মিষ্টি মূহুর্ত [৭ম পর্ব][সমাপ্ত]

লেখক :— a-man & বিচিত্রবীর্য
Typist :— বিচিত্রবীর্য

নতুন জীবনের স্পর্শ

সকাল সাড়ে ছটার দিকে সুচির ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতে পিটপিট করে তাকিয়ে সুচি উঠে বসলো । হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে , একটা লম্বা হাই তুলে আলস্য কাটানোর চেষ্টা করলো। নতুন ঘর হলেও ঘুমটা ভালোই হয়েছে তার। আলস্য কাটানোর পর , ঘুম জড়ানো চোখে , পাশে যে ছেলেটা শুয়ে আছে তার দিকে তাকালো।
মাথার দিকের জানালা দিয়ে সূর্যের মিঠে আলো বিছানায় এসে পড়ছে। না , বিছানার উপর সেই রোদ পড়ছে না। রোদটা পড়ছে সুচির স্বামীর ঘুমন্ত মুখের উপর। রোদের তেজ এখনও বাড়েনি তাই তার স্বামীর ঘুম এখনও ভাঙেনি।
সুচি মুখে একটা মিষ্টি লাজুক হাসি নিয়ে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কি মিষ্টি লাগছে দেখতে ! চওড়া মুখে চাপ দাড়িতে হ্যান্ডসাম দেখায় খুব । আকাশের লম্বা শরীরটা দেখে সুচি বললো , ‘ উমম , আমাকে খুব তালগাছ বলে রাগাতো ! এখন নিজেই ছয় ফুটের তালগাছ হয়ে গেছে। , আরও কিছুক্ষণ আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেই সুচির ঠোঁটে একটা লজ্জার হাসির রেখা ফুটে উঠলো ।
কাল পর্যন্ত সে ছিল সুচিত্রা তালুকদার । আর আজ হয়ে গেছে সুচিত্রা মিত্র। একজনের স্ত্রী , একজনের বৌমা। কথাটা ভাবতেই লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠলো । লজ্জায় নিজেই দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো । পরক্ষণেই ভাবলো , ‘ ঘরে তো শুধু সে একা জেগে । আর পাশে আকাশ ঘুমাচ্ছে। তাহলে মুখ ঢাকার কি দরকার ! , কথাটা মাথাতে আসতেই নিজের পাগলামির জন্য সে আরও লজ্জা পেল।
আরও কিছুক্ষণ খাটের উপর বসে থেকে ভাবলো স্নানটা করে নিই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আলনায় চোখ পড়তেই মনে পড়লো তার একটাও জামা কাপড় এই ঘরে নেই। আছে নিজের ঘরে। , ‘ কিন্তু এখন নিতে যাওয়া কি ঠিক হবে ! দিদিকে বলবো ! না , দিদি ইয়ার্কি মারবে। আকাশকে পাঠাবো ? না। কি আনতে কি এনে বসবে ! তার চেয়ে নিজে গিয়ে সব একবারেই গুছিয়ে আনাই ভালো।
এটা ভেবেই সে দরজার ছিটকিনি খুলে ঘরের বাইরে চলে এলো। ঘরের বাইরে এসে দেখলো তার শাশুড়ি অর্থাৎ আকাশের মা মুখ হাত ধুয়ে ব্রাশ করে সবে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন। আর কেউ মনে হয় এখনও জাগেনি । আকাশের মাকে কিছু না বলে সুচি চুপিচুপি ফ্ল্যাটের বাইরে আসতে লাগলো। বিপত্তিটা বাধলো চৌকাঠ পেরনোর সময়।
চৌকাঠের বাইরে পা রাখতেই সুচি পিছন থেকে আকাশের মায়ের গলা পেল , “ কোথায় যাচ্ছিস এখন ? „
সুচি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো । পিছন ফিরে বললো , “ শাড়ি পাল্টাবো , এখানে তো পড়ার মতো একটাও জামা নেই তাই ওই ঘর থেকে জামা কাপড় আনতে যাচ্ছি। „
“ ও , একেবারে স্নান করে নিস । „ বলে তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। কালকের বিয়েতে বেশ অনেক খাবার বেঁচে গেছিল। তাই আকাশের বাবা একটা এনজিও কে ডেকে সব খাবার দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ঘরে এখন ব্রেকফাস্ট করার মতোও খাবার নেই। আকাশের মা কি বানানো যায় ভাবতে ভাবতে লুচি বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
এদিকে সুচি নিজের বোকামির জন্য নিজের জিভটায় একবার কামড় বসালো । তবে সে কি বোকামি করেছে সেটা সে নিজেও জানে না। ফ্ল্যাটের বাইরে এসে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখলো ফ্ল্যাটের দরজাটা হাট করে খোলা। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলো লিভিংরুমে মামা মামি মামাতো ভাই বোন সব বসে আছে। আর তাদের আন্ডা বাচ্চাগুলো এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। সুমি আর মা তাদের চা পরিবেশন করতে ব্যাস্ত।
সুচি খুব অবাক হলো। এই ঘরের প্রায় সবাই জেগে গেছে। আর ওই ঘরে শুধু আকাশের মা। হয়তো এদের তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস তাই ! এটা ভেবেই সে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো।
সুচি যে ফ্ল্যাটে ঢুকেছে সেটা সুমির দৃষ্টি এড়ালো না। সে সুচিকে দেখে ইয়ার্কি করে বললো , “ এখানে কি করছিস তুই ? বিয়ের পরের দিনই বাবার বাড়ি চলে এসছিস ! জানিস না , বিয়ের পর শশুর বাড়িই নিজের বাড়ি হয়ে যায়। „
দিদির ইয়ার্কি বুঝতে পেরে , সুচি নিজের জিভটা বার করে , দিদিকে ভেঙিয়ে বললো , “ আমি জামা কাপড় নিতে এসছি। নেওয়া হয়ে গেলেই চলে যাবো। তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। „
সুচি নিজের ঘরে ঢুকে দেখলো খাটে এখনও তার দুজন মামাতো বোন ঘুমিয়ে আছে। সে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আলনা আর আলমারি থেকে জামা কাপড় গুলো বার করে একটা বড়ো কাপড়ের ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
ফ্ল্যাটের বাইরে আসতে দেখলো তার ছোট মামা বাথরুম থেকে বার হচ্ছে। সুচির মনে পড়লো দাঁত মাজার ব্রাশের কথা। সে সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমে ঢুকে নিজের পিঙ্ক রঙের ব্রাশটা নিয়ে চলে এলো।
নিজের ঘরে এসে ঢুকতেই দেখলো আকাশ খাটের উপর বসে আছে। সুচি আকাশকে দেখে লজ্জা পেয়ে , নিজের ডান গালের উপর পড়ে থাকা চুল কানের পিছনে দিয়ে দিল। আকাশ সুচিকে দেখে একটা হাই বড়ো তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় গেছিলি ? „
