দ্বিতীয় অংক [পার্ট ৩]

Written by Pinuram

দশম পর্বঃ নোনাধরা প্রাচীর। (#1)
এপ্রিলের মাঝামাঝি বুধাদিত্য দুই সপ্তাহের জন্য অস্ট্রেলিয়া যায় অফিসের কাজে। সমীর ঝিলাম দুজনেই ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিল। সেই নিয়ে বুধাদিত্যের কি হাসি, বলে ওকি অগস্ত্য যাত্রা করছে নাকি যে একেবারে দল বেধে ছাড়তে এসেছে। অগস্ত্য যাত্রার কথা শুনে ঝিলামের চোখ ছলছল করে ওঠে। সমীর না থাকলে ঝিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে বলত, যে ওইরকম কথা বলতে নেই। যাবার আগে ঝিলাম বারবার ওকে জানায় যে ওখানে পৌঁছে অন্তত একটা এস.এম.এস যেন করে দেয় যে ঠিক করে পৌঁছে গেছে, আর যেন ওর ঘুমের ব্যাঘাত না করে। অপেক্ষা করে থাকবে ওর পৌঁছানর খবরের জন্য। বুধাদিত্য ওকে জানিয়ে দেয় যে পৌঁছে ফোন করে দেবে। বুধাদিত্য মেলবোর্ন পৌঁছেই ফোন করেছিল। ভোরেরবেলা মেলবোর্ন পৌঁছায়, তখন ঝিলাম ঘুমিয়েছিল, মাথার কাছেই ফোন রেখে দিয়েছিল। এক ডাকেই ফোন ধরে ঘুম ঘুম চোখে ওকে বলে, “ভালো করে পৌঁছে গেছ? এবারে আর আমাকে জ্বালাতন করো না একটু ঘুমাতে দাও।” বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর ঘুম জড়ানো মিষ্টি গলার আওয়াজ শুনে। হাজার মাইল দূর থেকে সেই গলার আওয়াজ শুনে ফোন বুকের কাছে ধরে বুধাদিত্য। এখানে ওকে কেউ দেখতে যাচ্ছে না, ও কি করছে। মোবাইলে ওর ছবিটা খুলে একবার দেখে ছোটো একটা চুমু খায়।
সিডনি থেকে সমীরের জন্য একটা জিন্স কেনে আর ঝিলামের জন্য একটা ভারসাসের কাঁধের ব্যাগ কেনে। তার সাথে ঝিলামের জন্য একটা হাল্কা বেগুনি রঙের খুব সুন্দর ইভিং গাউন কেনে। মনের কোনায় সযত্নে একটা স্বপ্ন একে নেয়, ভবিষ্যতে কোনদিন এই গাউন ঝিলামকে পরাবে, তবে সমীরের সামনে নয়। সেদিন শুধু ঝিলাম আর বুধাদিত্য থাকবে, জানেনা সেইদিন কোনদিন আসবে কি না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি নেই। ফিরে এসে এয়ারপোর্টে নেমেই সমীরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দিল্লী পৌঁছে গেছে। সমীর আর ঝিলাম দুজনেই ওর বাড়িতে এসেছিল সেইদিন বিকেলবেলায়। সমীর আর ঝিলাম ওর আনা উপহার পেয়ে খুব খুশি, সমীরের জন্য আলাদা করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছিল এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি দোকান থেকে। ইচ্ছে করেই মদ কেনেনি, কেননা ঝিলামকে কথা দিয়েছিল।
দিনেদিনে সমীরের অফিসের কাজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই অফিসের ট্রিপে বাইরে চলে যায় একদিন দুদিনের জন্য। ঝিলাম সেই নিয়ে বিশেষ কথা বাড়ায় না, কেননা কাজের জন্য যায় সমীর। একদিন অস্ত্রেলিয়া থেকে এক ক্লায়েন্ট আসে, বুধাদিত্য আর সি.টি.ও তাকে নিয়ে লাঞ্চে বের হয়, হোটেল সাংরিলা, অরিয়েন্টাল এভিনিউ’তে। দিল্লীর বেশ নামী দামী হোটেল। তিনজনে বসে নিজেদের কাজে গল্পে মশগুল হটাত চোখ পরে দুরে একটা টেবিলে। পেছন থেকে দেখে মনে হয় যেন লোকটাকে কোথায় দেখেছে। লোকটার সামনে এক সুন্দরী মেয়ে বসে। দুজনের হাবভাব আচার আচরনে দেখে মনে হল বেশ ভালভাবে পরস্পরকে চেনে আর বেশ হেসে কথা বলছে দুজনে। কিন্তু বুধাদিত্যের চোখ আটকে থাকে সেই লোকটার দিকে। ওর দিকে পিঠ থাকার দরুন মুখ দেখতে পায়না। পেছন থেকে সমীরের মতন দেখতে। বাথরুমে যাবার আছিলায়, ঝিলামকে ফোন করে জানে যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে কোন অফিসের কাজে। কিছু বলেনা বুধাদিত্য, বাথরুম থেকে বেড়িয়ে সেই লোকের মুখোমুখি হয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পরে সমীর, যেন ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে, সামনে বুধাদিত্য। বুধাদিত্য চুপ করে একবার ওর লাল মুখের দিকে তাকায় আর দুরে টেবিলে বসা সেই মেয়েটার দিকে তাকায়। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে যে সেই মেয়েটা কে? সমীর আমতা আমতা করে জানায় যে অফিস কলিগ। বুধাদিত্য ওকে জানতে দেয় না যে ঝিলামের কাছে আগে থেকেই সমীরের আহমেদাবাদ যাবার খবর আছে। শুধু একটা কথা বলে চলে যায়, মিথ্যেটা না বললেই ভালো হত। বলে যে, পরে এই নিয়ে কথা হবে। সমীরের যেন বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। বুধাদিত্যের দিকে এক পা এগিয়ে হাত ধরতে যায়, কিন্তু ততক্ষণে বুধাদিত্য নিজের টেবিলে গিয়ে বসে পরে। ঝিলামকে এইসব কথা কিছুই জানায় না। ভাবে একবার সোজা সমীরের সাথে কথা বলে দেখবে আগে।
একদিন দুপুরে ঝিলাম অফিসে না ঢুকে ফোন করে বুধাদিত্যকে নিচে আসার জন্য। গলার স্বরে একটু আহতভাব। নিচে নেমে দেখে যে ঝিলাম বাইরে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। অন্যদিনে রিসেপ্সানে বসে থাকে, পেপার বাঁ কোন ম্যাগাজিন পড়ে যতক্ষণ না বুধাদিত্য নেমে আসে। ঝিলামের মুখের ভাব দেখে বুঝে যায় যে সমীরের সাথে হয়ত কোন বিষয়ে মনমালিন্য ঘটেছে। গাড়ি চেপে বাড়ি ফেরার সময়ে ঝিলাম অস্বাভাবিক ভাবে চুপ। বুধাদিত্য আড় চোখে ওর দিকে তাকায় আর গাড়ি চালায়।
ঝিলামের উচ্ছল গলার আওয়াজ না পেয়ে বড় আহত হয়, জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে? সমীরের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
ঝিলাম মাথা দুলিয়ে বলে, “কই না ত।” ঠোঁটে জোর করে হাসি টেনে বলে, “কেন আমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নাকি?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “তোমার চোখ মুখ বলছে যে কিছু একটা ঘটেছে আর সেটা সমীরের সাথেই। কি হয়েছে আমাকে বলবে না?”
ঝিলাম একটু আহত গলায় বলে, “একটু দেরি করে অফিসে ফিরলে তোমার অসুবিধে আছে?”
বুধাদিত্য গাড়ি ঘুড়িয়ে নেয় অফিসের দিকে। ঝিলামের ম্লান চেহারা বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন কি হয়েছে?”
ঝিলাম নিচু স্বরে বলে, “জানো, কাল ওর একটা ক্রেডিট কার্ডের বিল এসেছিল। সেটা খুলে দেখেছি বলে কত কথা শুনিয়ে দিল আমাকে। আমি যেন ওর কেউ না, এমন একটা ভাব দেখাল সমু।” চোখের কোল ভিজে এসেছে ঝিলামের। “মাঝে মাঝে আজকাল কি রকম আলগা আলগা ব্যাবহার করে আমার সাথে। আজকাল আবার মদ খাওয়া ধরেছে, কিছু বলতে গেলেই রেগে যায়।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ঝিলামের কথা শুনে। অফিস পৌঁছে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরে। বাড়ি না ফিরে ওকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে ফাঁকা এন.এইচ-১ হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম চুপ করে পাশে বসে থাকে, কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। বিকেল গড়িয়ে আসে, দুজনে চুপ। ঝিলামের বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়।
বুধাদিত্য ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সমীরকে সোজাসুজি প্রশ্ন কেন করছ না?”
ঝিলাম ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “কি জিজ্ঞেস করব?”
বুধাদিত্য, “সোজাসুজি জিজ্ঞেস কর, যে ওর কি কাউকে মনে ধরেছে নাকি?”
বুধাদিত্যের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ঝিলাম। সমীর ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে, না ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্যকে বলে, “না না, এটা নয়, হয়ত ওর কাজের জন্য খুব ব্যাস্ত থাকে তাই হয়ত মাঝে মাঝে মদ খায় আর রাত করে বাড়ি ফেরে।”
বুধাদিত্য, “একবার জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে।”
ঝিলাম, “তোমার ত বন্ধু, তুমি না হয় একবার জিজ্ঞেস কর।
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, একবার সমীরকে হাতেনাতে ধরতে হবে, প্রমান যোগাড় করে ওর সামনে দাঁড়াতে হবে। না হলে সমীর প্রতিবারের মতন কিছু না কিছু আছিলায় এড়িয়ে যাবে বুধাদিত্যের প্রশ্নবান আর কোন এক গল্প বানিয়ে বলে দেবে। ঝিলামের মন ভোলানোর জন্য ওকে জিজ্ঞেস করে স্কুলের কথা, বাড়ির কথা। বাড়ির জন্য শপিং করেছিল কিন্তু বাড়ি যাওয়া হয়নি। ঝিলাম ভেবে রেখেছে যে গরমের ছুটিতে দুর্গাপুর যাবে। অবশ্য সে কথা এখন সমীরকে জানায়নি, তবে ইচ্ছে আছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। ঝিলাম সমীরকে ফোন করে কিন্তু ফোন রিং হয়ে যায়। ঝিলাম বার কয়েক ফোন করার পরে আর করে না। ঝিলামে কে নামিয়ে দেবার পরেও ঝিলাম দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। ঝিলাম ওকে ঘরে আসতে বলে। ঝিলামের মুখ দেখে বুধাদিত্য আর পিছিয়ে থাকতে পারে না। গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ওর সাথে হাঁটতে শুরু করে। ঝিলাম কিছু কেনাকাটা করে, বুধাদিত্য ওকে সেই সব ব্যাগ নিতে সাহায্য করে। পাশে বুধাদিত্যকে পেয়ে ঝিলামের মনে যেন একটু বল আসে। বাড়িতে ঢুকেই আগে বুধাদিত্যের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে আনে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে ঝিলামের মন একটু হাল্কা হয়। বুধাদিত্য বাড়ি ফিরে যায়।
দশম পর্বঃ নোনাধরা প্রাচীর। (#2)
বুধাদিত্য একদিন সমীরকে সোজাসুজি ফোনে জিজ্ঞেস করে হোটেল সাংরিলায় দেখা মেয়েটার কথা। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে সমীর। বুধাদিত্য চেপে ধরে সমীরকে কোন ঠাসা করে বলে দেয় যে সেদিন ঝিলামকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে সমীর নাকি আহমেদাবাদ গেছে। সমীর ধরা পরে যায়, বিকেলে দেখা করার কথা বলে। বিকেলে দেখা হয় দুই বন্ধুর। বুধাদিত্যকে সমীর জানায় যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ওদের বম্বের অফিসের একজন। বুধাদিত্য ঠিক মানতে পারে না, পাল্টা জিজ্ঞেস করে যে, যদি অফিস কলিগ হয়ে থাকে তাহলে কেন এত লুকোচুরি, কেন ঝিলামকে বলেছিল যে আহমেদাবাদ যাচ্ছে? সমীরের কাছে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর থাকে না। বুধাদিত্য ওকে সাবধান করে দেয়, বলে যে, নারীসঙ্গ করছ কর, বুধাদিত্য নিজে কিছু কাল আগে পর্যন্ত অনেকের সাথে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু কাউকে মনে ধরলে যেন একবার ভেবে দেখে সমীর, ঘরে একজন বউ আছে। সমীর চুপ করে ওর কথা শুনে যায়। শেষে জানায় যে শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক আছে সেই মেয়েটার সাথে। বুধাদিত্য জানতে চায় সেই মেয়েটার নাম আর ঠিকানা, সমীর এড়িয়ে যায়। বলে যে একদিনের দেখা, এত প্রশ্ন বাণে কেন জর্জরিত করছে? সব ভুলে এবার নতুন করে ঝিলামকে কাছে টেনে নেবে সমীর। বুধাদিত্য ওকে বাড়ি ছাড়ার আগে শেষ বারের মতন সাবধান বানী দেয়।
সেদিনের পরে ঝিলামের মুখে আবার হাসি ফিরে আসে। সমীর মাঝে মাঝেই আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, ঝিলামকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজারে বের হয়। ঝিলাম বেশ খুশি সমীরের আচরনে। ঝিলামের অফিসে হানা দেওয়া একটু কমে গেছে। আগে যেখানে পাঁচ দিনে চারদিন হানা দিয়ে আব্দার করত বাড়ি পৌঁছে দাও সেখানে আজকাল হয়ত দু’দিন অফিসে আসে। সমীর নতুন বাইক কিনেছে, মাঝে মাঝই ঝিলামকে স্কুল থেকে নিতে আসে। সমীর ঝিলামকে নিতে আসলে মাঝে মাঝে দু’জনে মিলে বুধাদিত্যের সাথে দেখা করে যায়। ঝিলামের মুখে হাসি দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আলমারি খুলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা সেই ইভিনিং ড্রেস টা দেখে আর ম্লান হাসে। মনের মধ্যে যে স্বপ্ন গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেটা হয়ত এই যাত্রায় আর সফল হবে না। সমীরের এই আচরনে বুধাদিত্যের ভাল লাগে তবে মনের কোনে একটু ব্যাথাও জাগে।
এক মাস কেটে যায়। সমীর আর ঝিলামের সাথে দেখা সাক্ষাৎ অনেক কমে যায়। ঝিলাম মাঝে সাঝে ফোন করে, খবরা খবর নেয়। বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায় ঝিলাম, মনে মনে বোঝে যে সমীরের সাথে নিশ্চয় বুধাদিত্য কথা বলেছে তাই সমীর বদলে গেছে।
দেশের খুব বড় একটা মোবাইল অপারেটারের সাথে মিটিং করতে একবার পুনে যায় বুধাদিত্য, দিন দুয়েকের কাজ। এবারে যাবার আগে ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোন কথা হয়না। রাতের বেলা কাজের শেষে একদিন বুধাদিত্য অফিসের বাকি লোকদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায় কাজের খুশিতে পার্টি দেবার জন্য। সেখানে সমীরের মুখোমুখি হয়। বুধাদিত্য প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায় সমীরকে দেখে, জিজ্ঞেস করে কি কারনে পুনেতে? যথারীতি সমীর এক উত্তর দেয় যে অফিসের কাজে এসেছে। রাতের বেলা ঝিলামকে ফোন করে জানতে পারে যে সমীর পুনে গেছে অফিসের কাজে। অনেকদিন পরে ঝিলাম ওর গলার আওয়াজ পেয়ে খুব খুশি হয়, জানায় যে সমীর অনেক বদলে গেছে নাকি। তবে আজকাল অফিসের কাজে হামেশাই বাইরে থাকে। একটু সন্দেহ হয় বুধাদিত্যের, কিছু বলে না, শুধু জানায় যে সমীরের সাথে দেখা হয়েছে ওর। সেটা শুনে ঝিলাম একটু অবাক হয়ে যায়। বুধাদিত্যকে জানায় যে কিছু আগে নাকি সমীরের সাথে কথা হয়েছিল, কিন্তু ওদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে সমীর ওকে কিছুই জানায় নি। সমীরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি যে কোন হোটেলে উঠেছে না হলে একবার দেখা করে আসত বুধাদিত্য। ঝিলামের কথা শুনে ওর নাকে একটা সন্দেহের গন্ধ আসে। সমীর খুব বড় একটা খেলা খেলছে ঝিলামের সাথে।
পরেরদিন ভাগ্যবশত সমীরের সাথে একটা চাইনিজ রেস্তুরেন্টে দেখা হয় বুধাদিত্যের। এবারে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে যে ওর সাথে সেই মেয়েটা যাকে ও হোটেল শাংরিলতে দেখেছে। সমীরের ওপরে যা সন্দেহ করেছিল সেটা চোখে দেখে প্রতীত হয় যে সমীর অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে নিজের মোবাইলে। একটা ভিডিও তুলে নেয়, যেখানে সমীর বেশ গা এলিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে গল্প করছে, কাঁটা চমচে নুডুলস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বেশ হাত ধরে আছে সমীরের, দেখে মনে হল ওদের প্রেম অনেক গভীর খাদে বয়ে চলেছে। চোখের সামনে ঝিলামের চেহারা ভেসে ওঠে। খাবার পরে বুধাদিত্য সোজা ওদের টেবিলে যায় আর সমীরের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সমীর ওকে দেখে ভুত দেখার মতন থমকে যায়। এবারে হাতেনাতে ধরা পরে গেছে সমীর। পাশে বসা মেয়েটা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। বুধাদিত্য সমীরকে বাইরে ডাকে কিছু কথা বলার জন্য।
বাইরে যেতেই বুধাদিত্য সমীরকে চেপে ধরে, “কি ব্যাপার একটু খোলসা করে জানা আমাকে।”
সমীর একটু রেগে যায় ওর কথায়, “তোর সব ব্যাপারে মাথা গলাবার কি দরকার। আমি আমার জীবন নিয়ে কি করব না করব সেটা তোকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চোখের সামনে ঝিলামের হাসি মাখানো মিষ্টি মুখ ভেসে ওঠে। সমীরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসে ঝিলাম। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরকে বলে, “তোদের দুজনকে দেখে ত মনে হয় না যে তোদের সম্পর্ক শুধু মাত্র শারীরিক। মানসিক দিক থেকেও তুই ওই মেয়েটার দিকে ঝুঁকে গেছিস বলে মনে হচ্ছে?”
সমীর প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়, “না রে, তোকে বলেছিলাম ত, এই ব্যাস ফ্লারটিং, শালা আর কি, এক রাত ব্যাস কাম খালাস।”
বুধাদিত্য, “এটা এক রাতের ব্যাপার নয় সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে সমীর। এই মেয়ে হোটেল শাংরিলাতে ছিল, এই মেয়ে হয়ত কাল তোর সাথে ছিল।”
সমীর কিছু বলতে যাবার আগেই বুধাদিত্যের সব সন্দেহ দূর করে মেয়েটা সমীরের পেছনে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে সমু, এনি প্রবলেম?”
বুধাদিত্য চোখ বন্ধ করে নেয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওর, যাক কানে শুনে সন্দেহের ভিত অনেক মজবুত হয়ে গেছে। সমীর মেয়েটাকে ভেতরে যেতে বলে। ওকে বলে যে অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই একটু কথা বলেই টেবিলে ফিরে যাবে। মেয়েটা একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায় একবার সমীরের মুখের দিকে তাকায়, তারপরে চলে যায় ভেতরে।
মেয়েটা চলে যেতেই সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “ঝিলাম যা চায় সেটা ও পেয়ে গেছে। আমি আমার জীবনে কি করছি না করছি সেটা ওর দেখার দরকার নেই।”
বুধাদিত্য, “সমীর, ঝিলাম তোর বিয়ে কর বউ, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি তোর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না, ছেলে হয়েছিস যখন তখন যে শালা এদিকে ওদিকে মুখ মারবি সেটা আর নতুন কি? কিন্তু শালা মুখ মারতে গিয়ে প্রেমে পড়বি আর বাড়িতে বউ একা থাকবে?”
সমীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরে জিজ্ঞেস করে রাতে খালি আছে কিনা? বুধাদিত্য নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেয় আর বলে রাতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। বিস্তারিত ভাবে কথা বলতে চায় সমীর ওর সাথে। রাতে সমীর ওর হোটেলের ঘরে আসে। বুধাদিত্য ওকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করে যে দুজনে একসাথে এক রুমে থাকছে কি না। মাথা দুলিয়ে মেনে নেয় সমীর, যে মেয়েটা আর সমীর এক রুমে আছে। বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বুধাদিত্য কারন জানতে চায়, কেন সমীর ঝিলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সমীরের সাথে কথাবার্তা টেপ করার জন্য চুপিচুপি মোবাইলে ভয়েস রেকর্ডার চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য।
সমীর বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, “আগেও তোকে জানিয়েছিলাম ঝিলামের কথা। জানিনা তোর মনে আছে কি না। চাকরি পাওয়ার পরে ঝিলাম যে আরও বদলে যাবে সেটা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। ও সুন্দরী, ও ভীষণ আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি ও ভীষণ জেদি আর বদরাগী। চাকরি পাওয়ার পরে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে সবসময়ে। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, স্কুলে বেড়িয়ে যায় আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। রাতে আমার দেরি হয় ফিরতে, সেই নিয়ে ওর কথা শুনতে হয়। ওর কথা সারে আট’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত নিয়ম কানুন মেনে চলা বড় কঠিন। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই দুই, তিন মাসে। জোর করে গাড়ি কেনার জন্য, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত বাইক কিনি। আজকাল আবার আমার পয়সার হিসাব চায়। কই, আমি’ত ওর চাকরির পয়সার হিসাব চাই না? আমার আতে লাগে যখন আমার খরচ খরচার ওপরে হাত লাগাতে চায়।”
বুধাদিত্য চুপচাপ শুনে যায়। সমীর বলে চলে, “আজকাল জানিস আর আমাদের সেক্স হয়না। কোলকাতায় থাকাকালীন ঝিলাম উদ্দাম ছিল, প্রচন্ড উচ্ছল ছিল, সেই ঝিলাম অনেক বদলে গেছে। আমি বাড়ি ফিরি, ঝিলাম ঘুম চোখে দরজা খুলে আমার জন্য খাবার গরম করে শুতে চলে যায়। আমি চুপচাপ ওকে না ঘাটিয়ে নিজের খাবার খাই। এমত অবস্থায় আর কি একসাথে থাকা যায়? তুই জানিস না, এই দিল্লী এসেই ওর একটা মিস্ক্যারেজ হয়েছিল। তারপরে আমাদের শারীরিক সম্বন্ধ অনেক কমে যায়। আমাকে দোষ দেয় যে আমার নাকি স্পারম কাউন্ট কম।”
বুধাদিত্য, “তুই কি সে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলি কোনদিন?”
সমীর, “না আমার কিছু হয়নি, ওর মা হবার ক্ষমতা নেই। ওর গাইনি দেখে বলেছিল যে ওর গর্ভাশয়ে কিছু সমস্যা আছে।”
বুধাদিত্য, “দ্যাখ, আমি সেসব বিশেষ জানি না, তবে আমার মনে হয় তোর একবার ডাক্তার দেখান উচিত। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে একটা মিস্ক্যারেজের পরে একটা মেয়ের মনে বড় আঘাত লাগে, সেই আঘাত কাটতে একটু সময় লাগে। তুই কি সেই সময় টুকু ঝিলামকে দিয়েছিস?”
সমীর চুপ করে থাকে, বুধাদিত্যের বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঝিলামের দিকে তারপরে হয়ত আর ফিরেও তাকায়নি ঠিক ভাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে বম্বের সেই মেয়েটার কথা। বুধাদিত্য দু’টো সিগারেট জ্বালায়, একটা সমীরকে দেয়। সমীর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, “বম্বে অফিসে নন্দিতার সাথে দেখা।” মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, অবশেষে সমীরের জীবনের নতুন নারীর নাম জানা গেল, নন্দিতা। সমীর বলে চলে, “এক বিকেলে মিটিঙ্গের পরে আমার মাথায় এই সব চিন্তা ভাবনা ঘোরে, আমি খুব ড্রিঙ্ক করি। আর ড্রিঙ্কের বশে নন্দিতাকে মনের কথা বলে দেই, সেদিন রাতে দু’জনে আমার রুমে এসে পাগলের মতন সহবাস করেছিলাম। আমি তারপরে ওর প্রতি ঝুঁকে যাই। নন্দিতাকে ফেলে দেওয়ার এখন উপায় নেই। আমি সেইজন্য নন্দিতাকে দিল্লীতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিকে ঝিলাম, একদিকে নন্দিতা। একজন কে ছাড়তে পারিনা বাড়ির চাপে, আত্মীয় সজ্জনের চাপে, অন্যজনকে ছাড়তে পারিনা কেননা মন মানে না।”
সব কথা বলে সমীর চুপ করে থাকে। বুধাদিত্যের কান লাল হয়ে যায় সব কথা শুনে, জিজ্ঞেস করে সমীরকে, “কি করতে চাস তুই? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এই রকম দুই নৌকায় পা দিয়ে ত চলা যায় না।”
সমীর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, “মাঝে মাঝে মনে হয় ডিভোর্স দিয়ে দেই। কিন্তু ওর পরিবার, আমার পরিবার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, এমন কি ঝিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে না। আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ঝিলাম, অনেক বার করেছিল। আমি ঝিলামকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এক সবল পুরুষ, যেকোনো নারীকে সঙ্গমের সুখ দিতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি নন্দিতাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি ঝিলামের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করব না কোনদিন। ও আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না কোনদিন। আমি কোথায় কি করছি, না করছি সেটা ওর জেনে দরকার নেই। আমিও দেখতে যাবো না ও কার সাথে ঘুরছে, কার সাথে রাত কাটাচ্ছে।”
ঝিলামের মতন মিষ্টি, পবিত্র মেয়ের নামে ওই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যায় বুধাদিত্য। মনে হয় এক থাবরে মাথা ফাটিয়ে দেয় সমীরের, গর্জে ওঠে বুধাদিত্য, “ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছে? ঝিলাম কি কোনদিন তোকে ছাড়া কোথাও ঘুরতে গেছে? ঝিলামের নামে এই কথা বলার আগে তোর বুকে একবারের জন্য বাঁধল না? তোকে বুকে আগলে বাঁচিয়ে এনেছে আর তুই মাদা… শালা শুয়োরের বাচ্চা, শেষ পর্যন্ত, বউয়ের নামে এত জঘন্য অপবাদ দিলি?”
সমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “সারা জীবন ধরে কি আমাকে সেই এক কথা শুনাতে চাস? ঝিলামের প্রতি তোর অত দরদ কিসের বোকা… তুই কি আমার বউয়ের সাথে শুয়েছিস?”
রাগে কাঁপতে শুরু করে বুধাদিত্য, কান মাথা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে দেয়। সত্যি ওর বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝিলাম বসবাস। যদিও ঝিলাম সেই কথা এখন জানেনা জানলেও হয়ত এই জানে যে বুধাদিত্যের মনে কোন পাপ নেই। মনকে শক্ত করে বেঁধে নেয় বুধাদিত্য, হৃদয়ের টান যেন চোখে না এসে যায়। বুধাদিত্য চিবিয়ে চিবিয়ে সমীরের প্রশ্নের উত্তর দেয়, “মাদার… কুত্তারবাচ্চা, এই কথা বলতে তোর একবার বাধল না? গত ছয় বছর পরে তোদের পেয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, দিল্লীতে আমার নিজের বলতে কেউ আছে। আজ আমার বুকের সেই আশা সেই ভালোবাসা খানখান করে দিলি তুই।” সমীররে মুখ চোখ লাল হয়ে যায়। সমীর মনেপ্রানে জানে যে বুধাদিত্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে সেই রাতে। চুপ করে থাকে, সমীর, বুধাদিত্য গর্জে ওঠে, “বেড়িয়ে যা শালা, বোকা… এখুনি বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে। মাদা… একবার ভেবেছিলাম তোদের থেকে দুরে চলে যাব, কিন্তু যাবো না এবারে। তোর জ্বলানো এই আগুনের খেলার আমি শেষ দেখে যাব। ঝিলামের চুলের ডগা যদি এই আগুন ছোঁয়, কথা দিচ্ছি, তুই শালা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখতে পাবি না।”
সমীর উঠে দাঁড়িয়ে পরে, রাগে, দুঃখে দুচোখ লাল হয়ে গেছে ওর। রোষ ভরা নয়নে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি, আর তুই যদি আমাদের মাঝে আসিস তাহলে সেই আগুনে তোকে জ্বালিয়ে দেব।” সমীর দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়, বুধাদিত্য হাতের মুঠি শক্ত করে চেয়ারে বসে থাকে। ভীষণ রাগে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে দেয়, একবার মনে হয় সমীরকে খুন করে ওর কবল থেকে ঝিলামকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ওকে আইনের চোখে, ঝিলামের চোখে নিচ, ঘৃণ্য অপরাধী বলে প্রমানিত করবে। মাথা কাজ করে না বুধাদিত্যের।
______________________________
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#1)
কাজের চাপ ভীষণ ভাবে বেড়ে যায়, প্রায় দিন অফিসে রাত কাটাতে হয়। বাড়ি ফিরলেও শুধু মাত্র স্নান আর একটু ঘুমানোর জন্য। পুনে থেকে ফিরে ঝিলামের সাথে দেখা করা হয়ে ওঠে না। ওর সান্নিধে যদি ঝিলামের প্রতি কোন বিরূপ আচরন করে সমীর, তাহলে ঝিলাম বুধাদিত্যকে দোষারোপ করবে ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর জন্য। মাথার মধ্যে শুধু ঝিলামের চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। একবারের জন্য মনে হয় যে মোবাইলে তোলা ছবি, ভিডিও আর ওদের কথোপকথন ঝিলামকে শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় হয়, সব শুনে ঝিলাম যদি আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে? বেশ কিছু দিন এমন ভাবে কেটে যায়। কোনদিক থেকে কোন খবরা খবর আসে না। প্রত্যেক দিন ভাবে এই ঝিলামের ফোন আসবে, কিন্তু সেই খবর আর আসে না। একবার ভাবে যে সমীরের বাড়ি যাবে দেখে আসবে ঝিলামকে, কিন্তু সমীরের শেষ বাক্য ওকে বাধা দেয়। সমীর সেই আগের তেলু নেই, অনেক বদলে গেছে, অনেক হিংস্র আর কুটিল হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্ম কাল, সকাল বেলার কাঠ ফাটা রোদ শান্ত পরিবেশ ঝলসে দেয়। সবে অফিস পৌঁছেছে বুধাদিত্য, এমন সময়ে ঝিলামের ফোন আসে। গলার স্বর শুনে মনে হল, খুব ক্লান্ত। ওর ক্লান্ত গলার আওয়াজ শুনে বুধাদিত্যের বুক হুহু করে ওঠে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলাম কোথায়? ঝিলাম জানায় যে স্কুলে এসেছে কিন্তু স্কুল করার ইচ্ছে নেই ওর। ব্যাগ হাতে করে বেড়িয়ে পরে বুধাদিত্য, ঝিলামের গলার স্বর শুনে মনে হয় আর অফিস করে দরকার নেই, এবারে কিছু একটা বিহিত করা উচিত।
ঝিলাম স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, কাঁধে ব্যাগ, পরনে হাল্কা নীল রঙের সুতির শাড়ি। দূর থেকে দেখলে সবাই সুন্দরী বলবে, কিন্তু শুধু বুধাদিত্য জানে যে ওই কাজল কালো দু’চোখের পেছনে লুকিয়ে আছে হৃদয় ভাঙ্গার শত সহস্র টুকরো। বুধাদিত্যের গাড়ি দেখে ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে, গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে এসে বসে পরে। চোখের পাতা ভিজে, ফর্সা গাল লাল, নাকের ডগা লাল। চোখে দেখে মনে হল যেন ঘুম হয়নি গত রাতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলাম মাথা নিচু করে আঙ্গুলের নখ খোটে কিছুক্ষণ। তারপরে ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলে, “একটু বিষ দিতে পার আমায়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা গলায় বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
ঝিলাম উলটো হাতে চোখের কোল মুছে উত্তর দেয়, “আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে গেছে, এবারে নাকি অনেক লম্বা টুর। বম্বে থেকে আরও অনেক জায়গা নাকি যাবার আছে। ফিরবে সাত আট দিন পরে।”
ঝিলাম রাতের কথা বলতে শুরু করে। বেশ কয়েকদিন ধরে সমীর রোজ রাতে মদে চুড় হয়ে আসে। ঝিলাম কিছু বলতে গেলেই ওকে বলে যে, ঝিলাম নিজের মতন থাকতে পারে আর ওকে যেন ওর কোন চালচলন নিয়ে না ঘাটায়। সমীর সোজাসুজি ঝিলামকে জানিয়ে দেয় যে পরস্পরের যৌনজীবন যেন কেউ আঘাত না করে। ঝিলামের সাথে তুমুল ঝগড়া হয় সমীরের, সারা রাত দুজনের কেউ ঘুমায়না। রাতে একবার বুধাদিত্যের কথা মনে পড়েছিল ঝিলামের, ফোন করতে যায়। কিন্তু সমীর ধমকে ওঠে, হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে বুধাদিত্য ওর মাথা খেয়েছে, এর মধ্যে যেন ওকে না ডাকা হয়।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, শেষ পর্যন্ত সমীর ওকে বলে যে যদি ডিভোর্স চায় তাহলে সমীর ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। সেই শুনে ওর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়েছিল; সেই শুনে সমীর বলে আত্মহত্যা করতে হলে যেন ও চলে যাবার পরে করে। সকালবেলা চলে যাবার আগে জানিয়ে যায়, যে টুর থেকে এসে বাড়ির লোকজন ডেকে একটা বিহিত করবে। ঝিলাম জানায় যে ওর বাবা মা হয়ত সব শুনে ওকে বলবে চাকরি ছেড়ে স্বামীর সেবা করতে। এত সব হয়ে যাবার পরে সেটা করতে পারবে না ঝিলাম।
দুচোখে অঝোর ধারায় জল পরে যায়, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার আজকাল ওর সাথে কথা বলতে, এক ছাদের নিচে থাকতে পর্যন্ত খারাপ লাগে। মনে হয় দুটি অজানা অচেনা প্রাণী এক ঘরের মধ্যে আটকে পরে আছে। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে সব কথা শুনে তারপরে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা আসুক তারপরে একটা বিহিত করা যাবে।”
বুধাদিত্য গাড়ি চালিয়ে ঝিলামের বাড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঝিলাম চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রাখে, ওর হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম।
চোখে জল, ঠোঁটে একটু খানি হেসে নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমাকে বলে মনের দুঃখ কেটে গেছে। আমাকে আবার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এস।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “পাগলি মেয়ে কোথাকার।” কাঁধের গোলায় আলতো চাপ দিয়ে বলে, “ঠিক করে বল, আবার স্কুলে গিয়ে বলবে যে বাড়ি নিয়ে যাও তাহলে কিন্তু রাস্তার মাঝে ছেড়ে দেব।”
চোখের জল মুছে হেসে ফেলে ঝিলাম, “না সত্যি বলছি। ফালতু একটা সি.এল মেরে লাভ নেই, আমাকে স্কুলে ছেড়ে দাও প্লিস।” ঝিলামের চোখ মুখ কুঁচকে “প্লিস” বলাতে, বুধাদিত্যের মনে হল জড়িয়ে ধরে ওই লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন ঠোঁটে চুমু খায়।
অগত্যা বুধাদিত্যকে গাড়ি ঘুড়িয়ে নিয়ে আবার স্কুলে ফিরে যেতে হয়। স্কুলের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য ঝিলামকে পেছন থেকে ডেকে বলে, “ঝিল্লি, স্কুল শেষ হলেই অফিসে চলে এস।”
ঝিলাম ওর কথা শুনে মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। কিন্তু পরক্ষনে কানে বেজে ওঠে “ঝিল্লি” নাম। থমকে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। বুধাদিত্যের খেয়াল হয় যে ঝিলামকে আদর করে “ঝিল্লি” বলে ডেকে ফেলেছে, দাঁত চেপে হেসে ফেলে। ঝিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের লাজুক ভাব লুকিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে যায়।
সারা সকাল কাজে মন বসাতে পারে না বুধাদিত্য, ল্যাপটপ সামনে খোলা। অগুনতি মেইল আসে, কয়েকটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখে, কখন দুটো বাজবে আর ঝিলাম ওকে এসে ডাক দেবে। সময় যেন কাটতে চায় না আর। অফিসের কয়েকজনের সেই ইতস্তত ভাব চোখে পরে যায়। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, সুকৌশল উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যায় সবার প্রশ্ন।
ঠিক লাঞ্চের পরেই ঝিলামের আবির্ভাব। চেহারার বিষণ্ণ ভাব কেটে বেশ খুশির জোয়ার খেলে বেড়ায়। স্কুল থেকে রোদে হেঁটে আসার ফলে ফর্সা ঝিলাম লাল হয়ে গেছে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালের লালিমা উপভোগ করে। বড় বড় চোখ করে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে যে কি দেখছে? মিচকি হেসে ফেলে বুধাদিত্য। গাড়িতে করে ঝিলামকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঝিলামকে বলে, “একা একা বাড়িতে থাকবে?”
ঝিলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কি করব আর, এর পর থেকে একাই হয়ত কাটাতে হবে।”
সেই দীর্ঘশ্বাস বুধাদিত্যের বুকে বড় বাজে, একটু নিচু গলায় বলে, “যদি কিছু মনে না কর তাহলে একটা কথা বলতে পারি।” ঝিলাম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি কথা? বুধাদিত্য একটু ইতস্তত করে বলে, “জামা কাপড় প্যাক করে আমার বাড়িতে চলে এসো।”
বুধাদিত্যের সাহস দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে যায়। তারপরে হেসে ফেলে বলে, “বিকেলে অফিস ফেরত আমাকে নিয়ে যেও, আমি তৈরি থাকব।”
উত্তর শুনে বুধাদিত্যের হৃদয় খুশিতে নেচে ওঠে। দু’চোখ চকচক করে ওঠে, কিন্তু চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যাক্তি চেহারার ওপরে আনতে দেয় না। ঝিলামের চোখ এড়ায় না, ওর দুই চোখের ভাষা। ঝিলাম ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের খুশি চেপে রাখে। ঝিলাম ফ্লাটে ঢোকার জন্য পা বাড়ায়, বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির কাছে। সুন্দরী অপ্সরা যতক্ষণ না দরজা দিয়ে ঢুকে যায়, ততক্ষণ চেয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। অফিসে ফিরে কাজে মন বসাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। এর মাঝে সি.টি.ও ডাক আসে, কিছু প্রেসেন্টেসানের জন্য। এক ঝটকায় ঝিলামকে মাথার থেকে বের করে আবার কাজে ডুবে যায়। হাতে দু’দুটো প্রোজেক্ট, একটা অস্ট্রেলিয়ার, একটা পুনের, মাথায় বাজ পড়েছে। দ্বিতীয় অর্ধে কাজে ডুবে গিয়ে সময়ের দিকে আর খেয়াল থাকে না বুধাদিত্যের।
সময়ের খেয়াল পরে ঝিলামের ফোনে। ওপাশ থেকে ধমকে ওঠে “ঝিল্লি”, “সাড়ে ছটা বাজে, সময়ের খেয়াল আছে? আমাকে নাকি নিতে আসছিলে? কোথায় মরতে বসেছ?” বুধাদিত্যের তখন খেয়াল পরে যে ঝিলামকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। একদম ভুলে গেছিল সে কথা। বুধাদিত্য ক্ষমা চাইতেই ঝিলাম অভিমানী সুরে ধমক দেয়, “সব পুরুষ মানুষ এক রকমের। দেরি হবে তা একবার ফোন করে জানাতে পার নি? আর আসতে হবে না তোমাকে।” ভীষণ রেগে গেছে ঝিলাম, রেগে মেগে ফোন রেখে দেয়।
বুধাদিত্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। খুব ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা মারে। অভিমানিনী ঝিলাম দরজা খুলে ভেতর দিকে হাটা দেয়। ঝিলামের চুরিদারের ওড়না দরজার ছিটকিনিতে আটকে টান পরে যায়। ঝিলাম কেঁপে ওঠে এক অজানা ভয়ে, একা পেয়ে বুধাদিত্য ওর সতীত্ব হরন করতে চলেছে? রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিলাম, “তোমার এত সাহস যে আমাকে একা পেয়ে শেষ পর্যন্ত…” হাত উঠিয়ে বুধাদিত্যকে থাপ্পর মারতে যায়। থাপ্পরটা হাওয়ায় ঘুরে দরজায় লাগে। বুধাদিত্য কিছুই বুঝতে পারেনা। পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিলামের এই অধভুত আচরনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করে। ঝিলাম দরাজায় থাপ্পর মারার পরে বুঝতে পারে যে ওড়না ছিটকিনিতে আটকে গেছে। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ওড়না ছিটকিনি থেকে খুলে নেয়। বুধাদিত্য হেসে ফেলে ওর লাল নাকের ডগা দেখে।
বুধাদিত্য, “তোমার মারা পেটা হয়ে গেলে, একটু বাড়ির দিকে রওনা দিতে পারি।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, পেছনে সরে গিয়ে ওকে সোফার ওপরে বসতে বলে। মাথা তুলে বুধাদিত্যের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা করে, নিজের আচরনের জন্য। রান্না ঘর থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দেয় এক কাপ। মিষ্টি লাজুক গলায় ওকে বলে, “একটু বসো, আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”
বুধাদিত্য, “আর কি তৈরি হবে, ভালোই ত কাপড় পরে আছো বেশ ত লাগছে। একে গাড়িতে ত যাবে, পায়ে হাওয়াই চটি পরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “দাঁড়াও বাবা, এখুনি অফিস থেকে এসেছ, একটু ত বসবে নাকি?”
