকায় ঝিলিক, মাথা নাড়ায় না, একটু চুপ করে থেকে ওকে বলে, “তুই সেই গতকাল বিকেল থেকে কিছুই খাস নি, তুই কিছু খা।”
দিয়া ঝিনুকের বাজু ধরে মৃদু নাড়িয়ে বলে, “তুমি কিছু খাও না হলে শরীর খারাপ করে যাবে।”
দিয়ার গালে হাত রেখে কেঁপে ওঠে ঝিনুকের ঠোঁট, “আমি শেষ, আমার খাওয়া না খাওয়া এক ব্যাপার।”
এই কথার জবাব ওই দুই সপ্তদশী তরুণীর কাছে নেই।
ঠিক তখনি ঝিনুকের মায়ের ফোন আসে ঝিনুকের কাছে। ওর হাত কেঁপে ওঠে ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দিয়া আর বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোন উঠায়, “হ্যালো।”
পিয়ালী মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রে? তোরা নাকি ফিরে আসছিস?”
দিয়া ইশারায় ওকে বলে, ওর দাদা গাড়িতে বসে ওর মাকে যে কথা বলেছিল সেই কথাই বলতে। ঝিনুক ছোট উত্তর দেয়, “হ্যাঁ আমরা তিনজনেই ফিরছি। কিন্তু তোমাকে কে বলল?”
পিয়ালী উত্তর দেয়, “এই মাত্র আম্বালিকা আমাকে ফোন করল। হটাত করে কি হয়েছে?”
ঝিনুক একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, “বাড়ি এসে সব বলব।” বলে ফোন কেটে দেয়।
বেশ কিছু পরে, ওরা প্লেনে উঠে বসে পরে। দিয়া দাদাভাইকে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দেয়, যে ওরা প্লেনে বসে গেছে। দাদাভাইয়ের ছোট একটা উত্তর আসে, পৌঁছে ফোন করিস।
প্লেনটা দিল্লীর মাটি ছাড়তেই বুক কেঁপে ওঠে ঝিনুকের, এই বুকে কি আর ফিরে আসতে পারবে এই জীবনে? জানা নেই ওর। চোখ বুজে সিটের ওপরে মাথা পেছন করে হেলিয়ে দেয় ঝিনুক।
ঝিনুক কাঁচের দরজার ওপাশের ভিড়ে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত স্থাণুবৎ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল রিশু। দুর থেকেও সেই ভিড়ের মধ্যে তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটাকে খুঁজে বেড়ায় ওর তৃষ্ণার্ত নয়ন। হাতে ফোন নিয়ে বেশ কিছুক্ষন নড়াচড়া করতে করতে ট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে হাঁটা লাগায়। দিনটা রবিবার, ভেবেছিল সবাই কে নিয়ে শপিং করতে যাবে, কিন্তু বিধি সেই সুখ ওর কপালে লিখে যায়নি। মাকে ফোন করে ছোট ভাবেই জানিয়ে দেয় ওদের প্লেন ছাড়ার কথা। ক্যাবে চেপে শুন্য বাড়িতে ফিরতে ভীষণ কষ্ট হয় রিশুর। বাড়িতে পা রাখতেই ফাঁকা বাড়ি ওকে চেপে ধরে। জানালা দরজায় ঝিনুকের কেনা ঝিনুকের পছন্দের পর্দা ঝুলানো, নতুন কেনা সোফার কভার। খাওয়ার টেবিলে সাজানো একটা চামচের স্টান্ড সেটাও ঝিনুকের পছন্দের। শোয়ার ঘরে ঢুকে আলমারি খুলতেই নীলচে রঙের শালটা ওর হাতের ওপরে পরে যায়। রোজ দিন বাজারে যাওয়ার সময়ে এই শালটাকে ঝিনুকের গলায় জড়িয়ে দিত রিশু। শালটা নাকের ওপরে চেপে ধরে, এখন ওর ভালোবাসার গন্ধ রয়েছে, মুছে যায়নি। বুকের ভেতরে মিশ্র অনুভূতি জাগ্রত হয়। ওর অর্ধেক শরীর ভীষণ ভাবেই ঝিনুককে দুই হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছে। বাকি অর্ধেক বিতৃষ্ণায় ধিক্কার জানায় সেই মেয়েকে যে মেয়েটা ওর মাকে অপমান করেছে। কাজের মেয়ে রোজি এসে কাজ করে রান্না সেরে চলে যায়, ওর প্রচুর প্রশ্ন দিদি হটাত করে কেন চলে গেল। রিশু মৃদু বকুনি দেয়, কাজ সারো। কারুর সাথে তখন কথা বলার ইচ্ছে ছিল না ওর।
প্লেন কোলকাতার মাটি ছুঁতেই এক শূন্যতা ভর করে আসে ঝিনুকের বুকের মধ্যে। সুটকেস নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরনোর সময়ে দিয়া বাড়িতে আর দাদাকে ফোনে জানিয়ে দেয় ওদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। দাদাভাইয়ের গলা নিরুত্তাপ, এক রাতেই গলা বসে গেছে। দাদাভাইয়ের এত হিমশীতল কন্ঠস্বর এর আগে কোনদিন শোনেনি দিয়া। দুই বোনকে নিয়ে এয়ারপোরট ছেড়ে বেড়িয়ে এসে দেখে দিয়ার গাড়ির ড্রাইভার, সন্তোষ ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। সন্তোষ ওদের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রেখে দেয়। তিনজনে গাড়িতে উঠে পরে। সন্তোষ জিজ্ঞেস করাতে ঝিনুক বলে সল্টলেকে ওদের বাড়িতে আগে যেতে তারপরে ঢাকুরিয়া যেতে। পেছনের সিটের এক কোনায় ঝিনুক আর অন্য কোনায় দিয়া, ঝিলিক সামনের সিটে বসে। গাড়ি সল্টলেকে ঢুকে ওদের বাড়ির সামনে থামে। সন্তোষ নেমে ঝিলিকের ব্যাগ বের করে দেয়। ঝিলিক মাথা উঠিয়ে দুই তলার ওদের ফ্লাটের বারান্দায় দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ঝিনুক তখন গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে, মুখের সামনে ডান হাত মুঠো করে কোন এক অজানা জগতে হারিয়ে গেছে।
দিয়া ঝিনুকের হাত ধরে আলতো চাপ দিয়ে নরম গলায় বলে, “ঝিনুকদি বাড়ি এসে গেছে।”
কোথায় যাবে, কি করবে এই সব খেয়ালেই হারিয়ে গেছিল ঝিনুক। দিয়ার হাতের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে। সত্যি গাড়িটা ওদের ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে। ঝিলিক ওর দিকের দরজার পাশে সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে। সন্তোষ ড্রাইভার সিটে বসে পরে অপেক্ষা করছে।
ঝিনুক ওর দরজার কাঁচ নামিয়ে বোনের দিকে দেখে বলে, “তুই বাড়ি যা। দেখি বিকেলের দিকে আমি আসতে পারি।” বলে ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে দেয়।
গাড়ি ছেড়ে দিতেই ঝিনুকের মায়ের ফোন আসে ওর কাছে, “কি রে বাড়ি এলি না?”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে, চোখের কোল মুছে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না গো ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। বাড়ি গিয়ে তোমাকে ফোন করছি।”
রবিবার সকালের রাস্তায় যানজট কম ছিল। সল্টলেক থেকে ঢাকুরিয়া দিয়ার বাড়িতে পৌঁছাতে গাড়ি বেশি সময় নেয় না। সারাটা রাস্তা সিটের একপাশে দিয়া চুপ অন্যপাশে ঝিনুক চুপ করে বসে। গাড়ি দিয়ার বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই দিয়া ঝিনুকের হাতে আবার আলতো চাপ দিয়ে ওর সম্বিত ফিরিয়ে আনে। সারা রাত ঘুম হয়নি, প্লেনেও ঘুমাতে একটু চেষ্টা করেছিল কিন্তু চোখ বুজলেও নিদ্রা ওকে ছেড়ে বহুদুর চলে গেছে। শুন্য নয়নে দিয়ার দিকে একবার দেখে চোখের কোল মোছে ঝিনুক। দিয়া আর ঝিনুক গাড়ি থেকে নেমে দেখে দরজার সামনে দীপ দাঁড়িয়ে আর ওপরের বারান্দায় ওদের অপেক্ষায় রিশুর মা আর পাপা দাঁড়িয়ে। ঝিনুক ওপরের দিকে একবার দেখে দিয়ার দিকে তাকায়।
দিয়া ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাতেও ওপরে আলতো চাপ দিয়ে বলে, “চলো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মেয়েটা সত্যি অনেক বোঝে, হয়ত মামনির শিক্ষাদীক্ষার ফল। বাড়ির মধ্যে পা রাখতেই দীপ দিয়ার হাত থেকে সুটকেস নিয়ে নেয়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে চড়ে বসার ঘরে ঢুকে সব থেকে আগে দিয়ার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে ঝিনুক। তারপরে রিশুর মায়ের দিকে অপরাধীর মতন তাকিয়ে থাকে।
আম্বালিকা ভুরু কুঁচকে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোকে অমন কেন দেখাচ্ছে? ফ্লাইটে ঘুমাসনি?”
মামনির গলা পেয়ে, মামনিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ঝিনুক। কাঁধের ওপরে মাথা গুঁজে চুপ করে থাকে। আম্বালিকা নরম হাত ওর মাথার ওপরে বুলিয়ে শান্ত করে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রে, মা?”
“মা” ডাক ঝিনুকের কানে যেতেই ওর বুকের ভেতরে আটকে থাকা বন্যা দুই চোখের বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে পরে। ধিরে ধিরে ঝিনুকের পিঠ ফুলে ওঠে। আম্বালিকা টের পায় ওর কাঁধ ঝিনুকের চোখের জলে ভিজতে শুরু করেছে। দিয়াকে প্রশ্ন করাতে কোন সঠিক উত্তর পায় না। আম্বালিকার বুঝতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হয়না যে আসলে দিয়া অথবা ঝিলিকের কিছুই হয়নি, যা হয়েছে এই দুইজনের মধ্যেই কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু এই একটু আগেই রিশুকে ফোন করেছিল, কিছুই তো বলল না ছেলেটা। ওইদিকে দিয়াও কোন কথা বলছে না।
অনেকক্ষণ পরে মামনির কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে ধরা গলায় মৃদু হেসে বলে, “তোমায় অনেকদিন দেখিনি তাই।”
আম্বালিকা বড় বৌমার থুঁতনি ধরে আদর করে বলে, “এই তো এসে গেছিস। তাই বলে কাঁদতে আছে নাকি রে বোকা মেয়ে।”
এতক্ষন পর ঝিনুক যেন ধড়ে প্রান ফিরে পেল। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মৃদু হেসে বলে, “খুব খিধে পেয়েছে, মামনি।”
আম্বালিকার সাথে সাথে দিয়াও হেসে ফেলে ঝিনুকের কথা শুনে। আম্বালিকা ওকে জিজ্ঞেস করে, “গলদা চিংড়ির মালাইকারি খাবি?”
