Written by bourses
[৩৫] জোর্ডিয়ান স্টারস্ট্রাক
২৩শে অক্টোবর, শনিবার
এতক্ষনে জোর্ডি ঘুমিয়েছে… পারেও ও… বকবক করতে শুরু করলে আর থামতেই চায় না… বকেই যায়, বকেই যায়… কিন্তু এটাও ঠিক… মনটা বড্ড সাদা ওর… মনের ভেতরে কোন প্যাঁচপয়জর নেই একেবারেই… আর সেই কারণেই এত ভালোবাসি ওকে…
হ্যা… ভালোবাসি… বোধহয় এতদিনে এই কথাটা প্রথম বললাম আমি… এতগুলো মানুষের সাথে মেশার পর… আজ আমার লিখতে কোন দ্বিধা হচ্ছে না যে আই অ্যাম ইন লাভ… আই অ্যাম ইন লাভ উইথ জোর্ডি… হয়তো ভালোবাসা এভাবেই এসে বাসা বাঁধে মনের গভীরে… অজান্তে… কখন কি ভাবে কার সাথে কোথায় দেখা হয়ে যাবে… আর তারপর সেই মানুষটাকে মন দিয়ে ফেলবে, কে বলতে পারে?
ভালোবাসা বলতে আমি একটা নিজস্ব আইডিওলজি বিশ্বাস করতাম… আমি মনে করি ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা… বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা… তবুও… ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ভাগ করা যায় বলে আমার মনে হয়… আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয়… বিশেষ কারুর সাথে নিজের সকল মানবীয় অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া, এমনকি শরীরের ব্যাপারটাও এই ধরণের ভালোবাসা থেকে পৃথক করা যায় না… আর আমার মনে হয় এই অতি আনন্দদায়ক অনুভুতিই হলো ভালোবাসা… যদিও ভালোবাসার সংজ্ঞা বিতর্ক, অনুমান এবং অর্ন্তদর্শনের উপরে প্রতিষ্ঠিত… অনেকেই ভালোবাসার মত একটি সর্বজনীন ধারণাকে আবেগপ্রবণ, কল্পনাপ্রবণ কিংবা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভালোবাসা ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী নয়… তবে এসব ভালোবাসাকে শারীরিক আকর্ষণের উপরে ভিত্তি করে শ্রেণীবিন্যাস করা যেতে পারে… তবে আমার মনে হয় ভালোবাসা একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি… যেটা একজন মানুষ অপর আরেকজন মানুষের প্রতি অনুভব করে… কারো প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীলতা কিংবা প্রতিক্ষেত্রে কারো উপস্থিতি অনুভব করা এই ভালোবাসার সাথেই সম্পর্কযুক্ত… কল্পনাবিলাসিতার একটি বিশেষ ক্ষেত্র… যেটা ঘটেছে এই এত বছর পর… এতগুলো মানুষের সাথে মেশার পর… প্রায় হটাৎ করেই… জোর্ডির সাথে দেখা হওয়ার পরে…
আজ আমার ডাক ছেড়ে বলতে ইচ্ছা করছে…
ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;
ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠান্ডা কফির পেয়ালা সামনে অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে হাজার দুঃখের মাঝেও নিজেকে সুখী রাখা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও মুখোমুখি বসে থাকা।
হি হি… একটু কাব্য করে ফেললাম… তিতাসের কলম থেকে কাব্যিও বেরোচ্ছে… ভাবো কান্ডটা একবার…
তবে প্রেম বোধহয় এই ভাবে এসেই বাসা বাঁধে মনের গভীরে… মিলে যায় দুটো হৃদয়… স্থান কাল ব্যক্তি বিশেষ না বাছাই করেই… কে ভেবেছিল? ডঃ চন্দ্রকান্তা চৌধুরী… যার শরীরে কিনা দর্পনারায়ণের রক্ত বইছে… যে কিনা কত নারীপুরুষের সংসর্গ করে এসেছে এযাবৎ কাল… সেই কিশোর বয়স থেকেই… সেই মেয়েটা… সেই একরোখা, একগুয়ে মেয়েটা শেষে কখন কি ভাবে যেন মন হারালো জোর্ডির মত একজন… এটাই হয়তো হওয়ার ছিল… আর সত্যিই তো তাই… এটা কি কারুর হাতে আছে? এ বোধহয় ওই ওপরে যে বসে আছে… তার আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা আছে… তাই না? জানি… আমার এ কথা বাড়ির কেউ যদি শোনে… শুধু বাড়ির মানুষগুলোর কথাই বা কেন বলবো? ভারতে আমার চেনাজানা যে কেউ যদি শোনে… হয়তো নাক শিঁটকাবে… অথবা অবাক হবে… কিংবা হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না কোন মতেই… তা না করুক… শিঁটকাক নাক… অথবা হোক অবাক… জীবনটা আমার… মন আমার… দেহ আমার… তাই ভালোবাসাটাও আমারই… সেটা থাক না আমার মত করেই… কি যায় আসে এতে কে কি ভাবলো বলে?