বুধাদিত্য, “সে’ত ওই বাড়ি গিয়েও বসা যাবে।”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “তুমি না সত্যি… ঠিক আছে চল।” নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
সারাটা রাস্তা ঝিলামের কল্লোলে বুধাদিত্যের কান গুঞ্জরিত হয়। সারাদিনের স্কুলের গল্প বলতে শুরু করে। গাড়ি চালায় আর আড় চোখে দেখে ঝিলামকে। অর্ধেক কথা কানে যায়, অর্ধেক কথা কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য শুধু তাকিয়ে থাকে ওর লাল ঠোঁটের দিকে, তোতাপাখীর মতন কিচিরমিচির করে কথা বলছে আর নড়ছে, সেই সাথে নরম পাতলা আঙ্গুলের নড়াচড়া। শরীরের সুগন্ধে গাড়ির ভেতর ভরে গেছে, ওই মাদকতা ময় রুপের কাছে হার মেনে গেছে বুধাদিত্য। পুরানো ঝিলাম ফিরে এসেছে এক নতুন করে। পারলে বুকের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে দেবে এই তরঙ্গিণীকে।
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#2)
প্রচন্ড গরম, ঘরে ঢুকেই এসি চালিয়ে দেয় বুধাদিত্য। ঝিলামের থাকার জন্য বুধাদিত্য নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে দেয়। প্রথম বার নিজের শোয়ার ঘরে অন্য একজনের পায়ের ছাপ। ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় শোবে, উত্তর বুধাদিত্য জানায় যে গেস্ট রুমে থাকবে এই কটা দিন। বুধাদিত্য ওর ব্যাগ আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ঝিলাম বাথরুমে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য মনের মধ্যে আনন্দের খই ফোটে, অবশেষে ভালোলাগার রমণী ধরা দিয়েছে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও, চোখের সামনে থাকবে “ঝিল্লি”। হাত মুখ ধুয়ে বারমুডা আর গেঞ্জি পরে বসার ঘরে বসে থাকে। মন বারেবারে উঁকি মারে শোয়ার ঘরে, ঝিলামের অপেক্ষায় এক মিনিট যেন এক বছর বলে মনে হয়। কাঁধে তোয়ালে, চোখ মুখ তরতাজা, সকালের বিষণ্ণতার লেশ মাত্র নেই শরীরে। সারা অঙ্গে এক নতুন মাদকতা, এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে একটা ঢিলে টপ আর গাড় নীল রঙের স্লাক্স। ওর যৌবনের ডালি ফুলে ফুলে ভরা। সেই রুপসুধা দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে বুধাদিত্য।
ঝিলাম ফ্রিজ খুলে বলে, “কাঁচা বাজার ত কিছু নেই, একটু বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “খাসির মাংস নিয়ে আসি?”
ঝিলাম আলতো ধমক দেয়, “এই গরমে খাসির মাংস খেতে হবে না। পারলে সি.আর.পার্ক না হয় গোবিন্দপুরি থেকে ট্যাঙরা মাছ নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “আমি ট্যাঙরা ফ্যাংরা চিনিনা, কাটা কাতলা না হলে রুই নিয়ে আসব।”
ঝিলাম, “চেন টা কি, তাহলে? বাঙালি হয়ে মাছ চেন না?”
বুধাদিত্য, “ছোটো বেলা থেকে হস্টেলে মানুষ, মাছ চেনাবার মতন কেউ কোনদিন পাশে ছিল না।”
ঝিলামের মনে পরে যায় বুধাদিত্যের অতীতের কথা। মন কেমন করে ওঠে ওর চোখ দেখে, মিষ্টি গলায় বলে, “আজ তাহলে সামনে থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এস, কাল মাছের বাজার যাওয়া যাবে।”
বুধাদিত্য, “যথাআজ্ঞা ঝিল্লিরানী।” খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিলাম, ওর মুখে “ঝিল্লি” নাম শুনে বুকের ভেতরে প্রজাপতি পাখা মেলে নেচে ওঠে। বুধাদিত্য গায়ে একটা টিশার্ট পরে বাজারে বেড়িয়ে যায়। সাধারণত সপ্তাহে একদিন বাজার করলে ওর চলে যায়, কিন্তু এবার থেকে মনে হয় ঝিলাম প্রত্যকে দিন বাজারে পাঠাবে। কাঁচা সবজি কিনে বাড়ি ফিরে দেখে রান্না ঘরে ঝিলাম। ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। বুধাদিত্যকে দেখে বলে, সবজি গুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে। রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হবে। বুধাদিত্য মুখ কাচুমাচু করে জানায় যে রাত দশটা এগারোটার আগে ও খায় না। ধমকে দেয় ঝিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি খেতে হয় তারপরে না হয় টিভি দেখতে পারে বা নিজের কাজ করতে পারে। ঝিলামকে সকালে উঠতে হয় স্কুল যাবার জন্য। পরেরদিন শনিবার, ছুটি, কি করবে অত সকালে উঠে, সেই শুনে ঝিলাম একটু শান্ত হয়। বুধাদিত্য কাতর চোখে এক কাপ কফির আবেদন করে, ঝিলাম কপট রেগে জানিয়ে দেয় এত রাতে কফি খেলে ভাত খেতে পারবে না। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে ওর জীবনের অঙ্ক এক নতুন খাতায় আঁচর কাটতে শুরু করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিলাম কে দেখে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খালি, ফর্সা পায়ের গুলির মসৃণ ত্বক আলোতে চকচক করছে, পরনের কাপড় এঁটে বসে ওর কোমরের নিচে। জড়িয়ে ধরে ওর ফর্সা গোলাপি গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কোনোরকমে সেই মনোবৃত্তি সামলে নেয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া ঝিলামের চাপের ফলে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঝিলাম।
ঝিলাম, “এসি বন্ধ করে দাও, এই দুদিনে এসি তে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। পরে ত আর এসি পাবো না।”
বুধাদিত্য, “আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছ যে? অত সকালে উঠতে পারব না আমি।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে, শুধু ছুটির দিনে ছুটি, উইক ডেইসে কিন্তু আমার সাথে উঠতে হবে।”
বুধাদিত্য, “অত সকালে উঠে আমি কি করব?”
ঝিলাম, “কাজের লোক সকালে আসে তার সাথে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর পরিষ্কার করাবে।”
বুধাদিত্য, “বাপরে, ওই সব আমার দ্বারা হয় না। কুতুব মিনার থেকে লাফ দিতে বললে লাফ দিয়ে দেব।”
ঝিলাম, “ঠিক আছে তোমাকে দেখতে হবে না। কাল এলে আমি ওকে বলে দেব বিকেলে আসতে। আমিও স্কুল থেকে ততক্ষণে ফিরে আসব, তারপরে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেব।”
বুধাদিত্য, “তাহলে আমার টিফিনের কি হবে?”
ঝিলাম, “স্কুল বের হবার আগে তোমার টিফিন বানিয়ে দিয়ে যাব।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “কতদিন ঝিলাম, কতদিন করবে?”
হটাত ওই কথা শুনে হারিয়ে যায় ঝিলাম। বুকের ভেতর হুহু করে কেঁদে ওঠে, কতদিন এই সুখ? হয়ত ক্ষণিকের। দুজনেই মনের ভাব ব্যাক্ত করে না। শুধু চোখে চোখে কথা হয়। ঝিলাম চোখ নিচু করে ঘরের আলো বন্ধ করে শুয়ে পরে। বুধাদিত্য চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে আলাস্কার সবুজ, নীল অধভুত সুন্দর নরদান লাইটস ঝকমক করছে, মনের ভেতরে ঝিলামের চোখের জল ভেসে যায়। চুপ করে সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, ডিসকভারি চ্যানেলে কি চলছে, কি চলছে না, কিছুই মাথায় ঢোকে না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে ওর, মাথা শূন্য। কি করে ওই ইতর, নীচ, বিশ্বাসঘাতক সমীরের কবল থেকে মুক্ত করা যায় এই ফুলের কুঁড়িকে। একমাত্র উপায়, যদি ওদের ডিভোর্স হয়, না হলে এই জীবনে ঝিলামকে বুকে পাওয়ার স্বপ্ন শুধু মাত্র স্বপ্ন থেকে যাবে। অতি সযত্নে রাখা সেই সুন্দর ইভিনিং ড্রেসিংগাউন আলমারির কোনায় পরে থাকবে।
“কি হল এখন ঘুমাতে যাও নি?” ঝিলামের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে বুধাদিত্য আচমকা সোজা হয়ে বসে। শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “পারে বটে মানুষটা। রাত একটা বাজে যাও ঘুমাতে যাও। ডিসকভারিতে আর কিছু নতুন দিচ্ছে না।” নিরুপায় বুধাদিত্য, ঝিলামের আদেশের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে শুতে চলে যায়।
এতদিন সকাল বেলা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারত বুধাদিত্য। সুন্দরী এক নদীর ঝঙ্কারে সকাল থেকে বাড়ি মুখরিত। কাজের লোক সকাল বেলা এসে যায়। তাকে নিয়ে ব্যাস্ত বাড়ির নতুন রাজ্ঞী “ঝিল্লি”। বিছানায় শুয়ে আধোঘুমে আধজাগরন, “ঝিল্লি”র কলতান কানে ভেসে আসে, “সারা বরতন ধোকে পেহেলে স্লাব পে রাখ দেনা, ফির পানি ঝড়নে কে বাদ উঠাকে রাখনা।” “ইয়ে সোফা কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু লাগা, উওহ কোনে মে ক্যায় হ্যায়, উধর নেহি কিয়া ক্যা? ইয়হান পোছা মার ঠিক সে, নেহি দুবারা মার।” সেই কলতান মধুর করে তোলে পায়ের নুপুরের আওয়াজ। গতকাল ছিল না, সকালে হয়ত পড়েছে। বুধাদিত্য টের পায়, ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ের ওপরে চাদর একটু টেনে দেয়্*। এসি বন্ধ করে, ফ্যান চালিয়ে দেয়। নিচু স্বরে কাজের লোককে আদেশ দেয়, “সাব কা বিস্তর কে নিচে ঠিক সে ঝাড়ু পোছা লাগা দেনা।” বুধাদিত্য আধাচোখ খুলে নতুন রাজ্ঞীর রুপ দর্শন করে। সকালেই মনে হয় স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুল পিঠের ওপরে মেলে ধরা, চেহারায় ভোরের সূর্য ঝলমল করছে পরনে ঢিলে প্যান্ট, গায়ে ঢিলে একটা জামা। ওর চোখ খোলা দেখে মিষ্টি হেসে, ঘুম থেকে উঠতে বলে। মুক্ত সাজান দাঁতের ঝিলিক দেখে বুধাদিত্য কাতর চোখে আবেদন করে, একটু ঘুমাতে দাও? মাথা নাড়ায় ঝিলাম, ঠিক আছে, কিন্তু মাত্র এক ঘন্টা, ন’টার সময়ে উঠিয়ে দেবে। তাইসই, মাথার নিচের বালিস মাথার ওপরে চেপে ধরে আবার স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য। স্বপ্নে তলিয়ে যায় প্রান, তরঙ্গিণীর সুরে তালে নেচে ওঠে পাগল বুধাদিত্য। তপ্ত বালুকাবেলায় আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার মরূদ্যান।
“দাঁত মেজে নাও এবারে, কফি বানিয়ে ফেলেছি।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আদেশ দেয় ঝিলাম, “কি হল, ওদিকে ফিরে আর শুতে হবে না। কাল মাংস খাবে বলছিলে? আনতে যাবে না?”
অগত্যা বুধাদিত্য উঠে পরে। অর্ধখোলা চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মনে হয় ভাসাভাসা মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বর্গের অপ্সরা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। কফি হাতে বসার ঘরে বসে ঝিলামকে দেখে, সারা ঘর নেচে বেড়ায় সেই সুন্দরী তরঙ্গিণী। থেকে থেকেই কানে ভেসে আসে ঝিলামের কণ্ঠস্বর, “চা খাও না? শুধু কফি! ধুর, আমার কফি একদম ভালো লাগে না। বিকেলে আমাকে নিয়ে একটু বাজারে বেরিয়, অনেক কিছু কেনার আছে।” “শুধু রান্না ঘরটা বড়, হাড়ি কড়া বলতে কিছুই নেই। কি করে কাটালে এত দিন?” “একি, জ্যামটা শুকিয়ে চিনির দলা হয়ে গেছে? খাও না যখন ফালতু কিনতে যাও কেন?” “বরফের ট্রে ভেঙ্গে গেছে, একটা কিনতে পার না?” “স্টাডির টেবিল সিগারেট খেয়ে পুড়িয়ে দিয়েছ? মরন আমার, আশট্রে কোথায়?” “ওয়াশিং মেশিনের কভার কোথায়? দাগ পরে গেছে সারা গায়ে। বাড়িতে একটা কলিন্স নেই।” একটা কাগজ পেন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে, “একটা লিস্ট বানাও আমি বলছি, বিকেলে কিনতে যেতে হবে।” “জিরে, ধোনে, শুকনো লঙ্কা, লঙ্কা গুরো, কালা মিরচ, জাবিত্রি, জায়ফল, গোলাপ জল, কালো জিরে, মুগ ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল, অরহর ডাল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরষের তেল…”
বুধাদিত্য লিখে চলে চুপচাপ, ফর্দ তৈরি হয়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর কিছু বাকি আছে? না না, মনে করে নাও।”
ঝিলাম, “মনে পড়লে আবার বলব, কাগজ টা ওখানে রেখে দিয়ে এবারে দই আর মাংস নিয়ে এস।”
বুধাদিত্য, “তোমার দরকার পড়লে নিজে লিখে নিও, আমাকে জ্বালাতে যেও না।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আহা রাগ দেখ। ঠিক আছে আমি লিখে নেব। উঠে পড়ো আর মাংস আনতে যাও।”
দুপুরে খাওয়ার পরে ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে বিকেলে বাজার করার পরে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। জানায় যে ওই বাড়ি থেকে আরও জিনিস পত্র আনতে হবে, বুধাদিত্যের রুকস্যাক আর একটা সুটকেস খালি করতে বলে। ঝিলাম জানায় যে ওর একটা বড় আলমারি চাই। বুধাদিত্য বড় আলমারি খুলে দেয়, সারিসারি সুট টাঙ্গানো আর ওর কিছু জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। একপাসে ভাঁজ করে রাখা ঝিলামের দেওয়া সুট পিস। সেটা দেখে ঝিলাম একটু রেগে যায়, বুধাদিত্য জানায় যে সময়ের অভাবে আর সেটা বানানো হয়নি। ফের আদেশ হয় যে বিকেলে বেড়িয়ে বাজার করে, সুটের মাপ দিয়ে ওকে যেন একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। ঝিলাম ব্যাগ থেকে জিনিস পত্র বের করে আলমারি সাজিয়ে নেয়।
বিকেল বেলা ঝিলামের সাথে বাজার করতে যেতে হয় অগত্যা বুধাদিত্যকে, তারপরে কাল্কাজির একটা নামকরা সুটের দোকানে ঢুকে ওর সুটের মাপ দেওয়া হয়। সবশেষে ঝিলামের বাড়ি গিয়ে ব্যাগ আর সুটকেস ভর্তি করে নিজের জিনিস। দুটি ব্যাগ, একটা সুটকেস, একটা মেকআপ বাক্স, সব নিয়ে ভালো করে তালা দিয়ে ঝিলাম বেড়িয়ে পরে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন এই বাড়িতে আর পা রাখার মন নেই। সমীর এলে ওর সাথে একটা বিহিত করতে চায়। এই একদিনে ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেছে, ওর পাশে ওর সব থেকে বড় শক্তি দাঁড়িয়ে, বুধাদিত্য।
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#3)
রাতের খাওয়ার পরে ঝিলাম শোয়ার ঘরে ঢুকে বুধাদিত্যকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে যে সমীরের কাছে শুনেছিল যে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর মা মারা যান। সেই শুনে ঝিলাম সেদিন পায়েস বানিয়ে এনেছিল। বুধাদিত্য চুপ করে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোটো বেলার কথা মনে পরে যায়, মায়ের কথা মনে পরে যায়। চোখের কোনে একচিলতে জল ছলকে আসে। ঝিলাম ওর কাঁধে হাত রাখতেই শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্য। হেসে জানায় যে পুরানো ব্যাথা জাগিয়ে কি হবে। ঝিলাম ওই চোখের আড়ালে ঘন কালো মেঘের দেখা পায়। জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, ক্রুর চোখে তাকায় ঝিলামের দিকে, মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল ঝিলাম। সুবির গুহ’কে যত বার ভুলে যেতে চায় ততবার কেউ কেন ওকে মনে করিয়ে দিতে আসে। আরও রেগে যায় যখন দেবস্মিতার মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোয়াল চেপে ঝিলামকে বলে, যে এক সুন্দরী নারীর কবলে পরে ওর বাবা ওকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ঝিলামের বুক কেঁপে ওঠে বুধাদিত্যের ব্যাথার কাহিনী শুনে। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে যায়, কিন্তু বুধাদিত্য কারুর অনুকম্পায় বাঁচতে নারাজ। গত চোদ্দ বছরে একা থেকে ওর হৃদয় পাথরের মতন কঠিন হয়ে গেছে। বুধাদিত্য বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। ঝিলাম চুপ করে থাকে, ভাবে একি করে ফেলল।
ঝিলাম ওর পাশে বসে নিচু গলায় বলে, “আমি সরি, আমি জানতাম না এই সব। সত্যি বলছি জানলে আমি আঘাত দিতাম না তোমাকে।”
ম্লান হেসে বলে, “জানি তুমি জানতে না, ঠিক আছে ছেড়ে দাও ও সব কথা। আমি মিস্টার সুবির গুহ’র ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না।”
ঘরের আবহাওয়া সেই পুরানো ব্যাথার কাঁপুনিতে বদ্ধ হয়ে ওঠে। ঝিলাম চেষ্টা করে সেই বদ্ধ ভাব কাটিয়ে দিতে, বুধাদিত্যকে বলে, “এই, আইস্ক্রিম খেতে যাবে?”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে নাকি? এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাবে?”