বাচ্চা মেয়ের মতন মাথা দোলায় ঝিনুক, “তুমি যা দেবে তাই খাবো।”
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আচ্ছা যা, স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি সন্তোষকে বাজার পাঠিয়ে এক কিলো চিংড়ি আনাই।”
রিশুর ঘরের মধ্যে ঢুকে বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক। বুকের ব্যাথাটা অনেক কমে গেছে। বাথরুমে ঢুকতে যাবে তখন নিজের ভীষণ হাসি পায়, রাগের মাথায় হাতের কাছে যা পেয়েছিল তাই ল্যাপটপের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। বেশ কয়েকটা ব্রা পান্টি টুথব্রাশ চিরুনি আর ছোট একটা সিঁদুরের কৌটো, সেটা শেষ মুহূর্তে আনতে ভোলেনি। আলমারি খুলে রিশুর একটা শার্ট আর একটা পায়জামা বার করে। শার্টটা বিশাল বড়, ওর শরীরের অধিকাংশ রিশুর শার্টেই ঢেকে যাবে কিন্তু শুধু মাত্র শার্ট পরে তো আর মামনির সামনে পাপার সামনে যাওয়া যায় না। নিজের বাড়ি হলে আলাদা কথা, সেখানে কি কেউ ওকে দেখতে যেত নাকি? দিল্লীতে দুপুরে স্নানের পরে একটা তোয়ালে গায়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়তে পারত। দিয়াকে ডেকে ওর একটা পায়জামা চাইতেই দিয়া হেসে ফেলে।
দিয়া ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সত্যি কিছুই আনোনি?”
ঝিনুক মাথা নাড়ায়, “না”।
দিয়ার কানে ভেসে আসে মায়ের গলা, ফোনে নিশ্চয় দাদাভাইয়ের সাথেই কথা বলছে মা। “হুম… এই তো ঢুকলও একটু আগেই… তুই কি ওকে বকাবকি করেছিস নাকি?… কেন?… (একটু হাসির) আচ্ছা বাবা ওকে বকাবকি করব না… রোজি এসেছে?… তুই খেয়েছিস কিছু?… হ্যাঁ, গলদা চিংড়ির মালাইকারি খাবে বলল তাই সন্তোষকে বাজারে পাঠিয়েছি… তোর তো গলা বসে গেছে দেখছি… (একটু হাসির আওয়াজ)… হ্যাঁরে বাবা তুই তো বড় সার্জেন, এখন আর মায়ের কথা কেন শুনবি… আচ্ছা বাবা গারগেল করিস… প্যাকিং হয়ে গেছে?… আচ্ছা, ভালো তো… ”
বাড়ির পরিবেশ সরল হয়ে গেছে দেখে দিয়া চেঁচিয়ে ওর মাকে বলে, “মা, তোমার বৌমা জামা কাপড় না নিয়েই চলে এসেছে।”
কথাটা ওর মায়ের কানে যায়নি কারণ তখন ওর মা ওর দাদাভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল। ঝিনুক আদর করে দিয়ার কান টেনে দেয়। দিয়া ওর একটা জোড়া পাজামা আর টপ ঝিনুককে পড়তে দেয়। ঝিনুক সেই নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। সেই প্রথম দিনেই এসে দেখেছিল, বাথরুমটা অনেক বড় ওদের শোয়ার ঘরের মতন। গিজার চালিয়ে গরম জল করে বাথটাবে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষন। বাড়ির পরিবেশ হয়ত সরল হয়ে আসবে কিন্তু যার বুকে শক্তিশেল বিঁধেছে সে কি আর ওকে কাছে ডাকবে? স্নান সেরে বেড়িয়ে আসে ঝিনুক। বিয়ের পরে কয়েক ঘন্টার জন্য এই বাড়িতে ছিল, বেশির ভাগ সময় ওর রিশুর ঘরের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল। বাড়িটা সেই ভাবে সেদিন দেখা হয়নি। বিশাল বসার ঘরের এক পাশে একটা দেয়াল জুড়ে আলমারিতে প্রচুর ছবি। সবার এখানে আলাদা আলাদা করে ঘর আর ঘর গুলো বিশাল। অনেক দিনের পুরানো বাড়ি হলেও আভিজাত্যের ছোঁয়া দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে আঁকা। মাঝে মাঝে অবাক লাগে ঝিনুকের, এত বড় বাড়ির ছেলে রিশু কিন্তু কত অনায়াসে দিল্লীতে দুই কামরার একটা ছোট ফ্লাটে এত বছর ধরে রয়ে গেল। সারাটা দিন এই ভাবেই কেটে যায় ওর, দিয়া দীপের সাথে গল্প করে, মামনি পাপার সাথে গল্প করে। ড্রাইভার পাঠিয়ে বাড়ি থেকে নিজের পুরানো জামা কাপড় আনিয়ে নেয়। কিন্তু সারাদিনে যার গলার আওয়াজ শোনার জন্য ভীষণ ভাবেই অপেক্ষা করেছিল, তার ফোন সেই নামে আর বেজে ওঠে না। রাতে শোয়ার সময়ে বিশাল ঘরের মধ্যের বিশাল বিছানার ওপরে ভীষণ ভাবেই একা মনে হয় নিজেকে। প্রথম রাতের কথা ভীষণ ভাবেই মনে পরে যায়, বিছানার পাশে রাখা সোফাটার দিকে শুয়ে শুয়েই অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। সেই রাতে এই সোফায় বসে কাটিয়ে দিয়েছিল রিশু।
রিশু সারাদিন ওর ল্যাপটপ খুলে পড়াশুনা করেই কাটিয়ে দেয়। মাঝে একবার মায়ের সাথে বোনের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল কিন্তু ঝিনুকের সাথে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি ওর। রাতে একা একা খেতে বসে ভীষণ ভাবেই একা লাগে। বিয়ের আগে একাই খেত কিন্তু এই কয়দিনের মধ্যে ওর জীবন অনেক বদলে গিয়েছিল। রাতে শুতে এসে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে।
পরেরদিন সোমবার, যথারীতি সকাল সকাল হসপিটাল বেড়িয়ে যায়। হেলমেট পরে বাইকে স্টার্ট দিয়ে আপনার হতেই ওর ডান হাত উপরের দিকে উঠে যায়, দুই তলার নিজের ফ্লাটের বারান্দার দিকে দেখে হাত নাড়ায়। না ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই ওর জন্য, প্রচন্ড খালি ওই জায়গাটা। মাথা ঝাকায় রিশু, হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল। সারাদিন ওপিডিতে ভীষণ ব্যাস্ত।
ওপিডি শেষে ফাইল আর রিপোর্ট বানাতে ব্যাস্ত ছিল রিশু। এমন সময়ে রিতিকার ফোন আসে ওর কাছে, “কি করছ? ডিউটি শেষ হল?”
প্রখর গ্রিস্মের তাপে মানুষ ছায়া খোঁজে তাই মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ডিউটি শেষ। কাল বেড়িয়ে যাবো তাই আমার পেসেন্টের রিপোর্ট গুলো বানিয়ে দিচ্ছি। তোমার কি খবর?”
রিতিকা মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “চলছে এই আর কি। তুমি কখন বের হবে?”
জিজ্ঞেস করে রিশু, “কেন কিছু কাজ ছিল নাকি?”
রিতিকা উত্তর দেয়, “না না, শুধু কাজ থাকলেই কি তোমাকে ফোন করা যেতে পারে?”
হেসে ফেলে রিশু, “না না, এমনিতেও ফোন করতে পারো।”
রিতিকা জিজ্ঞেস করে, “ডিনার?”
একটু ভেবে রিশু উত্তর দেয়, “বাড়িতেই।”
রিতিকা জিজ্ঞেস করে, “রান্না আছে কি?”
মাথা নাড়ায় রিশু, “না মনে হয়। কিছু একটা বানিয়ে নেবো।”
রিতিকা ওকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কিছু নিয়ে আসব নাকি?”
একটু ভেবে উত্তর দেয় রিশু, “তুমি বাড়িতে আসবে?”
রিতিকা উত্তর দেয়, “অসুবিধে আছে নাকি? তাহলে থাক।”
মাথা নাড়ায় রিশু, “না না, তোমার অসুবিধে না থাকলে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
রিতিকা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “না থাক, বাড়ি নয়। তোমাদের বাড়ির পাশে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে সেখানে।”
রিশু উত্তর দেয়, “ওকে, এক ঘন্টার মধ্যে।”
মুচকি হাসে রিতিকা, “শিওর ডিয়ার।”
শেষের সম্বোধন শুনে রিশু হেসে ফেলে। নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন, ও জানত যে সন্ধ্যের পরে বাড়ির পাশের সেই রেস্তোরাঁতে জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। রেস্তোরাঁতে ফোন করে দুই জনের জন্য একটা টেবিল রিসার্ভ করে নেয়। রেস্তোরাঁর মালিক আবার ওদের ব্লকের বাসিন্দা, বাঙালি, তাই জায়গার জন্য কোন অসুবিধে হয়নি। যথারীতি কাজ সেরে বেড়িয়ে পরে রিশু। সারাদিনে দুই বার বাড়িতে ফোন করেছে ঠিকই কিন্তু তাকে আর ফোন করেনি। ওর মনে একটাই প্রশ্ন, এখন ঝিনুক কেন ওর বাড়িতে? নিজের বাড়িতে কেন ফিরে যায়নি? সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ রেস্তোরাঁতে পৌঁছে যায় রিশু। অনেক ভিড় কিন্তু যেহেতু ওর টেবিল রিসার্ভ করা ছিল তাই জায়গা পেতে অসুবিধে হল না। রিতিকা তখন এসে পৌঁছায়নি। একটা মকটেল নিয়ে রিতিকার অপেক্ষা করে আর হাতে ফোন নিয়ে আবার নড়াচড়া শুরু করে দেয়। কেমন আছো? হটাত করেই আপন মনে জিজ্ঞেস করে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ঝিনুকের মিষ্টি হাসি হাসি মুখটা। ছবিটা শালিনী তুলে দিয়েছিল সেদিন, যেদিন ঝিনুক শাড়ি পরেছিল আর সবাই ডিনারে গিয়েছিল।
একটা নরম হাতের ছোঁয়া কাঁধে এসে পরে, “হাই…”
মাথা উঠিয়ে দেখে, রিতিকা। মৃদু হেসে উত্তর দেয় রিশু, “হাই।”
মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে রিতিকা, “দেরি হয়ে গেল নাকি?”
দুই পাটি মুক্তো সাজানো দাঁতের সারি মেরুন রঙের নরম ঠোঁটের মধ্যে থেকে ঝিলিক মারে। রিতিকার সাথে ঝিনুকের কেন রেশারেশি ছিল সেটা অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না রিশুর। রিতিকা ভীষণ সুন্দরী দেখতে। পরনে একটা কালো জিন্স, গায়ে গলা উঁচু ফ্যাকাশে সাদা রঙের সোয়েটার, একটা মেরুন রঙের লম্বা ওভারকোট, বেল্ট বাঁধা না থাকার ফলে সামনের দিক খোলা। সাদা রঙের সোয়েটার রিতিকা পীনোন্নত নিটোল বক্ষ যুগল বাঁধনে বাঁধতে অক্ষম তাই ভীষণ ভাবে সামনের দিকে উঁচিয়ে। চেহারায় যৎসামান্য প্রসাধনী হয়ত অফিস ছিল তাই বিশেষ সাজেনি তাও চোখের কোনে কাজল, চোখের পাতার ওপরে হাল্কা মেরুন রঙ করা। হাতের নখ গুলো বেশ লম্বা। কোমল কমলালেবুর মতন ঠোঁট জোড়া ওভারকোটের রঙের সাথে মিলিয়ে মেরুন রঙে রঞ্জিত। মাথায় বেশ লম্বা চুল তবে ঝিনুকের মতন রঙ করা নয়, আষাঢ়ের মেঘের মতন ঘন কালো। কাঁধের ব্যাগ আর হাতে ফাইল টেবিলের ওপরে রেখে ওর বিপরিত দিকের চেয়ারে বসে পরে রিতিকা।
রিশু উত্তর দেয়, “না দেরি কিসের। কিছুর তাড়া নেই তাই এখন হাতে অনেক সময়।” একটু থেমে ওকে বলে, “থারটি ফার্স্টের জন্য সরি।”
রিতিকা ওর হাতের ওপরে নরম হাতের ছোঁয়ার প্রলেপ লাগিয়ে মৃদু হেসে বলে, “ধ্যাত, ওর জন্য সরি বলতে নেই। মাঝে মাঝে হয়ে যায়।” হাতে মেনু কার্ড নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি খাবে বলো।”
হেসে ফেলে রিশু, “তুমি খাওয়াচ্ছ নাকি?”