নাহ!… বলি তাহলে প্রথম থেকেই…
এই মুহুর্তে আমি জার্মানির ফ্রাঙ্কফার্টএ বসে রয়েছি… এখন দেওয়াল ঘড়িতে সময় জানাচ্ছে রাত সাড়ে দশটা… অন্য সময় হলে আমি এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়তাম… কারন খুব একটা কারণ না থাকলে আমি রাত জাগার পক্ষপাতি নই কোনদিনই… বরাবরই আর্লি টু বেড মন্ত্রে বিশ্বাস করে এসেছি… কারণ ওই দিকে আমার দিন শুরু হয় অনেক ভোরে… সূর্যোদয়ের অনেক আগে… তাই বেশি রাত করে শোয়া আমার ধাতে নেই… কিন্তু আগামীকাল যেহেতু রবিবার… কালকের রোস্টারে আমার কোন সার্জারী নেই… তাই ভাবলাম অনেকদিন হয়ে গেলো ডায়রিটা নিয়ে বসা হয় নি… সেই লাস্ট লিখতে বসেছিলাম ফ্রান্সে থাকতে… তারপর এতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো… একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে চলে এলাম… তাই ভাবলাম একটু বসি লিখতে… যদি ঘুম এসে যায় চোখে, তাহলে না হয় বন্ধ করে রেখে দেবো’খন লেখার মাঝপথেই…
এর মধ্যে না না করেও প্রায় বছর খানেক হয়ে গিয়েছে আমি ফ্রান্সএ চাকরি করে ফেলেছি… শেষের দিকে আর একটু বড় কোথাও জবের জন্য অ্যাপ্লাই করতে শুরু করে দিয়েছিলাম… এবং এই অ্যাপ্লাই করার কিছুদিনের মধ্যেই ইন্টার্ভিউএর জন্য ডাক পেয়ে গেলাম… Bürger Hospital, জার্মানী থেকে…
সত্যি বলতে ভাবিনি যে এই এত বড় একটা হস্পিটাল থেকে আমার ইন্টার্ভিউ কল আসবে বলে… তাই কি করবো মন স্থির করতে পারছিলাম কিছুতেই… তাই শেষে মনে হলো যে আমার স্যরকে, মানে যার আন্ডারে আমি এখানে আসার পর একটা থিসিস পেপার কমপ্লিট করেছি, তাঁকে একবার জানাই ব্যাপারটা… উনি যা বলবেন, তাই ডিসিশন নেবো না হয়…
ওনাকে আমার ইন্টার্ভিউয়ের কল লেটার দেখাতে উনি খুব খুশি হলেন… বললেন, “খুব ভালো জায়গা থেকে কল পেয়েছ কান্তা… ওটা জার্মানীর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট হসপিটাল… ট্রাই ফর ইট… ওখানে যদি তুমি জয়েন করতে পারো, তাহলে তোমার কেরিয়ারের অনেক উন্নতি হবে… ওখানকার সেটআপ অনেক বেশি ভালো… এখানের থেকেও…” তারপর একটু থেমে বলেন, “আমি বরং এক কাজ করবো… ওখানে আমার এক বান্ধবী আছে… ডঃ মার্থা… ও ওখানকার সার্জারীর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট… আর ওখানকার গভর্নিং বডিতেও আছে জানি… আমি বরং ওকে জানিয়ে দেবো… তাতে তোমার ওখানে জয়েন করতে কোন অসুবিধা হবে না…”
ওনার কথা শুনেই আমি সাথে সাথে নাকচ করে দিই… “না স্যর… আপনি প্লিজ কোন রকম ভাবে কাউকে আমার নাম রেকমেন্ড করবেন না… যদি এখানে আমি জব পাই, তাহলে সেটা একমাত্র নিজের যোগ্যতাতেই আমি পেতে চাই… নচেৎ নয়…”
আমার কথা শুনে হেসে ফেলেন স্যর… মাথা নাড়েন… “ইয়েস কান্তা… ইয়েস… আমি জানতাম, তুমি এমনটাই বলবে… তাও… কি মনে হলো… ভাবলাম বলি একবার তোমায়… ঠিক আছে… আমি কাউকে তোমার কথা আগে থাকতে বলবো না… তুমি যাও… আমি জানি… তুমি তোমার নিজের যোগ্যতাতেই ঠিক অফারটা পাবে… বেস্ট অফ লাক…”
ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ওখানকার হসপিটাল থেকে দিন পাঁচেকের লীভ নিয়ে এলাম জার্মানী… এসে নির্দিষ্ট দিনে ইন্টার্ভিউ দিলাম… একেবারে প্রথম ইন্টার্ভিউতেই ক্র্যাক করলাম আমি… আলাপ হলো ডঃ মার্থার সাথে… উনি আমায় বললেন যত শীঘ্র সম্ভব এসে জয়েন করতে… আমি বললাম যে একটু তো টাইম লাগবেই… কারন আমায় ফ্রান্সে ফিরে আমার আগের হস্পিটালে নোটিস সার্ভ করতে হবে… অন্তত এক মাস সময় লাগবে এই নোটিস পিরিয়েডটা ক্রস করতে… আর তাছাড়া ওই হস্পিটাল থেকেই আমি সার্জারীতে হায়ার স্টাডিটা কমপ্লিট করেছি, তাই ওখানের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে… তাই ওখানে গিয়ে আমি হয়তো আমার রেসিগনেশন সাবমিট করে দেবো, কিন্তু ওইটুকু সময় তো আমায় দিতেই হবে…
শুনে ডঃ মার্থা বললেন, “হ্যা… তোমার রিজিউমেতে আমি দেখলাম তোমার ওখানকার হস্পিটালের উল্লেখ রয়েছে… আর তুমি যাঁর আন্ডারে তোমার স্টাডি কমপ্লিট করেছ, উনি আমার বিশেষ পরিচিত…”
“জানি ম্যাম…” আমি বলে উঠি… “এখানে আসার আগে উনিই বলেছিলেন আমার নাম আপনার কাছে উনি রেকমেন্ড করে দেবেন… কিন্তু আমিই বারন করেছিলাম… আমি চেয়েছিলাম আমি নিজের থেকে এই ইন্টার্ভিউটা ক্র্যাক করতে, কোন রকম রেকমেন্ডেশন ছাড়াই নিজের যোগ্যতাতে জবটা পেতে চেয়েছিলাম…”