ঝিলাম, “ধুর বোকা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে আইস্ক্রিম খাবে। ইন্ডিয়া গেট গিয়ে আইস্ক্রিম খাবো, প্লিস চলো না, একদম না করবে না।”
কাষ্ঠ হাসি হাসে বুধাদিত্য, “সবাই তাদের বউ না হয় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে আইস্ক্রিম খেতে যায়।”
ঝিলাম, “বাঃরে, আমি তোমার বান্ধবী নই? আমি মেয়ে আবার বান্ধবি, ব্যাস ইংরাজি মানে গার্লফ্রেন্ড।” ঝিলাম ইংরাজির শিক্ষিকা, সেও জানে সে কি বলেছে আর বুধাদিত্য জানে সে কি শুনেছে। দু’জনের মুক ভাষা পরস্পরের বুকের মাঝে হাজার বাক্য রচনা করে চলে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে নিজের জন্য একটা স্টোল আর বুধাদিত্যের জন্য একটা টিশার্ট নিয়ে আসে। স্টোল নিজের গলায় জড়িয়ে ওর হাতে টিশার্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে, “চলো।”
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য, “সত্যি তুমি যাবে?” আপাদমস্তক একবার ঝিলামকে দেখে নেয়। ঢিলে প্যান্ট ঢিলে শার্ট, মাথার চুল একটা রবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নেয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলে, চল, দাঁড়িয়ে কেন? নিজের পরনে শুধু একটা বারমুডা আর টিশার্ট।
ইনোভা দাঁড় করায় রাজপথে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, সারা দিল্লী ঘুমিয়ে শুধু রাজপথে লোকের ভিড়, সবাই গাড়ি চেপে এসেছে এখানের হাওয়া খেতে আর আইস্ক্রিম খেতে। হলদে আলো সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, ইন্ডিয়াগেটের অমর জাওান জ্যোতি থেকে সেই প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত। চারদিকে লোকের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটো মেয়ের মতন দৌড় লাগায় আইস্ক্রিম ঠ্যালা দেখে। বুধাদিত্য গাড়ি বন্ধ করার আগেই দুটি আইস্ক্রিম কিনে আনে। ঝিলাম গাড়ির পাশে ঠেস দিয়ে মনের আনন্দে আইস্ক্রিম চাটে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আলো আর মানুষ দেখে। বুধাদিত্য ভাবে আইস্ক্রিম চাটবে না ঝিলামের ফর্সা গাল। গোলাপি নরম গালে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে, একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা বড় প্রবল হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের, ওর দিকে হাত বাড়িয়ে ওর গাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দেয়। আচমকা গালের ওপরে উষ্ণ হাতের পরশে কেঁপে ওঠে ঝিলাম, ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “গালের পাশে একটা কিছু লেগে ছিল সেটা সরিয়ে দিলাম।”
ঝিলাম ছোটো মেয়ে নয়, ওর বোঝার ক্ষমতা আছে যে কোন আছিলায় বুধাদিত্য ওর একটু পরশ চায়। বুকের মাঝে এক অব্যাক্ত টান অনুভব করে, বৈধ না অবৈধ জানেনা। ঝিলাম ওর উষ্ণ আঙ্গুলের পরশে একটু গলে যায়, ওর পাস ঘেঁসে দাঁড়ায়। বাজুর সাথে বাজু ছুঁয়ে যায়, শরীরের সাথে শরীর মৃদু চেপে যায়। দুই তৃষ্ণার্ত নরনারীর শরীরে উত্তাপ ছড়াতে বেশি দেরি হয় না। বুধাদিত্যের কঠিন বাজুরে পেশির ওপরে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে এক নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে।
ঝিলামকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “আরও কয়েকটা আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে এস, যাও।”
ঝিলামের মুখে হাসি আর ধরে না, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “সত্যি!!!”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ সত্যি… যাও তারপরে গাড়ি ওঠ।”
ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে আরও দুটি আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে। ততক্ষণে বুধাদিত্য গাড়ির মধ্যে উঠে পরে। ঝিলাম কাতর চোখে তাকিয়ে অনুরোধ করে যে এখুনি বাড়ি যেতে চায় না। বুধাদিত্য বলে, বাড়ি ওরা যাবে না, আজ একটা লম্বা ড্রাইভে যাবে। সেই শুনে উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন নেচে উঠে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে।
ঝিলামের চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা, প্রানবন্ত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবো?”
বুধাদিত্য, “সকালে উঠে তোমার স্কুল যাবার তাড়া নেই, আমার অফিস যাবার তাড়া নেই। কাজের লোক আসার তাড়া নেই, ছেলে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর তাড়া নেই, পয়সার পেছনে দৌড়ানোর তাড়া নেই। একদিন সব তাড়া ছাড়িয়ে, এমনি সারা রাত গাড়ি চালাব, ব্যাস।”
বুধাদিত্যের গাড় গলার আওয়াজ ঝিলামকে নিয়ে যায় এক স্বপ্নপুরীতে। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “চল নিয়ে, দাঁড়িয়ে কেন?”
গাড়ি ছুটিয়ে দেয়, বিকাজিকামা পেরিয়ে, জয়পুর হাইওয়ে ধরে। ঝিলাম গিয়ারের পাস ঘেঁসে বসে থাকে। খালি রাস্তায়, রাত বারোটা, গাড়ি উদ্দাম গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করে। বুধাদিত্যের ইচ্ছে করে এই গাড়ি না থামিয়ে ওকে নিয়ে এই সব সংসারের পাঁক থেকে দুরে কোথাও নিয়ে চলে যায়। ঝিলামের শরীরের উত্তাপ ওর কাঁধে এসে লাগে, ঝিলামের মাথার চুল উড়ে এসে ওর চোখে মুখে কালো পর্দা ফেলে দেয়। নাকে ভেসে আসে সুন্দর মাদকতা ময় এক ঘ্রান। এসি বন্ধ করে দেয় ঝিলাম, গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে রাতের হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। গাড়ি প্রথম টোলগেট পার হবার পরে একশো ছুঁয়ে যায়। সামনের সাড়ি সাড়ি ট্রাক, একের পর এক বাসের লাইন, বুধাদিত্যের গাড়ি আজ উন্মাদ ঘোড়ার মতন ছুটছে। একের পর এক গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় টোলগেট পার হবার পরে স্পিডমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি, একশো তিরিশের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝিলামের বুকে জেগে ওঠে এক নব মুক্তির স্বাদ, পাশে বসা এই উন্মাদ ঘোড়ার সাথে হারিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
হটাত গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে ঝিলাম, “কেন কিছু কথা বলো না… শুধু চোখে চোখ রেখে, যা কিছু চাওয়ার আমার নিলে চেয়েয়ে, একি ছলনা, একি ছলনা… কেন কিছু কথা বলো না… যত দূর দূর থাকো, শুধু চেয়ে চেয়ে থাকো, সে চাওয়া আমার, আকাশ আমার বাতাস ভরে রাখো, একি ছলনা, একি ছলনা… কেন কিছু কথা বলো না…”
গানটা শুনে বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, গাড়ির গতি ধিরে করে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম, গাড়ির অন্যদিকের জানালা দিয়ে ছোটো মেয়ের মতন মাথা বের করে গান গেয়ে চলেছে। এ যেন এক অন্য ঝিলামকে দেখছে, বুধাদিত্য। হটাত বাঁপাশ দিয়ে একটা গাড়ি খুব জোরে হর্ন দিয়ে ছুটে আসে। বুধাদিত্য জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে ঝিলামের জামা টেনে ধরে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। টানের ফলে ঝিলাম সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে আছড়ে পরে। গাড়ির গা ঘেঁসে পাশের গাড়িটা ছুটে বেড়িয়ে যায়। ঝিলামের হাত ভেঙ্গে যেত একটু হলে, বুধাদিত্যের জামার কলার চেপে ধরে কেঁপে ওঠে ঝিলাম। ঝিলামের কোমল শরীর ওর বুকের ওপরে চেপে যায়, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলে। আসন্ন বিপদ দেখেতে পেয়ে ঝিলামের বুক ভয়ে দুরুদুরু কাঁপে। মুখ লুকিয়ে রাখে বুধাদিত্যের প্রসস্থ বুকের ওপরে। নরম গাল চেপে থাকে বুকের পেশির ওপরে, কানে ভেসে আসে বুধাদিত্যের বুকের ধুকপুক শব্দ। সেই শব্দ যুদ্ধের দামামার মতন প্রবল। বুধাদিত্য বাঁ হাতে ঝিলামকে প্রগাড় ভাবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে। চিবুক দিয়ে চেপে ধরে ওর মাথা, বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে চায় এখুনি। সময় থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুজনের বুকের মাঝে। চোখ বন্ধ করে সেই উষ্ণতার রেশ সারা অঙ্গে মাখিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে ঝিলাম, কিন্তু পারেনা শুধু বিবেকের টানাপড়েনে।
কিছু পরে জামা ছেড়ে ওর বাহু পাশ ছেড়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় ঝিলাম। বুধাদিত্যের বুকের ওপরে ওর মিষ্টি গন্ধ, নরম শরীরের পরশ লেগে থাকে। অলঙ্ঘনীয় কোন স্বাদের দিকে হাত বাড়ানোর ছায়া বুকের মধ্যে বিধে যায়। গান থামিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝিলাম। চুপচাপ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দেয় বুধাদিত্য, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়। মনের ভেতরে একটা উদ্দাম ভাব ছিল সেটা হটাত করে উধাও হয়ে গেল। ঝিলামের দিকে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য। সামনের দিকে তাকিয়ে শূন্য বুকে গাড়ি চালায়। কিছু পরে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসে, রাত অনেক গভীর, সামনে আলো যায় কিন্তু ফিরে আসেনা এমন কালো অন্ধকার। উলটো দিক থেকে শুধু ট্রাকের সারি আর গুমগুম আওয়াজ। হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে, শূন্য হৃদয় নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় একটু ঝিলামকে দেখে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লক্ষ্য করে যে ঝিলাম জানালায় হাত রেখে তার ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোল বেয়ে সরু একটা শুকনো জলের রেখা নাক পর্যন্ত বয়ে গেছে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে একটা সিগারেট জ্বালায়। বুক ভরে ধোয়া টেনে নেয়, চোয়াল শক্ত করে বলে, এই বুকে এই ধোয়া ছাড়া আর কিছু নেই।
বুধাদিত্যের সম্বিৎ ফিরে আসে ঝিলামের মৃদু ডাকে, “সকাল চারটে বাজে, বাড়ি ফিরবে না?”
কেউই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। ঝিলাম এখনো সমীরের বউ, জানেনা ঝিলামের মনে কি আছে, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার মতন সাহস নেই বুধাদিত্যের। আয়েশার সাথে সঙ্গমের সময়ে বুধাদিত্যের সেই অবৈধ প্রেম বুকের ভেতরে চরম উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল। ঋজু বুধাদিত্য, গত চোদ্দ বছর ধরে দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে গেছে জীবনের সঙ্গে, কোন বাঁধা তাকে আজ পর্যন্ত আটকাতে পারেনি, সেটা নারীসঙ্গ হোক, বা জীবনযুদ্ধ হোক। আজ এই ফুলের মতন ললনার সামনে বুধাদিত্য অতিব ভীতু হয়ে যায়। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে পরে বুধাদিত্য। সারা রাস্তা দুজনে চুপচাপ, শুধু মাত্র গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে যায় না। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া দুজনের কানে অন্য এক আওয়াজ ভেসে আসে, ফাঁকা এক হৃদয়বিদীর্ণ কান্নার আওয়াজ।
একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#4)
বাড়ি ফিরে দু’জনে নিজের নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। বুধাদিত্যের ঘুম আর আসেনা, বুকের বেদনা প্রবল হয়ে ওঠে। দরজা, জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে দেয়, চেষ্টা করে দিনের আলো সরিয়ে দিয়ে রাত নামিয়ে আনতে। চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু বাথরুম থেকে জলের আওয়াজে আর ঘুম হয় না। বুঝতে পারে যে ঝিলাম এক জ্বালায় জ্বলছে, জলে ভরা নদী কিন্তু নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল তার কাছে নেই। বুধাদিত্য বিছানায় শুয়ে শুনতে পায় ওর নুপুরের আওয়াজ। ঝিলামের চোখে ঘুম নেই, বাড়ির কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে প্রবল চেষ্টা করে। সারা বাড়ি যেন আজ চকচকে করে দেবে। নিজেই ঝাড়ু পোছা শুরু করে দেয়। আলমারি খুলে সব নোংরা বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফার কভার নিয়ে কিছু অয়াশিং মেশিনে কিছু নিজের হাতে কাচতে শুরু করে। নিজের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলে, মন কিছুতেই শান্ত হয় না। চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পরে থাকে বুধাদিত্য। বুঝতে পারে যে ওর ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে। চোখ খুলে ওকে দেখার শক্তি টুকু নেই।
অনেকক্ষণ পরে ঝিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা মেরে বলে, “স্নান সেরে নাও, খাবার তৈরি হয়ে গেছে।”
বুধাদিত্য চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসে পরে। বাড়ির চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে, অনেক দিন আগে অনিন্দিতাদি এসে সোফার কভার আর ঘরের পর্দা কিনে দিয়ে গেছিল। সেই গুলো কোথায় পড়েছিল জানত না, ঝিলাম সেই সব গুলি আলমারি থেকে বের করে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে। মেঝে চকচক করছে, টেবিল চকচক করছে, ব্যাল্কনিতে একগাদা কাপড় মেলে রাখা। আড় চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে তাঁর মুখ থমথমে, গম্ভির, চোখের কোন চিকচিক, দুই চোখ একটু লাল। টেবিলে একটা থালা তাতে বুধাদিত্যের খাবার বাড়া।
বুধাদিত্য গম্ভির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার থালা কোথায়?”
ঝিলাম গম্ভির স্বরে উত্তর দেয়, “তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাব।”
বুধাদিত্য, “সকাল থেকে কিছু খাওনি’ত, বসলে কি ক্ষতি আছে?”
ঝিলাম ওর কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “ভাত ভাঙ্গ, ডাল দেব।”
বুধাদিত্য, “কালকের মাংসের কিছু বেঁচে ছিল সেটা কোথায়?”
ঝিলাম, “সারা রাত ঘুমাও নি, রাতভর গাড়ি চালিয়েছ, সকালে বাড়ি ফিরে ঘুমাও নি। শরীর খারাপ করে মরার ইচ্ছে আছে?”
বুধাদিত্য আর ঘাঁটাতে সাহস পায়না ঝিলামকে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। ঝিলামকে উলটো দিকের চেয়ারে বসে ওকে খেতে দেয়। কেউ কারুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না, একজন যখন তাকায় তখন অন্যজনের মুখ অন্যদিকে থাকে। নিঃশব্দে কথা বলে মানসিক দ্বন্দ।
বুধাদিত্য কিছু পরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গরমের ছুটি কবে থেকে?”
ঝিলাম, “কেন?”
বুধাদিত্য, “না, বাড়ি যাবে বলছিলে, তা টিকিট কাটা হয়ে গেছে?”
ঝিলাম, “আসছে শুক্রবার, তারপরের শুক্রবার থেকে ছুটি। সমীরকে বলেছিলাম টিকিট কাটতে, এর মাঝে…” কথাটা বলেই ফর্সা মুখখানি বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঝিলামের। উলটো হাতে নাক মুছে নেয়, চোখের কোনে যে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল সেটা ওর চোখের লম্বা পাতা ভিজিয়ে দেয়। একটু ধরা গলায় বলে, “খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”
বুধাদিত্য চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। স্টাডিতে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে বসে পরে অফিসের কাজ করতে। কাজে মন ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিছুতেই মন বসাতে পারেনা, চোখের সামনে ল্যাপটপ খোলা পরে থাকে। কিছুপরে জল খাবার জন্য খাবার ঘরে এসে দেখে, ঝিলাম একাএকা বসে খাবার খাচ্ছে। খেতেখেতে বারেবারে নাক, চোখ মুছে চলেছে। বুধাদিত্য ওকে না ঘাটিয়ে জলের বোতল নিয়ে স্টাডিতে ঢুকে পরে।
প্রজেক্টের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় বুধাদিত্য, সময়ের খেয়াল থাকেনা। দুপুর গড়িয়ে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। খেয়াল পরে যখন ঝিলাম ওর ঘরে ঢুকে ওর সামনে এক কাপ কফি রেখে চলে যায়। পেছন থেকে দেখে ঝিলামের চলে যাওয়া। হটাত চুড়িদার কামিজ পড়েছে, সাধারণত বাড়িতে থাকলে এই কাপড় পরে না। একবার মনে হল জিজ্ঞেস করবে কিন্তু আর জিজ্ঞেস করা হয় না। অফিসের কয়েকজনের ফোন, প্রেসেন্টেসানের কাজ, কিছু সারভার খুলে দেখা, এই করতে করতে সময় কেটে যায়। মাঝেমাঝে কান পেতে ঝিলামের পায়ের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ আর শুনতে পায়না। কিছু পরে সামনের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে। বাইরে বেড়িয়ে দেখে, হাতে একটা প্লাস্টিক, ঝিলাম জুতো খুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করে ঝিলামকে, “কোথায় গেছিলে?”
উত্তর দেয় ঝিলাম, “মাছের বাজারে। দুপুরে নিরামিষ খেয়েছ তাই ভাবলাম একটু মাছ আনি।”
বুধাদিত্য, “আমাকে বললেই পারতে আমি নিয়ে আসতাম।”
ঝিলাম, “তুমি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তাই আর তোমাকে বিরক্ত করিনি।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা, তোমার প্লেনের টিকিট কেটে দিলে হবে?”
ঝিলাম, “দুর্গাপুরে প্লেন নামে না। পূর্বা’তে তৎকালে টিকিট কেটে নেব।”
বুধাদিত্য, “প্লেনের টিকিট কেটে দেব খানে। কোলকাতা থেকে গাড়ি ঠিক করে দেব, তোমাকে দুর্গাপুর পৌঁছে দেবে। আসার দিনেও সেই গাড়ি তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে।”
ঝিলাম ঘাড় ঘুড়িয়ে বুধাদিত্যের চোখের দিকে তাকায়, অনেকক্ষণ পরে পরস্পরের চার চোখ এক হয়। ঝিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই চোখ তখন চিকচিক করে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে থাকে, বুকের ঝড়কে শান্ত করার প্রবল চেষ্টা। ঝিলাম কিছু পরে ওকে বলে, “দেখি ভেবে দেখব খানে।”
আবার সারা বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। টিভি দেখতে মন করে না, সোফায় বসে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে বুধাদিত্য। কানে ভেসে আসে অতিপরিচিত নুপুরের ঝঙ্কার, কিন্তু সেই নদীর কলতান যেন হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজ থেকে মাথা তুলে দেখে ঝিলামকে। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের স্বত্তায় ফিরে আসে দুজনে। রাতে দু’জনে এক সাথে খেতে বসে।
ঝিলাম ওকে বলে, “বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা দিও।”
বুধাদিত্য, “কেন?”
ঝিলাম, “তোমার অফিসে অনেক কাজ থাকে, রোজ দিন অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি অটো করে একাই চলে আসব।”
বুধাদিত্য কিছু বলে না, মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে দিয়ে দেবে। কিছু পরে বলে, “কাল দেখি, একটা ড্রাইভারের ব্যাবস্থা করে নেব।”
ঝিলাম, “খাবার পরে একটু ল্যাপটপ’টা দিও ত, একটু মেইল দেখার আছে আর স্কুলে কিছু কাজ করার আছে।”
একটু অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ল্যাপটপ নেই?”
ঝিলাম চিবিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার মতন বড়লোক নই যে ল্যাপটপ কিনতে পারব।”
বুধাদিত্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়, চাপা গলায় বলে, “কি করেছি একবার বলতে পার? কেন এমন করে কথা বলছ?”
ঝিলাম থালা থেকে মুখ উঠিয়ে ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপরে চাপা গম্ভির গলায় বলে, “কিছু করনি। আমার ভুল, আমি তোমার সাথে এখানে এসেছি। ঠিক আছে, আমি ব্যাগ ঘুছিয়ে নিচ্ছি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এস।”
ঝিলামের চাপা কান্না বুকে বেঁধে রাখে, বুধাদিত্য চেপে যায় বুকের ব্যাথা, ওর কথার কোন উত্তর দেয় না।
পরেরদিন সকাল বেলা উঠে দেখে যে ঝিলাম স্কুলের জন্য বেড়িয়ে গেছে। ফ্রিজের ওপরে একটা হলদে স্টিকনোটে লেখা, “কফি, মাইক্রো তে রাখা, কুড়ি সেকেন্ড গরম করে নেবে। উপমা বানিয়ে রেখে গেছি, একটু গরম করে খেয়ে নিও। টিফিন তৈরি করে খাবার টেবিলে রাখা, লাঞ্চের আগে পারলে একবার গরম করে নেবে।”
অফিসে গিয়ে জানতে পারে যে বুধবার অফিসের কাজে চন্ডিগড় যেতে হবে। নিজেকে সেই কাজে ডুবিয়ে দেয়। দুপুরে একবার ভাবে ঝিলামকে ফোন করবে, কিন্তু ইতিস্তত ভাবে আর করা হয়না। প্রোডাক্টের ম্যানাজার, রাকেশ সান্ডিল্য, ওকে মজা করে জিজ্ঞেস করে যে ওর গার্লফ্রেন্ড এল না। ওর কথা হেসে উরিয়ে দেয়। অফিসের মোটামুটি সবাই আচ করে ঝিলাম আর বুধাদিত্যের সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু রাকেশ ছাড়া অন্য কেউ ওকে ঘাঁটানোর বিশেষ সাহস করেনি কোনদিন। মাঝেমাঝেই রাখেশ মজা করে, কিন্তু বুধাদিত্য ওর সব কথা মজার ছলে উরিয়ে দেয়। লাঞ্চের কিছুপরে নেহেরু প্লেসে গিয়ে ঝিলামের জন্য একটা দামী ল্যাপটপ কেনে। রমণীর অভিমান কিছু করে ভাঙ্গাতে হবে না হলে বাড়ির পরিবেশ দমবন্ধ হয়ে আসছে।
বিকেল পাঁচটায় ঝিলামের ফোন আসে, ফোন ধরতে গিয়ে এক অন্য উত্তেজনায় হাত কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “কখন বাড়ি ফিরবে?” গলার স্বর অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে “ঝিল্লি”র।
বুধাদিত্য চাপা হেসে বলে, “কফি বানাও, আমি এই এখুনি আসছি।”
হেসে ফেলে ঝিলাম, “কফি গরম থাকতে থাকতে না পৌঁছালে কিন্তু কফি পাবে না।”
বুধাদিত্যের মন নেচে ওঠে ঝিলামের হাসি শুনে, “একটা সারপ্রাইস গিফট আছে তোমার জন্য।”
ঝিলাম হেসে বলে, “আগে বাড়ি এসে আমাকে উদ্ধার কর, তারপরে দেখব খানে।”
বুধাদিত্য আর দাঁড়ায়না, ব্যাগ উঠিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দরজা খুলে দাঁড়ায় ঝিলাম, সেই পুরাতন ঝিলাম, উজ্জ্বল দুই চোখে হাসি ফিরে এসেছে, গালের লালিমা ফিরে এসেছে। উচ্ছল তরঙ্গিণী আবার নিজের মত্ততায় মেতে উঠেছে।
হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “কফি বানানোর আগেই উপস্থিত দেখছি। অফিসে কাজ ছিল না নাকি?”