রিতিকা মুচকি হাসি দেয়, “না না, হাফ হাফ, আমারটা তুমি পে করবে, তোমারটা আমি পে করব।” বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।
রিশুও হেসে ফেলে ওর কথা শুনে। চিকেন মোমো দিয়েই শুরু হয় ওদের খাবার।
রিশুর হসপিটালের গল্প, রিতিকার অফিসের নানান গল্প করতে করতে এক সময়ে রিতিকা ওকে জিজ্ঞেস করে, “ঝিনুক ওর বাড়িতে না… কি…” বাকিটা উহ্য রেখে দেয় রিতিকা।
রিশু খাওয়া থামিয়ে রিতিকার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয়, “না, আমার বাড়িতে।”
মাথা দুলিয়ে মুচকি হাসে রিতিকা, “হুম বুঝতেই পারছি ভীষণ মিস করছ ওকে, তাই না।” উত্তর জানা নেই রিশুর তাই চুপ করে থাকে। রিতিকা ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি হটাত করেই বিয়ে করতে কেন গেলে?”
প্রশ্নটা শুনে ঘাবড়ে যায় রিশু, “মানে?”
খাওয়া থামিয়ে পালটা প্রশ্ন করে রিতিকা, “মানে, এক রাতে তুমি সোজা কোলকাতা গেলে। একেবারে অচেনা অজানা একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। কেন? কি জন্য?” রিশু রিতিকার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। বুঝতে চেষ্টা করে কি সঠিক বলতে চাইছে রিতিকা। রিতিকা মুচকি হেসে বলে, “ঝিনুক ভীষণ সুন্দরী আর এম বি এ করেছে তাই বিয়ে করে নিলে?”
ম্লান হাসে রিশু, কথাটা অতটা সত্যি নয়। কোন সন্দেহ নেই, ঝিনুক ভীষণ সুন্দরী তবে। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় রিশু, “না তা ঠিক নয়।”
পালটা প্রশ্ন কর রিতিকা, “তাহলে?”
একটু ভেবে রিশু উত্তর দেয়, “ওর মা, আমার মায়ের ভীষণ ভালো বান্ধবী। আর মায়ের পছন্দ ছিল তাই শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেই নিলাম।”
কাঁটা চামচ দিয়ে শেষ মোমোটা চেপে ধরে মুখের কাছে এনে রিশুকে বলে, “তাহলে মায়ের পছন্দের জন্য বিয়ে করেছ?”
একটু ভাবুক মৃদু হাসি দেয় রিশু, “হ্যাঁ, তা বলতে পারো।”
মোমোটা শেষ পর্যন্ত মুখের মধ্যে দিতে গিয়েও দিল না রিতিকা। রিশুর চোখে চোখ রেখে ভুরু কুঁচকে একটু খানি তাকানোর পরে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে যখন ওকে এটা বললে যে, তোমায় আজ থেকে ফ্রিডম দিলাম তখন তোমার মায়ের কথা মনে পরে নি? মনে হয়নি বাড়িতে আন্টি জানতে পারলে কি ভাববে?”
কথাটা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রিশুর, “কি বলতে চাইছ তুমি?”
মৃদু হাসি দেয় রিতিকা, “না না, আমি কিছু ভাঙতে আসিনি। কিছু গড়তেও আসিনি।”
হসিটা ভালো লাগে না রিশুর তাই চাপা স্বরে বলে, “হেঁয়ালি ছেড়ে সোজাসুজি বল কি বলতে চাও।”
দুই জনার পাতেই শেষ মোমো পরে থাকে। খাওয়া থামিয়ে দেয় রিতিকা, তারপরে বলতে শুরু করে, “ঝিনুক নিশ্চয় তোমাকে বলেছে আমাদের কলেজের কথা।”
মাথা নাড়ায় রিশু, “না।” রিশু সম্পূর্ণ না জানলেও এটা জানে যে কলেজে পড়াকালীন রিতিকার আর ঝিনুকের সম্পর্ক সুহৃদ ছিল না।
রিতিকা বলে, “ওহ আচ্ছা। কলেজে আমাদের মধ্যে বিশেষ ভালো সম্পর্ক ছিল না, জানো। মেয়েলি ব্যাপার স্যাপার। আমি আমার ব্যাচের টপ টেনের মধ্যে ছিলাম, সেদিক থেকে ঝিনুক ব্রিলিয়ান্ট হলেও কেন জানি না ঠিক ভাবে র্যাঙ্ক করতে পারত না।” মুচকি হেসে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে নাকের অপর থেকে চুল সরিয়ে মরালী গর্দান আর ডান কানের ফর্সা লতি উন্মুক্ত করে লাজুক হেসে বলে, “আর একটু এই মেয়েলি ব্যাপারে আমাদের মধ্যে রেশারেশি ছিল। কে বেশি সুন্দরী।” কথাটা শুনে মৃদু হাসি দেয় রিশু। রিতিকা প্রশ্ন করে, “পার্থের ব্যাপার আশা করি জানো?”
নামটা শুনে শরীর জ্বলে ওঠে ওর, মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ। বেশ ভালো ভাবেই।”
রিতিকা মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, তুমি কিছুই জানো না। আমি বলছি তোমাকে।” রিশু ভেবে পায়না রিতিকা আসলে কি বলতে চাইছে। রিতিকা বলতে শুরু করে, “ফার্স্ট সেমেস্টারের শেষের দিকে ওদের মধ্যে প্রেম হয়, প্রেম না বলে বলো এই ফ্লারটিং, ভালো লাগা, ওই বয়সে যা হয়ে থাকে আর কি। জানো, মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খোঁজ বেশি রাখে। আর মেয়েদের জন্য পরনিন্দা পরচর্চা, গল্প করার জন্য ভীষণ ভালো উপাদান। তাই ভীষণ ভাবেই আমিও ওর খবর রাখতাম। পার্থের সাথে কবে কোথায় যাচ্ছে, কোন ডিস্কোথেকে, কোন পাবে, কবে কোথায় পার্টি করছে সব। তার কারণ ছিল, বলতে পারো আমাদের রেশারেশি। মাঝে মাঝেই কলেজে এসে গল্প করত আজকে এইখানে পার্থের সাথে গেছে, কালকে ওর সাথে ওইখানে যাবে। আরো অনেক কিছু। আমিও সেইদিনে ডিস্কোতে যেতাম। কলেজে আমাকেও তো শুনাতে হবে।” বলেই মুচকি হাসি দেয়। “কখন আমি একটা হাই হিল কিনলাম তার পরের দিনে ওর পায়েও দেখি একটা দামী হাই হিল। কখন ও পার্টিতে যাওয়ার জন্য একটা বডিকন ড্রেস কিনেছে, আমিও ঠিক সে রকম না হলেও একটু ভালো কিম্বা একটু মন্দ একটা বডিকন পার্টি ড্রেস কিনে ফেলতাম।”
একটু থেমে চোখ টিপে রিতিকা মুচকি হাসি হেসে বলে, “আমার ড্রেস গুলো বেশির ভাগ আমার তখনের বয়ফ্রেন্ড, হরিশের পকেট মেরে কেনা। সেখানে ঝিনুক নিজের পয়সায় ড্রেস কিনত। ওর বাবা খুব বড়লোক। রানীগঞ্জে কোলিয়ারিতে ম্যানেজার ছিল। আর কোলিয়ারির ম্যানেজার মানে হাতে প্রচুর টাকা। ঝিনুক কলেজে আসত নিজের গাড়িতে, রোজ সকালে ড্রাইভার গাড়ি করে ওকে কলেজে ছেড়ে যেত। তবে কলেজের পরে পার্থের সাথে বেড়িয়ে যেত। কতবার দেখেছি, পার্থের সাথে বাইকের পেছনে বসে সিগারেট টানছে। ঝিনুক একটু পয়সার দেমাক একটু দেখাত সবাইকে। প্রত্যেক সপ্তাহে পার্লার যাওয়া চাই। চুলে রঙ করিয়েছে, হাইলাইটিং করিয়েছে, এইসব গল্প শুনাত সবাইকে। আমি সেটা পারতাম না, কারণ আমি জামসেদপুর থেকে কোলকাতা এসে পেয়িং গেস্ট থাকতাম। বাবা যা টাকা পাঠাত তাতেই আমাকে চালাতে হত, আমার খাওয়া দাওয়া, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, সব কিছু। মাঝে মাঝে অনলাইন কিছু বইয়ের প্রুফ রিডিং করে দিতাম, কখন কোন মেডিকেল ডেটা আপলোড করে দিতাম, তাতে আমার হাতে মোটামুটি কিছু চলে আসত।”
একটু থেমে এক চুমুক জল খায় রিতিকা। তারপরে আবার বলতে শুরু করে, “কোলকাতায় কেন এমন বড় বড় শহরে প্রচুর এমন মেয়ে আছে যাদের বাড়ির দেওয়া টাকায় চলে না, তখন তারা অনেক কিছু করেই টাকা কামিয়ে নেয়। আমাদের ব্যাচের মধ্যে তিন চারজন এমন ছিল। তাদের হাতে কাঁচা টাকা, এক রাতের মধ্যে পনেরো থেকে কুড়ি। অপর্ণা বলে আসানসোলের একটা মেয়ে ছিল। কোন মাসে ওর হাতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাস হাজার টাকা চলে আসত। তার সাথে ঝিনুকের খুব ভাব ছিল। অপর্ণা যেটা করতে পারত, সেটা আমি পারিনি।” একটু থেমে যায় রিতিকা। রিশু খাওয়া ভুলে ওর দিকে চেয়ে থাকে এক ভাবে। “এই অপর্ণা পার্থের সাথে ঝিনুকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।” বলে থেমে যায়। কথাটা শুনে কান গরম হয়ে যায় রিশুর।
প্লেটের শেষ মোমোটা মুখের মধ্যে পুরে রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “এরপর কি কিছু আর খাবে?”
খিধে ছিল কিন্তু রিতিকার কথা শুনে খাওয়া ভুলে গেছে রিশু। মাথা নাড়ায়, “না আর কিছু না।”
একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি দেয় রিতিকা, “আমার কিন্তু এখন খিধে আছে ডক্টর সান্যাল।”
হেসে ফেলে রিশু, “কি অর্ডার করতে চাও?”
চোখ টিপে ওকে বলে, “তুমি পে করছ?”