শুনে খুব খুশি হলেন ডঃ মার্থা… আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বাহ!… ভেরী গুড… ইয়ু আরে সাচ আ ট্রু স্পিরিট মাই গার্ল…” তারপর একটু থেমে বললেন, “ঠিক আছে… তুমি ফ্রান্সে ফিরে যাও… তোমার রিলিজটা একটু আগে যাতে হয়ে যায়, তার ব্যবস্থাটা আমি করছি… আর আরো একটা ভালো খবর দিই তোমায়… অবস্য তুমি সেটা জানো কি না জানি না আমি… আর সেটা হলো তোমার স্যর… ডঃ ল্যুজেন… উনিও এই হস্পিটালেই জয়েন করছেন… আমাদের বিশেষ অনুরোধে…”
স্যর এখানে জয়েন করছেন শুনে ভিষন ভালো লাগলো… মনে মনে ওনার মত একজন গুরুর সান্নিধ্য হারাবো ভেবে একটু যে মন খারাপ লাগছিল না তা নয়… কিন্তু ডঃ মার্থার কথায় যেন বুকের ভেতর থেকে একটা বড় চাপ নেমে গেলো… আমি জানি, উনি আমায় ভিষন ভাবে স্নেহ করেন… তাই এখানে এসেও যে ওনার গাইডেন্স পাবো, এটার থেকে বড় পাওয়ানা যেন হয় না…
ডঃ মার্থাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসি আবার ফ্রান্সে… সেখানকার হস্পিটালে নিজের রেজিগনেশন সাবমিট করে দিই… তারপর কিছুদিন অপেক্ষা করার মধ্যেই আমার রিলিজ অর্ডার এসে যায়… আমিও আর সময় নষ্ট করি না… স্যরএর সাথে দেখা করে নিজের তল্পিতল্পা গুটিয়ে একেবারে হাজির হই জার্মানীতে… ফ্র্যাঙ্কফার্টএর হস্পিটালে… ভেবেছিলাম ভেনা বা মার্ক আমায় ছাড়বে না, কিন্তু এখানে দেখলাম এদের মানসিকতা অনেক উদার… আমার ভবিষ্যত যাতে আরো ভালো হয়, সেটাই এদের কাছে আসল কাম্য… তবুও… চলে আসার দিন সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল… যতই হোক, প্রথম এখানে আসার পরেই যে ভাবে ওরা দুজনে আপন করে নিয়েছিল আমায়… তাও… জীবন তো এই ভাবেই এগিয়ে চলে…
হাজির তো হলাম জার্মানি… কিন্তু এসেই যে থাকার জায়গা পাবো… সেটা জানতাম সম্ভব হবে না… ফ্র্যাঙ্কফার্টে চট করে থাকার জায়গা পাওয়া একটু কষ্ট সাধ্য… আছে অনেক জায়গা, কিন্তু মনের মত জায়গা পাওয়াটা একটু কষ্ট বিশেষ… তাই উঠলাম আপাতত একটা হোটেলে… এক মাসের রেন্ট আগাম দিয়ে দিলাম… দিদিমার দৌলতে আমার টাকার সমস্যা নেই… ওটা নিয়ে ভাবিও না আমি… কিন্তু খাওয়া দাওয়া!… সেটা তখন বাইরের হোটেলে বা রেস্তরায় সারতে হচ্ছে… এটা একটা সমস্যা বটেই আমার কাছে… কারন আমার অভ্যাস নিজের রান্না নিজে করে খাওয়ার… কারন আমার খাওয়ার একটু ভিরকুটি আছে… খুব একটা মসলাদার খাওয়া বা বাইরের খাওয়া পোষায় না… কলকাতায় হোস্টেলে থাকতে হয়তো সেই বাছবিচার করার সুযোগ ছিল না… কারন তখন হাতে না ছিল পয়সা, না ছিল কোন সুযোগ… কিন্তু বিদেশে আসার পরে, নিজে যেদিন থেকে উপার্যন করতে শুরু করেছিলাম, তবে থেকে চেষ্টা করেছি সব সময় খাওয়া দাওয়াটা নিয়ন্ত্রিত রাখতে… বরাবরই চেষ্টা করি তাই নিজের মত করে যা হোক একটা কিছু ফুটিয়ে নেওয়ার… ফ্রান্সএ থাকতেও ভেনা হাজার বারন করলেও সময় সুযোগ পেলেই গিয়ে হাজির হতাম রান্না ঘরে, কিছু না কিছু করে নিতাম ভেনার সাথে… কিন্তু এখানে এই ভাবে এসে তো আর সেটা সম্ভব নয়… অন্তত যতদিন না একটা মাথা গোঁজার জায়গা মেলে…
দেখতে দেখতে দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো… আসতে আসতে এই হস্পিটালের অনেকের সাথেই আলাপ হলো… বন্ধুত্ব হলো… তাতে নিজের ডিপার্টমেন্টের যেমন লোকজন আছে, তেমনই অন্য ডিপার্টমেন্টের কলিগদের সাথেও বন্ধুত্ব তৈরী হতে সময় লাগে না আমার… আর সেই সুযোগে, এখানকার প্রায় প্রত্যেককেই আমি একটাই অনুরোধ করে গিয়েছি, একটা কোথাও ভালো বাড়ি ভাড়ার খোঁজ যদি এনে দেয়… কারন জানি, এখানকার বাসিন্দাদের পক্ষেই সেটা সম্ভবপর হবে… এরাও বলেছে, দেখবে… তবে শুধু যে এদের উপরেই ভরসা রেখেছিলাম তা নয়, কাগজের বিজ্ঞাপন দেখেও বার বার বাড়ির খোঁজে ঘুরে বেরিয়েছি… শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত… কিন্তু মনের মত যেন কোথাওই পেয়ে উঠি নি কিছুতেই…
এই ভাবেই মাস শেষের দিকে প্রায় পৌছে গেলো… ততদিনে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি… কারন হোটেলে আমি আগাম এক মাসের রেন্ট দিয়েছিলাম… মাস শেষ হলেই আবার আমাকে পরের মাসের টাকা জমা করতে হবে… বাড়ি যখন নিতেই হবে আমায়, তখন শুধু শুধু হোটেলে সে টাকা ব্যয় করতে গায়ে লাগে… টাকা থাকলেই যে সেটা এই ভাবে নয়ছয় করতে হবে, সেটার পক্ষপাতী আমি নই একেবারেই… তাই এবার একটু অধৈর্যই হয়ে উঠি… মনে মনে ঠিক করি, যদি আর দিন দুইয়েক এর মধ্যে কোন খবর না আসে, তাহলে ঐ বিজ্ঞাপন দেখে যে বাড়িই পাই, তাইই না হয় আপাতত নিয়ে নেবো… তারপর পরে ভেবে দেখা যাবে’খন…
সেদিনটা ছিল বুধবার… আমার এই হস্পিটালে জয়েন করার ছাব্বিশ তম দিন… আমি ওটি শেষ করে হাত ধুতে যাবো… নার্দা… আমারই ওটির নার্স… আমায় বলল, “ডক্টর… আপনি কি এখন ফ্রি থাকবেন?”