আকাশের তুই তোকারি শুনে সুচি রাগী চোখে তাকালো। সুচির রাগী চোখের অর্থ বুঝতে পেরে আকাশ খাটে বসেই হাত দুটো সামনের দিকে তুলে সুচির রাগ কমানোর চেষ্টা করে বললো , “ সরি , সরি , সকাল সকাল মাথায় ছিল না। কোথায় গিয়েছিলে ? „
সুচি একবার উদাস দৃষ্টিতে আকাশকে দেখে বললো , “ জামা কাপড় আনতে । „
কথাটা বলে সুচি কাপড়ের বড়ো ব্যাগটা আলনার পাশে রাখলো। ব্যাগটা রেখে ভিতর থেকে স্নান করার পর কি পড়বে সেটা ভাবতে লাগলো। ঠিক তখনই সুচি দেখলো আকাশ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিতে সুচি একটা নিবিড় আকর্ষণ খুঁজে পেল। এই দৃষ্টির ভিতরে লুকিয়ে থাকা তীব্র আকর্ষণ সুচির বুকের ভিতরটা পুড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগের ভিতর থেকে তাড়াহুড়ো করে যেকোন একটা জামা বার করে সুচি বললো , “ আমি স্নানে চললাম। „ তারপর আকাশের দিকে না তাকিয়েই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । ঘরের বাইরে এসে একটা বড়ো গভীর নিশ্বাস ফেলার পর সুচি আকাশের ওই দৃষ্টি থেকে শান্তি পেল।
বাথরুমে গিয়ে সুচি দেখলো যে , সে যেটা তাড়াহুড়ো করে এনেছে সেটা একটা চুড়িদার আর প্লাজো । তারপর ব্রাশ করার পর স্নান করে , চুড়িদার পড়ে বেরিয়ে এলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো আকাশ একটা স্যান্ডো গ্যাঞ্জি পড়ে সোফায় বসে আছে। সুচিকে চুড়িদার পড়ে থাকতে দেখে আকাশ বললো , “ আমি তো ভাবছিলাম তুমি শাড়ি পড়বে। „
সুচি আকাশের কথায় রেগে গেল “ কেন ! চুড়িদার পড়লে তোমার আপত্তি আছে ? „
আকাশের মা সবে গ্যাসে আগুন ধরিয়েছেন। তিনি দুজনের কথা শুনে সুচিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , “ তোর যা ইচ্ছা হয় তাই পড়ে থাকবি। শাড়ি পড়ে থাকতে ভালো না লাগলে পড়বি না। „
কাকির সম্মতি পেয়ে সুচি আকাশের দিকে একবার রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে নিজের ঘরে চলে গেল।
আকাশ সুচির রাগি দৃষ্টির মানে বুঝতে পারলো না। সে তো ভেবেছিল , ‘ মা হয়তো খারাপ বলবে । , তাই আগে থেকে সুচিকে সাবধান করছিল। আর এইটুকু বিষয়ে এতো রাগের কি আছে সেটা বুঝিনা। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের বেগে মাথায় একটা কারণ খেলে গেল । কথাটা মাথায় আসতেই আকাশ চিন্তায় পড়ে গেল। সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
আকাশ ঘরে এসে দেখলো সুচি আয়নার সামনে বসে আছে। মাথায় তোয়ালেটা পাগড়ীর মতো পড়ে আছে। নিজের প্রেয়সীকে আয়নার সামনে , বাড়ির বউয়ের মতো বসে সাজগোজ করতে দেখে আকাশের উতলা মন শান্ত হয়ে এলো। আকাশ চুপচাপ খাটের উপর বসে সুচিকে দেখতে লাগলো। প্রথমে সুচি একটা ছোট কালো টিপ কপালে পড়লো। তারপর মেহেন্দী পড়া হাত দিয়ে সিঁদুরের কৌটো থেকে একটা কাঠি মত বার করলো। তারপর মাথায় জড়ানো তোয়ালেটা একটু সরিয়ে সেই কাঠিটা সিঁথিতে দিয়ে টেনে দিল।
গতকাল যখন আকাশ তাকে সিঁদুর পড়াতে শুরু করেছিল তখন মনের ভিতরে এমন একটা ঝড় উঠেছিল যা আগে কখনো ওঠেনি। সেই মূহুর্তে চোখ বন্ধ করে আকাশের চাল মাপার কাঠা দিয়ে সিঁদুর পড়ানোর মিষ্টি মূহুর্তটা উপভোগ করছিল। সেই ঝড়টা যেমন হঠাৎ করে সিঁদুর পড়ানো শুরু করার সময় শুরু হয়েছিল তেমন সিঁদুর পড়ানো শেষ হলে ঝড়টা হঠাৎ থেমেও গেছিল। আর আজ জীবনে এই প্রথম নিজের হাতে সিঁদুর পড়ায় এক আলাদা পূর্ণতার স্বাদ পেলো সুচি।
ছোটবেলা থেকে মাকে সিঁদুর পড়তে দেখে আসছে সে। সিঁদুর পড়লে মাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগে তাই একদিন সে মায়ের অলক্ষ্যে সিঁদুর পড়তে গেছিল। মা দেখতে পেয়ে খুব বকা বকেছিল। আজ নিজের হাতে সিঁদুর পড়তে গিয়ে ছোটবেলার সেই কথা মনে পড়ে গেল। আর তাই লজ্জায় ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
সিঁদুর পড়ার পর সুচি টেবিল থেকে উঠে দাড়ালো। আকাশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে চুল মুছতে লাগলো। এদিকে আকাশ সুচির এই অবহেলা দেখে বললো , “ সরি আমি ওটা মিন করতে চাইনি। আমি ভেবেছিলাম মা হয়তো খারাপ ভাববে। তাই ! „
এর উত্তরে সুচি কিছু বললো না। সুচির অবহেলা দেখে আকাশ সুচির হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো , “ প্লিজ ভুল বুঝোনা। কাল আমাদের বিয়ে হয়েছে । এখনও সারাজীবন পড়ে আছে। আমি সত্যিই তোমাকে ডমিনেট করতে চাইনি , চাইওনা । মায়ের কথা ভেবে ওটা বলেছিলাম। প্লিজ ভুল বুঝোনা । „
“ হয়েছে। আমি কিছু মনে করিনি। ছাড়ো , স্নানে যাও। „ বলে আকাশের বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো।
তখনই বাইরে থেকে মায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল , “ এই আকাশ , স্নান না করে ঘরে ঢুকে গেলি যে । „
সঙ্গে সঙ্গে আকাশ সুচিকে ছেড়ে দিলো। মায়ের উদ্দেশ্যে গলা তুলে বললো , “ তোয়ালে নিতে এসছি । „ বলে সুচির মাথা থেকে তোয়ালে খুলতে লাগলো। সুচি মাথা থেকে তোয়ালে খুলে আকাশকে দিয়ে দিল।
আকাশ তোয়ালে আর একটা জামা প্যান্ট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেল। সুচিও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকলো , “ কি করছো কাকি ? „
সুচির মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে আকাশের মা বললেন “ মা বলে ডাকতে অসুবিধা আছে ! „ এর উত্তরে সুচি কিছু বলছে না দেখে আকাশের মা বললেন , “ পায়েস বানাতে পারিস ? „