বুধাদিত্য ওর দিকে ঝুঁকে বলে, “কফির কথা শুনে আর থাকতে পারলাম না।”
ঝুঁকে পড়ার জন্য ঝিলামের মুখের ওপরে উষ্ণ শ্বাস বয়ে যায়, বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে।”
“একটা সারপ্রাইস আছে” বুধাদিত্য ওর হাতে ল্যাপটপের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার জন্য।”
হাতে ল্যাপটপের বাক্স নিয়ে একটু অবাক হয়ে যায়, তারপরে হেসে ফেলে ঝিলাম, “হটাত কি মনে করে? তোমাকে কিছু বলা মানে তুমি সারা পৃথিবী নিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।”
বুধাদিত্য ঘরে ঢুকে বলে, “আমার ল্যাপটপে যাতে আর হানা না দেওয়া হয় তাই নিয়ে এলাম।”
ঝিলাম মজা করে বলে, “কেন তোমার গার্লফ্রেন্ডেদের সাথে কবে কোথায় কিকি কেচ্ছাকলাপ কি করেছ সেই সব ছবি তুলে রেখেছ নাকি? চিন্তা নেই আমি চোখ বন্ধ করে নিতাম ওই ফটো দেখলে।”
চাপা হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শুধু মাত্র আয়েশার কয়েকটা ফটো আছে ল্যাপটপে তা ছাড়া অসংখ্য পর্ণ মুভি’ত আছেই। ঝিলামের কাঁধে একটু ধাক্কা মেরে বলে, “দেখার সখ আছে নাকি?”
কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “জাঃ শয়তান।” বুধাদিত্যের পিঠে আলতো করে চাঁটি মেরে বলে, “যাও ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার জন্য চা খাব বলে বসেছিলাম।”
বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে। শনিবার রাতে বাজার থেকে চা কিনে আনা হয়েছিল। ঝিলাম নিজের জন্য চা বানায় আর বুধাদিত্যের জন্য কফি।
চা খেতে খেতে ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কত দাম নিয়েছে ল্যাপটপের?”
বুধাদিত্য, “কেন দাম দেবে নাকি?”
ঝিলাম ভুরু কুঁচকে বলে, “হ্যাঁ টাকা জমিয়ে নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দেব।” তারপরে হেসে বলে, “শয়তান, আমাকে নিয়ে যেতে পারলে না, ল্যাপটপ কেনার সময়ে, একটু দেখে নিতাম।”
বুধাদিত্য, “একদম ভালোটা এনেছি, এইচ.পি’র বেশ ভালো ল্যাপটপ। অফিস থেকে সব লোড করে নিয়ে এসেছি। নিয়ে আস সব দেখিয়ে দিচ্ছি।”

একাদশ পর্বঃ অপ্রকাশিত বন্ধন। (#5)
ঘরের পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, দু’জনে ল্যাপটপ খুলে বসে পরে, ঝিলামের হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “এটা কি? ওটা কি করে খুলতে হয়? একটা হেডফোন আনতে পারনি, একটু কানে লাগিয়ে গান শুনতাম।”
বুধাদিত্য বলে, “বাড়িতে দামী ফাইভ পয়েন্ট অয়ান মিউসিক সিস্টেম আছে, কবার গান শুনেছ বলতে পার?”
ঝিলাম ওর কাঁধে আলতো চাঁটি মেরে হেসে বলে, “পরশু দিন কাজে চলে গেল। কাল থেকে মাথার ওইত খিচুরি করে রেখে দিয়েছিল। তারমধ্যে গান, হ্যাঁ।”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “ওকে বাবা সরি। আচ্ছা একটা কথা আছে, বুধবার সকাল বেলা আমাকে চণ্ডীগড় যেতে হবে।”
ঝিলাম, “গাড়িতে যাবে না শতাব্দীতে?”
বুধাদিত্য, “গাড়িতে যাবো, মিটিং শেষ হলেই আবার যাতে ফিরতে পারি।”
ঝিলাম ধমকে ওঠে, “না অত দূর গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে না, শতাব্দী করে যেও।”
বুধাদিত্য কোনদিন চণ্ডীগড় ট্রেনে যায়নি, যেতেও চায় না। গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসে বুধাদিত্য। মিটিঙ্গে কেউ না কেউ ওর সাথে যায়, পথে তাই কোন কষ্ট হয় না। এবারে রাকেশ যাবে ওর সাথে। বুধাদিত্য ওকে বলে, “না কোন প্রবলেম নেই গাড়ি চালাতে।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার খুঁজে পেয়েছ?”
বুধাদিত্য একদম ভুলে গেছিল ড্রাইভারের কথা, জিব কেটে বলে, “জাঃ একদম ভুলে গেছি।”
ঝিলামের আরও এক চাটি বুধাদিত্যের পিঠের ওপরে, রেগে মেগে বলে, “আগে একটা ড্রাইভার খুজবে। যদি কালকের মধ্যে ড্রাইভার পাও তাহলে গাড়িতে যাবে না হলে ট্রেনে যাবে। একা গাড়িতে আমি যেতে দেব না। ব্যাস শেষ কথা।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা বাঃবা, আমি ফোন করে দেখছি।”
ঝিলাম, “ড্রাইভার পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাসের কাছাকাছি হতে হবে, তাঁর পুলিস ভেরিফিকেশান করাতে হবে।”
বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “অত বয়স কেন?”
ঝিলাম, “একটু বয়স্ক ড্রাইভার ভালো গাড়ি চালায়, ধিরে সুস্থে গাড়ি চালায়, আর অন্তত এদিক ওদিক তাকায় না।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বুঝতে পারে ঝিলাম কি বলতে চায়, “তুমি আর বল না, তুমি রাস্তা দিয়ে হাটলে, আবালবৃদ্ধবনিতা তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। সে আমি বুড়ো আনি কি জোয়ান ড্রাইভার আনি।”
ঝিলাম লজ্জায় লাল হয়ে যায়, “ধুত, অনেক হয়েছে তোমার। যা বলছি সেটা করো। আমি রান্না করতে চললাম।”
ঝিলাম উঠে পরে রান্না করতে চলে যায়। অগত্যা বুধাদিত্যকে বেশ কয়েক জনকে ফোন করতে হয় ড্রাইভারের জন্য, না হলে আর গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না। এমনিতে একটা ড্রাইভারের দরকার ছিল, ঝিলামকে স্কুল থেকে আনার জন্য। আগে যখন ছেড়ে আসতে হত তখন মাঝে মাঝে বুধাদিত্যকে মিটিং ছেড়ে বা কোন কাজ ছেড়ে আসতে হত। ড্রাইভার থাকলে সেই অসুবিধে গুলো হবে না। যাদের ফোন করেছিল, তারা জানায় যে পরেরদিন বিকেলের মধ্যে ড্রাইভার যোগাড় করে দেবে।
পরেরদিন যথারীতি কেটে যায় কাজে কর্মে। বিকেলবেলায় দুটি ড্রাইভার আসে, তাদের মধ্যে একজনের কথাবার্তা শুনে আর কাজের কথা শুনে ঝিলাম তাকে কাজে নিযুক্ত করে। ড্রাইভার বিহারী নাম কালিনাথ, বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। ঝিলাম ওকে কাজ বলে দেয়, যে সকালবেলা, বুধাদিত্যকে অফিসে ছেড়ে দিতে হবে, তারপরে দুপুরে ওকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার অফিসে যেতে হবে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ছুটি, যদি কখন বিকেলে কাজ থাকে তাহলে দেরি করে ছুটি পাবে। বুধাদিত্য চুপচাপ ঝিলামকে দেখে, অতি নিপুণ হস্তে সব কিছু করে চলেছে। ড্রাইভার চলে যাবার পরে বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে এবারে ওর মন শান্তি হয়েছে কিনা। হেসে ফেলে ঝিলাম, বলে যে তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে, পরেরদিন চণ্ডীগড় যেতে হবে।
পরেরদিন বুধবার, সকালবেলা ঝিলাম ঠেলে বুধাদিত্যকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম চোখে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নেয়। ঝিলাম ওর আগেই উঠেছে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়। অবশ্য ওর অনেক সকালে ওঠার অভ্যাস আছে। কফি বানিয়ে দেয়। কালিনাথ কে বারবার বলে দেয় ঠিক ভাবে গাড়ি চালাতে। ম্যাডামের কথা অমান্য করে না। বুধাদিত্যের আঁকাবাঁকা রেখার জীবন সরল রেখায় চলতে শুরু করে। চণ্ডীগড় পৌঁছান মাত্র ঝিলাম ফোন করে জেনে নেয় যে ঠিক ভাবে পৌঁছেছে কিনা। সারাদিন কাজের মধ্যে খুব ব্যাস্ত থাকে, সারাদিনে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। রাখেশ ফেরার পথে ফোঁড়ন কাটে, কিরে শালা, গার্লফ্রেন্ড কে ফোন করে জানাবি না? তখন বুধাদিত্যের মনে পরে ঝিলামকে ফোন করা হয়নি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ফোন করে ঝিলামকে। ঝিলাম ফোন তুলেই একটু সাবধান বানী শুনিয়ে দিল, যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে আর কালিনাথ কে ধিরে সুস্থে গাড়ি চালাতে। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, ঝিলাম ওর জন্য না খেয়ে বসে থাকে। বাড়ি ফিরে ঝিলামের মুখের হাসি দেখে সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যায় এক নিমেষে। ঝিলাম ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে স্টাডিতে রেখে দেয়, ওর জন্য জল এনে দেয়। বুধাদিত্যের বড় ইচ্ছে করে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধতে, আবার ওই পুরানো দ্বিধা বোধ ওকে আটকে দেয়। ওই মিষ্টি হাসি হারাতে চায় না, সময়ের ওপরে সব ছেড়ে দেয়।
শুক্রবার সকালবেলা ঝিলাম যথারীতি স্কুলে বেড়িয়ে গেছে। এই কদিনের মধ্যে সমীরের বা অন্য কারুর ফোন আসেনি, ঝিলামের খোঁজ নেবার জন্য। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করেনি, সমীরের কথা, ফোন করেছিল কিনা সেটাও জানা হয়নি। বুধাদিত্য অফিসের কাজে ব্যাস্ত, ঠিক লাঞ্চের পরে ঝিলামের ফোন আসে। গলা শুনে মনে হল খুব ত্রস্ত আর উদ্বেগ মাখা।
ঝিলামের গলা কাঁপছে, “বাড়ি আসতে পার এখুনি?”
বুধাদিত্য, “তুমি কোথায়?”
ঝিলাম, “আমি বাড়িতে, গাড়ি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
বুধাদিত্য, “কি হয়েছে?”
ঝিলাম, “সমীর এসেছে বাড়িতে, তুমি প্লিস এখুনি বাড়ি আস।”
সমীরের নাম শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের। চোয়াল শক্ত করে ঝিলামকে বলে, “সামনের দরজা খোলা রেখে দেবে, আর বসার ঘরে বসিয়ে রাখবে। ফোন অন রাখ, কিছু হলে যেন আমি শুনতে পাই।”
ঝিলাম কাতর কণ্ঠে ডাক দেয়, “প্লিস, তাড়াতাড়ি এস।”
তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে কালিনাথ কে গাড়ি চালাতে বলে। বাড়িতে ঢোকার আগে, প্যাসেঞ্জার সিটের নীচ রাখা বাক্স থেকে পিস্তল’টা বের করে প্যান্টের পেছনে গুঁজে নেয়। একটু এদিক ওদিক করলে সমীরের মাথার মধ্যে সব কটা গুলি নামিয়ে দেবে, তারপরে যা হবার হবে, যদি মরতে হয় তাহলে বুকের মাঝে ঝিলামের ভালোবাসা নিয়ে মরবে। দৌড়ে তিনতলার সিঁড়ি চড়ে। বাড়িতে এসে দেখে, ঝিলাম কথা মত বাড়ির সদর দরজা হাঁ করে খুলে রেখেছে। সমীর মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে আর ঝিলাম বেশ কিছু দুরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে। বুধাদিত্য একবার সমীরের দিকে তাকায়, একবার ঝিলামের দিকে তাকায়। ওকে দেখে, ঝিলাম প্রানে বল পায়। সমীর ওর দিকে মাথা তুলে তাকায়, চোখ মুখ বিধ্বস্ত পরাজিত সৈনিকের মতন। দুই চোখ লাল, কিন্তু সেই করুন চোখ, মিনতি ভরা চাহনি বুধাদিত্যকে শান্ত করতে পারে না।
ওর সামনের সোফায় বসে ধির গম্ভির গলায় সমীর কে জিজ্ঞেস করে, “কি মনে করে এখানে আসা হয়েছে?”
সমীর মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, “আমি বড় পাপী, ঝিলামকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি।”
বুধাদিত্য চোয়াল চেপে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করে, “হটাত এই বোধোদয় হওয়ার কারন? নন্দিতা কি লাথি মেরেছে তোর গাঁড়ে?”
সমীর আলতো মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে ঝিলামের দিকে তাকায়। ওর চোখে জল, একবারের জন্য ভেবেছিল যে সমীর অন্য কারুর সাথে শুতে পারে। কিন্তু সেই কথা স্বামীর মুখে শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেছে ঝিলাম। স্বামী এক অন্য মেয়ের প্রেমে পরে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল, আর সেই স্বামী আবার ফিরে এসেছে। কি করবে ঝিলাম, কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
বুধাদিত্য, “তোর বাবা মা’র সাথে কথা বলতে চাই, তারপরে ঝিলামকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবি।”
সমীর নিচু গলায় বলে, “বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার কার্যকলাপে তাঁরা মর্মাহত।”
বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “এই বোকা… আমাকে গরু পেয়েছ? তুই শুয়োরের বাচ্চা, বললি আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম। এখুনি শালা ফোন লাগা কোলকাতায়, লাউডস্পিকারে দে, আমি কথা শুনতে চাই।” ঝিলামকে ইঙ্গিত করে যে পাশের সোফায় এসে বসতে। ঝিলাম ধির পায়ে বুধদিত্যের পাশের সোফায় এসে বসে পরে।
নিরুপায় সমীর প্রথমে ইতস্তত করে, কিন্তু বুধাদিত্যের লাল চোখের সামনে ঝুঁকে যায়। ফোন লাগায় কোলকাতায়, সমীরের মা ফোন ধরেন। ফোন ধরা মাত্রই ঝিলাম ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু বলে দেয়। সমীরের মা চুপ করে কিছুক্ষণ শোনেন সব কথা। তারপরে সমীরকে উত্তমমধ্যম বকা দিতে শুরু করেন। বলেন যে, ঝিলাম যদি চাকরি করতে চায় সে ভালো কথা, ওকে চাকরি করতে দিতে হবে, আর ঝিলামকে যদি কোনদিন কষ্ট দেয় তাহলে এক কথায় তাজ্যপুত্র করে দেবেন। সমীরের বাবা প্রচন্ড রেগে যান, এক কথায় জানিয়ে দেন, যে মা লক্ষ্মীর মতন মেয়ে ঝিলামকে যদি একটুও চোখের জল ফেলতে দেখে তাহলে সমীরকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। সমীরের চোখে জল, মুখ থমথমে, বুকের মাঝে পরিতাপের ছায়া। সব কথা শোনার পরে লুটিয়ে পরে ঝিলামের পায়ের কাছে।
পা ধরে বলে, “শেষ বারের মতন ক্ষমা করে দাও ঝিলাম। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে নাও।”
সমীরের বুক ফাটা কান্না দেখে ঝিলাম কেঁদে ফেলে, একবার বুধাদিত্যের মুখের দিকে তাকায়। বুধাদিত্যে সামনে ওর ভালোবাসা চলে যায়, বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটে হাসি আনে। মাথা দুলিয়ে সমীরের সাথে যাবার সম্মতি দেয়। বুক ভেঙ্গে আবার টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে ঝিলামকে ওর কোলে টেনে নেবে, কিন্তু সমীরের কান্না আর পরিতাপের ডাক শুনে সেই স্বপ্ন দূর অস্ত। ঝিলাম চুপচাপ উঠে নিজের ঘরে চলে যায় কাপড় পড়ার জন্য আর ব্যাগ গুছানোর জন্য।
সমীর চোখের জল মুছে হাত জোর করে বুধাদিত্যের সামনে বসে থাকে। বুধাদিত্য গর্জে ওঠে ওর মুখ দেখে, “মাদা… ওই কুমিরের কান্না আমাকে দেখাবি না। শালা তোকে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয় না, শুধু মাত্র ঝিলামের মুখ দেখে তোকে ছেড়ে দিলাম।” পিস্তল বের করে টেবিলে ওপরে রেখে দেয়। সমীরের নাকের সামনে তর্জনী নাড়িয়ে বলে, “ভাবিস না তোকে ছেড়ে দিলাম আমি। ঝিলামের চুল যদি বাঁকা হয়, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই পিস্তলের সব গুলি তোর মাথার মধ্যে নামিয়ে দেব। আমার আগে পেছনে কাঁদার কেউ নেই, বুঝলি। আমি তোকে খুন করে জেলে যেতে রাজি।”
ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সমীর, কাতর কণ্ঠে বলে, “না রে, আমি তোর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি।”
বেশ কিছুপরে ঝিলাম শাড়ি পরে, হাতে একটা সুটকেস নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়, একবার সারা বাড়ির দেয়ালের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য চুপ করে বসে থাকে, চোখের সামনে ঝিলামকে ছেড়ে দিতে বুক কেঁপে ওঠে। কালিনাথ কে ডেকে বলে ওদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসতে। ঝিলাম ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না, দু’চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলে। বুধাদিত্য মাথা তুলে তাকাতে পারেনা ঝিলামের মুখের দিকে। ঝিলাম ওর মাথায় আলতো করে হাত ছোঁয়ায়, তারপরে ধির পায়ে সমীরের পেছন পেছন ঝিলাম বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। কালিনাথ ঝিলামের ব্যাগ নিয়ে আগেই নিচে নেমে যায়। ঝিলাম চলে যাবার পরে দরজা খোলা পরে থাকে। স্বপ্ন দেখেছিল বুধাদিত্য, ঝিলামকে ওই দরজা দিয়ে এই বাড়ির গৃহিণী করে আনার। সেই ঝিলামকে শেষ পর্যন্ত সমীরের হাতে সঁপে দিতে হয়। মন মানে না, কিন্তু ঝিলাম যে সমীরের বিয়ে করা, আইনসিদ্ধ স্ত্রী। বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের হাতের ছোঁয়া লেগে। সব জায়গায় ঝিলামের নাম লেখা। একবার মনে হয় এই শোয়ার ঘর থেকে ঝিলাম বেড়িয়ে আসবে।
খানিক পরে দেখে ঝিলাম ওর দরজায় দাঁড়িয়ে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ায় বুধাদিত্য, সত্যি পাগল হয়ে গেছে ঝিলামের প্রেমে, দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিলামের ছায়া। সম্বিৎ ফিরে পায় যখন রক্ত মাংসের ঝিলাম দৌড়ে এসে ওর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে জড়িয়ে ধরে। বুধাদিত্যের বুক সেই প্রেমের পরশে হুহ করে কেঁপে ওঠে। প্রানপন শক্তি দিয়ে ঝিলামকে জড়িয়ে ওর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে। ঝিলাম দুই হাতে আঁকড়ে ধরে থাকে বুধাদিত্যের ঋজু দেহ। এই বুকের ওপর থেকে যেন মৃত্যুই ওকে ছিনিয়ে নেয় আর কারুর ক্ষমতা থাকে না ওকে বিচ্ছিন্ন করার।
বেশ কিছু পরে ধরা গলায় ঝিলাম ওকে বলে, “সুট’টা কিন্তু কাল দেবে, মনে করে নিয়ে এস যেন। বড় আলমারির লকারে আমার সব গয়না আর আমার সার্টিফিকেট গুলো রাখা। আমার জিনিস গুলো ছড়িয়ে দিও না আবার। দরকার পড়লে নিয়ে যাব, না হলে এখানেই থাক।” বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে ঝিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি চলে যাবার পরে প্লিস আর মদ খেও না।” বহু কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমি চললাম বুধো, ভালো থেক।”
“বুধো” নাম শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় বুধাদিত্য, আলতো করে ওর গালে হাত দিয়ে বলে, “চলি বলতে নেই ঝিল্লিরানি, বলে আসছি।”
“ঝিল্লিরানী” কোন রকমে “বুধো”র হাত ছাড়িয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। বেড়িয়ে যাবার আগে একটু বহু কষ্টে ঠোঁটে হেসে টেনে বলে, “সোমবার গাড়ি পাঠাতে ভুলোনা, আমি অপেক্ষা করে থাকব।”

______________________________
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#1)
ঝিলাম চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বুধাদিত্য। চোখের সামনে থেকে চলে যায়নি ভেবে ওর বুকে এক নব পল্লব অঙ্কুরিত হয়। নিজের না হোক, দূর থেকে দেখে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পরের দিন বিকেলে ঝিলামের বাড়িতে যায়। ওকে দেখে ঝিলামের মন খুশিতে ভরে যায়। বুধাদিত্য সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ঝিলামকে নিয়ে দুর্গাপুর কবে যাবে? ওকে জানায় যে সামনের সপ্তাহে ঝিলামের গরমে ছুটি পরে যাবে। সমীর ওকে জানায় যে এই সবের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য দুর্গাপুর যাবার আগে ঝিলামকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, আবার একবার হানিমুন করার ইচ্ছে আছে। জানায় যে ট্রেকিং যাবার ইচ্ছে আছে, যেখানে শুধু সমীর আর ঝিলাম, আর কেউ ওদের সাথে থাকবে না। সব ভুলের মাশুল গোনার জন্য তৈরি সমীর, তাই কোন দূর পাহাড়ের কোলে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে কয়েকটা দিন কাটাবে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যেতে চায়, তাঁর উত্তরে সমীর জানায় যে জায়গা এখনো ঠিক নেই তবে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে নেবে। বুধাদিত্যের মনে জাগে অপার শূন্যতা। ঝিলাম শেষে সমীরের সাথে, একা দূর পাহাড়ের কোলে, ঠিক ভেবে উঠতে পারেনা বুধাদিত্যের মাথা। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের বেলা বুবাইয়ের ফোন, “মামু নেক্সট উইক আমার গরমের ছুটি। মাম্মা বলেছে এবারে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে।”
ভাগ্নির গলার আওয়াজ শুনে ফাঁকা মন আনন্দে ভরে যায়। বুবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোর মা?”