আমি ওয়াশ বেসিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কল খুলে হাত ধুতে ধুতে বললাম, “কেন? কোন প্রয়োজন?”
আমার কথায় মাথা হেলায় নার্দা… “হ্যা ডক্টর… আপনার সাথে একজনের আলাপ করিয়ে দেবো তাহলে, যদি আপনার সময় থাকে…”
ওর কথার ধরণ দেখে মনে হলো হয়তো কোন ওর নিজের কেউ চেনাপরিচিত কাউকে আমায় দেখিয়ে নিতে চাইছে… এই রকম টুকটাক আনএনলিস্টেড পেশেন্ট তো দেখে দিতেই হয়… ওটা কোন ব্যাপারই নয়… এক সাথে কাজ করতে গেলে এই টুকু তো করতেই হবে… ততক্ষনে আমার হাত ধোয়া হয়ে গিয়েছে… গায়ের থেকে ওটির স্ক্রাবটা খুলতে শুরু করতেই নার্দা এগিয়ে এসে আমায় সাহায্য করে… তারপর সেটা খুলে দিয়ে বলে, “আসলে আপনি বলেছিলেন না ঘরের কথা… তাই…”
সত্যিই… ওটা ভুলেই গিয়েছিলাম যে নার্দাকেও একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম বটে একটা বাড়ি দেখে দেওয়ার জন্য… যাক… ওর মনে আছে দেখে খুশি হলাম… বুঝলাম, নিশ্চয় তার মানে কোন দালাল নিয়ে এসেছে… বললাম… “ঠিক আছে… আমার চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বসাও, আমি একটু রাউন্ডটা শেষ করে আসছি…”
আমার কথায় মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো নার্দা… আমিও আমার অ্যাসিস্টেন্টকে সাথে নিয়ে ওয়ার্ডের দিকে হাঁটা লাগালাম…
যখন নিজের চেম্বারে ফিরলাম, তখন বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছে… চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখি নার্দা বসে রয়েছে আমার টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে… আর পাশের চেয়ারে আর একটি মেয়ে… স্বর্ণকেশী… আমায় ঘরে ঢুকতে দেখেই দুজনেই চেয়ার ছেড়ে সসভ্রমে উঠে দাঁড়ালো…
আমি ভেবেছিলাম নার্দার সাথে কোন পুরুষমানুষ এসেছে দেখা করতে… কিন্তু এতো একটি মেয়ে… আর যেটা আরো দেখে আশ্চর্য হলাম, এই মেয়েটির পরনেও এই হস্পিটালেরই ইয়ুনিফর্ম… এবং সেটা ওটি নার্সএর ইয়ুনিফর্ম… কিন্তু আগে কখনও এই মেয়েটিকে দেখেছি বলে মনে পড়ল না… হয়তো অন্য ডিপার্টমেন্টের হবে…
ওদেরকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি হাত তুলে বসতে বলে উঠি… “আরে আরে… উঠে দাঁড়াবার কি হলো… বসো তোমরা… বসো…” বলতে বলতে গলার থেকে স্টেথোটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে টেবিল ঘুরে আমার চেয়ারে গিয়ে বসি… সামনে তখনও দেখি নার্দা আর মেয়েটি দাঁড়িয়েই রয়েছে…
নার্দা তো আমার পরিচিত… আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম ভালো করে…