সুচি আকাশের মায়ের প্রথম কথাতেই লজ্জা পেয়ে গেছিল। জন্ম থেকে যে মহিলাকে ‘ কাকি , বলে ডেকে আসছে তাকে হঠাৎ ‘ মা , বলতে হবে ভেবেই সে লজ্জা পেয়েছিল। পায়েস বানানোর জিজ্ঞাসায় সে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে , “ হুম „ বললো।
“ এই নে । „ বলে আকাশের মা একটা ছোট গামলা সুচির দিকে এগিয়ে দিলেন । সুচি দেখলো তাতে চাল ভেজানো আছে।
“ আর এই নে দুধ। আর যা যা লাগবে সব এখানে আছে । „ বলে আরও একটা প্লাস্টিকের পাত্র এগিয়ে দিলেন। তাতে বিভিন্ন ছোট বড়ো আকারের কৌটা রাখা আছে।
সুচি বুঝতে পারলো যে আকাশের মা তাকে আকাশের জন্য পায়েস রান্না করতে বলছে। সুচি কিছু না বলে রান্না করতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণ পরেই আকাশের মামা মামি আর অজয় ঘুম থেকে উঠে পড়লো। আকাশের মামি এসে ব্রেকফাস্ট বানাতে সাহায্য করতে লাগলো ।
আকাশ বাথরুম থেকে বার হতেই নাকে পায়েসের মিষ্টি গন্ধ পেল। পুরো ঘরটা যেন পায়েসের গন্ধে ম ম করছে। আকাশ সোফায় বসলে এবং সুচির পায়েস রান্না হওয়ার পর সে একটা বাটিতে পায়েস তুলে আকাশকে দিল। আকাশ প্রথমে অবাক হয়ে সুচির মুখের দিকে তাকালো , তারপর পায়েসের বাটিটা নিয়ে খেতে লাগলো। সুচির হাতের রান্না আকাশ আগেও খেয়েছে। কিন্তু বউ রুপি সুচির হাতের রান্নার স্বাদ সে এই প্রথম পেল। সুচির বানানো পায়েস আকাশের কাছে অমৃতের মতো লাগলো। যদিও সে অমৃত খায়নি কিন্তু এই পায়েস খেয়ে সে এই সিদ্ধান্তে এলো যে অমৃত এই পায়েসের থেকে কোন ভাবেই বেশি সুস্বাদু নয় ।
পায়েস খাওয়া শেষ হতেই প্রজ্ঞা আর প্রজ্ঞার কাঁধে হাত দিয়ে পরপর কয়েকটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে রেলগাড়ি খেলতে খেলতে আরও কয়েকটা বাচ্চা এই ফ্ল্যাটে এসে কোলাহল করতে লাগলো। তাদের সাথে খেলতে খেলতে আর বড়দের সাথে গল্প করতে করতে বিয়ের পরের দিন সকালটা খুব আনন্দে কাটতে লাগলো । তারপর সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করা , দুপুরের লাঞ্চ করার মধ্যে দিয়ে কতো দ্রুত সময় কাটতে লাগলো সেটা সদ্য বিবাহিত দুজনের মধ্যে কেউই আন্দাজ করতে পারলো না। তবে এই সবের মধ্যেও আকাশ ঘন ঘন সুচির দিকে তাকাতে ভুললো না। আকাশের অসভ্যতামি দেখে একবার তো সুচি বলেই বসলো , “ কি হচ্ছে টা কি ! এতো গুলো আত্মীয়ের সামনে বারবার অসভ্যের মতো তাকাচ্ছো কেন ! „
এর উত্তরে আকাশ কিছু বললো না। কিন্তু তার নিজের বিয়ে করে আনা প্রেয়সীর দিকে তাকানোয় , অসভ্যের কি আছে ! সেটা সে বুঝেও বুঝতে চাইলো না।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার ঠিক আগের মূহুর্তে সুচির মা আকাশের মা-কে কিছু বলতে আকাশের মা বললেন , “ এখন এইসব কেউ মানে ? „
সুচির মা বললেন , “ অপরের সাথে আমাদের কি ? একটা রাত যদি আলাদা থাকে তাহলে অসুবিধা কোথায় ! আচারের আচারও হলো আর আমার মনের দুঃশ্চিন্তা ও থাকলো না। „
আকাশের মা সুচির মায়ের যুক্তিটা বুঝে বললেন , “ তাহলে তুমি সুচিকে তোমাদের ওখানে নিয়ে যাও । আমি আকাশকে এখানে রাখছি। „
সুচির মা সম্মতি পেয়ে সুচিকে একটা কোনায় নিয়ে গিয়ে বললেন , “ চল আমার সাথে । „
সুচি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় ? „
সুচির মা গম্ভীর হয়ে বললেন , “ আজ বিয়ের পরের দিন। মানে কালরাত্রি। তাই আলাদা থাকবি। „
সুচি হেসে ফেললো , “ এইসব তুমি মানো নাকি ! „
মেয়ের হাসিতে বিন্দুমাত্র রেগে না গিয়ে তিনি বললেন , “ হ্যাঁ মানি। আর আমার জন্যে তোকেও মানতে হবে। একটা রাতের তো ব্যাপার । কেন ! আমার জন্যে এতোটা করতে পারবি না। „
মায়ের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল এর জন্য সুচি আকাশকে কিছু না বলে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল। প্রায় দশ মিনিট সুচিকে চোখের দেখা দেখতে না পেয়ে আকাশ উতলা হয়ে উঠলো। মাকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলো , “ সুচি কোথায় ? „
আকাশের মা ছেলের আবেগ বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে আস্তে করে বললেন , “ ও নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেছে। আজ আর আসবে না। „
আকাশ মায়ের কথা শুনে আরও উতলা হয়ে উঠলো , “ কেন ? আজ আর আসবে না কেন ? „
“ আজ কালরাত্রি । স্বামী স্ত্রীর একে অপরের মুখ দেখতে নেই । তাই বৌদি ওকে নিয়ে গেছে। „
আকাশ মায়ের কথায় প্রতিবাদ করলো না। কিছু করার নেই ভেবে উদাস মনে নিজের আর সুচির মামাতো ভাগ্নে ভাগ্নিদের সাথে খেলতে লাগলো , টিভিতে কার্টুন দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য খবরটা চাউর হয়ে গেল । সুচিকে কেউ ইয়ার্কি মেরে কিছু না বললেও আকাশকে আকাশের মামা ইয়ার্কি মারলেন। আকাশের পিঠে হাত দিয়ে তিনি বললেন , “ দুঃখ পাস না ভাগ্নে একটা রাতের তো ব্যাপার ! „
মামা কথাটা সহানুভূতি দেখিয়ে বললো নাকি ইয়ার্কি মেরে বললো সেটা আকাশ বুঝতে পারলো না। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আকাশ আর সুচি দুজনেই একই চিন্তা করতে লাগলো , ‘ মেসেজ করবো ! নাকি কথা বলাই বারণ। হবে হয়তো। এই নিয়ম যখন বানানো হয়েছিল , তখন তো ফোন আবিষ্কার হয়নি , তাই ফোনে লুকিয়ে একে অপরকে না দেখে কথা বলা যেতে পারে এটা যারা নিয়ম বানিয়েছে তারা ভাবতেই পারে নি। তাই ফোনে কথা বলাটাও হয়তো বারণ। না বাবা , থাক। কথা বলে লাভ নেই। একটা রাতের তো ব্যাপার। , দুজনেই এই একই কথা ভেবে ফোনে একে অপরকে মেসেজও করলো না।