হেসে ফেলে রিশু, “নিশ্চয়, সেটাই আমাদের শর্তে ছিল তাই না।” বলেই দুইজনেই হেসে ফেলে।
রিতিকা দুই প্লেট চিকেন নুডুলস অর্ডার দিয়ে আবার বলতে শুরু করে, “এই অপর্ণার ব্যাপারটা আমাদের ব্যাচের অনেকেই জানত না। আমি জেনেছিলাম কারণ একবার হরিশের সাথে একটা রেস্তোরাঁতে ডিনার করতে গিয়ে আচমকা দেখা হয়ে যায়।” একটু থেমে কড় গুনে বলে, “ওহ সরি, একবার নয় তিনবার দেখা হয়। আলাদা আলাদা জায়গায়, আলাদা আলাদা মানুষের সাথে। যেমন তার ড্রেস ছিল তেমন ছিল তার সেই মানুষের সাথে ব্যাবহার, একদম গায়ে ঢলে যাওয়া আর কি।” চোখ টিপে বলে, “মেয়েলি মন, খোঁজ লাগালাম, তারপরে জানতে পারলাম যে অপর্ণার হাতে কি করে এত টাকা আসে। যাই হোক সেটা অন্য ব্যাপার। ব্যাপার যেটা সেটা হচ্ছে এই পার্থ আর ঝিনুক।”
কথাটা কানে যেতেই রিশুর চোয়াল কঠিন হয়ে যায়। এই পার্থের সাথে একবার শেষ দেখা করতেই হবে।
রিতিকা না থেমেই বলে, “আমি এটা বলতে চাই না, যে অপর্ণার সাথে মিশে ঝিনুক সেই পথে গেছে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি যেটা করতে পারিনি সেটা ঝিনুক ও পারেনি। কারণ একটাই, ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যেত ঝিনুক অন্ধের মতন বিশ্বাস করত পার্থকে। পার্থের আসল পরিচয় ঝিনুক জানত না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অপর্ণার আসল উদ্দেশ্য অথবা অপর্ণার আসল চরিত্র ঝিনুক জানত না। পার্থ শুধু মাত্র ঝিনুককে খেলায় নি, আরো অনেক মেয়েকে খেলিয়েছে। আর আমি, যেহেতু তখন আমাদের মধ্যে একটা রেশারেশি আমরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী তাই আমিও শুধু মাত্র মজা দেখতাম। জানতাম একদিন ঝিনুক হোঁচট খাবে তখন আর ওঠার শক্তি থাকবে না। তখন আমি প্রান খুলে হাসব।” শেষের কথাটা বলতে বলতে রিতিকার চেহারায় একটু কালো মেঘের ছায়া দেখা দেয়। একটু থেমে মুচকি হেসে রিশুকে বলে, “আমি জানি তোমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে এই সব কথা শুনে।”
পার্থের ব্যাপারে এত কথা শোনার পরে সত্যি রিশুর শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দেয়, “একদম হচ্ছে। হাতের সামনে পেলে …”
হেসে ফেলে রিতিকা, “হাতের সামনে পেলে কি করবে, ডক্টর? মেরে ফেলবে?” হটাত করে এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না রিশু। রিতিকা বুক ভরে এক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “ঝিনুককে ধোঁকা দেওয়ার উচিত শিক্ষা ভগবান পার্থকে দিয়ে দিয়েছে। আমি গতকাল সকালেই আমার কোলকাতার এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম পার্থের কথা। সে খবরা খবর নিয়ে আমাকে বলল, তোমাদের বিয়ের এক সপ্তাহ পরে পার্থের একটা এক্সিডেন্টে হয়। তারপর থেকে পার্থ ব্রেন ডেড অথবা বলতে পারো কোমায় চলে গেছে। শরীরের প্রচুর হাড়গোড় নাকি ভেঙ্গে গেছে। ওর নাকি অনেক পাওনাদার ছিল, কারুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে একটা ব্যাবসা করবে বলেছিল। কিন্তু পার্থের ছিল টাকার লোভ আর মদের নেশা মেয়ের নেশা। ব্যাবসা কি করবে, এদের পেছনেই টাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। ঠিক সময়ে পাওনাদারেরা টাকা পায়নি। তাই ওরা নাকি এক্সিডেন্ট করিয়েছে। মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। ওর গাড়িটা নাকি ভেঙ্গে এমন দুমড়ে গেছিল যে গাড়ির দরজা কেটে পার্থকে বার করতে হয়েছিল।” একটানা এত কথা বলার পরে রিতিকা একটু থেমে একটু জল খায়। তারপরে বলে, “তুমি ডাক্তার, অনেক পড়াশুনা করেছ, বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছ, তুমি হয়ত ভগবান বিশ্বাস কর না। তবে কি জানো, একটা শক্তি কোথাও আছে। পাপের শাস্তি হয়।” বলে বড় একটা শ্বাস ছাড়ে রিতিকা।
যে রাগটা পার্থের ওপরে হয়েছিল রিশুর সেটা মিলিয়ে যায়। রিতিকাকে প্রশ্ন করে রিশু, “তুমি কি এই খবর ঝিনুককে দিয়েছ নাকি?”
হাসিতে ফেটে পরে রিতিকা, “তুমি পাগল নাকি? আমি হয়ত ওর শত্রু হতে পারি কিন্তু মরার ওপরে খাঁড়ার ঘা আমি মারি না।”
হেসে ফেলে রিশু, “এখন ওর শত্রু?”
মুচকি হেসে ভুরু নাচায় রিতিকা, “একটু একটু…”
হাসির তাৎপর্য অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না রিশুর তাই সেই সাথে ও হেসে ফেলে, “শালী সাহেবা…”
রিতিকাও সেই হাসিতে যোগদান দিয়ে বলে, “ডক্টর সাব, আধি ঘরওয়ালি হু ম্যায়।”
নুডুলস এসে যাওয়াতে খাওয়া শুরু করে রিশু আর রিতিকা। সেই সাথে রিতিকা বলতে শুরু করে, “তুমি জানো ঝিনুক দারুন নাচতে পারে?”
মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ এটা ও আমাকে বলেছে।”
মৃদু হাসে রিতিকা, “আমাদের ফাইনাল ইয়ারের এনুয়াল ফাঙ্কশানে ঝিনুক একটা সোলো ড্যান্স করেছিল। দিল তো পাগল হ্যায় এর ফেমাস গান। মুঝকো হুই না খবর, চোরি চোরি ছুপ ছুপ কর… করিশ্মা কাপুরের নাচ। ঝিনুকের সোলো পারফর্মেন্স। মারাত্মক নেচেছিল ঝিনুক, উফফফ পাগল যাকে বলে। স্টেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ওডিটোরিয়াম হাততালিতে ফেটে পড়েছিল। ছেলেরা জামা ছিঁড়ে ফেলেছিল সেই নাচ দেখে। সিনেমা করার সময়ে সেই নাচে করিশ্মা কাপুর কতবার রিটেক করেছিল জানি না। কিন্তু ঝিনুক এক বারে, কোন রিটেক ছাড়া সেই দুর্ধর্ষ নাচ নেচেছিল। আমি পরে কৃষ্ণা, আমাদের একটা কমন ফ্রেন্ড, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঝিনুক কোথায় নাচ শেখে রে? ওর উত্তর শুনে আমি থ হয়ে গেছিলাম। ঝিনুক কোথাও নাচ শেখেনি। কিন্তু ঝিনুক নাচের জন্য পাগল। বাড়িতে টিভিতে দেখে দেখে সেই নাচ প্রাকটিস করেছিল।”
এতক্ষন শোনার পরে রিশু মুখ খোলে, “হ্যাঁ এই ব্যাপারটা আমাকে বলেছে। ওর বাড়ি থেকে ওকে নাচ শিখতে দেওয়া হয়নি তাই তারপর থেকে এক প্রকার জেদি হয়ে যায়।”
মাথা দোলায় রিতিকা, “হ্যাঁ সেটাই। বাড়ির সবাইকে ওর শত্রু বলেই মনে হত, তাই বাইরে যা পায় তাতেই নিজের শান্তি খুঁজে বেড়ায়। তাই বলে এটা বলতে চাই না যে ওর বাবা মা ওকে ভালোবাসে না। নিশ্চয় ভালোবাসে। তবে কি জানো, কখন কোন কথা গায়ে লেগে যায় আর তার কি যে পরনিত ঘটতে পারে সেটা কেউ জানে না।” খাওয়া থামিয়ে দেয় রিতিকা। “ওর মধ্যে জানো, কচি ভাবটা এখন রয়ে গেছে। তোমার সাথে মার্কেট গিয়ে নিজের হাতে তোমাকে ফুচকা খাইয়েছে নাকি?”
কথাটা শুনে হেসে ফেলে রিশু, “এটাও বলেছে তোমাকে?”
মৃদু হাসে রিতিকা, “হ্যাঁ আমাকে বলেছে। কথাটা বলার সময়ে ওর চেহারার ভাবটা তোমার একবার দেখা উচিত ছিল, জানো। একটা বাচ্চা মেয়ে, যখন তার সাধের ভাঙা পুতুলকে আবার কেউ জোড়া লাগিয়ে তার হাতে তুলে দেয়, তখন সেই বাচ্চা মেয়ের ঠোঁটে যে হাসি ফুটে ওঠে, তেমন ভাবে হাসি ফুটে উঠেছিল ওর ঠোঁটে।”
সব তো বুঝলো কিন্তু এই মেয়ে কি সত্যি ওর পরিবারকে ভালবাসতে পারবে? বড় প্রশ্ন সেখানেই। রিশু ম্লান হেসে মাথা দোলায়, “হুম।”
রিতিকা একটু থেমে রিশুর চোখে চোখ রেখে বলে, “ঝিনুক বড্ড নরম আর ইমোশানাল মেয়ে, রিশু।”
শেষের কথাটা বলতে বলতে গলা ধরে আসে রিতিকার। রিশুর চোখের দিকে অনেকক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকে রিতিকা।
রিতিকা আলতো মাথা নাড়িয়ে ম্লান হেসে বলে, “মেয়ে মানুষ জলের মতন রিশু, তাই তো নদী স্ত্রীলিঙ্গ। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের মতন নিজেকে ঢেলে সাজিয়ে নেবে।”
রিশু শেষ পর্যন্ত রিতিকাকে প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছ তাহলে? তুমি ওইখানে ছিলে। সব কিছুই জানো সব কিছুই দেখেছ শুনেছ। তারপরেও?” শক্ত চোয়াল, শীতল চাহনি। একটু চুপ করে থেকে রিতিকাকে বলে, “দুধ খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো হাই প্রোটিন থাকে। লেবু খাওয়াও শরীরের পক্ষে ভালো, ভিটামিন সি থাকে। তাই বলে দুধের সাথে আমরা লেবু খাই না। আলাদা আলাদা করেই খাই।”
কথাটা শুনে ম্লান হাসে রিতিকা, “আমার চেয়ে তুমি অনেক অনেক বড়। অনেক বেশি শিক্ষিত। এমসের মতন একটা বড় হসপিটালের অরথোপেডিক সার্জেন তুমি। এর বেশি আর আমি তোমাকে কিছুই বলতে চাই না।”
বাকি খাওয়া চুপচাপ সেরে ফেলে দুইজনে। খাওয়া শেষে, রিতিকা রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “কাল কখন ফ্লাইট?”
রিশু উত্তর দেয়, “রাত একটায়।”
রিতিকা প্রশ্ন করে, “সুটকেস গুছানো হয়ে গেছে?”
রিশু বলে, “না গো অর্ধেক হয়েছে। আমি ঠিক ভাবে গুছাতে পারি না…” বলেই হেসে ফেলে।
রিতিকাও হেসে ফেলে, “যা বাবা। উলের মোজা কিনেছ?”
মাথা দোলায় রিশু, “না না ও সব লাগবে না।”
হেসে ফেলে রিতিকা, “লন্ডন যাচ্ছও, মাইনাসে টেম্পারেচার থাকবে। গ্লাভস আছে?”