আগেই ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম মেয়েটি স্বর্ণকেশী… এখন সামনে থেকে দেখলাম তাকে… মাথা ভর্তি ঘন এক ঢাল কোঁচকানো সোনালী চুল… পীঠ ছাড়িয়ে প্রায় কোমর অবধি লম্বা… মেয়েটি বেশ লম্বা… যদিও ইয়ুরোপীয়ন দেশে প্রায় প্রত্যেকেই লম্বা হয়… এই মেয়েটিও সে রকমই… প্রায় পাঁচ দশ কি এগারো তো হবেই… আমার থেকে আরো বেশ খানিকটা উচ্চতায় বেশি… আগে দেশে থাকতে নিজেকে বেশ লম্বা মনে হতো সবার কাছে, কিন্তু এখানে এসে পৌছবার পর যেন নিজেকে কেমন বেঁটে বেঁটে ঠেকে… পাঁচ আট উচ্চতাটা যেন কোন মাপই না এদের কাছে… তা যাই হোক… আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম… কি অদ্ভুত একটা সারল্য মাখা সমগ্র মুখটায়… জার্মানরা এমনিতেই বেশ সুন্দরী… আর সেখানে এই মেয়েটিকে যেন ভগবান রূপের ডালি নিয়ে বসে বানিয়েছেন… যেমন টিকালো নাক, তেমনি পাতলা ঠোঁট… নিটল গ্রীবা… চওড়া কাঁধ… ভারী বুক… ওই নার্সের ইয়ুনিফর্মের উপর দিয়েই বেশ বোঝা যায় তার সুগোল উন্নত বুকজোড়া… পাতা পেট… ভারী পাছা…
আমি হাতের ইশারায় বসতে বলি ওদেরকে ফের… এবার দুজনেই চেয়ারে বসে পড়ে… কথা শুরু করে নার্দা… “ডক্টর… এর নাম জোর্ডিয়ান স্টারস্ট্রাক… ও এই হস্পিটালেই কাজ করে…”
আমি ওর নাম শুনে মৃদু হাসি… মাথা নেড়ে বলে উঠি “হাই…” মুখে বলি, কিন্তু আমার চোখ যেন আটকে থাকে মেয়েটির মুখের উপরে… কেন জানি না… কিছুতেই আমি চোখ সরাতে পারছিলাম ওর মুখের উপর থেকে… একটা কেমন অদ্ভুত মাদকতা… একটা অদ্ভুত আকর্ষণ… ইচ্ছা না করলেও যেন চোখ আমার বার বার ওর মুখের উপরে গিয়ে আটকে যাচ্ছে… কি অদ্ভূত গভীর স্বপ্ন-নীল চোখদুটো… যেন ঘন্টার পর ঘন্টা ওই চোখের দিকে তাকিয়ে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়…
আমার ‘হাই’ শুনে মৃদু হাসে মেয়েটি… হাসি মুখে ওর মুখে ভেতরে সাজানো সাদা দাঁত গুলো দেখা যায়… প্রতিটা দাঁত যেন যত্ন সহকারে সাজিয়ে রাখা… হাসিটাও খুব মিষ্টি… হাসলে গালে দেখলাম টোল পড়ে দুটো… টকটকে ফর্সা গালে সেই টোল যেন আরো সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে… ধারালো চিবুক আরো যেন ক্ষুরধার হয়ে ওঠে…
পাশ থেকে নার্দা বলে চলে… “জোর্ডিও এই হস্পিটালে আপনার মতই খুব রিসেন্টলী জয়েন করেছে… আর সেই কারনে ও-ও একটা বাড়ির খোঁজে ছিল…” বলতে বলতে থেমে যায় নার্দা… বোধহয় খেয়াল করে থাকবে যে আমায় একটু অনমনষ্ক হয়ে পড়তে… “ডক্টর… আপনি শুনছেন…”
নার্দার কথায় সম্বিত ফেরে আমার… এই ভাবে ওর পরিচিতের দিকে আমার তাকিয়ে থাকা উচিত হয় নি… আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিই… “হ্যা হ্যা… বলো… শুনছি…” খানিকটা যেন প্রায় জোর করেই আমি জোর্ডির মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকাই নার্দার দিকে… যদিও মন যেন আরো চাইছিল জোর্ডির আপদমস্তক রূপ পান করে যেতে… আমি জীবনে অনেক মেয়ে পুরুষ দেখেছি… মিশেছি… সংসর্গও করেছি… কিন্তু এই ভাবে প্রথম দর্শনেই আমার মনের কোনে নাড়া দিয়ে কেউ যায় নি কখনও… এটা কেন হচ্ছে আমার? নিজেরই অস্বস্থি হয় অদ্ভুত ভাবে নার্দার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে… ঠিক যেন সেই প্রথম যৌবনের ক্রাশকে দেখে নিজের জ্ঞানবাহ্য হারিয়ে ফেলা… ছি ছি… আমি একজন সার্জন ডাক্তার… আমায় কি এই রকম ছেলেমানুষি মানায়?