রাতের ডিনার করে যখন দুজন আলাদা ঘুমাতে গেল তখন একে অপরের অনুপস্থিতি খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারলো। এক রাতেই যেন একটা অভ্যাসে দাড়িয়ে গেছে। কোন এক অদৃশ্য চুম্বকের আকর্ষণে একজনের মনকে অপরজনের কথা ভাবতে বাধ্য করছে।
খাটের উপর শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে দুজনে বুঝতে পারলো যে এটা শরীরের আকর্ষণ না। এটা শরীরের গন্ধের আকর্ষণ । মনে হচ্ছে যেন নাকটা অপর জনের চুলের মিষ্টি গন্ধ না পাওয়ার জন্য প্রতিবাদ করছে। অপর জনের হৃৎপিন্ডের প্রানবন্ত শব্দ শুনতে পেয়ে কানটাও নাকের মত প্রতিবাদ করছে। গত রাতে নিস্তব্ধ ঘরে অপরজনের নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ একটা মন মাতানো সুরের মতো শোনাচ্ছিল। আজ সেই সুরটা শোনার জন্যে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
বিছানার উপর শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতেই দুজনে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো। এক রাতের দূরত্ব আকাশকে এতো বেশি ব্যাকুল ও উতলা করে তুলবে সেটা সে ভাবেনি। তাই কাকভোরে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু দেরিতে ঘুমানোর জন্য একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে আকাশ দেখলো সুচি অলরেডি এই ফ্ল্যাটে এসে মায়ের সাথে কথা বলছে ।
আকাশ বুঝতে পারলো যে শুধুমাত্র তার মনটাই সুচির জন্য উতলা হয়নি। সুচির মনটাও তাকে দেখতে পাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল।
আজ বৌভাত অর্থাৎ রিসেপশন। সেই মত সবাই এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ি করে নিজের দায়িত্বে থাকা কাজ করতে লাগলো। বিয়ে সোসাইটির কমিউনিটি হলে হলেও বৌভাত কোন অন্য বড়ো Banquet এ করার কথা চলছিল। কিন্তু লোকজন আবার কষ্ট করে এখান থেকে অতদূর যাবে ! তাই এখানেই বৌভাতের আয়জন করতে লাগলো।
দুপুর গড়াতে সুচি ভাবলো , ‘ আজ কি পড়বে ? যে গাউনটা বৌভাতের দিন পড়ার কথা ছিল সেটা তো দাগ লেগে , পুড়ে খারাপ হয়ে গেছে। , পড়ার জন্যে দামী শাড়ির অভাব নেই। সেদিন কেনাকাটার সময় অনেক এক্সট্রা শাড়ি কেনা হয়েছিল। কিন্তু ওই একটা গাউনই তো আকাশ পছন্দ করে দিয়েছিল। এইসব ভেবে সুচি আকাশকে বললো , “ চলো , শপিং করতে যাবো । „
আকাশ সুচির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো , “ এখন। মানে আজকে ! আজ তো বৌভাত ! „
“ হ্যাঁ , তো কি হয়েছে ! গেলে বলো । না হলে আমি একা যাচ্ছি । „
সুচির কথায় আকাশ দমে গেল , “ ঠিক আছে চলো । „
দুজনকে ঘর থেকে বার হতে দেখে আকাশের মা জিজ্ঞাসা করলেন , “ আজ আবার কোথায় যাচ্ছিস ? „
সুচি বললো , “ একটু বাইরে যাচ্ছি মা , কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো। „ বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আকাশের মা হয়তো বাঁধা দিতেন। কিন্তু এই প্রথম সুচি তাকে “ মা „ বলে ডেকেছে। তাই আবেগে তার মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আকাশের বাইকেই যাওয়া হলো সেই শপিংমলে। রাস্তায় একবার আকাশ জিজ্ঞাসা করেছিল , “ কি কিনতে যাচ্ছি সেটা তো বলো ? „
এর উত্তরে সুচি রেগে গিয়ে বললো , “ ওতো কৈফিয়ত দিতে পারবো না। চুপচাপ বাইক চালাও। „ এই উত্তর আকাশ চুপ করে বাইক চালাতে লাগলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে সেই শপিংমলে পৌছে গেল। নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে গাউনটার খোঁজ করতেই সেলসগার্ল বললো “ হ্যাঁ ম্যাম আছে। ওটা একটু বেশি এক্সপেনশিপ , তাই এখনো স্টক আছে। „
আকাশ আবার সেই গাউনটা দেখে অবাক হলো। বুঝতে পারলো সুচি এটা ওর পছন্দের জন্যেই কিনছে। সুচি নিজের ডেভিড কার্ট দিয়ে পেমেন্ট করে গাউনটা কিনে নিল। রাস্তায় আসতে আসতে আকাশ বললো , “ তুমি ওটা আমার জন্যে কিনেলে না। „
এর উত্তরে সুচি কিছু বললো না। সুচি যে লজ্জা পেয়েছে সেটা বাইক চালানোর জন্য আকাশ বুঝতে পারলো না।
সোসাইটিতে ঢুকতে ঢুকতে বিকাল হয়ে গেল। একবার ফ্রেশ হয়ে দুজনেই রিসেপশনের জন্য নতুন জামা কাপড় পড়তে লাগলো। আকাশ পড়লো শেরওয়ানি আর সুচি গাউন। শেরওয়ানি পড়ার সময় আকাশ দেখলো যে সুচির গাউনের সাথে তার শেরওয়ানি একেবারেই মানাচ্ছে না। সুচি হেসে বললো , “ হাঁদা গঙ্গারাম ! গাউনের সাথে শেরওয়ানি মানায় কখনো ! „
আকাশ ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ তাহলে ! „
সুচি সন্দিহান হয়ে বললো , “ কোর্ট কিংবা ব্লেজার নেই ! „
“ আছে তো । „ বলে আকাশ আলমারির এক কোনা থেকে , প্যাক করা নতুন ব্লেজার বার করলো। “ এটা গত বছর কিনেছিলাম। একজনের বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। তখন মা পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। „
“ এটা পড়ো । „
আকাশ সেই ব্লেজারটা পড়ার পর সুচির পাশে দাড়াতেই দুজনকে ফটোজেনিক লাগলো।
দুজনেই নিচে নেমে হলে এসে রাজ সিংহাসনের মতো বড়ো সোফাতে বসলো। একে একে সব আত্মীয় আসতে লাগলো। সোসাইটির সবাই আসলো। সোসাইটির বাইরে যাদের নেমন্তন্ন করা হয়েছিল তারা সবাই এলো। একে একে সবাই বর বউয়ের হাতে উপহারের বাক্স তুলে দিয়ে , তাদের সাথে ফটো তুলছিল । হঠাৎ প্রজ্ঞা এসে মাসির কোলে চড়ে , মাসির কানে কানে বললো , “ জানো মাসি , ভাই আসবে । „
সুচি দেখলো খুশিতে প্রজ্ঞার চোখ জলজল করছে। একদম পাশে বসে থাকায় কথাটা শুধু আকাশই শুনতে পেল। আকাশ সুচিকে জিজ্ঞাসা করলো , “ তুমি প্রেগন্যান্ট ! „
“ কি আজেবাজে বকছো। আমি কেন ! ….