বুবাই, “জানি না মামা, তবে সেখানে নাকি অনেক বড় একটা শিবের মন্দির আছে।”
অনিন্দিতাদি মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কিরে কেমন আছিস তুই?”
বুধাদিত্য, “এই বেশ ভালো আছি, ত হানিমুনে যাচ্ছ নাকি?”
অনিন্দিতাদি হেসে ফেলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েটাকে তুই দেখ, তাহলে আমি যেতে পারি আমার বরের সাথে।”
বুধাদিত্য, “চলে এস এখানে, ডালহৌসি নিয়ে যাব তোমাকে।”
অনিন্দিতাদি, “যাবোরে, তবে এবারে সুব্রত নেপাল নিয়ে যাচ্ছে।”
বুধাদিত্য, “হুম, বেশ বেশ ঘুরে এস।”
অনিন্দিতাদি একটু চুপ করে গলা নিচু করে বলে, “তোকে একটা কথা বলার আছে। সুবির পিসেমশাই আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, তোর ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।” কথা শুনে একটু থমকে যায় বুধাদিত্য। অনিন্দিতাদি বলে, “শোন বুধি, উনি তোর বাবা। একবার ত ঠিক ভাবে কথা বলা উচিত অনার সাথে, শোনা উচিত কি বলতে চান। গতবার ঠিক ভাবে কথা না বলে চলে এসেছিলি। মনে হয় তোর ওখানে যেতে চায়, আমি পিসেমশাইকে তোর ঠিকানা দিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখিস বুধি।”
বুধাদিত্যের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “তোমরা, মা মেয়েতে কি শুরু করেছ বলতে পার? আমার ফোন নাম্বার একজন বারোয়ারী বানিয়ে দিয়েছে, আর তুমি আমার ঠিকানা দিয়ে আমার বাড়ি’টাকে ধর্মশালা বানিয়ে দেবে।” রাগ হজম করে হেসে বলে, “আমার পমুসোনা কেমন আছে?”
অনিন্দিতাদি হেসে বলে, “মা ভালো আছে, আমাকে এবারে বলছিল কেদার বদ্রি নিয়ে যেতে।” অনিন্দিতাদি আরও কিছুক্ষণ বাড়ির কথা, মা বাবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
সোমবার যথারীতি বুধাদিত্য নিজে যায় ঝিলামের স্কুলে, ওকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ঝিলামের বুকে নিরাপত্তার এক বাতাস বয়ে যায়। হয়ত পাশে দাঁড়ানোর অধিকার নেই, কিন্তু মনে প্রানে জানে যে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বুধাদিত্য। গাড়িতে সারা রাস্তা ঝিলাম বুধাদিত্যের পাশ ঘেঁসে বসে থাকে। ঝিলাম জানায় যে সমীরের আচরন অনেক বদলে গেছে, গতকাল ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মনের মধ্যে একটু সংশয় ছিল কিন্তু সমীর ফিরে আসাতে ঠিক খুশি হবে না দুঃখিত হবে ভেবে পাচ্ছে না, ঝিলাম। বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় ওর কথা। ঝিলামের চোখ দুটি ভাসাভাসা, ঝিলামের মনের দ্বন্দ বুঝতে দেরি হয় না। নিচু গলায় ওকে জানায় যে সমীর যখন বদলে গেছে তখন ওর কাছেই ফিরে যেতে। ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে জানায় যে জানেনা। সমীর বলেছে যে একটা বড় চমক দেবে ওকে, একদম নতুন কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে মানুষ কম যায়। ঝিলামকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময়ে বলে বুধাদিত্য সবসময়ের জন্য ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিলামের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে, ধির পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়।
মাঝে একবার সমীরের অফিসে যায় বুধাদিত্য। সমীরকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যেতে চায়। বুধাদিত্যের প্রশ্নের সামনে সমীর জানায় যে ঝিলামকে একটা চমক দিয়ে চায় এক নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে। ভালো কথা, কিন্তু বুধাদিত্যকে পুরো যাত্রার পরিকল্পনা না জানালে ঝিলামকে ওর সাথে ছাড়বেনা। বুধাদিত্য জানায় যে সমীরের ওপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে গেছে। সমীর ওকে জায়গার নাম, দিনক্ষণ সব জানায়, আর অনুরোধ করে যে ঝিলামকে যাতে না জানায় ওর পরিকল্পনা। বুধাদিত্য কথা দেয় যে ঝিলামকে জানাবে না, কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয় যে কোনরকম চালাকি যেন না করে। সমীর করজোড়ে জানায় যে ফিরে পেয়েছে যখন তখন ঝিলামকে আগলে রাখবে। দিন কয়েক আর দেখা করে না ঝিলামের সাথে, তবে সকাল বিকেল ফোনে খবরাখবর জেনে নেয়। ঝিলাম বারবার বলে দেখা করতে, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যায় বুধাদিত্য, ঝিলাম যদি চোখের সামনে ওকে বারবার দেখে তাহলে হয়ত সমীরকে আবার নিজের করে নিতে পারবে না। ঝিলাম একটু খুশি, সমীর ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। প্রত্যকে বিকেল ফাঁকা হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। মনে মনে ঠিক করে নেয় যে একবার সমীরের সাথে ঝিলামের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেলে, দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে।
একদিন বিকেলে বুধাদিত্যের কাছে এক অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, ওপর পাশে দেবস্মিতার কণ্ঠস্বর শুনে অবাকের সাথে একটু বিরক্ত হয়ে যায়। অনিন্দিতাদির কথা মনে পরে ধির স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে কারন।
দেবস্মিতা বলেন, “যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে কি একবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে দেখা করা যেতে পারে?”
বুধাদিত্য অবাক, দেবস্মিতা দিল্লীতে আর তিনি হোটেলে উঠেছেন। উলটে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “মিস্টার সুবির গুহ কি সাথে এসেছেন?”
দেবস্মিতা, “না, আমি আর বাপ্পা এসেছি। ব্যস্ত কি খুব? একটু সময় বের করে দেখা করলে বড় ভালো হত।”
বুধাদিত্য, “কবে আসা হয়েছে?”
দেবস্মিতা, “আজ রাজধানিতে। দুপুরে ভেবেছিলাম ফোন করব কিন্তু পরে ভাবলাম যে বিকেলে ফোন করা নিরাপদ।”
বুধাদিত্য, “হটাত এই রকম ভাবে না জানিয়ে দিল্লী আসা আর এসে হোটেলে থাকা, কারন জানতে পারি কি?”
দেবস্মিতা একটু হেসে বলেন, “এমনিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা হয়, বারেবারে চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। তাই একবার ভাবলাম যে না জানিয়ে গিয়ে যদি একটু দর্শন পাওয়া যায় এই ব্যাস্ত মানুষের। কিছু কথা ছিল, আসলে বড় ভালো হত।”
দেবস্মিতার হাসি আর নরম কণ্ঠস্বর শুনে একটু নরম হয়ে যায় বুধাদিত্য। যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই যেন কাছে ডাকে ওর ফেলে আসা অতীত। ভাবে যে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো তাই দেবস্মিতাকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছে যাব। চেক আউট করে নিলে ভালো হয়, আমি বাড়িতে নিয়ে আসব বাপ্পাকে।”
শুনে একটু খুশি হন দেবস্মিতা, ওকে বলেন, “ঠিক আছে আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাপ্পাকে নিয়ে তৈরি থাকব। লবিতে এসে জানিয়ে দিলে আমরা নেমে আসব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। লবিতে গিয়ে দেবস্মিতাকে ফোন করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবস্মিতা বাপ্পাদিত্যর হাত ধরে নেমে আসেন। বুধাদিত্যকে দেখেই মায়ের পেছনে লুকিয়ে যায় বাপ্পাদিত্য। বাপ্পাদিত্যের জন্য বুধাদিত্য চকলেট এনেছিল, সেগুলো এগিয়ে দিতে, ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসে বুধাদিত্যের কাছে। দেবস্মিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুধাদিত্য ধরে ফেলে সেই শিশুশাবক কে, খিলখিল করে হেসে ওঠে বুধাদিত্যের কোলে উঠে। বুধাদিত্য আপাদমস্তক দেবস্মিতাকে নিরীক্ষণ করে। পরনের শাড়ি বেশ দামী, সাজগোজ আড়ম্বরহীন নেই অথচ অধভুত সুন্দরী দেখতে। এই বয়সে নিজের দেহের গঠন বেশ সুন্দর করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখতে দেবীপ্রতিমার মতন, তা সত্তেও ভদ্রমহিলাকে মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুখে হাসি মাখিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বলে। হোটেলের লোক গাড়িতে ওদের ব্যাগ রেখে দেয়।
গাড়িতে উঠে দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “নিজের গাড়ি?”
মাথা নারে বুধাদিত্য, “হ্যাঁ” তারপরে জিজ্ঞেস করে, “মিস্টার গুহ জানেন যে বাপ্পা এখানে এসেছে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ জানেন, তিনি আসতে চাইছিলেন। কিন্তু শরীর একটু খারাপ তাই ঠিক সাহস পেলাম না নিয়ে আসার। মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল যে দেখা আদৌ হবে কি না, তাই।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, দেবস্মিতাকে বলে, “কেন এলে তাড়িয়ে দিতাম নাকি?”
বাড়ি পৌঁছে কালীনাথকে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি ঢুকে দুই ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতা একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন এত বড় বাড়ি দেখে, “এত বড় বাড়িতে একা থাকা হয়? বিয়েথা করা হয়নি?”
কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয় বুধাদিত্য, “মনে হয় আমার কপালে বিয়ের কথা ভগবান লিখতে ভুলে গেছেন।”
দেবস্মিতা, “চা খাবে?” সেই প্রথম ভাববাচ্য ছেড়ে বুধাদিত্যকে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন দেবস্মিতা। বুধাদিত্য তাকিয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে। দেবস্মিতা “তুমি” বলে ফেলার পরেই হেসে বলেন, “আর ভাব বাচ্যে কথা বলতে পারছি না। আপত্তি থাকলে আপনি বলে ডাকতে পারি।”
বুধাদিত্য হেসে দেয়, “না তুমি শুনতে আপত্তি নেই, যদি তোমার না থাকে। আমি চা খাই না, তবে অতিথিদের জন্য চা রাখা আছে। তুমি বস, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
দেবস্মিতা, “একটু দুধ পেলে ভালো হয়, বাপ্পাকে খাইয়ে দিতাম।”
বাপ্পাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় দেবস্মিতা। বাপ্পা বায়না ধরে টিভি দেখবে, বুধাদিত্য টিভি চালিয়ে দেয়। দেবস্মিতাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়, দেবস্মিতা ঢুকে যান গেস্টরুমে। বুধাদিত্য কালীনাথকে বাজার থেকে দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলে। বাপ্পার শিশু কলতানে ঘর ভরে ওঠে, বুধাদিত্যকে ওর হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, “আমার বাড়িতে এত্ত বড় একটা টিভি আছে জানো।” “ড্যাডা টিভিতে শুধু তাইগার আর দিয়ারের লড়াই দেখে, আমার একদম ভালো লাগে না।” “তুমি আমাকে এত্তা বেনতেন কিনে দেবে, আমি উমঙ্গসর হয়ে সব দুত্তু লোককে মেরে দেব।” “তোমার ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে?” “আমার জন্য একটা কাইট এনে দেবে?” “রাতে তোমার বাড়িতে ব্ল্যাক বেবে আসে?” “তুমি দুধ খাও?” “দুধ খেলে হিম্যান হয়?”
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#2)
দেবস্মিতা কাপড় বদলে প্রসাধন সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখেন যে বুধাদিত্য আর বাপ্পাদিত্য মিলে গল্প শুরু হয়ে গেছে। বুধাদিত্য ভদ্রমহিলাকে যত দেখে তত যেন আশ্চর্য হয়ে যায়। দেবস্মিতার পরনে গাড় বেগুনি রঙের দামী সিল্কের জাপানি কিমোনো, গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা, অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। বুধাদিত্যকে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “খুব জ্বালাচ্ছে তাই না। একটু বস আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।” কালীনাথ দুধ এনে দেয়, দুধ গরম করে বাপ্পাকে দেন দেবস্মিতা। তারপরে নিজেদের জন্য চা আর কফি বানিয়ে আনেন।
বুধাদিত্যের সামনে বসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাড়ি সাজানোর রুচি বেশ আছে দেখছি।”
মনে মনে হেসে ফেলে বুধাদিত্য, বাড়ির আনাচে কানাচে ঝিলামের ছোঁয়া লেগে আছে। যেদিন চণ্ডীগড় গিয়েছিল বুধাদিত্য, ঝিলাম সেদিন নিজে লাজপত নগর গিয়ে শপিং করে এনেছিল, পর্দা, বিছানার চাদর, বেশ কিছু উইন্ড চাইম, বেশ কয়েকটা কাঁচের ফুলদানি। একটা ফল রাখার বেশ বড়সড় হাল্কা নীল রঙের কাঁচের বাটি, আরও অনেক কিছু। বুধাদিত্য হাসে চুপ করে। কিছু পরে জিজ্ঞেস করে দেবস্মিতাকে, “রাতে কি খাবে? বাইরে যাবে? যে হোটেলে ছিলে তার নিচে বেশ ভালো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে।”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “তোমাকে সেদিন রাতে খাওয়াতে পারিনি তাই আজ নিজে হাতে রান্ন করে খাওয়াব। বল কি খাবে।”
বাপ্পাদিত্য ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলে, “মাম্মা, মিত্তি খাব।” দেবস্মিতা মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। বাপ্পার কান্না ভরা চোখ দেখে বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে। ওকে কোলে টেনে বলে, “চল বাজারে, যেখানে হাত রাখবে সেটা তোমার।” বাপ্পা খুব খুশি হয়ে, দেবস্মিতাকে চোখ পাকিয়ে বলে, “আঙ্কেল আমাকে মিত্তি কিনে দেবে আমি একা একা খাব, তোমাকে মিত্তি দেব না।” ওর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
বুধাদিত্য, “তোমাকে আর হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না। প্রথম বার এসেছ, কাছেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে, ইচ্ছে থাকলে সেখানে অর্ডার দিয়ে দিতে পারি।”
বাপ্পাদিত্য বায়না ধরে, “মাম্মা ম্যাগি খাব।”
দেবস্মিতা ধমক দিতে যান বাপ্পাকে, বুধাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “আর বোকো না, আমি চাইনিজ অর্ডার দিচ্ছি। পারলে মিস্টার গুহ কে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি।”
দেবস্মিতা হেসে ফেলেন ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বলেন, করে দিচ্ছি। বুধাদিত্য বাপ্পাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, মিষ্টি, ঘুড়ি, কিছু খেলনা, কিছু চকলেট আর সি.আর.পার্কে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে দেবস্মিতার আসার কারন খুঁজতে চেষ্টা করে। মাথার মধ্যে ঠিক খুঁজে পায় না কারন। বাপ্পাদিত্য খেলনা পেয়ে খুব খুশি, সে তার খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। বুধাদিত্যের মন উৎকণ্ঠায় ভরে আসে, মনের ভেতরে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পায়না।
দেবস্মিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে বুধাদিত্যের মনের ভেতরে হাজার প্রশ্নের ভিড় করে এসেছে। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন বুধাদিত্যকে, “তোমার নিশ্চয় কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাকে, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞেস করতে পার।”
বুধাদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ এখানে?”
দেবস্মিতা ম্লান হেসে বলেন, “আমার উপরে নিশ্চয় তোমার খুব রাগ আছে, তাই না?” পাশে বাপ্পাদিত্য তার বেনটেন পুতুল আর গাড়ি নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। দেবস্মিতা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওর নাম আমি দিয়েছি, তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
বুধাদিত্যের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়, তাঁর মানে ভদ্রমহিলা সব আগে থেকে জানতেন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগ বিদ্বেষ কোনোরকমে গিলে উত্তর দেয়, “তোমার উপরে রাগ করব না কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।”
দেবস্মিতা ধির গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মিস্টার গুহ কে কত টুকু চেন?”