আমার গলার স্বরে চোখ তুলে তাকায় স্বর্ণকেশী… আহ! কি অদ্ভুত গভীর সে দৃষ্টি… আমি প্রায় জোর করেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাই নার্দার দিকে… “বলো তুমি… আমি শুনছি…”
নার্দা ফের বলতে থাকে… “ও… মানে জোর্ডি ইতিমধ্যেই একটা বাড়ি দেখেছে… ওখানে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ওরা ভাড়া দেবে, কিন্তু ভাড়াটা অনেকটাই বেশি… ও এখানে যা পায়, তাতে ওর পক্ষে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া সম্ভবপর নয়… এদিকে আপনি বলার পর আমিও অনেককেই বলে রেখেছিলাম বাড়ির কথা… তা যা বুঝলাম তাতে ওটা আপনার পছন্দ হলেও হতে পারে…” বলে থামে নার্দা… তারপর বলে, “আপনি কি দেখবেন সেটা? কারন আপনি হয়তো এফোর্ড করতে পারবেন ওটার ভাড়া…”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “বেশ তো… দেখতে ক্ষতি কি? আর আমার আজকে আর কোন ওটি নেই… তাহলে সেকেন্ড হাফএ বেরিয়ে একবার দেখে এলেই হয়…”
শুনে নার্দা বলে, “সেই ভালো… আর সেই কারনেই জোর্ডিকে নিয়ে এসেছি… কারন আমার অফ নেই… এর পর ডঃ হেরমুটএর একটা ওটি আছে… ওনাকে অ্যাসিস্ট করতে হবে… তবে ওর, মানে জোর্ডির মর্নিং ডিউটি ছিল, ওর এখন অফ হয়ে গেছে, তাই ও পারবে আপনার সাথে গিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিতে…”
জোর্ডির সাথে যাবো শুনে ভালো লাগলো আমার… আমি মুখ ফিরিয়ে ওকে বলতে গিয়ে দেখি ও এক দৃষ্টিতে আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে… নাকি সেটা আমারই মনের ভুল ছিল! কে জানে… হয়তো আমিই মনে মনে একটু বেশিই আকৃষ্ট বোধ করছি বলে মনে হলো সেটা… আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিই… ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে ধরে বলে উঠি… “থ্যাঙ্ক ইয়ু জোর্ডি…এই হেল্পটা করার জন্য…” ওর হাতটা ধরি… মনে হয় কি অদ্ভুত মসৃণ হাত ওর… ওও যেন আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাল্কা চাপ দেয়… বেশ লম্বা সরু সরু আঙুলগুলো… নখগুলো সুন্দর করে পরিচর্যা করা… মেরুন নেলপালিশে রাঙানো… ফর্সা হাতে মেরুন রঙটা বেশ ভালো মানিয়েছে…
সব কিছু গুছিয়ে বেরুতে আরো খানিকটা সময় কেটে গেলো… নার্দার ওটি ছিল, তাই ও চলে গিয়েছিল এর পর, জোর্ডিকে বললাম রেডি হয়ে আমার চেম্বারেই চলে আসতে… সেই মত ড্রেস চেঞ্জ করে ফের ফিরে আসে ও… এবারে দেখি একটা গাঢ় বাদামী রঙএর স্কার্ট আর ঘীয়ে রঙা ব্লাউজ পরেছে… তাতে যেন আরো সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে… ওর সুগোল মাইদুটো যেন ব্লাউজের নীচ থেকে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে… হাঁটার ছন্দে ওর ভারী পাছার নাচন দেখার মত… সুঠাম সুগঠিত লম্বা পা… আমি যেন আরো একবার নতুন করে দেখে মহিত হয়ে গেলাম…
হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাব বুক করে চলে এলাম জোর্ডির বলা ঠিকানায়… জায়গাটা Rödelheim এ, আমাদের হস্পিটাল থেকে পনেরো ষোল কিলোমিটার দূরত্ব… ক্যাবে লাগলো মিনিট কুড়ি মত… অবস্য রাস্তায় ট্র্যাফিক সেই সময় একটু হাল্কাই ছিল… দেখি বেশ পশ এলাকাটা… যথেষ্ট সবুজ চারিধার… ফ্র্যাঙ্কফার্টএর মত এত বানিজ্যিক একটা শহরের পাশেই এই রকম একটা সুন্দর জায়গা দেখে ভালো লাগলো… দূরত্বটাও একটা ফ্যাক্টর বটে… আমার হস্পিটাল যাতায়াত খুব সুবিধার হবে এখানে যদি পাওয়া যায়… এই ভাবতে ভাবতেই ক্যাবের ভাড়া মিটিয়ে নামলাম… এগিয়ে গেলাম ঠিকানা লক্ষ্য করে… দেখি একটা পুরানো বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি… বেশ বড়… পরে জেনেছিলাম এই বাড়ির মালিক পারিবারিক সম্পত্তিতে পেয়েছিল এটা… সে যাই হোক… সেটা আমার বিচার্য নয়… কিন্তু বাড়িটা দেখে বেশ লাগলো আমার… দেওয়াল ইঁটের… বাকি সব কাঠের… দেখে আমার ইংল্যান্ডের মামার বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়… তাই ফার্স্ট ইম্প্রেশনটাই ভালো লাগে… আমরা এগিয়ে গিয়ে দরজার বেল টিপতে ভিতর থেকে মালকিন বেরিয়ে এলেন… ষাটোর্ধ বয়েস হবে… সাথে ওনার হাজবেন্ড…
কথা জোর্ডিই শুরু করল… যতই হোক, ও জার্মান… তাই ও যতটা নিজের মাতৃভাষায় সড়গড়, ততটা তো আর আমি জানলেও নই… এটা তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার… আমরা বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছি শুনে ভিতরে নিয়ে গেলেন… তারপর যখন শুনলেন যে আমি ডাক্তার… শুনে খুব খাতির… রীতি মত সাদর আপ্যায়ন যাকে বলে আরকি… গড়গড়িয়ে নিজেদের বিস্তারিত পরিচয় দিতে শুরু করে দিলেন ভদ্রমহিলা… ওনার দুই মেয়ে ও এক ছেলে… কেউই নাকি বাড়িতে থাকে না… সকলেই শহরের বাইরেই জব করে… তার মধ্যে ছেলে আবার এই দেশেই নেই… ইত্যাদি ইত্যাদি… শুনে যা বুঝলাম, বেশ ভালো মানুষ এনারা দুজনেই… ঝামেলা ঝঞ্ঝাট কিছু নেই… সদা হাস্যময়ী… ওনারা একতলাতেই থাকেন… উপর তলাটা তিন ছেলে মেয়ের, কিন্তু ওরা যেহেতু এখন আর এখানে থাকে না, তাই ওপরটা অব্যবহৃতই থেকে গিয়েছে… বয়স হচ্ছে, তাই সব কিছু দেখাশুনা করে উঠতে পারেন না ওনারা আর… সেই কারনেই ভাড়া দিয়ে দিতে চান, অন্তত তাতে ওনাদের একাকিত্বও ঘুচবে, আর সেই সাথে বাড়িটাও ব্যবহার হবে… কথায় কথায় আমাদের উপরে নিয়ে এলেন… ছেলে মেয়েদের ঘর দেখালেন… তারপর ওই তলাতেই শেষের দিকে একটা বড় ঘর দেখিয়ে বললেন যে এটাই ওনারা ভাড়া দিতে চান…