রিশু মাথা দোলায়, “আছে। কিন্তু নেওয়া হয়নি।”
হেসে ফেলে রিতিকা, “তুমি না সত্যি কিছুই পারো না। চল, তোমার সুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছি।”
রিশু বাইকে উঠে বলে, “তোমার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে যে।”
বাইকের পেছনে উঠে রিশুর কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “আধি ঘরওয়ালি হু ম্যায়। সো কিছু তো খেয়াল রাখতেই হয়।”
হেসে ফেলে রিশু। রাত প্রায় ন’টা বাজে।
রেস্তোরাঁ থেকে বেড়িয়ে রিতিকা রিশুকে নিয়ে মার্কেটে যায়। তিন জোড়া উলের মোজা, একটা ছোট টুথপেস্ট আরো কিছু জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরে রিতিকা আর রিশু। আকাশটা একটু মেঘলা করে এসেছে। এই শীতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে রাতে অনেক ঠান্ডা পরবে। সারাটা রাস্তা, রিশুর পিঠ ঘেঁষে চুপ করে বসে থাকে রিতিকা। কারুর মুখে কোন কথা নেই। রিতিকার মাথায় হেলমেট ছিল না, তাই বাইক চালানর সময়ে মাঝে মাঝেই ওর মুখের ওপরে রিতিকার রেশমি চুলের পর্দা চলে আসে, সেই সাথে নাকে ভেসে আসে রিতিকার নধর লাস্যময়ী দেহপল্লবের মদির গন্ধ। বাড়ির সামনে বাইক থেকে নেমে রিতিকা ওর কাছ থেকে বাড়ির চাবি চেয়ে নেয়। রিতিকার হাতে বাড়ির চাবি ধরিয়ে দিয়ে বাইক পার্ক করে রিশু। বাইকটা পার্ক করার সময়ে ওর মনে হল অদুরে রাতের অন্ধকারে একটা স্কুটি দাঁড়িয়ে, স্কুটির ওপরে দুইজন বসে। অন্ধকারে তাদের ঠিক ভাবে দেখা গেল না। মাথা নাড়ায় রিশু, হয়ত ওর চোখের ভুল, হয়ত কোন প্রেমিক প্রেমিকা।
সিঁড়ির দিকে তাকাতেই রিশুর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। অর্ধেক সিঁড়ি উঠে, সিঁড়ির আধো আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে তীব্র আকর্ষণীয় এক সুন্দরী ললনা। কাজল কালো টানা টানা চোখের ভাষায় সম্মোহিত করে তোলে রিশুকে। মেরুন রঙের ঠোঁট জোড়া অল্প মেলে ধরে চাঁপার কলি কোমল আঙ্গুল ওর দিকে নাড়িয়ে ডাক দেয়।
রিশুর ব্যাথিত হৃদয়, সেই দৃশ্য দেখে মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলে, “চলো, দাঁড়িয়ে কেন?”
রিতিকা ওর দিকে ডান হাতের তর্জনী নাড়িয়ে কাছে ডেকে বলে, “আমি একা একা কি করে যাবো?”
রিশু হেসে ফেলে, “ইয়ার্কি মেরো না।”
খিলখিল করে হাসতে হাসতে রিশুর বাজুর ওপরে ঢলে পরে রিতিকা, “ইসসস, একটু ইয়ার্কিও মারা যাবে না।”
বাড়িতে ঢুকে, খাওয়ার টেবিলের ওপরে কিনে আনা জিনিস গুলো রেখে দেয় রিতিকা। রিশু শোয়ার ঘর দেখিয়ে দিতেই রিতিকা হেসে জানিয়ে দেয় যে ওর বাড়িতে এর আগেও দুইবার এসেছে। গায়ের অভারকোট খুলতে খুলতে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে রিতিকা। আলমারি খুলে ঝিনুকের জামা কাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাট পাট করে বেশ সুন্দর করে সাজানো ঝিনুকের জামা কাপড়। আলমারির দরজার একটা আংটাতে রিশুর একটা হাল্কা রঙ ওঠা কমলা রঙের শার্ট দেখতে পেল। সেটাই হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো রিতিকা। রিশুর দিকে দেখে ওর সুটকেস আর কি কি নেবে সেইগুলো বের করে রাখতে বলে বাথরুমে ঢুকে পরে। দিন দশেকের মতন থাকতে হবে বাইরে, তাই আলমারি খুলে বেশ কয়েকটা জামা আর প্যান্ট বার করে। মেডিকেল সেমিনার আর ওয়ার্কশপ, তাই হাল্কা রঙের শার্ট বার করে।
রুম হিটার চালিয়ে দেয় রিশু। নিজের জামা কাপড় নিয়ে বসার ঘরে এসে রিতিকার অপেক্ষা। বেশ কিছুক্ষন পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে রিতিকা। পরনে ওর শার্ট দেখে কিঞ্চিত আশ্চর্য হয়ে যায় রিশু। মসৃণ মরলি গর্দানে একটা পাতলা সোনার চেন। পরনে শুধু মাত্র রিশুর শার্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। শার্টটা রিতিকার নধর সুগোল নিটোল নিতম্ব জোড়া কোনমতে ঢাকতে সক্ষম। পাতলা কোমরের নিচে নিতম্ব জোড়া একটু বেশি করেই যেন ঠেলে বেড়িয়ে গেছে পেছনের দিকে। মাথায় ঢালাও কালো মেঘের মতন চুল। ওপরের বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা, ফর্সা মসৃণ গভীর উপরিবক্ষে আর গভীর স্তনের মাঝের খাঁজে আলো আঁধারের খেলা চলছে। কালো ব্রার কিছু অংশ উঁকি মারে বোতাম খোলা শার্টের ভেতর থেকে। নিটোল পীনোন্নত স্তন জোড়া ভীষণ ভাবে আঁটো রক্ত লাল রঙের ব্রার বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। শার্টের নিচ থেকে অনাবৃত মসৃণ সুগোল থামের মতন ঊরু জোড়া সরু হয়ে নেমে গেছে পাতলা গোড়ালিতে। ঝিনুকের মতন ওর পায়ের গোড়ালিতে রুপোর নুপুর বাঁধা নেই তবে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে একটা কালো সুতো বাঁধা। রিতিকা ঝিনুকের মতন অতটা ফর্সা না হলেও ওকে ফর্সা বলাই চলে। দুই নয়নে এক অজানা আকর্ষণ আর একটু লজ্জা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে রিতিকা। ঠোঁট জোড়ায় আর সেই মেরুন রঙ নেই, মুখ ধোয়ার ফলে গোলাপি আকর্ষণীয় ফোলা নরম অধর জুরে লোভনীয় লাজুক হাসি মাখা।
নিচের ঠোঁট কেটে রিশুর দিকে তাকাতে গিয়েও চোখ নামিয়ে বলে, “এই একদম ওইভাবে আমার দিকে তাকাবে না কিন্তু।”
রিতিকার মদির কন্ঠ শুনে বুকের বাম দিকে তুষের আগুন জ্বলে ওঠে রিশুর। মাথা নাড়িয়ে সেই আগুন নিভিয়ে মুচকি হেসে ওকে বলে, “তুমি আমার শার্ট পড়লে?”
রিতিকা তীব্র লাস্যময়ী দেহ পল্লবে রম্ভার মতন সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে, শোয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ওকে বলে, “তুমি যাও তো বাথরুমে।” বাম হাতে বুকের খোলা বোতাম চেপে ধরে ডান হাতে চপেটা ঘাতের ইশারা করে বলে, “না হলে কিন্তু…”
রিশু বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “বিছানায় আমার সব জিনিস রাখা আছে। আমি এই দুই মিনিটে স্নান সেরে এসে তোমায় হেল্প করছি।”
একটু আশ্চর্য হয়ে যায় রিতিকা, বড় বড় চোখ করে ওকে প্রশ্ন করে, “এই রাত দশটায় তুমি স্নান করবে?”
বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, হসপিটাল থেকে ফিরে আমাকে স্নানে যেতেই হয় না হলে ভালো লাগে না।”
রিশু ঢুকে পরে বাথরুমের মধ্যে। আয়নার সামনে আবার সেই দাঁড়িয়ে পরে। মুচকি হাসে নিজেকে দেখে। হ্যালো বস কি খবর?
প্রতিফলন উত্তর দেয়, চলছে এই আর কি।
রিশু প্রশ্ন করে, সত্যি কি দুধ আর লেবু মিলতে পারে?
প্রতিফলন উত্তর দেয়, না, একদম সম্ভব নয়। কিন্তু ঝিনুক যে তোমার বাড়িতে চলে গেছে?
ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষন আয়নায় তাকিয়ে তারপরে বলে, মুশকিল ব্যাপার আর সেটা একটা ভীষণ ভয়ের কারণ।
প্রশ্ন করে ওর প্রতিফলন, ভয় কেন ভয়?
রিশু উত্তর দেয়, জানি না তবে একটা অজানা আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু করছে।
চিন্তিত ওর প্রতিফলন, বটে। মাম্মাকে কি বলবে?
একটু ভাবে রিশু, এখন ভাবিনি। একটা ঘোরের মধ্যেই রয়েছি। লন্ডন থেকে ফিরে সিদ্ধান্ত নেব। তবে আমি শেষ বারের মতন বলছি…
হেসে ফেলে ওর প্রতিফলন, দুধে লেবুতে মিশতে পারে না। এই তো?
হেসে ফেলে রিশু, হ্যাঁ।
স্নান সেরে বাইরে এসে দেখে যে বিছানার ওপরে সুটকেস খুলে এক এক করে জিনিসপত্র গুছাতে ব্যাস্ত রিতিকা। সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার ফলে নিটোল ভারী নিতম্ব জোড়ার ওপর থেকে শার্ট সরে গেছে। পেছনের দিকে ভীষণ অসভ্যের মতন উঁচিয়ে দুই নিটোল অনাবৃত বর্তুল। ফর্সা মসৃণ ভারী নিতম্বের ত্বকের ওপরে ঘরের আলো পিছল খেয়ে পড়ছে। নিতম্বের খাঁজের মাঝে আটকা পরে থাকা ছোট লাল প্যান্টিটা হারিয়ে গেছে। সেই অনাবৃত সুগোল নিতম্ব দেখে রিশুর তলপেটের পেশিতে একটা টান অনুভব হয়। এই অনুভূতি অজানা নয় রিশুর। দেহের ধমনীতে ইতিমধ্যে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। গলা খ্যাঁকরে নিজের জানান দিতেই সজাগ হয়ে যায় রিতিকা। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিতম্বের ওপরে জামাটা টেনে ধরে নিজেকে রিশুর কামুক দৃষ্টি থেকে অসহায়ের মতন বাঁচাতে বৃথা প্রচেষ্টা করে। রিতিকার তীব্র লোভনীয় দেহবল্লরির শোভা দেখে রিশুর চোখে লাগে আগুন।
রিতিকা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার স্নান হল?”
মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ। তোমার গুছানো হল?”
রিতিকা বিছানার ওপরে সুটকেস দেখিয়ে ওকে বলে, “হ্যাঁ মোটামুটি, তুমি একবার দেখে নাও সব কিছু।”
সুটকেসের মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রিশু। সুচারু ভাবে রিতিকা ওর সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছে। সেদিন ঝিনুকও ঠিক এইভাবে অতি নিপুণ হাতে ওর সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, দুই লাস্যময়ী কমনীয় সুন্দরীর মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই। একজন একটু বেশি বালিকা সুলভ চরিত্রের অন্যজনে একটু পরিপক্ক।
রিতিকা আরো দুই পা পিছিয়ে রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “কাল ডিউটি আছে নাকি?”