মাসি আর মেসোর কথা থামিয়ে প্রজ্ঞা বললো , “ আরে না। তোমরা ভুল বুঝছো । মায়ের পেটে ভাই আছে। মা বললো নয় মাস পর ভাই আসবে। „
প্রজ্ঞার কথায় সুচি হো হো করে অট্টহাসি হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। বললো , “ তোর মাকে ডাক। „
প্রজ্ঞা মাসির কোল থেকে নেমে , ভিড় থেকে নিজের মাকে খুঁজে নিয়ে এলো। সুচি গলাটা খাদে নামিয়ে চাপা স্বরে অভিমান ভরে বললো , “ তুই আবার মা হতে চলেছিস আর আমাকে বলিস নি ! „
সুমি একবার নিজের দুষ্টু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে , মেয়েকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো , “ কিভাবে বলবো ! আজ সকালেই তো কনফার্ম হলাম। „
সুচির চমকের আরও কিছু বাকি ছিল। আধ ঘন্টার মধ্যে বৈশাখী এসে হাজির। বৈশাখী কে দেখে সুচির ধুতনি বুকে নেমে আসার জোগাড় , “ আমি তো ভেবেছিলাম তুই আমাকে ভুলেই গেছিস । „
“ কেমন দিলাম সারপ্রাইজ ? „
“ হুম ভালো। বিয়েতে আসলে খুশি হতাম । „
“ কি করবো বল ! ইচ্ছা তো ছিল তোর বিয়েতে আসি। কিন্তু এই এনার ছুটি নিতেই দেরি হয়ে গেল। „ বলে নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর দিকে কটাক্ষ ভরে চাইলো।
বৈশাখীর মা বাবা , বৈশাখীর কলেজ শেষ হওয়ার পরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। স্বামীর সাথে ও এখন থাকে ঔরঙ্গাবাদে। সুচির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে , সুচি আর আকাশের সাথে তার স্বামীকে আলাপ করিয়ে দিল।
আলাপ করার পরেই বৈশাখী আকাশের সাথে ইয়ার্কি শুরু করলো , “ তাহলে আমার বান্ধবীকে বিয়ে করেই ফেললি । „
আকাশ বৈশাখীর কথায় লজ্জা পেয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো। আকাশের লজ্জা দেখে বৈশাখী বললো , “ হয়েছে হয়েছে। জানি আমি সব। ও তো কখনো আমার কাছে স্বীকার করেনি। কিন্তু বুঝতে পারতাম সব। „
তারপর সবাই খেয়ে দেয়ে বর বউকে আশীর্বাদ করে চলে গেল। সারাদিনের ক্লান্তির জন্য আকাশ ঘরে এসে জামা কাপড় ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সুচি নিজের গয়না , গাউন পাল্টে ক্রিম মাখছিল। হঠাৎ দেখলো আকাশ ঘুমের মধ্যে থেকেই ঠোঁট নাড়ছে। আর এমন ভাবে নাড়ছে যেন কারোর সাথে কথা বলছে।
এটা আকাশের ছোট বেলার অভ্যাস সেটা সুচি জানে। সুচি এক দৃষ্টিতে আকাশের ঠোঁটের উপর তাকিয়ে থাকায় আকাশকে খুব কিউট লাগলো। ছোটবেলার মতো দুষ্টুমি করার ইচ্ছা জাগলো। খাটে উঠে আকাশের মাথার পাশে বসে , দুই ঠোঁটের মাঝে তর্জনী দিয়ে নাড়াতে লাগলো , ঠিক যেমন ছোটবেলায় করতো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো সুচির কর্মকাণ্ড , “ কি করছো ! „
“ আজকে কি মনে নেই ? „
“ কি ? „
“ আজ ফুলসজ্জা ! „
“ তাহলে সেদিন কি ছিল ! „
“ ওটা ছিল বাসর রাত । আর আজকে ফুলসজ্জা … সুচির কথা শেষ হওয়ার আগেই আকাশ তাকে নিজের কাছে টেনে নিল।
পরের দিন থেকে আস্তে আস্তে আত্মীয়রাও চলে যেতে লাগলো। দুই দিন পর আকাশের মামা মামি চলে গেল। দুটো ফ্ল্যাট খালি হতে চার দিনের বেশি লাগলো না। হঠাৎ করে ঘর গুলো খালি হয়ে গেল। সেই কোলাহল আর নেই। সবথেকে বড়ো কথা দুষ্টু প্রজ্ঞা নেই। তাই সবার মনে সাময়িক বিরহের সুর বেজে উঠলো।
তবে আগেও যা পরিস্থিতি ছিল এখনও তাই আছে। শুধু সুচি রাতে আকাশের ঘরে ঘুমায়। এই কয়দিনেই আকাশের ঘরের খোলনলচে পাল্টে গেছে। নিজের জামা কাপড় বার করতে গেলে মেয়েদের জামা কাপড় বেরিয়ে পড়ে। তার থেকেও বড় কথা আগে ঘরটা অগোছালো থাকলো আর অপরিষ্কার থাকতো। এখন নোংরার ছিটেফোঁটাও নেই আর সবকিছু গোছানো।
এই চারদিনে যে বিষয়টা আকাশকে সবথেকে বেশি অবাক করেছে সেটা হলো সুচির চারিত্রিক পরিবর্তন। সুচির রাগে আর আগের মতো সেই তেজ নেই। এখন বড্ড শান্ত হয়ে গেছে সে। এই তো সেদিন স্নানে যাওয়ার আগে জামা প্যান্ট খুলে খাটের উপর রেখে দিয়েছিল। এমনকি স্নানের পর ভেজা তোয়ালেটাও খাটের উপর রেখে দিয়েছিল। সুচি মায়ের সাথে গল্পো করে এসে খাটের উপর নোংরা জামা প্যান্ট আর ভেজা তোয়ালে দেখে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে জামা প্যান্ট গুলো আলনায় রেখে দিয়েছিল আর তোয়ালেটা শুকাতে দিয়েছিল। তবে সুচির এই চারিত্রিক পরিবর্তনের কারনটা আকাশ এখনও বুঝতে পারে নি।
সব আত্মীয় চলে যাওয়ার পরের দিন সকালে সুচি আবদার করে বললো , “ অফিস জয়েন করার আগে আমরা হানিমুনে যাবো না ! „
আকাশের মাথায় হানিমুনের কথাই আসেনি। কেন আসেনি সেটাই ভেবে অবাক হলো , “ হানিমুন ! „
“ হ্যাঁ হানিমুন ! এতে অবাক হওয়ার কি আছে ! সবাই যায় , আমরাও যাবো। „
আকাশ একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় যাবো ? ঠিক করেছো কিছু ! „
“ সবই কি আমি ঠিক করবো ! „
“ হ্যাঁ , তুমিই ঠিক করো। কারন তুমিই এই ইচ্ছা টা প্রকাশ করেছো। „
সুচি আকাশ পাতাল ভেবে অনেক জায়গা পছন্দ করলো। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন জায়গা স্থির করতে পারলো না , “ কোথায় যাওয়া যায় বলো না ! „
আকাশ কিছুক্ষণ ভেবে বুদ্ধিমান সেজে বললো , “ আমি বলি কি ! এখন আমরা দুজন দেশের ভিতরেই কোন একটা ভালো জায়গায় গিয়ে ঘুরে নিই। পরে পুরো পরিবার মিলে বিদেশ যাওয়া যাবে। কেমন ! „
খুশিতে সুচির চোখ জলজল করে উঠলো , “ খুব ভালো বলেছো। বাবা মাও অনেক দিন হলো কোথায় যাইনি । „
সুচি যখন কথা বলে তখন আকাশ বুঝতে পারে না যে সে কার মা বাবার কথা বলছে। ওর নিজের মা বাবা না সুচির মা বাবা।
এখন রোজ রাতের ডিনারটা দুই পরিবার একসাথেই করে। এদিকে সুচি আকাশ আর আকাশের মা বাবা খাবে আর ওদিকে ওই ফ্ল্যাটে অন্ধকারে একা সুচির মা বাবা খাবে , এটা কেমন একটা দেখায় ! তাই আকাশের মা বলেছিলেন , “ এবার থেকে ডিনারটা আমাদের সাথে করো। একসাথে বসে খাবো । „
প্রস্তাবটা সুচির মায়ের কাছে মন্দ লাগে নি। তাই এখন রাতে ছয় জন মিলে একসাথেই খাওয়া হয়। তেমনি আজও সবাই একসাথে বসে খাচ্ছিল মাংস ভাত । সুচি আর আকাশ পাশাপাশি বসে খাচ্ছিল। বারবার সুচির কনুইয়ের গুতোতে বিরক্ত হয়ে আকাশ বললো , “ আমরা ভাবছিলাম কয়েক দিন বাইরে গিয়ে ঘুরে আসবো। „
আকাশের বাবা বললেন , “ সদ্য বিয়ে করেছিস। বাইরে গিয়ে ঘুরে আসবি এ তো ভালো কথা। কোথায় যাবি ? „
এই কয়দিনে সুচি খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করেছে যে আকাশ তার বাবার সাথে কথা বলে না । আকাশের বাবার , “ কোথায় যাবি ? „ প্রশ্নের উত্তরে আকাশ কিছু বলছে না দেখে সুচি বললো , “ দেশের ভিতরেই কোথাও । গোয়া কিংবা কুলু মানালি । „
“ কুলু মানালি এই মে মাসে গিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে গোয়া গিয়ে ঘুরে আয়। আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। „
সুচির মা বললেন , “ সাবধানে যাস । „
“ তুমিও না ! এখনও কিছুই ঠিক হয়নি আর তুমি বলছো সাবধানে যাস । „
ডিনার খেয়ে , বাথরুম করে , আকাশ বিছানা এসে শুলো । সুচি আয়নার সামনে বসে হাতে পায়ে ক্রিম মাখছিল। হঠাৎ গম্ভীর স্বরে সে বলে উঠলো , “ তুমি এটা ঠিক করছো না। অন্যায় করছো। „
আকাশ বিছানায় উঠে বসে সুচির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সুচি বললো , “ বাবা তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করছিল। উত্তর দিচ্ছিলে না কেন ? „
“ আমার ভালো লাগে না আর ! „
“ কি ভালো লাগে না ? বাবার সাথে কথা বলতে আর ভালো লাগে না ? „
“ হ্যাঁ । „
“ কেন জানতে পারি ! „
আকাশ উত্তেজিত হয়ে বললো , “ তুমি এখনও কেন জিজ্ঞাসা করছো ! তোমার সাথে যা হলো …..