আমি আর জোর্ডি ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম… বেশ বড় ঘরটা… আলো হাওয়াও প্রচুর… সেইসাথে দেখলাম একটা অ্যাটাচড্ বাথও রয়েছে… সাথে একটা সিঙ্গল স্টুডিও টাইপের রান্না করার জায়গা… ওপেন কিচেন আর ডাইনিং স্পেস… ঘরের মধ্যে ফায়ারপ্লেসও রয়েছে… ওনারা বললেন যে আগে এখানে গেস্ট এলে উঠত… এখন আর ব্যবহার হয় না…
চারটে বিশাল জানলা… সেই সাথে সমস্ত আসবাব পত্রও রয়েছে… মানে আলাদা করে ফার্নিশিং করার প্রয়োজন নেই একদম… আলমারি, সোফা সেট, কফি টেবিল, স্টাডি টেবিল, দেওয়ালগুলো বেশ দামী ওয়েল পেংটিং দিয়ে সাজানো… আর ঘরের মাঝে একটা বিশাল কিংসাইজের খাট… আমি তো মনে মনে লুফে নিলাম একেবারে… এই রকমটাই তো খুঁজছিলাম… একেবারে স্বর্গ… ভদ্রমহিলার সাথে দরদাম করলাম… মোটামুটি রিসিনেবল্… এই ধরণের বাংলোর যেমন ভাড়া হওয়া উচিত একেবারে সঠিক দাম… আমি একেবারে তখনই বলে কন্ট্র্যাক্ট পেপারে সই সাবুদ সেরে ফেললাম… বললাম যে আমার জিনিস পত্র আমি নিয়ে আজকেই হোটেল থেকে চলে আসছি তাহলে… শুনে ভদ্রমহিলাম বললেন আমাদের একটু বসতে… উনি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছেন… বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে…
সত্যি বলতে এই এতক্ষন আমি ঘর দেখার আর পাওয়ার আনন্দ ভুলেই গিয়েছিলাম জোর্ডির কথা… ভদ্রমহিলা চলে যেতে আমার হুস ফেরে… তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে তাকাই জোর্ডির দিকে… দেখি সোফার এক কোনে চুপ করে বসে রয়েছে ও… মুখটা ম্লান… আমার সাথে চোখেচুখি হতে মৃদু হাসলো… ফের সেই গালের টোল…
আমি এগিয়ে গিয়ে বসে থাকা জোর্ডির পাশে গিয়ে দাঁড়াই… ওর কাঁধে হাত রাখি… ও মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে… ওর মুখটা দেখে মনে হয় যেন ওর মনের মধ্যে একটা চিন্তা বাসা বেঁধে রয়েছে যেন… আমি গাঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করি, “কোন প্রবলেম? একটু অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে তোমায়…”
ও আমার প্রশ্নে তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ে… “আরে না না… কোন প্রবলেম নয়… বরং তোমার জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেলো, কন্ট্র্যাক্ট সই হয়ে গেলো… এর থেকে আনন্দের খবর আর কি হতে পারে? নার্দা শুনলে খুশি হবে ভারী…”
ও কথাগুলো বলল বটে, কিন্তু গলার স্বর থেকে সেই দুশ্চিন্তার মেঘ যেন সরে যায় না…আমি ওর সামনে মেঝেতেই হাঁটু মুড়ে বসে ওর থাইয়ের উপরে হাত রেখে তাকাই ওর পানে… “তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করছ?” প্রশ্ন করি ওকে…
“না… আসলে আমাকেও দেখতে হবে কিছু… কিছুটা সস্তার… কারন আমাকেও যেখানে আছি এখন, সেখানটা ছাড়তে হবে যত শিঘ্র সম্ভব… ওখানের টাকাটা বড় বেশি লাগছে… তাই আর কি…” তারপরেই ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে আমায় বলে ওঠে, “ওটা ছাড়ো… আমার ব্যাপারটা নিয়ে ভেবো না… তোমার হয়ে গিয়েছে… এটাই দারুন কথা… কঙ্গ্রাচুলেশনস…”
আমি ওর থাইয়ে মৃদু একটা চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াই ফের… ধীর পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়াই খোলা জানলার সামনে… জানলার ওপারেই একটা বিশাল রডোডেন্ড্রণ গাছ… সবুজ পাতায় ভরা… ফুলের সিজিনে নিশ্চয় ওটা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে… দেখি গাছটাকে, কিন্তু মাথার মধ্যে জোর্ডির চিন্তান্নিত মুখটা ভাসে… সত্যিই তো… ও তো চাইলে আমায় ঠিকানাটা দিয়েই পাঠিয়ে দিতে পারতো… কিন্তু আমি যে হেতু জার্মান নই, তাই সাথে করে নিয়ে এসেছে এখানে… ঘর দেখাতে… এতে ওর তো কোন স্বার্থই নেই… তাও এসেছে… শুধু মাত্র আমার যাতে সুবিধা হয়… অথচ ও জানেও যে এই এত ভাড়া দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়… এই ধরনের কোন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া ওর কাছে অবিশ্বাস্য… নাগালের অনেক দূর… তাও এসেছে… কারন মানুষ হিসাবে মেয়েটা সত্যিই ভালো… আমি মনে মনে ডিসিশন নিয়ে নিলাম…
কফি নিয়ে ভদ্রমহিলা আসতেই আমি ওনাকে বললাম, “আন্টি… আপনাকে একটু কষ্ট দেবো আর একবার…”
শুনে ভ্রূ কোঁচকান ভদ্রমহিলা, আমার কথার বক্তব্য ধরতে না পেরে…
আমি বলি, “যে এগ্রিমেন্টটা এখুনি আমাকে দিয়ে সই করালেন, ওটা একবার আনতে হবে… ওখানে আরো একটা নাম ঢুকবে আর সইও হবে…”
“মানে তোমার সাথে কি আর কেউ ভাড়া নেবে?” একটু আশ্চর্য হয়েই প্রশ্ন করেন ভদ্রমহিলা…
আমি হেসে বলি, “হ্যা… আরো একজন কো-টেনেন্ট থাকবে, তবে ভাববেন না… ভাড়াটা আমিই দেবো… তবে লিগালী সেও ভাড়াটে হবে আপনার…”
ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করেন… “সে কি তোমার কেউ?”