বিছানার ওপরে খোলা সুটকেস বন্ধ করতে করতে মাথা দোলায় রিশু, “না, কাল অফ নিয়েছি।”
রিতিকা প্রশ্ন করে, “কখন বের হবে?”
রিশু উত্তর দেয়, “এই ধর সাতটা নাগাদ। ইমিগ্রেশানে সময় লেগে যাবে।”
বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে রিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “জানো তোমরা যেদিন দিল্লী পৌঁছালে, সেদিন আমি ফোন করেছিলাম?”
রিশুর মনে পরে যায়, হ্যাঁ সেদিন একজন কেউ ঝিনুকের বান্ধবী ফোন করেছিল বটে। রিশু ওকে বলে, “সেটা তুমি ছিলে?”
মাথা দোলায় রিতিকা, “হ্যাঁ, আমি ছিলাম।” একটু থেমে বলে, “জানো তখন আমার মধ্যে সেই কলেজের প্রতিদ্বন্দ্বী কাজ করছিল।” বলেই হেসে ফেলে রিতিকা।
রিশুও হেসে ফেলে, “বাপ রে, তাহলে তো বড় মুশকিল।”
রিতিকা কিছুক্ষন রিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবলে শেষ পর্যন্ত?”
মাথা নাড়ায় রিশু, “দেখো সত্যি বলছি এখন কোন কিছু ভাবছি না। আমার সেমিনার সব থেকে আগে তারপরে ফিরে এসে দেখা যাবে কি হবে।”
কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরে রিতিকা ওর দিকে এগিয়ে আসে। একদম ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে মুখ তুলে চেয়ে থাকে। রিতিকার পীনোন্নত নিটোল উদ্ধত স্তন জোড়ার উষ্ণতা জামা ছাপিয়ে রিশুর ছাতির ওপরে অগ্নিবর্ষণ করে। হাল্কা গোলাপি রসালো অধর জোড়া তিরতির করে কেঁপে ওঠে। দুই ভাসা ভাসা নয়ন যেন কিছু বলতে চায় রিশুকে। রিশুর মাথা নেমে আসে রিতিকার মুখের ওপরে। রিতিকার শ্বাস ফুলতে শুরু করে দেয়।
কাঁপা গলায় রিতিকা ওকে বলে, “রিশু, হাতের সোজা পিঠ দিয়ে যেমন আমরা লজ্জা পেলে আমাদের চোখ ঢাকি তেমন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছি।” রিশুর পরনের গেঞ্জি দুই হাতে খামচে ধরে রিতিকা, “হাত কিন্তু হাত থাকে, রিশু।”
রিশু গভীর ভাবেই রিতিকার দুই ভাসা ভাসা বাষ্পীভূত আঁখির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সে হাত হবে?”
হটাত করেই আকাশে গুড়গুড় চড়চড় ধ্বনি শুরু হয়ে যায় সেই সাথে রিশুর বুকের কাছে জড়সড় হয়ে আসে রিতিকা। রাতের অন্ধকারে আকাশের অবস্থা বোঝা যায়নি, কিন্তু শীতল হাওয়া বইছিল। ভুমধ্য সাগরের জলীয় হাওয়ায় মাঝে মাঝে দিল্লীতে শীতকালেও বৃষ্টি নামে। ঘরের লাইটটা একটু কেঁপে উঠল, সেই সাথে দুই নিঃসঙ্গ হৃদপিণ্ড। রিশু আঁজলা করে ধরে রিতিকার পান পাতার আকারের মুখ খানি। উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় রিতিকার চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে আসে বুকের ওপরে। রিতিকার শ্বাস ফুলে ওঠে আসন্ন উত্তেজনায়। কোমল পীনোন্নত স্তন জোড়ায় লাগে তীব্র কামনার ঢেউ। উষ্ণ হাতের পরশে রিতিকার কমনীয় দেহপল্লব মোমের মতন গলতে শুরু করে দেয়। রিশুর শরীরের ধমনীতে জ্বলে ওঠে কামাগ্নির লেলিহান শিখা। রিতিকার মুখ ছেড়ে দিয়ে কোমরে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে আনে। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে রিতিকার। একি হতে চলেছে ওর, এটা কি সত্যি রিতিকা চেয়েছিল? নিজের শরীর আর নিজের আয়ত্তে নেই। বাইরে ঝড়ের আওয়াজ শোনা যায় সেই সাথে বুকের মধ্যে ঝড় ওঠে রিশুর, তীব্র ঝঞ্ঝা, এই ঝঞ্ঝায় সব কিছু হারিয়ে দিতে চায় বুভুক্ষু প্রান। রিতিকার বন্ধ নয়নের কোল বেয়ে এক ফোঁটা জল অতি সরু ধারায় বেড়িয়ে আসে।
মুখের ওপরে রিশুর উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ বয়ে যেতেই ওর গেঞ্জি খামচে ধরে অস্ফুট ধরা গলায় বলে ওঠে, “নাহহহহ… আমি… নাহহহ…”
তুলতুলে নরম সুগোল পেটের উপরে রিশুর কঠিন লিঙ্গের পরশে কেঁপে ওঠে রিতিকার নধর কমনীয় দেহবল্লরী। নিজের অজান্তেই রিতিকা রিশুর গলা জড়িয়ে ধরে প্রসস্থ বুকের ওপরে নিটোল দুই স্তন চেপে ধরে। ওর শরীর অবশ হয়ে এসেছে। চোখ খলার শক্তি হারিয়ে ফেলে রিতিকা। পাঁজর শুন্য হয়ে আসে ওর, সেই সাথে রিশুর বলশালী বাহুপাশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে প্রবল ভাবে। অবশ হয়ে আসা শরীর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে রিশুর নেমে আসা ঠোঁটের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে প্রানপন চেষ্টা করে। ধিরে ধিরে রিতিকার বন্ধ ঠোঁট জোড়া খুলে যায়। রিশুর ঘাড় একদিকে কাত হয়ে যায়, চেপে ধরে পুরু ঠোঁট জোড়া রিতিকার সুমিষ্ট গোলাপি কোমল ঠোঁটের সাথে। রিশুর মাথার চুল দুই হাতে আঁকরে ধরে রিতিকা। দুই বলিষ্ট হাতে পিষে ধরে রিতিকার নধর কমনীয় শরীর। পাগলের মতন রিশু রিতিকাকে চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তোলে। হেরে যাওয়া ভাঙা হৃদয় কিছু একটা খুঁজতে ভীষণ ব্যাস্ত। কামনা মদির রিতিকার দেহের মাঝে ঝিনুককে খুঁজতে চেষ্টা করে রিশু। রিতিকার কোমল নিচের ঠোঁট মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে চুষে দেয় রিশু। দুষ্টু রিতিকা রিশুর মুখের মধ্যে জিব ঢুকিয়ে লালা দিয়ে ভিজিয়ে দেয় রিশুর মুখ। পাগলের মতন অস্থির চুম্বনে মেতে ওঠে দুই কাতর নর নারী। শরীরী কামনা নয়, বুকের মাঝে এক দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন নেভানোর জ্বালা দুই প্রানকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
রিশুর মাথা রিতিকার কানের লতি, গাল ঘাড় গর্দানের উপরে নেমে আসে। পাগলের মতন চুমু খেতে শুরু করে দেয় রিতিকাকে। চুমু খেতে খেতেই রিশু একটানে নিজের গেঞ্জি খুলে ফেলে। রিতিকাকে ঠেলে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রিশু। রিশুর প্রসস্থ বুকের উপরে হাতের তালু মেলে ধরে নখের আঁচর কেটে দেয় রিতিকা। রিতিকার নখের আঁচরের সুখানুভূতি রিশুর শরীর তীব্র কামনার আগুনে দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দেয়। রিতিকার দুই ভাসা ভাসা আঁধারে ঢাকা বেদনা মাখা চোখ জোড়া রিশুর পরাজিত পরাস্ত চোখের উপরে নিবদ্ধ।
ঠাস করে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দেয় রিশুর গালে। রিতিকার দুই চোখে বন্যা, “তুমি যদি আমার ঝিনুকের রিশু না হতে পারো তাহলে তুমি আমার কেউ নয়।”
মুখ চাপা দিয়ে দৌড়ে শোয়ার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় রিতিকা। যেতে যেতে হাতে নিজের জামা কাপড় নিয়ে পাশের ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। পরাজিত রিশুর হাত মুঠো হয়ে আসে, সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয় ওর। মাথার চুল আঁকরে ধরে বিছানায় বসে পরে রিশু। কাকে হারাতে গিয়ে কাকে হারিয়ে বসলো? বাইরে প্রবল বৃষ্টি, বুকের মাঝে তাণ্ডব, পাশের ঘরে এক বিধ্বস্ত পরাজিত নারীর নিস্তব্দ ক্রদন। সব মিলিয়ে রিশুকে ছারখার করে দেয়। কতক্ষন ওইভাবে মাথা নিচু করে বসেছিল খেয়াল নেই রিশুর।
ওর সম্বিত ফেরে রিতিকার ধরা গলা শুনে, “আমি চললাম।”
মাথা উঠিয়ে রিতিকার দিকে তাকায় রিশু। জামা কাপড় পরে তৈরি। হাতে ফাইল আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে তৈরি। চোখ জোড়া ফুলে গেছে এইটুকু কান্নায়, সারা চেহারায় ভীষণ এক বেদনার ছবি। ঘড়ি দেখে রিশু, রাত এগারোটা, গভীর রাত সেই সাথে বাইরে প্রবল বৃষ্টি।
রিতিকার ওই বিধ্বস্ত রূপ দেখে রিশু হাত তুলে ওকে বলে, “না যেও না।”
রিতিকা চেঁচিয়ে ওঠে ওর দিকে, “কেন থাকব?”