আকাশের কথার মাঝে সুচি বলে উঠলো , “ আরও বড়ো কিছু হতে পারতো। কিন্তু হয়নি । বাবা পিছিয়ে এসেছে বলেই হয়নি । „
“ আমরা কি কাপুরুষ যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো না ! „
“ বোকাদের মত কথা বলো না। আমরা কাপুরুষ নই। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলে আমার আরও বড়ো ক্ষতি হতো। তাই বাবা পিছিয়ে এসছে শুধুমাত্র আমার আর তোমার কথা ভেবে। না হলে বাবা অবশ্যই কিছু করতো । „
এর উত্তরে আকাশ কিছু বলছে না দেখে সুচি বললো , “ মাঝে মাঝে নিজের ক্ষতি বুঝে পিছিয়ে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হয়। একে কাপুরুষতা বলে না। কিন্তু তুমি বাবার সাথে কথা না বলে যেটা করছো সেটা অবশ্যই অন্যায়। „
আকাশ কিছু বললো না। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই বাবার সাথে কথা বলার। বাবার সিদ্ধান্ত কে এখনও মেনে নিতে পারে নি সে।
পাঁচ দিন পরের ফ্লাইটে গোয়ার টিকিট বুকিং হয়ে গেল। যে ট্যুর প্ল্যান করতে লাগে প্রায় চার পাঁচ মাস। নিজেদের ট্রাভেল এজেন্সির থাকায় সেটা করতে লাগলো পাঁচ দিন। দুদিন পর থেকেই গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। সবাই নানা উপদেশ দিতে লাগলো। সুমি বারবার ফোন করে উৎসাহ দিয়ে ‘ কোথায় কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো , সেটা বলতে লাগলো।
তিন দিনের দিন দুপুরে সুচি দুই মাকে সোফায় বসিয়ে বললো , “ শোন , এবার তোমরা নিজেদের দিকে একটু খেয়াল নাও । „
সুচির মা অবাক হয়ে বললেন , “ কি খেয়াল নেবো ! „
আকাশের মা বললেন , “ তুই কি আমাদের বুড়ি বলছিস নাকি ! „
সুচি বললো , “ বুড়ি হওনি কিন্তু বয়স বাড়ছে। এই বয়সে খাটাখাটনি কম করাই ভালো । „
আকাশের মা বললেন , “ তিনটে ঘর নিয়ে তিন জনের সংসার। এতে খাটাখাটনির কি আছে ! আর কাজ না করলে সারাদিন করবো টা কি ! „
“ কেন ! গল্পো করবে , আড্ডা দেবে। কিন্তু কাজ করা চলবে না। আমি একজন কে ডেকেছি। কাল থেকে আসবে। এবার তোমরা ছুটি নাও । „
আকাশের মা সুচির মায়ের দিকে ফিরে বললেন , “ এ মেয়ে আমাদের ছুটি নিতে বলছে ! „
“ আমি ওটা মিন করিনি ! „
এরপর আরও কিছুক্ষণ এই বিবাদ চললো। কিন্তু শেষে সুচির একজন কাজের মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত মানতে হলো। পরের দিন একজন মহিলা সকাল দশটায় এসে হাজির। নাম চপলা। সুচি তাকে দুই ফ্ল্যাটের ঘর ঝাট দেওয়া , মোছা আর কাপড় কাচার কথা বলেছে। থালা বাসন মাজার কথা উঠেছিল কিন্তু আকাশের মা ওতে রাজি হননি। বলেছিলেন , “ কে কিভাবে মাজবে ! বিশ্বাস নেই আমার। ওই কাজটা আমি করবো। „
দুদিন পরেই ভোরের ফ্ল্যাইটে দুজন চড়ে বসলো। আকাশ আগে প্লেন চড়লেও সুচি এই প্রথম চড়ছে । সুচির উৎসাহ , আনন্দ তাদের হানিমুন যাত্রাকে আরও মনোরম করে তুললো। বিমানবন্দরে পৌঁছে বাসে করে তারা পলোলেম বিচ সংলগ্ন নিজেদের রিসর্টে চলে এলো ।
চার পাঁচ তলা বিল্ডিং নয় , বাগানের মধ্যে পাশাপাশি একটা করে ঘর বিশিষ্ট রিসোর্ট । রিসোর্টে নিজেদের ঘরে ঢুকে সুচির নাচতে ইচ্ছা হলো । আকাশ ফ্রেস হয়ে এসে বললো , “ চলো যাবো তো এখন । „
সুচিও ফ্রেশ হয়ে এসে একটা নুডলস স্ট্রাপ টপ আর হট প্যান্ট পড়লো। পড়ার পর দেখলো আকাশ কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে। আকাশের দৃষ্টি বুঝতে পেরে সুচি বললো , “ তুমি ভেবেছিলে আমি বিকিনি পড়বো। তাইতো ! „
আকাশের দুষ্টুমি হাসি দেখে , সুচি ইয়ার্কি করে আকাশের গলা টিপে বললো , “ খুব শখ না ! আমায় বিকিনিতে দেখতে ! „
পলোলেম বিচের বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার বালি সাদা। আর এই বিচটাই গোয়ার সবথেকে বিখ্যাত বিচ। তাই এই বিচ সংলগ্ন রিসোর্ট লিজে নিতে আকাশের বাবাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আর দিতে হয়েছিল মোটা অংকের টাকা।
আকাশ একটা হাফ প্যান্ট পড়ে বিচে এসে , বিদেশী দেশি রমণীদের বিকিনি পড়ে থাকতে দেখে তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আকাশ ভাবলো , ‘ কি হলো ! এতক্ষণ তো চড়ে আমার গাল লাল হয়ে যাওয়ার কথা। ,
এটা ভেবে আকাশ সুচির দিকে তাকাতেই দেখলো সুচি কাঁদছে। আকাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কাঁদছো কেন ? …..