আমি হেসে ফেলি ওনার কথায়… বলি… “সেই মতই মনে করুন না… আমার বিশেষ কেউ…” তারপর জোর্ডির দিকে আঙুল তুলে দেখি বলি… “ও… জোর্ডিয়ান স্টারস্ট্রাক… ওর নামটাই ঢোকাতে হবে আপনাকে… আপনি বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে ওর পুরো পরিচয় পান নি এখনও…”
আমার কথায় মাথা নাড়েন ভদ্রমহিলা…
আমি বলি, “জোর্ডি আর আমি একই হস্পিটালএ চাকরি করি… আমি ডক্টর আর ও ওটি নার্স… তাই আমরা এক সাথেই থাকবো আপনার বাড়িতে… যদি অবস্য আপনার আপত্তি না থাকে… না হলে আমার পক্ষেও এখানে ভাড়া নেওয়া সম্ভব হবে না…”
ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই হাঁ হাঁ করে দৌড়ে আসে জোর্ডি… আমার হাত দুটো ধরে নিয়ে হাউমাউ করে ওঠে ও… “একি বলছ ডক্টর… আমার জন্য তুমি কেন এই রকম একটা বাড়ি ছেড়ে দেবে? আর তুমি তো জানো… আমার পক্ষে এত ভাড়া শেয়ার করা সম্ভব হবে না… আধা আধি হলেও… প্লিজ ডক্টর… তুমি এটা কোরো না… এটা আমার রিকোয়েস্ট…”
আমি ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জোর্ডির কাঁধে রাখি… শান্ত গলায় বলি, “তোমায় কে বলেছে যে তোমায় ভাড়া শেয়ার করতে হবে? ওটা আমার উপরেই ছেড়ে দাও না… আমার মুখের উপরে কথা বলা কিন্তু আমি একদম পছন্দ করি না… জানো সেটা?” তারপর হেসে বলি, “তোমায় কিচ্ছু বলতে হবে না… চুপ করে বসো গিয়ে সোফায়… আমি যা বলার আন্টির সাথে বলছি…”
ছলছলিয়ে উঠল জোর্ডির চোখ… অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে…
আমি ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে বললাম, “আন্টি… আপনার কোন আপত্তি নেই তো?”
ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন… “আপত্তি কি বলছ মেয়ে? আমার বাড়িতে একজন ডক্টর আর একজন নার্স থাকবে, আর তাতে আমার আপত্তি হবে? এটা তো আমার পরম সৌভাগ্য…” তারপর হেসে জোর্ডির গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “গড ব্লেস ইয়ু মাই চাইল্ড… তোমরা বোসো… আমি এগ্রিমেন্ট কপিটা নিয়ে আসছি নীচ থেকে…” বলে হন্ত দন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে…
আন্টি বেরিয়ে যেতেই হাত বাড়িয়ে আমার হাতটাকে ফের নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নেয় জোর্ডি… চোখ ভর্তি জল… বলে ওঠে সে… “ডক্টর… তুমি…” বলতে বলতে আবেগে গলা বুজে আসে জোর্ডির… কথা শেষ করতে পারে না সে…
আমি ম্লান হেসে বলি, “কি? কি হলো তোমার আবার?” চাপ দিই ধরে থাকা হাতের মুঠোয়…
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় জোর্ডি… তারপর একটু সামলে নিয়ে ফের বলে ওঠে… “অনেক… অনেক ধন্যবাদ ডক্টর… আমি যে কি ভাবে তোমার এ ঋণ শোধ করব জানি না… আমার এই বাড়ির যা ভাড়া, তার অর্ধেক দেওয়ারও ক্ষমতা নেই… তাও তুমি আমায় এই ভাবে সাহায্য করলে…”
আমি হেসে ফেলি ওর কথায়… “আরে বাবা… কে চেয়েছে তোমার থেকে ভাড়া? হু?… আর তাছাড়া তুমি কি ভাবছ? আমি এমনি এমনি তোমায় আমার সাথে থাকতে দেবো?”
আমার কথায় ওর চোখে একটু বিশ্ময়ের ছোঁয়া লাগে… জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে… আমি বলি, “আমি ভাড়া দিলাম, আর তুমি আমার সাথে থাকবে… ব্যস… আমারও আর একা লাগবে না, আর তুমি বাড়ির যে অন্যান্য কাজ, যেমন রান্না করা, বাজার করা… সেগুলো না হয় সামলে দিও… যদিও আমিও নিজেও রান্নায় হাত লাগাবো সময় থাকলে, কিন্তু ওই ডিপার্টমেন্টটা সম্পূর্ণ তোমার থাকবে… কি তাতে হবে তো?”
আমার কথায় আরো কেঁদে ফেলে জোর্ডি… জোরে জোরে মাথা নাড়ায় সে… “নিশ্চয়… নিশ্চয় হবে ডক্টর… এ নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না… আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তোমার সমস্ত কাজ করে দেওয়ার…”