বুধাদিত্য দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি বলতে চাও যে আমার চেয়ে তুমি ভালো করে মিস্টার গুহ কে চেন?” দেবস্মিতা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “আমি শুধু এই টুকু জানি যে যখন আমার দরকার ছিল, তখন আমার বাবা আমার পাশে ছিলেন না। সুতরাং আমার কাছে তিনি মৃত।”
দেবস্মিতার চোখের কোনে একটু জল চলে আসে, “তুমি নিশ্চয় ভাবছ যে আমি মিস্টার গুহ’কে তোমার কাছ থেকে, মঞ্জুষা’দির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি?” বুধাদিত্যের মনে সেই ধারনাই ছিল এতদিন। দেবস্মিতা বলেন, “সত্যি বল, বুধাদিত্য, কতটুকু তুমি মিস্টার গুহ’কে চেন? আমি তোমার সাথে এখানে ঝগড়া করতে আসিনি, আমি শুধু এসেছি কিছু পর্দা সরাতে, আমি নিজের দিক স্পষ্ট করতে এসেছি বুধাদিত্য।” গলা ধরে আসে দেবস্মিতার।
বুধাদিত্য, “সত্যি বলতে মিস্টার গুহ’কে আমি কাছে কোনদিন পাইনি। ছোটবেলায় তিনি কোনদিন আমার কাছে ছিলেন না, আমি ছিলাম হস্টেলে, বাড়ি ফিরে তাকে সবসময় মদে ডুবে থাকতে দেখেছি। মা আমাকে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন, পরবর্তী জীবন মামাবাড়িতে আর মায়ের কাছে মানুষ হলাম।” চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, “আজো এই বুকের মধ্যে মায়ের কান্না বাজে, আজো মনে পরে আমাকে বুকে করে মা লেকটাউনের ফ্লাটে চলে আসেন আর ধানবাদ ফিরে যাননি।” দেবস্মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার ধারনা যে তুমি আমার মায়ের কাছ থেকে মিস্টার গুহ’কে ছিনিয়ে নিয়েছ।”
বুধাদিত্যের কথা শুনে দেবস্মিতা চোখের জল মুছে বলেন, “সত্যি কথা শুনতে চাও?” বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ।
দেবস্মিতা বলেন, “মিস্টার গুহ’র সাথে আমার দেখা হয় প্রায় বারো বছর আগে, ঠিক মঞ্জুষা দি, তোমার মায়ের মারা যাবার দুই বছর পরে। আমি তখন ধানবাদ রেল হস্পিটালের একজন নার্স। তন্বী, সুন্দরী, সবে চব্বিশে পা রেখেছি। বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন গাঁথা, চোখের সামনে অনেক প্রজাপতি ডানা মেলে থাকত। আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে, আমি বাড়ির ছোটো মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা, চিত্তরঞ্জন লোকো তে সাধারন একটা চাকরি করতেন। আমরা বিশেষ বড়োলোক ছিলামনা।”
বুধাদিত্য চুপ করে শুনে যায় দেবস্মিতার কথা, “একদিন একটা কয়লার খনি দেখতে গিয়ে হটাত হার্ট এটাক হয় মিস্টার গুহ’র। পরে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর। হস্পিটালে ভর্তি হন তিনি। আমি সেই কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে নার্স ছিলাম। সেখানে আমাদের প্রথম দেখা, একজন নার্স আর একজন রোগীর সম্পর্ক ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। সেই সময়ে তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ প্রায়, আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়, আমার ওনাকে দেখে শ্রদ্ধা হত, ভালোবাসা জাগেনি। আমি সেই সময়ে একজন কে ভালবাসতাম, তার নাম রথিন। মিস্টার গুহ অনেক বড়লোক ছিলেন। হস্পিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ঘরের জন্য একজনের দরকার ছিল তাঁর। হস্পিটালের একজন ডাক্তারের সাথে তাঁর চেনাজানা ছিল, তিনি আমাকে মিস্টার গুহ’র বাড়ি গিয়ে ওনার ড্রেসিং করতে বলেন। আমি মত দিয়েছিলাম।”
“মিস্টার গুহ চেয়েছিলেন একজন হাউস নার্স, আমি প্রথমে না করে দিয়েছিলাম। মিস্টার গুহ বলেছিলেন যে হস্পিটালের চেয়ে বেশি মাইনে দেবেন। সেই সময়ে আমার পয়সার দরকার ছিল, বাবা মাকে আমার পরাশুনার খরচ ফিরিয়ে দেবার ছিল। বাবা অনেক ধারদেনা করে আমাকে নারসিং পড়িয়ে ছিলেন। হসপিটালে থাকতে আমার যেন কেমন মনে হত, সবাই যেন আমার দেহ’টাকে খাবলে খুবলে দু’চোখে ধর্ষণ করছে। এতসব ভেবে, শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারের কথা শুনে আর মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি হসপিটালের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সাথে আমাকে হস্পিটালের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে হয়। আমার থাকার জায়গা ছিলনা, মিস্টার গুহ আমাকে তাঁর বাড়িতে থেকে যেতে বলেন। সেই সময়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি, বিশাল বাড়ি, বেশ কয়েকজন চাকর বাকর। আমি নিচের একটা ঘরে থাকতাম আর মিস্টার গুহ ওপরের ঘরে থাকতেন। ওই বাড়িতে আমি নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করি। চাকর থাকা সত্তেও তিনি আমার হাতে ছাড়া আর কারুর হাতে ওষুধ খাবেন না। কয়েক মাস আমার যত্নে ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।”
“সুস্থ হবার পরে আমি চিন্তায় পরে যাই যে আমার কাজ এই বাড়িতে শেষ, আমাকে আবার পথে নামতে হবে। হস্পিটাল আমাকে ফিরিয়ে নেবে কিনা সেই সংশয়ে ছিলাম। মিস্টার গুহ সেই সময়ে একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করে, হেভি আরথ মুভারস ভেহিকেলেসে ব্যাবসা। অনেক টাকা ঢেলে দিয়ে সেই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, কয়লার খনিতে, বড় বড় কস্ট্রাক্সানে গাড়ি আর মেসিনারি ভাড়া দিতেন তিনি। মিস্টার গুহ আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে আমি নারসিং ছেড়ে ওনার ব্যাবসাতে সাহায্য করি। আমি ব্যাবসার কিছুই জানতাম না, তিনি আমাকে সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন, প্রথমে। নতুন কাজ, নতুন জীবন, বুকের মাঝে এক নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। আমি তাঁর কথা মেনে কাজে যোগ দিলাম।”
“মিস্টার গুহ, কোনদিন তাঁর অতীতের কথা কাউকে বলতেন না। আমি সেই ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম যে মিস্টার গুহ’র পত্নি ছিলেন আর এক পুত্র আছে। মিস্টার গুহ যখন বাড়িতে থাকতেন না, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সারা বাড়ি তাদের চিনহ খুঁজে বেড়াতাম, কিন্তু সেই বাড়িতে মঞ্জুষা’দির চিনহ বা তোমার কোন চিনহ ছিল না।”
বুধাদিত্যের খুব খারাপ লাগে সেই কথা শুনে, যে মিস্টার গুহ, জীবন থেকে তাঁর মাকে, তাকে মুছে দিয়েছে। দেবস্মিতা বলতে থাকেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি স্বকীয় রুপ ধারন করেন। দিনে রাতে আবার মদ খেতে শুরু করে দেন। কাজের আছিলায় মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে থাকতেন। বেশির ভাগ দিন বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা আসত, তাদের সাথে বসে মদ খাওয়া হত, আমি চুপ করে নিজের ঘরে বসে কোম্পানির কাজে ডুবে থাকতাম। মিস্টার গুহ’র প্রচুর নারীসঙ্গ ছিল। আমি নিজে চোখে অনেক কে ওই বাড়িতে দেখেছি। এমন দেখেছি যে, কোন ম্যানেজারের বউ মিস্টার গুহ’র বিছানায় পরে মদে চুড়। রাগে দুঃখে, ব্যাথায় আমার বুক ভেঙ্গে যেত। শুধু ভগবান কে ডাকতাম, যে এই নরক থেকে নিয়ে যাও। ভয় হত যে একদিন হয়ত নেশায় মত্ত হয়ে আমার শ্লীলতাহানি করবেন।”
পিতার আসল পরিচয় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বুধাদিত্যের। ঘৃণায় শরীর রিরি করে ওঠে। দেবস্মিতা বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে আমার কমনীয় আকর্ষণীয় দেহ টাকে মাঝে মাঝেই আড় চোখে মিস্টার গুহ দেখেন। কিন্তু মিস্টার গুহ একবারের জন্যেও আমার দিকে হাত বাড়াননি। মনে হয় আমার সেবার ফল যে তাকে বাঁধা দিত আমার দেহখানি ছিন্নভিন্ন করতে। মিস্টার গুহ’র কাজে যোগ দেবার পরে আমি সেই খোলামেলা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড, রথিন, একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হ্যাঁ, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারতাম আমি। মিস্টার গুহ এতই বদনাম ছিলেন যে বাইরে বের হলে মানুষ আমাকে কেমন একটা চোখে দেখত। রথিন আমার বাড়িতে সেই সব কথা বলে দেয়। আমি নিস্পাপ নিস্কলঙ্ক ছিলাম কিন্তু বাড়ির কেউ আমার কথা শুনতে নারাজ ছিল। আমার যাবার আর কোথাও জায়গা ছিলনা, অগিত্যা আমাকে ফিরে আসতে হয় সেই জীবনে, যা ছিল আমার কপালে লেখা।”
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#3)
“সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কালী পুজোর দিন। বিকেলবেলা রথিনের সাথে হিরাপুরে দেখা করার কথা ছিল। মিস্টার গুহ আমাকে গাড়িতে করে হিরাপুরে নিয়ে যান। গাড়ি থেকে নামার সময়ে আমার হাত ধরে বলেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। সেই প্রথমবার মিস্টার গুহ আমাকে ছুঁয়েছিলেন, কিন্তু সেই কথা বাইরের লোক জানত না। সেই দৃশ্য দেখে রথিন রেগে যায়। আমার কথা শোনার আগেই আমার ওপরে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, আমাকে নীচ, জঘন্য, মিস্টার গুহ’র রক্ষিতা বলে গালাগালি দেয়। এতই বদনাম ছিলেন মিস্টার গুহ, যে তাঁর হাতের একটু ছোঁয়া আমার দুই বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়। রথিন আমার কোন কথা শুনল না, চলে গেল মুখ ঘুড়িয়ে। সেদিন বুঝেছিলাম, বিস্বাসের আসল মানে। হয়ত আমাদের ভালোবাসার মধ্যে সেই বিশ্বাস ছিল না তাই ভেঙ্গে গেল।”
বুধাদিত্য মাথা নিচু করে দেবস্মিতার ধরা গলার কাহিনী শুনে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে দেখে দুই চোখ জলে ভরা, গাল বেয়ে টসটস করে বড়বড় ফোঁটায় শ্রাবনের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। মাথা দোলায় বুধাদিত্য, সত্যি এই ভদ্রমহিলাকে অনেক ভুল বুঝেছে সে। চোখের জল মুছে বুক ভাঙ্গা হাসি টেনে বলে, “ভাবছ যে এই মেয়েটা তোমার সামনে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে, তাই না। কি দরকার আমার এত দূর এসে তোমাকে বানিয়ে গল্প শুনানোর, বল বুধাদিত্য?”
বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, ভাষা হারিয়ে এক নতুন রুপ দেখছে এই দেবী প্রতিমার। ঠিক সেই সময়ে কলিংবেল বাজে, চাইনিজ খাবার নিয়ে লোক এসে যায়। বুধাদিত্য টাকা মিটিয়ে খাবারের প্যাকেট দেবস্মিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। বাপ্পাদিত্য ম্যাগি দেখে খুব খুশি। বাপ্পাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে থাকে বুধাদিত্য, বুকের ভেতরে এক শীতল মনোরম বাতাস বয়ে যায়। এই ছোট্ট শিশুর মুখে হাসি দেখে সব দুঃখ, সব কষ্ট নিভে যায় বুধাদিত্যের। চাইনিজ খেতে খেতে বাপ্পার গল্প শুরু হয়, উমংসর নাকি অনেক “ফাইত” করে, অনেক “রাইত” খায়, মাম্মা ওকে বলে পড়াশুনা করলে বড় হয়ে ওকে উমংসরের কাছে নিয়ে যাবে। খাবার পরে বাপ্পাকে নিয়ে শুতে চলে যায় দেবস্মিতা। বুধাদিত্য চুপচাপ বসে থাকে বসার ঘরে, সব কিছু ঠিক, কিন্তু এইসব কথা তাকে এত দিন পরে জানানোর কি দরকার? সেই অঙ্ক মিলাতে পারছে না, বুধাদিত্য। সে’ত মিস্টার গুহ’র সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর জন্য হাত পাতেনি। বারেবারে অঙ্ক মিলাতে চেষ্টা করে বুধাদিত্য।
“ব্লাক কফি খাবে?” দেবস্মিতা বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁর গলার স্বর শুনে অঙ্ক মিলাতে ভুলে যায় বুধাদিত্য। মাথা নাড়িয়ে ইঙ্গিত করে যে, হ্যাঁ। দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু কাপ ব্লাক কফি বানিয়ে আনেন। আবার বসে পড়েন বুধাদিত্যের সামনের সোফায়।
বুধাদিত্য চেয়ে থাকে দেবস্মিতার দিকে, জিজ্ঞেস করে, “বাপ্পা ঘুমিয়ে গেছে?” মাথা নাড়ায় দেবস্মিতা, হ্যাঁ। বুধাদিত্য বড় শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এমন কি হল যে চোদ্দ বছর পরে আমার কথা মনে পড়েছে, মিস্টার গুহ’র? তাঁর জীবন’ত ভালোই চলছিল, তবে?”
দেবস্মিতা ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ, এই তবের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি এসছি, বুধাদিত্য। রথিনের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, আমি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। মাস পার হয়ে বছর ঘুরে যায়। দিনেদিনে মিস্টার গুহ’র মদের নেশা আর নারীসঙ্গ বেড়ে যায়। আমি চোখ কান বন্ধ করে নিচের ঘরে পরে থাকতাম আর বাড়ির চাকরদের তদারকি করতাম। মিস্টার গুহ’র ব্যাবসার ম্যানেজার, তরুন সিনহা আমাকে কাজ শিখতে অনেক সাহায্য করেন। কোম্পানির কাজ আমার ঘাড়ে এসে পরে, কেননা মিস্টার গুহ তাঁর অফিস আর মদ নিয়ে পরে থাকতেন। দিনেদিনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। একদিন মিস্টার গুহ’র সাথে এই নিয়ে প্রচন্ড মনমালিন্য হয়। আমি কড়া গলায় জানিয়ে দিয়েছিলাম, যে আমাকে যদি কাজে রাখতে হয় তাহলে বাড়িতে মেয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নেশায় চুড় মিস্টার গুহ আমাকে সেদিন আমার জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন যে এক বেতনভুক্ত চাকর। আমি ওই বাড়িকে নিজের বলে ভাবতাম। মিস্টার গুহ’র কথা শুনে আমি ভেঙ্গে যাই। নিজের ঘরে ঢুকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি আমি।”
“ঠিক সেই সময়ে চাকর এসে আমার দরজা ধাক্কা দেয়, চেঁচিয়ে বলে যে দিদিমনি বড়বাবুর কিছু হয়েছে। আমি আত্মহত্যার কথা ভুলে দৌড়ে উপরের ঘরে গিয়ে দেখি যে মিস্টার গুহ রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পরে। চারদিকে কাঁচ ছড়ান, গ্লাস বোতল ভাঙ্গা। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি ওনার মাথা কোলের ওপরে তুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চাকরকে বললাম তরুন বাবু আর এম্বুলেন্সকে খবর দিতে। মিস্টার গুহ’কে হসপিটালে ভর্তি করা হল। এবারে আর কাছ ছেড়ে যেতে পারলাম না আমি। চোখের সামনে দেখতে পেলাম যে আমার ভবিষ্যৎ মিস্টার গুহ’র সাথে বাঁধা। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু ভগবান আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। আমি চোখ বন্ধ করে মেনে নিলাম আমার ভবিতব্যের লেখন।”
“দ্বিতীয় বার ফিরিয়ে আনলাম মিস্টার গুহ’কে, কিন্তু এবারে মন শক্ত করে নিলাম, আমি মিস্টার গুহ’কে আর বিপথে যেতে দেব না। তাঁর মদ খাওয়া, নারীসঙ্গ সব বন্ধ করে দিলাম। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তিনি অফিস যেতে শুরু করেন। ড্রাইভারের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যে শুধু মাত্র অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে একটু দোনামনা ভাব দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু আমি তাঁর মিনতির সামনে নরম হয়ে যাইনি। সময়ের সাথে সাথে মিস্টার গুহ বদলে যান। অফিস থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতেন। ওনার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভাব ছিল আমার মনে, সেটা এক ভালোবাসায় পরিনত হয়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে আসার সময়ে অহেতুক ফুলের তোড়া, আমি চকলেট খেতে ভালবাসতাম, তাই মাঝে মাঝে চকলেট কিম্বা কোন উপহার নিয়ে আসতেন। আমাদের সম্পর্কে এক নতুন মোড় নেয়। আমি জানতাম যে আমাদের বয়সের ব্যাবধান অনেক, আমি জানতাম ভালোভাবে যে আমি কোন পথে চলেছি, কিন্তু আমি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারিনি। ওনার চোখে, ওনার আচরনে আমি আমার ভালোবাসা পুনরায় খুঁজে পাই। সেই পুরানো কচি মেয়েটা আবার আমার মধ্যে জেগে ওঠে, বুক ভরে মুক্তির শ্বাস নিলাম আমি।”
“মিস্টার গুহ’র সাথে দেখা হওয়ার প্রায় দু’বছর পরে, একদিন বিকেলে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি তাঁর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, সম্মতি জানালাম তাঁর প্রস্তাবে। আমি মিস্টার গুহ’র সামনে একটা শর্ত রাখলাম, আমাকে বিয়ে করতে হলে আমাকে তাঁর অতীত জানাতে হবে। তিনি রাজি হলেন, যে আমাকে তাঁর অতীতের কথা, মঞ্জুষা’দির কথা, তোমার কথা, সব বলবে। আমরা দু’জনে আমার বাড়ি চিত্তরঞ্জনে গেলাম, বাবা মা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দেন না। বলেন যে, মিস্টার গুহ আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়, সেমত অবস্থায় এই বিয়ে হতে পারে না। আমার দৃঢ়সঙ্কল্প’র সামনে বাবা মা শেষ পর্যন্ত ঝুঁকে যান, এবং আমাদের বিয়েতে আসেন। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব ছোটো করে হয়েছিল, গোটা কুড়ি বাইশ জন খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে বলা হয়নি সেই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমার স্বপ্ন ছিল আমার খুব বড় করে বিয়ে হবে, কিন্তু পাশে যখন ভালোবাসার মানুষকে পেলাম তখন আর সেই অলিক স্বপ্ন ছেড়ে মিস্টার গুহ’কে বুকে টেনে নিলাম।”
“সেই প্রথম রাতে আমি মিস্টার গুহ’কে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম যে তাঁর অতীতের কথা না জানালে তিনি আমাকে চিরতরে হারাবেন। আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে তাঁর অতীতের কালো পাতা মেলে ধরে। টাকা-পয়সা, প্রতিপত্তি আর নারীসঙ্গের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে এই পাঁকের মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেছেন। মঞ্জুষাদি’র শত বারন সত্তেও কোন কথা কানে দেননি তিনি। নিজের মনে যা ইচ্ছে হত তাই করতেন, শেষ পর্যন্ত মঞ্জুষাদি’কে একদিন বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন, বলেন যে সে আর তাঁর পুত্র তাঁর চাহিদার মাঝে দাঁড়িয়ে, তাদের তিনি মুখ দেখতে চাননা। তোমাকে তাঁর আগেই হস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চোখে জল, বুকে অনুতাপ, কাঁধে অসীম পাপের বোঝা, ঝুঁকে পড়েছেন মিস্টার গুহ। আমার হাত ধরে কাতর মিনতি করেন তাকে সেই পাপের বোঝা থেকে মুক্ত করতে। আমি তাঁর চোখের জলে, তাঁর নতুন রুপের সামনে গলে গিয়ে বুকে টেনে নিলাম। আমি তাকে বলি যে সেদিন থেকে তাঁর সব কষ্ট সব দুঃখ আমি বরন করে নিলাম। সেইদিন আমি বাড়ির নাম মঞ্জুষা মন্দির রাখি। সেটাই আমার উচিত মনে হয়েছিল।”