সুচি কান্না ভেজা গলায় , দুই গালে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো , “ আমি আর কাউকে মারবো না। কাউকে না। „
আকাশ বোকা হলেও অতোটা নয়। তার কাছে এখন সব পরিষ্কার। পলাশকে চড় মারার জন্য পলাশ সুচির মুখে এ্যাসিড ছুড়েছিল। আর সুচি ওর চড় মারার বদ অভ্যাস টাকেই নিজের দোষ ভেবে নিয়েছে এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আর তাই সুচির এই চারিত্রিক পরিবর্তন। আকাশ সঙ্গে সঙ্গে সুচিকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ কি উল্টোপাল্টা বলছো এসব ! তুমি কোন ভুল করোনি। „
এর বাইরে আর কি বলবে সেটা সে নিজেও ভেবে পেল না। সুচি শান্ত হয়ে এলে দুজনে নিজেদের হানিমুন উপভোগ করা শুরু করলো । স্কুবা ডাইভিং করে জলের নিচে মাছেদের সাথে ফটো তোলা। বিভিন্ন গির্জা , দূর্গ এবং অন্যান্য বিচে গিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক শোভা দেখা। জেটস্কি করা , প্যারাসুটে চড়া , সার্ফিং করা। তবে সার্ফিং দুজনের কেউই তেমন শিখতে পারলো না। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন স্বাদের খাবার খাওয়া , মনোরম বিচে শুয়ে সানবাথ নেওয়া আর রাতে একান্ত ব্যাক্তিগত মূহুর্ত তো আছেই।
দেখতে দেখতে পাঁচ দিন কিভাবে কেটে গেল দুজনে বুঝতে পারলো না। কালকেই সকালের বিমানে চলে যেতে হবে ভেবে দুজনের মন খারাপ। তাই পলোলেম বিচে একে অপরের হাত ধরে মনমরা হয়ে হাটছিল। হঠাৎ সুচি বায়না করে বললো , “ আমায় পিঠে তোল । „
আকাশ অবাক হলো না। এমন অনেক আবদার বায়না সে এই পাঁচদিনে পুরন করেছে। তাই সুচিকে পিঠে তুলে হাটতে লাগলো। সুচি বললো , “ আমায় নিয়ে দৌড়াতে পারবে ! „
সুচির কথা শেষ হতেই আকাশ দৌড় শুরু করলো। আর সুচি চোখ বন্ধ করে নিজেদের হানিমুনের শেষ দিন উপভোগ করতে লাগলো। হঠাৎ কি একটা দেখে আকাশ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লো। সামনের দৃশ্য দেখে সে উৎসাহে বলে উঠলঝ , “ সামনে দেখ , সামনে দেখ ! „
এতদিন পর আবার আকাশ তুই তোকারি শুরু করেছে দেখে সুচি বিরক্ত হলো , “ হুম ! কি হচ্ছে ! „
“ সামনে দেখো । „
সুচি চোখ খুলে সামনে দেখতেই বিস্ময়ে তার থুতনি বুকে নেমে এলো। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের পিঠ থেকে নেমে দাড়িয়ে , সামনে একদৃষ্টিতে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলো ।
সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আছে লাল রঙের টু পিস বিকিনি। মেয়েটাকে আকাশ সুচি দুজনেই খুব ভালো ভাবে চেনে। মেয়েটার নাম “ লাবনী „ । হাতে তার একটা ককটেল এর গ্লাস ধরা। লাবনীর পাশে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে। কালো মোটা অর্ধেক মাথা টাক । আর বিভৎস ব্যাপার হলো সেই লোকটার বয়স আন্দাজ ষাট তো হবেই।
সুচি নিজের বিষ্ময় দূর করার জন্য , চোখে যেটা দেখছে সেটা স্বপ্ন কি না প্রমাণ করার জন্য সে আকাশের হাতে একটা চিমটি কাটলো। আকাশ “ আআআঃ „ বলে চিল্লিয়ে উঠতেই লাবনী আকাশের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে লাবনীর মুখে এমন একটা ভাব ফুটে উঠলো যার মধ্যে ভয় , খুশি , লজ্জা এবং কিছুটা দুঃখ মিলে মিশে আছে।
লাবনীর মুখ দেকে সুচির মোনালিসার ফটো মনে পড়লো। লিওনার্দো নিশ্চয়ই লাবনীকে দেখেই পেন্টিংটা এঁকেছিল। আকাশকে দেখেই লাবনী এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো , “ তোমরা এখানে ! „
সুচি লাবনীর সাথে আশা ওই বয়স্ক লোকটাকে দেখতে দেখতে বললো , “ হ্যাঁ , হানিমুনে এসছি । „
লাবনী বললো , “ ও ওয়াও। আমরাও। পরিচয় করিয়ে দিই ইনি আমার হাসবেন্ড । মি. অভিরুপ পাকরাশি। „ তারপর নিজের স্বামীকে বললো , “ এরা আমার কলেজ ফ্রেন্ড , আকাশ মিত্র আর….
লাবনীর কথার মাঝে সুচি বলে উঠলো , “ সুচিত্রা মিত্র। „
লোকটা অর্থাৎ লাবনীর স্বামী বললো , “ আমরা কালকেই এসছি । বেশ কিছুদিন থাকবো। দেখা হবে তাহলে। „
আকাশ বললো , “ আসলে কালকেই আমাদের ট্যুর শেষ হচ্ছে। সকালের ফ্ল্যাইট। „
“ ও স্যাড। তোমরা এঞ্জয় করো। আমরা আসি । „ বলে টাটা করে দিয়ে চলে গেল।
দুজনের পিঠের দিকে তাকিয়ে সুচি বললো , “ টাকার জন্য বিয়ে করেছে । „
আকাশ নিরস গলায় বললো , “ সুখী নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। „
তারপর ভুরু কুঁচকে পায়ের নিচের সাদা বালির দিকে তাকিয়ে বললো , “ এই লোকটাকে আমি কোথাও একটা দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছি না। „ তারপরেই , “ ওওওও , তোমাকে বৌভাতের দিন বলেছিলাম মনে আছে ? ব্লেজার বার করার সময় । বলেছিলাম এই ব্লেজারটা মা গত বছর একজনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। „
“ হ্যাঁ বলেছিলে। „
“ এই অভিরুপ পাকরাশির একমাত্র ছেলের বিয়ে ছিল সেটা। ওখানেই দেখেছিলাম। এ লোকটা আমাদের পুরানো ক্লায়েন্ট । „
সুচির শোনার ইচ্ছা নেই। টাকার জন্য মানুষ এতোটা নিচে নামতে পারে ভেবেই সুচির গা গুলিয়ে উঠছে। এই লাবনীর ফাঁদেই আকাশ পড়তো। সবকিছু তছনছ হয়ে যেত। একমাসও হয়নি বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এই কয়দিনে আকাশের সাথে ঘর করে সুচি কতোটা সুখে আছে সেটা শুধু ওই জানে। এই সুখ কপালে জুটতো না যদি আকাশ লাবনীর ফাঁদে পা দিত। এটা ভেবেই ভয় পেয়ে সুচি আকাশের হাত কোষে জড়িয়ে ধরলো। অবশ্য আকাশ সুচির এই ভয়ের কিছুই বুঝতে পারলো না।
মন খারাপ করলেও পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে তারা বাড়ি ফিরে এলো। ঘরে ঢুকতেই দুই মা বললেন , “ কালো হয়ে গেছিস । „ তারপর সবার জন্যে আনা ফেন্সি গিফ্ট দেওয়া চলতে লাগলো। সবথেকে বেশি গিফ্ট আনা হয়েছে প্রজ্ঞার জন্য। সে তো খুব খুশি।
পরের দিন থেকে দুজনেই অফিস জয়েন করলো। বিয়ের পর এই প্রথম দুজনে অফিস গেল । আকাশের বাইকেই যাওয়া হলো অফিস। সুচি প্রথম দিনেই লক্ষ্য করলো যে অফিসের সবাই আগের থেকে অনেক বেশি ভদ্র ব্যবহার করছে। সুচি এর কারন খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারলো।
দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে এসে আকাশ দেখলো , বাবার কেবিন থেকে এই কোম্পানির লিগাল এডভাইজার ও উকিল সিদ্ধার্থ কাকু রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছেন। আকাশের সামনাসামনি আসার পর উকিল মশাই বললো , “ তোমার বাবা পাগল হয়ে গেছে । „
কথাটা বলে সিদ্ধার্থ চলে গেল। সিদ্ধার্থ কাকুর কথাটা শুনে আকাশের মুখ চোখ বেকে গেল। মুখ দিয়ে “ অ্যাঁ „ জাতীয় একটা শব্দ বেরিয়ে এলো । মনে মনে ভাবলো , ‘ বাবা পাগল হয়ে গেছে ! এইতো সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট করলাম। , বলে পিছন ফিরে সিদ্ধার্থের দিকে তাকালো । আকাশ দেখলো , যেসব এমপ্লয়ি কথাটা শুনতে পেয়েছে তারা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশ আবার মনে মনে বললো , ‘ ইয়ার্কি মারছে মারুক। তাই বলে এতো গুলো লোকের সামনে এই ধরনের ইয়ার্কি ! ,
সিদ্ধার্থের কথাটাকে আকাশ ইয়ার্কি হিসেবেই নিল। এডভোকেট সিদ্ধার্থ বহু বছর ধরে এই কোম্পানির সাথে যুক্ত। প্রায় আকাশের বাবার সমবয়সী , তাই আকাশের বাবাকে ‘ তুমি , বলে সম্বোধন করে। গম্ভীর স্বভাবের হলেও আপনজনের সাথে ইয়ার্কি মারাটা ওর একটা রসিক দিক । তাই সিদ্ধার্থের এই কথাটাকেও আকাশ ইয়ার্কি হিসাবেই নিল।
দুই দিন পর রাতে , খাওয়া দাওয়া করে , আকাশ বিপ্লব বিচ্ছুর সাথে ফোনে কথা বলছিল । এতদিন পর বা বলা ভালো জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েকে বিপ্লবের ভালো লেগেছে। মেয়েটা বিপ্লবের অফিসেরই একজন কর্মী। কয়েকদিন ধরে কথা বলার পর গতকাল তারা ডিনার বা ডেটিংয়ে গেছিল এবং ডিনারের পর বিপ্লব মেয়েটাকে প্রোপজ করে। মেয়েটা একসেপ্ট করার পর দুজনে মিলে লেট নাইট শো দেখতে যায় । সেই নিয়েই এখন বিপ্লব আকাশকে বলছে — শোন ভাই ! লেট নাইট শো-তেই আসল মজা। বেশি কেউ দেখতে যায় না। যারা যায় তারা সবাই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড।
আকাশ — আমার আর গার্লফ্রেন্ড ! আমার তো বিয়েই হয়ে গেল। বিয়ের আগে একবার গেলে মজা হতো।
বিপ্লব — এই শোন। রাখছি। ও ফোন করছে।
আকাশ — বল , কথা বল। এখন তো তোরই দিনকাল !