রিশু নিচু গলায় বলে, “বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।”
রিতিকা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “হয় হোক, তোমার কি যায় আসে তাতে।”
রিশুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, বিছানা ছেড়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “তুমি এখন নাটক করছ? তুমি তো ইচ্ছে করেই আমার জামা পরে…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই হাসিতে ফেটে পরে রিতিকা, কপালে করাঘাত করে বলে, “হ্যাহ… তোমার জন্য?” ওর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “তুমি বুঝবে না। তুমি শুধু মাত্র বই পড়তে জানো, ডক্টর সান্যাল, মানুষ পড়তে এখন শেখোনি। ঝিনুকের জামা কাপড় গায়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না আমার। ওর সাধ করে পাট পাট করে সাজিয়ে রাখা জামা কাপড় ভাঙতে ইচ্ছে করেনি আমার। ওর সাধের বাগান আমি ভাঙতে আসিনি, ডক্টর সান্যাল। যদি সেটাই করতে হত আমাকে তাহলে আলমারিতে ঝিনুকের অনেক সেক্সি লঞ্জারি ছিল, তোমার কাচা শার্ট ও ছিল। না, আমি তো শুধু মাত্র … ছিঃ তোমার মানসিকতা। এই নাকি সার্জেন। আরো একটা কথা। সব মানুষের মা থাকে। মায়ের ওপরে কারুর কিছু বলার থাকে না। তবে কি জানো, ডক্টর সান্যাল, বিয়ের পরে বেশি মা মা করতে নেই। তখন তোমার জীবনে আরও একজন আসে। মন বোঝ কি তুমি? শ্বাশুরি বোউমা, দুজনের মনের কোন অবচেতন কোনায় এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করে। একজনের মনে হয় অন্যজনে ওর ভালোবাসার মানুষটাকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। একদিকে মাতৃ স্নেহ অন্যদিকে প্রেম। বিয়ের পরে সেটা বুঝতে হয় ডক্টর সান্যাল। বউ শুধু মাত্র তোমার শরীরের খিধে মেটাতে আসেনি। শুধু মাত্র বই পড়লে মানুষ হওয়া যায় না, কখন বইয়ের বাইরে চোখ মেলে তাকাতে হয়। সব কথা বইয়ে লেখা থাকে না। আর সত্যি বলতে, আমিও সেখানে ছিলাম। ঝিনুক কি বলেছে? আন্টিকে অপমান করেছে কি? সত্যি কথাটা খুব আঁতে লেগে গেছে, তাই না। কেন তোমাদের কিছু বলা যাবে না? সোনার আংটি বেঁকা হলেও সোনা, তাই? আজ আমি বলছি ডক্টর সান্যাল, তুমি ঝিনুকের যোগ্য নয়।”
রিতিকা আর দাঁড়ায় না। বাইরে ক্যাবের আওয়াজ পেতেই রিতিকা দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়।
বিধ্বস্ত পরাজিত সৈনিক, শুন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের বর্ম, নিজের ঢাল তরোয়াল সব খুইয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বিছানায় বসে থাকে রিশু, যেন এক ধাক্কায় রিতিকা ওর সব কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে পায়ের নিচে দলে চলে গেল। বাইরের বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়ায় দরজাটা ভীষণ ভাবেই দুমদুম করছে, সেই সাথে দুমদুম করছে রিশুর হৃদপিণ্ড। দরজা বন্ধ করে শোয়ার ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে পাট পাট করে সাজানো ঝিনুকের জামা কাপড়। গোলাপি রঙের একটা টপ হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঝিনুকের গায়ের গন্ধে নিজেকে মাখিয়ে নেয়।
রাতে শোয়ার সময়ে বিশাল ঘরের মধ্যের বিশাল বিছানার ওপরে ভীষণ ভাবেই একা মনে হয় নিজেকে। প্রথম রাতের কথা ভীষণ ভাবেই মনে পরে যায়, বিছানার পাশে রাখা সোফাটার দিকে শুয়ে শুয়েই অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। সেই রাতে এই সোফায় বসে কাটিয়ে দিয়েছিল রিশু। কোলকাতায় অতটা ঠান্ডা নেই তবে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে বিশাল বিছানার এক কোনায় কুঁকড়ে শুয়ে ছিল। কিছুতেই ঘুম আসছিল না ওর চোখে। পরের দিন রিশু চলে যাবে, এই ভেবেই বুকের বাঁ দিকে ভীষণ ভাবেই ব্যাথা করছিল ঝিনুকের।
রাত কত জানা নেই, হটাত করেই ওর ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে নামের সাথে ছবিটা ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, তিরতির করে কেঁপে ওঠে নরম গোলাপি ঠোঁট জোড়া, চোখ জোড়া টলটল করে ওঠে। ভীষণ রাগ হয়, না উঠাব না তোমার ফোন, এখন কেন উঠাতে যাবো। ফোনের সবুজ বোতাম টিপে কানের কাছে চেপে ধরে ঝিনুক।
অন্য পাশে সেই জলদ গম্ভির আওয়াজ একদম নেই, “ঘুমিয়ে পড়েছ?”
কানের ভেতর ঢুকে সেই আওয়াজ ওর বুক ছারখার করে দেয়। ঘুমাতে দেয় কই আর। দুই চোখে বন্যা। মনে পড়েছে তাহলে, এতক্ষন পরে? বুকের মাঝে হাপর টানে।
ওইপাশে সেই কন্ঠস্বর আবার বলে, “কিছু বলবে না?”
মাথা নাড়ায় ঝিনুক, কেন ওর সাথে কথা বলতে যাবে? জীবনে না জেনে কত ভুল করেছে যে নিজেই ভুলে গেছে। তাই বলে এক্কেবারে এক কথায় ওকে এইভাবে…
নিচু গলায় ফোনের মধ্যে থেকে ভেসে আসে বহু প্রতীক্ষিত ডাক, “ঝুনু…”
শেষ ভালোবাসার একমাত্র পুরুষের কাঁপা কন্ঠে ভালোবেসে দেওয়া নাম শুনে চোখ টিপে বন্ধ করে নেয় ঝিনুক। আর পারছে না। হেঁচকির মতন দলা পাকিয়ে কান্না গলা বেয়ে উঠে, খোলা মুখ দিয়ে ঠিকরে বের হতে চাইছে।
ধরা কন্ঠস্বর ওকে বলে, “আই এম সরি, ঝুনু।”
কিসের “সরি”? একটা সামান্য ইংরেজি শব্দ কি সব কিছু ঠিক করে দেবে নাকি? জীবনে প্রচুর ভুল করলেও, সেই রাতে মায়ের কথা শুনে এই শয়তানটার সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। একটা ছোট “সরি” তে কি করে ভুলে যায়? কিন্তু ওর হৃদয়টা চুরি করে নিজের কাছে রেখে দিয়ে বলে কি না ওকে সব “ফ্রিডম” দিয়েছে। “ফ্রি” কোথায় হতে পারল তাহলে?
ওইপাশ থেকে গলা ভেসে আসে, “সত্যি বলছি, বুকের বাঁ দিকটা ভীষণ ব্যাথা করছে, ঝুনু।”
কেঁদে ফেলে শেষ পর্যন্ত ঝিনুক। মনে হচ্ছিল ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দেয় শয়তানটার গালের ওপরে। আদিখ্যেতা দেখান হচ্ছে এত রাতে, ন্যাকামো করে বলা হচ্ছে, বুকের বাঁ দিক ব্যাথা করছে। চলে যেতে বলার সময়ে মনে ছিল না?
গলাটা ভীষণ ভাবেই খাদে নেমে যাচ্ছে মনের মানুষটার, “আমি অনেক কিছু বুঝি না। কি করব বল। এমন একটা প্রোফেশানে আছি যে মাঝে মাঝে আমার নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না, জানো।”
কোনদিন বলেছে নাকি সেই নিয়ে? সেদিন তো রাগের বশে মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছিল। কোনদিন জেদ ধরেনি যে রোজ বিকেলে ওকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। কোনদিন জেদ ধরেনি যে শপিং করাতে নিয়ে যেতে হবে। দুই অবুঝ প্রানের মেল বন্ধন, হয়ত কঠিন। ওর বাজুর ওপরে মাথা রেখে রাতের বেলা যখন ওই বুকের উষ্ণ ওম ওর গালে লাগত তখন সবকিছু ভুলে যেত। অবুঝ ও নিজেও, ভালোবাসার খোঁজে কত উল্টোপাল্টা পথে গেছে।
কাঁপা গলা শোনা যায়, “হিসাবে হয়ত আমি অনেক এগিয়ে গেছি, কিন্তু শেষ বেলায় তুমি জিতে গেলে। চুপচাপ, বিনা বাক্যব্যায়ে একটা আওয়াজ পর্যন্ত না করে তুমি জিতে গেলে।”
জিততে আসেনি ঝিনুক, কোনদিন জিততে আসেনি। সেই প্রথম দেখাতেই কেমন যেন হারিয়ে গেছিল। ভেবেছিল যে মানুষ ওর ব্যাথা দেখতে পারে সে মানুষ হয়ত অনেক কিছুই বুঝবে। ইসস শয়তানটা আবার কেমন করে বলছে দেখো, ও নাকি জিতে গেল। সব খুইয়ে দিয়ে সর্বহারার দলের প্রথম সারিতে ঝিনুকের নাম এখন। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ ওইপাশ থেকে শ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসে। সেটাই ওর কানে মধুর সঙ্গীত, এই আওয়াজ ভীষণ ভাবেই ওকে কাছে টানে। যখন শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে রাতের বেলা ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে কিন্তু ওর চোখে ঘুম আসে না, তখন চুপচাপ ওর বন্ধ চোখের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে এই আওয়াজ শুনত। কানের ওপরে মোবাইল চেপে ধরে ক্রমাগত ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।
বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে কাঁপা গলা ভেসে আসে, “ঝুনু, তোমায় ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, ঝুনু।”
দূরে ঠেলে দিয়ে এখন আবার, আদিখ্যেতা দেখো লোকটার, বলে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ অভিমান হয় মনের মানুষটার ওপরে। আর চুপ করে থাকতে পারে না ঝিনুক। বুকের পাঁজর অনেক কিছুই চেঁচিয়ে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু ঠোঁট থেকে দুটো শব্দ বের হল ওর, “খেয়েছ কিছু?”
প্রেয়সীর বহু প্রতীক্ষিত কম্পিত সুমিষ্ট কন্ঠ শুনে বুকের পাঁজর দুমড়ে যায় হৃদপিণ্ড গলায় এসে ধাক্কা মারে রিশুর। কানের ওপরে মোবাইল চেপে ধরে, সেই আওয়াজটা বারে বারে মনের মধ্যে আওড়ায়। কানের মধ্যে বারেবারে ওই ছোট দুটো শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। ছোট উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, খেয়েছি।”
ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “বাড়ি কখন ফিরলে?”
উত্তর দেয় রিশু, “একটু দেরি হয়েছে। এখানে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।”
উল্টো হাতে চোখের কোনা মুছে রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “সুটকেস গুছানো হয়ে গেছে?”
মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ।”
জিজ্ঞেস করে ওর সাধের কামিনী, “মাফলার নিয়েছ?”
ইসস এটা ভুলে গেছে, মাথা নাড়ায় রিশু, “না ভুলে গেছি।” সত্যি ঝিনুক ছাড়া ওর গতি নেই।
অভিমানিনী কপট ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “এখুনি নাও। লন্ডনে এক ডিগ্রি চলছে। আলমারির ডান দিকে নিচের দিকের কোনায় রাখা আছে।”
হেসে ফেলে রিশু, কোলকাতায় বসে লন্ডনের তাপমান পর্যন্ত মুখস্থ করে বসে আছে ওর প্রেয়সী সুন্দরী। বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারি খুলে নিচের তাক থেকে মাফলার বের করে আনে। সুটকেস খুলে মাফলারের সাথে সাথে ঝিনুকের গোলাপি টপটা সঙ্গে নিয়ে নেয়। “হ্যাঁ, ঢুকিয়ে নিয়েছি।”
ঝিনুক ওকে জিজ্ঞেস করে, “গ্লাভস নিয়েছ?”
মৃদু হেসে মাথা দোলায় রিশু, “হ্যাঁ ওটা তুমি আগেই গুছিয়ে দিয়েছিলে।”
উত্তর শুনে জল ভরা চোখে হেসে ফেলে ঝিনুক, “না, আমি ভাবলাম তুমি আবার সব বার টার করে দিলে নাকি। কি জানি বাবা কথায় কথায় সবাইকে বের করে দাও।”
শেষের কথাটায় ব্যাথা পায় রিশু। অপরাধীর মতন নিচু গলায় বলে, “সরি, ঝুনু।”
ভগ্ন হৃদয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে ব্যাথিত ললনা, “বারেবারে আমাকে ওই নামে ডাকবে না, বুঝলে।” তারপরে কেঁদে ফেলে ঝিনুক, “আমার ভীষণ কষ্ট হয়।”
দুই রিক্ত প্রান চুপচাপ গভীর রাতের অন্ধকারে নিজেদের ব্যাবধান দুর করতে মুখিয়ে ওঠে। কিন্তু হায় বিধি ওদের মাঝে যে কয়েক হাজার কিলোমিটারের ব্যাবধান।
গলা কেঁপে ওঠে রিশুর, “তোমায় ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, ঝুনু।” অন্যপাশ থেকে ভেসে আসে প্রেয়সীর বাঁধ ভাঙা চাপ ক্রন্দন ধ্বনি। কতদিন দেখেনি ওর প্রেয়সীকে, “আমি কাল একদম ভোরের টিকিট কাটছি। তুমি শুধু মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য এসো।”
অভিমানী হৃদয় ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “না যাবো না।” বুক ফেটে যায় ঝিনুকের। বেশ কিছুক্ষন পরে চোখের কোল মুছে জিজ্ঞেস করে, “পাঁচটায় কোন ফ্লাইট আছে কি?”