“একটা অতি পুরানো কাঠের বাক্স থেকে একটা এ্যালবাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন, তাঁর অতীত সেই হলদে কাগজে আটকা পরে আছে। আমাকে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি দেখিয়ে বললেন যে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি বুকে টেনে বলি যে আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়া জীবন হয়ত ফিরিয়ে দিতে পারবোনা, তবে ওনার ভবিষ্যৎ নিজে হাতে সুন্দর করে তুলবো।”
“দিন যায়, বাড়ির নতুন রানী আমি। আমি ব্যাবসার কাজে ডুবে গেলাম, নিজে হাতে সেই কোম্পানির ভার নিলাম। মিস্টার গুহ’র দুই দুই বার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে, তাই তাকে শুধু অফিস আর বাড়ি করতে নির্দেশ দিলাম। একটি নরম মেয়ে ধিরে ধিরে এক কোম্পানির কর্ণধারে পরিনত হল। আমি আমার সংসার আমার কাজ নিয়ে মেতে উঠলাম। আমাদের ভেতর থেকে মঞ্জুষাদি হারিয়ে গেল। বিয়ের পাঁচ বছর পরে বাপ্পার জন্ম হয়। আমি বাপ্পার নাম রেখেছিলাম তোমার নামের সাথে মিলিয়ে, হয়ত কোনদিন ওর দাদার সাথে দেখা হবে না, তবে নামের মধ্যে হয়ত জানবে যে ওর একটা দাদা এই পৃথিবীতে আছে। বাপ্পা জন্মাবার পরে মিস্টার গুহ চাকরি থেকে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিলেন, সারাদিন বাড়িতে থাকতেন আর বাপ্পার সাথে সময় কাটাতেন। কোন কোন দিন দুপুরে যদি অফিস থেকে বাড়ি আসতাম তাহলে দেখতাম যে বাপ্পা মিস্টার গুহ’র পেটের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে। ওদের দুজনকে দেখে আমার খুব ভালো লাগত।”
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে গেস্টরুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখে, কচি শিশু বাপ্পা, বিশাল বিছানায় উলটে শুয়ে, লাল পদ্মের মতন গোল মুখ, টোপা টোপা নরম গাল, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ খোলা, গায়ের ওপরে চাদর। দেবস্মিতার চোখের কোনা চিকচিক করছে, বাপ্পাকে আর বুধাদিত্যকে দেখে।
দেবস্মিতা চোখের কোল মুছে বুধাদিত্যকে বলেন, “গত বছর, জুলাই মাসে, আমি অফিসের কাজে একটু ব্যাস্ত ছিলাম। বাপ্পা আমার পায়ের কাছে, টেবিলের নিচে খেলছিল। খুব বায়না ধরে লুকোচুরি খেলার জন্য, ওর সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারতাম না, তাই লুকোচুরি খেলতে বসে গেলাম। বাপ্পা লুকিয়ে গেল একটা আলমারির ভেতরে। আমি খুঁজতে গিয়ে সেই আলমারির নিচে খুঁজে পেলাম সেই পুরানো কাঠের বাক্স। বাক্স খুলে এ্যালবাম হাতে নিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাতা উলটাতেই আমার সামনে মঞ্জুষাদি’র ছবি আর তোমার ছবি চলে এল। কাগজের ভেতর থেকে তোমার আর মঞ্জুষাদির চোখ আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে হাসছে। সেই ছবি দেখে আমার চোখে জল চলে আসে, আমি বাপ্পার দিকে তাকালাম। এই বিশাল পৃথিবীতে কোন এক কোনায় এক মাতৃহীন ছেলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই নিস্পাপ ছেলেটা যদি আমার বাপ্পা হত তাহলে…” কেঁপে ওঠে দেবস্মিতার গলা, মুখে হাত চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেন তিনি।
দ্বাদশ পর্বঃ কলুষিত দেবী। (#4)
দেবস্মিতা ধরা গলায় বলেন, “সেই ছেলেটার কি দোষ, সেও চেয়েছিল এক সুন্দর জীবন, সেও চেয়েছিল ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে, অন্যের পাপের বোঝা ঘাড়ে করে কেন সেই ছেলেটা এই বিশাল পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়াবে। আমি সেদিন সেই ছবি নিয়ে মিস্টার গুহ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিস্টার গুহ’র হাত বাপ্পার মাথায় রেখে বললাম, যে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, তোমাকে ডাকতে, তোমার প্রাপ্য তোমাকে ফিরিয়ে দিতে। মিস্টার গুহ ইতস্তত করেন, তিনি জানান যে তিনি তোমার কোন খবর জানেন না। আমি তাঁর কথা মানতে পারলাম না, আমি জানিয়ে দিলাম যে তিনি যদি তোমার সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন না করেন তাহলে আমি বাপ্পাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। মিস্টার গুহ বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলেন যে তিনি সচেষ্ট হবেন তাঁর পুত্রের সাথে যোগাযোগ করতে। সাথেসাথে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র তাকে ক্ষমা করে দেবে না। আমি জানিয়ে দিলাম, যে ক্ষমার প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তাঁর অতীতের জন্য আমি তাকে ক্ষমা করতে পারিনা, কেউ যদি পারে তিনি মঞ্জুষা’দি আর বুধাদিত্য।”
“অনেক জোর করার পরে মিস্টার গুহ রঞ্জন বাবুকে ফোন করেন। তোমার মামিমা ফোন ধরে অবাক হয়ে যান, বেশ কিছুক্ষণ তিনি কথা বলতে পারেন না। আমি বুঝতে পারি তোমার মামিমার রাগ আর বিদ্বেষ। আমি মিস্টার গুহকে তাঁর সামনে অনুরোধ করতে বললাম, যে একবারের জন্য তিনি যেন তোমার ফোন নাম্বার দেন। তোমার মামিমা, শেষ পর্যন্ত তোমার ফোন নাম্বার দিলেন। আমি মিস্টার গুহকে সেইক্ষণেই তোমাকে ফোন করতে বললাম। হাত কাঁপছিল তাঁর, চোখে অনুতাপের অশ্রু নিয়ে ফোন করেছিলেন তিনি। তাঁর পরের ঘটনা তুমি জানো ভালো করে। তোমার সাথে কথা বলার সময়ে তিনি জানতেন যে তুমি মিস্টার গুহ’কে ছেড়ে কথা বলবে না, সব দোষ আমার ওপরে পরবে আর আমার ছেলে বাপ্পার ওপরে পরবে।”
বুধাদিত্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, চোখে জল নেই, বুক ফাঁকা, ধিরে ধিরে জীবনের অঙ্ক মিলছে চোখের সামনে। বুধাদিত্যের সামনে এক কলুষিত দেবী বসে, সমাজ অনেক ঘৃণ্য নাম দিয়েছিল তাঁকে। সেই সব পার করে, এক পাপী আত্মা কে বুকে করে পাঁকের জীবন থেকে টেনে তুলেছে এই দেবী। দেবস্মিতা দেবীর মতন হেসে ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুমি আমাদের বাড়িতে এলে, তোমার আচরন দেখে মনে হল না যে তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পেরেছ। আমি তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারি যে তুমি আমাকেই দোষী সাবস্ত্য করেছ। আমি মিস্টার গুহ’র যখন অর্ধাঙ্গিনী তখন তাঁর পাপ ভাগ করে নিয়েছি আমি। আমি শেষ চেষ্টা করতে তৎপর হয়ে উঠলাম, শেষবারের জন্য তোমার সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলার জন্য। তোমার ঠিকানা জানার জন্য মিস্টার গুহ’কে দিয়ে অনিন্দিতাকে ফোন করালাম। তোমাকে এখানে না জানিয়ে আসার একটাই কারন, তোমাকে জানালে তুমি হয়ত আমাদের আসতে বারন করতে। তাই ভাবলাম একবারে এখানে এসে তোমার সাথে যোগাযোগ করা, চোখের সামনে দেখে অন্তত ফেলে দিতে পারবে না আমাদের।”
বুধাদিত্যের সামনে মিনতির সুরে ধরা গলায় বলেন, “আমি যখন মিসেস গুহ হবার জন্য সম্মতি দিয়েছিলাম, সেই সময়ে আমি জানতাম মিস্টার গুহ কি রকম মানুষ ছিলেন। তিনি বদলে গেছেন, বুধাদিত্য। আজ তিনি এক অন্য মানুষ। আমি জানিনা, তুমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা, কেননা তিনি তোমার অতীত তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।” দুই হাত জোর করে কেঁদে বলেন, “আমার ছেলেটা কোন পাপ করেনি, বুধাদিত্য। তোমার বিদ্বেষের অভিশাপ যেন ওর কাছে না আসে। শুধু তোমার একটু আশীর্বাদ চাইতে এসেছি, বুধাদিত্য, দয়া করে ফিরিয়ে দিও না আমাকে। আমি ভিক্ষে চাইছি, বুধাদিত্য।” দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন দেবস্মিতা।
বুধাদিত্য ঘাড় ঘুড়িয়ে বাপ্পাকে দেখে, এই শিশু কি সত্যি পাপ করতে পারে? ছোট্ট একটি ফুলের কুঁড়ি, এখন জীবন পরে আছে সামনে। বুধাদিত্য ত ভুলেই গিয়েছিল ওর বাবার কথা, তাঁর নতুন জবনের কথা। সামনে বসা এই দেবী প্রতিমা যদি এগিয়ে না আসত, তাহলে হয়ত কোনদিন যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হত না।
বুধাদিত্য কিছু পরে দেবস্মিতাকে বলে, “চিন্তা করো না, আমি তোমাদের মাঝে কোনদিন আসব না।”
চাপা আঁতকে ওঠেন দেবস্মিতা, “না, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পার না। ধানবাদের যা কিছু আছে তাতে বাপ্পার যেমন অধিকার তোমার সেই এক অধিকার। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “আমি কোথাও যাইনি, আমাকে কোথায় ফিরিয়ে নেবে?”
দেবস্মিতা, “তোমার বাবার কাছে, মিস্টার গুহ’র কাছে।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে চুপ করে মাথা দোলায়, কিছু পরে বলে, “তুমি সত্যি একজন দেবী। সব কিছু জেনেশুনে একজন পাপী আত্মার বিষ বুকে টেনে তাঁকে শুদ্ধ করে দিয়েছ। তোমার কথা কি করে ফেলব। ঠিক আছে আমি ছুটি পেলে নিশ্চয় যাব ধানবাদ। আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখব। কিন্তু আমি মিস্টার গুহ’র এক পয়সা নেব না, ক্ষমা করে দিও। আমার সম্পত্তি আমার মা, আমার সাথে আছেন, তাতেই আমি শান্তিতে আছি। আমাদের এই নতুন সম্পর্কের মাঝে টাকা পয়সা নিয়ে না আসাটাই শ্রেয়।”
দেবস্মিতা চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলেন, “আমি বড় আশা করে এসেছিলাম, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য।”
বুধাদিত্য, “না ম্যাডাম, সেটা সম্ভব নয়। দয়া করে সেই অনুরোধ দ্বিতীয় বার করো না, আমি মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারব না তাহলে।”
দেবস্মিতা, “আর বাপ্পা?”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “বুধাদিত্যের ভাই বাপ্পাদিত্য, আমার আশীর্বাদ সব সময়ে ওর সাথে। সত্যি বলছি, আমি ধানবাদ না গেলে জানতেই পারতাম না যে আমার একটা ভাই আছে।”
দেবস্মিতা অবশেষে চোখের জল মুছে হেসে বলেন, “আমি তাহলে মিস্টার গুহ’কে ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমি শেষ পর্যন্ত আমার কারজে সফল হয়েছি।”
বুধাদিত্য ঠিক বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, “মানে?” ঘড়ি দেখে সকাল প্রায় চারটে বাজে, “তুমি এখন ফোন করবে?”
দেবস্মিতা, “হ্যাঁ, তিনি জেগে আছেন। তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন, দাঁড়াও একটু কথা বল তাঁর সাথে। তোমার গলার আওয়াজ শুনে হয়ত একটু ঘুমাতে পারবেন।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “বয়স হয়েছে, ফোন করে ঘুমাতে বল এখন। কাল কথা হবে।”
দেবস্মিতা ফোন করেন সুবির বাবুকে, “ওষুধ খেয়েছিলে? রতন ঠিকঠাক খাবার দিয়েছিল?” “হ্যাঁ, বাপ্পা ঘুমাচ্ছে।” “হ্যাঁ, আমার সামনে বসে আছে।” “চিন্তা করো না। আমি কথা দিয়েছিলাম, ফিরিয়ে এনেছি আমি।” “না, সেটা আর হল না। তোমার ছেলে অনেক ঋজু, নিজের আত্মসন্মান আছে।” “তুমি এখন শান্তিতে ঘুমাও, পরে ফোন করব।” “কথা বলবে? ঠিক আছে দিচ্ছি।” ফোন বুধাদিত্যের হাতে ধরিয়ে বলেন, “একটু কথা বল না হলে ঘুমাবেন না।”
সুবির বাবুর গলা কেঁপে ওঠে, “কেমন আছো?”
বুধাদিত্য হেসে বলে, “এক প্রশ্ন কয় বার করবে। ঘুমাতে যাও, আর পারলে কালকে বা পরশুর ফ্লাইট ধরে চলে এস।”
কেঁদে ফেলেন সুবর বাবু, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
বুধাদিত্য, “ঠিক আছে, চলে এস। এখন ত ঘুমাও” ফোন দেবস্মিতাকে ফিরিয়ে দেয়।
ভোরের নবীন ঊষার আলো, খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসে।
দেবস্মিতা ফোন রেখে ওর দিকে হেসে বলেন, “মিসেস গুহ হিসাবে যে সম্পর্ক আমাদের হওয়া উচিত সেই মর্যাদা তুমি দেবে না আমি জানি আর সেটা চাইতেও আসিনি।” হাঁ করে থাকিয়ে থাকে বুধাদিত্য। আবার কোন নতুন হেঁয়ালি শুরু করল দেবস্মিতা, সেই ভাবতে থাকে। দেবস্মিতা বলে, “আমি বাড়ির ছোটো ছিলাম, খুব ইচ্ছে ছিল আমার একটা ভাই হোক। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমাদের মাঝে হতে পারে না। তাই না?”
বুধাদিত্য বুঝতে পারে কি বলতে চায় দেবস্মিতা। হেসে বলে, “তুমি দেবী, সুতরাং তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে আমি তোমাকে দেবী বলে ডাকব ব্যাস। আর সম্পর্কের অলগলিতে ঘুরতে চাই না।”
স্বস্তির শ্বাস নিলেন দেবস্মিতা, জিজ্ঞেস করেন “কফি খাবে?”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “তোমার ঘুম পাচ্ছে না?”
দেবস্মিতা হেসে বলেন, “দশ বছর অপেক্ষা করেছিলাম এই দিন’টার জন্য। আমার না ঘুমালেও চলবে, তুমি ঘুমাতে যেতে পার।”
দেবস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকে দু’কাপ কফি বানিয়ে এনে বুধাদিত্যের সামনে বসে। কফির কাঁপে চুমুক দিয়ে বুধাদিত্যকে প্রশ্ন করে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি, যদিও প্রশ্ন টা অনেক ব্যাক্তিগত, তাও উত্তর জানালে একটু খুশি হব।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “কি?”
দেবস্মিতা মৃদু হেসে বলে, “তোমার রান্নাঘর, সোফার কভার, বাড়ির দেয়াল ইত্যাদি দেখে মনে হয় তোমার জীবনে কেউ আছে, সত্যি কি না জানিনা।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, শেষ পর্যন্ত দেবীর কড়া নজরে ধরা পরে গেছে। হেসে বলে, “কি জানি ঠিক জানিনা, আছে কি নেই।”
দেবস্মিতা, “কি ব্যাপার, কি অসুবিধে একটু জানতে পারি কি?”
বুধাদিত্য একটু খানি চুপ করে থেকে বলে, “আমি একজনকে ভালোবাসি।” শেষ পর্যন্ত নিজের হৃদয়ের কথা ভালোবাসার মানুষকে না জানিয়ে অন্য কাউকে জানাতে হচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন করে এক অব্যাক্ত ব্যাথা শুরু হয় বুধাদিত্যের।
দেবস্মিতা বড় বড় চোখ করে হেসে বলে, “বেশ ভাল কথা, কবে বিয়ে করছ?”
বুধাদিত্যের মুখ শুকিয়ে যায় ঝিলামের কথা ভেবে, “বিয়ে হয়ত হবে না আমাদের।” ঝিলাম কিছুদিন পরে সমীরের সাথে বেড়াতে যাবে, ঝিলাম আর সমীরের সুখের সংসার থেকে দুরে সরে যেতে যায়।
দেবস্মিতা, “কেন? অসুবিধে কোথায়?” বুধাদিত্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেবস্মিতা ওর পাশে বসে ওর পিঠের ওপরে হাত রেখে মৃদু সুরে বলে, “দেবী বলে ডেকেছ, আর নিজের মনের কষ্ট একটু জানাবে না?”
নরম হাতের পরশে মায়ের কথা মনে পরে যায় বুধাদিত্যের, চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে বেদনায়। কোনোরকমে আবেগ সামলে বলে, “বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক, দেবী। জানিনা শুনলে তুমি আমাকে কি বলবে। আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার বন্ধুর বৌ, নাম ঝিলাম। সমীরের সাথে বিয়ে হয় বছর তিন আগে। এই গত বছর দিল্লীতে দেখা, এখন দিল্লীতে থাকে। সমীর আর ঝিলামের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরে খুব টানাপড়েনের মধ্যে চলে। সমীর কাউকে ভালোবাসে বা ভালবাসত। আমি ভেবেছিলাম যে হয়ত ওদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যাবে আর আমি ঝিলামকে আমার করে নিতে পারব। কিন্তু কিছুদিন আগে সমীর ফিরে আসে ঝিলামের জীবনে। আমি সেই একা।”
দেবস্মিতা পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনদিন তোমার মনের কথা ঝিলামকে জানিয়েছ?” বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “না।” দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করে, “ঝিলাম তোমাকে ভালোবাসে?” বুধাদিত্য শূন্য চোখে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবস্মিতা বুঝে যায় যে বুধাদিত্য অথবা ঝিলাম কেউ পরস্পরকে মনের কথা জানায়নি। চিন্তায় পরে যায় দেবস্মিতা, “সত্যি বড় প্যাঁচালো সম্পর্ক। এখানে কিছু করা মানে সবার চোখে পাপী, ব্যাভিচারি হয়ে যাওয়া, এক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরা। কি করবে ভেবেছ?”
বুধাদিত্য মাথা দোলায়, “জানিনা, দেবী। আমি সত্যি নিজের কাছে হেরে গেছি। ওদের মাঝে যেদিন বুঝব যে ভালোবাসা ফিরে এসেছে, সেদিন আমি দিল্লী ছেড়ে, দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাব। আমি জানি, আমি যদি ঝিলামের চোখের সামনে থাকি তাহলে সমীরকে মেনে নিতে ঝিলামের বড় কষ্ট হবে। আমি চাই না ওদের ভালোবাসার মাঝে কাটা হয়ে দাঁড়াতে।”
দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি হারতে পার না, বুধাদিত্য। আমার মন বলছে, একদিন এই কালো মেঘের মাঝ খান থেকে এক নতুন সূর্য উঠবে, তোমার মনের সব কালিমা দূর করে দেবে। সত্যি যদি তোমাকে কোথাও যেতে হয়, তুমি আমার কাছে চলে এস। আমার বাড়ি, তোমার বাবার বাড়ির দরজা তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছে বুধাদিত্য।”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “ভেবে দেখব দেবী। যাও একটু বিশ্রাম করো, আমাকে নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও।”
সকাল বেলায় বুধাদিত্য মামাকে ফোন করে সব কথা বলে। প্রমীলা দেবীর মন একটু খারাপ হয়ে যায়। বুধাদিত্য বুঝতে পারে যে মামিমা ভাবছেন যে ছেলে বাবা পেয়ে হয়ত তাকে ভুলে যাবে। বুধাদিত্য মামিমাকে আসস্থ করে, “পমুসোনা”র জায়গা ওর জীবনে অন্য কেউ নিতে পারবে না। বাবাকে হয়ত ফিরে পেয়েছে, কিন্তু রঞ্জনবাবুকে জানায় যে সুবিরবাবু কর্মে নয়, শুধু মাত্র জন্ম দিয়েছেন বলে তাঁর বাবা। তৎক্ষণাৎ প্লেনের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেয় মামা মামীকে। বিকেলের মধ্যে প্রমীলাদেবী আর রঞ্জনবাবু দিল্লী আসেন। প্রমীলাদেবী দেবস্মিতাকে দেখে তার সাথে কথা বলে আসস্থ হন। বাপ্পাকে দেখে বেশ খুশি হন। রাতের মধ্যে সুবিরবাবু দিল্লী পৌঁছান। বাড়ি লোকজনের সমাগমে মুখর ওঠে, ছোট্ট বাপ্পা মায়ের কোলে চেপে নতুন লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুবিরবাবু অনেক চেষ্টা করেন ছেলেকে ধানবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার। বুধাদিত্য সুবিরবাবুকে শোয়ার ঘরে মায়ের ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দেয়’যে ওর মা ওর সাথেই আছে, আর এই সম্পত্তি নিয়ে অথবা ধানবাদ যাওয়া নিয়ে যেন কথা না বলে। জানায় যে, নতুন সম্পর্কে টাকা পয়সা না আসলেই ভালো, মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না। বুধাদিত্যের জীবনে সব আছে নতুন আর কিছু চায় না।

More বাংলা চটি গল্প

Leave a Comment