হেসে ফেলে রিশু, “দেখছি দাঁড়াও।”
মৃদু ঝাঁঝিয়ে ওঠে রূপসী ললনা, “শুয়ে আছি তাতে গায়ে লাগছে নাকি?” বলেই হেসে ফেলে।
সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ খুলে বসে পরে রিশু। প্লেনের সময় দেখে ওকে বলে, “পাঁচটায় একটা আছে কিন্তু সেটা ধরতে হলে তোমাকে তো রাত দুটোতে বাড়ি থেকে বের হতে হবে। বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট এক ঘন্টার মতন লেগে যাবে যে।”
বিছানায় উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে মাথা নাড়ায় ঝিনুক, “আমি কিছু জানি না।”
রিশু ঘড়ি দেখে বলে, “আরে একটা বাজে এখানেই। তুমি তাহলে রেডি হও। কিন্তু এত রাতে কি বলে বের হবে?”
ঘাড় কাত করে মোবাইল কানের ওপরে চেপে ধরে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে ঝিনুক। রাত একটা বাজে হাতে মাত্র এক ঘন্টা। কিন্তু এত রাতে যদি মামনি শোনে যে ঝিনুক দিল্লী যাচ্ছে তাহলে হয়ত খুব বকাবকি করবে। কিন্তু ও যাবেই।
মাথার চুল এলো করে খোঁপায় বাঁধতে বাঁধতে বলে, “কাউকে কিছুই বলব না, চুপিচুপি পালিয়ে যাবো।” বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।
কানের ওপরে মোবাইল চেপে ধরে রিশু। কতদিন এই গলার আওয়াজ শোনেনি, কতদিন এই হাসির কলতান ওর কানে ভেসে আসেনি। প্লেনের টিকিট কেটে ওকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে, “পালাও পালাও, কেউ ধরে ফেলার আগেই পালিয়ে আসো।”
আলমারি খুলে সেই ওর দেওয়া সালোয়ার কামিজ বার করে। রেগে মেগে সেদিন কিছুই আনা হয়নি। জামা কাপড় হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলে, “হ্যাঁ শয়তান, আর শয়তানি করতে হবে না। ফোন রাখো আমি রেডি হব।”
রিশু মাথা চুলকে আদর করে আবদার করে, “একটা ভিডিও কল কর।”
মাথা দোলায় রিশুর রূপসী তন্বী প্রেয়সী, “তুমি না ভীষণ দুষ্টু। আমি এখন বাথরুমে যাবো।”
দুষ্টুমির হাসি দেয় রিশু, “ভালো তো তাহলে।”
মোবাইলে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে বলে, “ফোন রাখো আমি রেডি হই। ক্যাবে উঠে তোমাকে আবার ফোন করব।”
রিশু নাছোড়বান্দা, “প্লিজ ঝুনু একটা ভিডিও কল কর।”
হাসতে হাসতেই ঝিনুক রিশুকে একটু বকে দেয়, “ধ্যাত, তুমি না। পরে করব। এয়ারপোর্টে গিয়ে করব।”
রিশু মুচকি হেসে আবদার করে, “আচ্ছা একটা ছোত্ত হামি।”
গোলাপি নরম ঠোঁট জোড়া ফোনের কাছে কুঁচকে মিষ্টি করে একটা চুমু ছুঁড়ে দেয়, “মুহহহহহাআআআ… হয়েছে এবারে, শান্তি।”
চুম্বনের আওয়াজ পেয়ে রিশুর বুক ভরে ওঠে, নিচু গলায় বলে, “মিসিং ইউ ঝুনু।”
আরও একটা সুদীর্ঘ চুম্বন ছুঁড়ে দেয় ফোনের মধ্যে থেকে, “মুয়াহহহ… এই এবারে আমাকে ড্রেস আপ করতে দাও।”
ওর প্রেয়সী শেষ পর্যন্ত ওর ক্রোড়ে ফিরে আসছে। কেমন যেন একটা শিউরে ওঠা অদ্ভুত অনুভূতি জাগে ওর সারা শরীরে। কেমন যেন কাউকে মাঝ রাতে চুরি করে নিয়ে আসার মতন অনুভূতি। প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছে না, “তাড়াতাড়ি আসো।”
আবার বকুনি দেয় ওর প্রেয়সী কামিনী, “তুমি ফোন রাখলে তবে না আমি ড্রেস করব, শয়তান।” গভীর রাতে বাড়ি থেকে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য পালিয়ে যাওয়া। উফফফ, সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে ঝিনুকের। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, নাক মুখ কুঁচকে রিশুকে মুচকি হেসে বলে, “ইসসস কি মনে হচ্ছে জানো…”
কথাটা রিশু শেষ করে, “বয়ফ্রেন্ডের জন্য বাড়ি থেকে পালাচ্ছ…”
দুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতী বহুদুরে হলেও এক সাথেই খিলখিল করে হেসে ফেলে। শেষের পাতায় শুরু হল দুই মিলন পিয়াসী তৃষ্ণার্ত প্রানের।
!!শেষের পাতায় শুরু!!
সামনের একটা গাছের ডালে এক গাদা শালিক বসে অনেকক্ষণ ধরে একটানে কিচির মিচির করে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘের ঘটা দেখে কারুর বলার জো নেই যে শরত কাল এসে গেছে। সেই সাদা পোজা তুলোর মেঘের জায়গায় কালো মেঘ ছেয়ে ছিল আকাশে। হয়ত কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। আটান্ন বসন্ত পেরিয়ে আসা সুন্দরী আম্বালিকার মন চাপা উত্তেজনায় বড় অস্থির যায় আকাশের কালো মেঘের আনাগোনা দেখে। গত রাতে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হয়েছিল। অন্ধকার থাকতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেছিল আদরের বড় বৌমা, ঝিনুকের প্রসব যন্ত্রণার চিৎকারে। বড় ছেলে, রিশু দিল্লীর এমসের চাকরি ছেড়ে কোলকাতায় এসএসকেএম কে চলে এসেছে পাঁচ বছর আগেই। ঝিনুক বাড়ি আসার পর থেকে ওর প্লে স্কুলের সব ভার তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে। ভীষণ অস্থির লাগছে, এখন কোন খবর এলো না।
ওর প্রিয় বান্ধবী, পিয়ালী ওর পাশে বসে বলে, “এত টেন্সান নিচ্ছিস কেন?”
আম্বালিকা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ঝিলিক কিছু বলল?”
পিয়ালীর ছোট মেয়ে, ঝিলিক ডাক্তারি পড়ছে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে। পড়াশুনায় বেশ ভালো মেয়েটা। ওর জিজুর দেখনো পথেই গেছে।
মুচকি হেসে ফেলে পিয়ালী, যদিও ওর মনের মধ্যেও সমান অস্থিরতা। “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আম্বালিকা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে। ফোনে কারুর সাথে কথা বলছে। ফোন নিয়েই ওর দিকে এগিয়ে আসে দিয়া। আম্বালিকা জিজ্ঞেস করে, “এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিস?”
একমাত্র কন্যে, দিয়া ওর বাবার মতন যাদবপুর থেকে আর্কিটেকচার পাশ করে ওদের অফিসেই জয়েন করেছে। সেটার কৃতিত্ব ঝিনুকের। যদিও ওর ইচ্ছে ছিল মেয়েও ডাক্তার হোক, ঝিনুক বলেছিল যে যেটা করতে চায় সেটাই করতে দেওয়া হোক। বাধা দিতে পারেনি আম্বালিকা, তবে ভীষণ খুশি। বাবার সাথেই নিজেদের আর্কিটেকচার ফার্মের ভার তুলে নিয়েছে।
দিয়া ফোন রেখে উত্তর দেয়, “রিতিকাদির ফ্লাইট ল্যান্ড করে গেছে, এই ট্যাক্সিতে উঠেছে।”
মাথা দোলায় আম্বালিকা, “ওহ আচ্ছা। সুভাষ ছুটি পায়নি?”
দিয়া মাথা নাড়ায়, “না, আজকে সুভাষদার ওপিডি।”
ঝিনুকের বান্ধবী রিতিকা, দিল্লীতেই থাকে। রিশু এক জুনিয়ার ডাক্তারের সাথে বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। সুভাষ আর রিতিকার মধ্যে পরিচয়টা রিশুই করিয়ে দিয়েছিল।
দিয়া চেঁচিয়ে বলে ভাইকে, “এই ভাই, ভিহানকে দেখ কোথায় যাচ্ছে।”
ওটির দরজার সামনে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়েছিল দীপ, দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে ছেলেটা। ঝিনুকের ত্বতাবধনে দীপ পড়াশুনায় বেশ উন্নতি করেছে। সামনের মাসে ইউএসএ চলে যাবে, একটা বড় ইউনাভারসিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়েছে। দিয়ার গলা শুনে দীপ দৌড় লাগায় শালিনীর একমাত্র পুত্র, কচি ভিহানের পেছনে। ভীষণ বদমাশ হয়েছে বিচ্ছুটা। গত দুইদিন ধরে বাড়ি মাথায় করে রেখেছে। ঝিনুক আসন্ন প্রসবা শুনেই শালিনী তিন দিন আগে ছেলে নিয়ে চলে এসেছে কোলকাতায়। দীপ ভিহানকে কোলে তুলে নিতেই ভিহানের রাগ। ছোট ছোট হাতে দীপের গালে সমানে চাঁটি মারছে। ঘোর প্রতিবাদের ঝড়, কেন ওকে কোলে তোলা হয়েছে, কেন ওর স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। কি সুন্দর মনের আনন্দে ম্যাগাজিনের পাতা ছিঁড়ছিল।
একটু বাদে দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে ঝিলিক। মা আর আন্টির হাত ধরে মুচকি হেসে বলে, “এই একটু পরে দিদিকে বেডে দেবে। জিজু দিদির সাথেই আছে।”
আম্বালিকা আর পিয়ালী এক সাথেই জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক তো? ভালো আছে তো।”
খুশির হাসি ঝিলিকের ঠোঁটে, “হ্যাঁ সব ভালো।”
অদুরে দাঁড়িয়েছিল সোমনাথ আর নিলাদ্রী। ঝিলিককে বেড়িয়ে আসতে দেখে ওদের দিকে এগিয়ে আসে। উৎসুক সোমনাথ ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
মুচকি হাসে ঝিলিক, “এই আসছে।”
সাদা নরম কাপড়ের মধ্যে মুড়ে সদ্যজাত কচি শিশুকে কোলে নিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে আসে শালিনী। সবাই উন্মুখ। আনন্দে পিয়ালী কেঁদে ফেলে। শালিনী সদ্যজাত কচি শিশুকে আম্বালিকার হাতে তুলে দেয়, “এই নাও তোমার নাতনি।”
আম্বালিকার চোখে আনন্দশ্রু। সদ্যজাত কচি শিশুটিকে কোলে নিয়ে বলে, “আমার ঝিনুকের মুক্তো।”
শালিনী চোখের কোল মুছে হেসে বলে, “আমার বউমা।”
ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে।
!!সমাপ্ত!!