বিপ্লব হাসতে হাসতে ফোনটা কেটে দিল। তারপর ওর গার্লফ্রেন্ড কে ঘুরিয়ে ফোন করে কথা বলতে লাগলো। সুচি মাকে ঘর গোছানোয় সাহায্য করছিল। মায়ের কাজে সাহায্য করে , সুচি ঘরে এসে দেখলো আকাশ আনমনে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। সুচি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে হাতের চুড়ি , কানের দুল , গলার হার খুলে , চুলে বিনুনি করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি ভাবছো ? „
আকাশ সুচির কথা শুনতে না পেয়ে ‘ উম , বলে উঠল। সুচি গলার স্বর তুলে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি ভাবছো ? „
আকাশ সিলিংয়ে তাকিয়ে আনমনে বললো , “ আমরা কোনদিন নাইট শো দেখতে যাইনি। সেটাই ভাবছিলাম। „
সুচি আকাশের কথা শুনে ভাবলো , ‘ হঠাৎ এইসব ভাবার মানে কি ! , তখনই সুচির চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আকাশ বললো , “ যাবে কালকে ? নাইট শো দেখতে ? „
সুচি বললো , “ তুমি হয়তো ভুলে গেছো ! „ তারপর নিজের সিঁথির সিঁদুরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পয়েন্ট করে বললো , “ আমরা বিবাহিত । ওসব যারা সদ্য প্রেম করছে তাদের মানায়।
আকাশ সুচির দিকে দিকে ঘুরে , ডান হাতের কনুই বালিশের উপর রেখে , মাথটাকে ডান হাতের তালুর উপর ফেলে বললো , “ তুমি কি বলতে চাইছো যে আমি আর তুমি প্রেমিক প্রেমিকা নই ? আমরা প্রেম করি না ? „
“ না মশাই , আমরা প্রেম করিনা , কখনো করিওনি । আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। „
সুচির কথায় আকাশ ভাবলো , ‘ কথাটা একদিক থেকে ঠিক। আমরা কখনো প্রেম করিনি। মানে প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো এঞ্জয় করিনি। সারাজীবন বন্ধু ছিলাম। তারপর ছাড়া ছাড়ি আর এই এক মাস আগে বিয়ে। ,
সুচির সাথে আকাশ কখনোই প্রেমিক যুগলের মতো ঘোরেনি , এঞ্জয় করেনি । সব সময় বন্ধু হিসাবেই ছিল। এই কথাটা ভাবতেই আকাশের নাইট শো দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হাজার গুন বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খাটে উঠে বসে বললো , “ প্লিজ , প্লিজ চলো না। তুমি আর আমি একবার শুধু। শুধু একবার ! „
সুচি এবার রাগি গলায় বললো , “ ছেলেমানুষি করোনা , বলেছি তো না । মা কি বলবে ভেবেছো ! „
“ মায়ের চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দাও। একবার চলো। কখনো নাইট শো দেখিনি। প্লিইইইজ । „ বলেই আকাশ ফোন বার করে কিছু একটা করতে লাগলো।
সুচি ভাবলো , ‘ এ আবার কিসের ভুত চাপলো ! নিশ্চয়ই কেউ কান ভরিয়েছে । , এইসব ভাবতে ভাবতেই আকাশের ফোনে কয়েকটা মেসেজ আসার শব্দ সুচি শুনতে পেল। কিছুক্ষণ পরেই মুখে একটা বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে তুলে ফোনটা সুচিকে দেখিয়ে আকাশ বললো , “ বুকড। কালকে নটার শো দেখতে যাচ্ছি দুজনে । „
আকাশের ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে , সিনেমার টিকিট বুকিং এর কনফার্মেশন মেসেজ দেখার পর , সুচির একসাথে রাগ দুঃশ্চিন্তা এবং বিরক্তি লাগতে শুরু করলো। এতো বলার পরেও , বোঝানোর পরেও এইরকম ছেলেমানুষি সহ্য করা যায় না। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকার পর , গলায় একরাশ বিরক্তি ঝড়িয়ে সুচি বললো , “ রাত নটায় শো শুরু হলে শেষ হবে বারোটায়। একবারও ভেবে দেখেছো রাত বারোটায় বাড়ি ফিরলে মা কি বলবে ……
“ তুমি মায়ের চিন্তা করো না। আমি বলে দেবো। „ বলেই খাটে শুয়ে পড়লো। সুচি আর আকাশের সাথে কথা বললো না। খুব বিরক্ত লাগছে তার। লাইট নিভিয়ে মশারি টাঙিয়ে সে শুয়ে পড়লো ।
পরের দিন অফিস শেষ হওয়ার পর , বাড়ি ফেরার জন্য পার্কিংয়ে এসে দাঁড়ালে , আকাশ সুচিকে বললো , “ ভাবছি এখন আর বাড়ি গিয়ে লাভ নেই। কোন শপিংমলে গিয়ে সময় কাটিয়ে নেওয়া যাবে । „
“ মা কিন্তু খুব রাগ করবে । „
“ তুমি বারবার মা মা করো না তো। মাকে বলে এসছি ফিরতে দেরি হবে । „
আর কোন রাস্তা নেই দেখে সুচি নাছোড়বান্দা আকাশের বাইকের পিছনে বসে পড়লো। এতক্ষণ সে মনে মনে এটাই ভাবছিল যে ‘ যদি আকাশের জন্য তাকে মায়ের কাছে বকা খেতে হয় তাহলে সে আকাশকে ছাড়বে না। এইরকম ছেলেমানুষি করলে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। ওকেও তো বুঝতে হবে যে এখন আমরা বিবাহিত। ,
কিছুটা অনিচ্ছা আর কিছুটা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সে আকাশের সাথে শপিং করতে গেল। সন্ধ্যাটা ভালোই কাটলো। বিভিন্ন শোরুমে বিভিন্ন ডিজাইনের ড্রেস দেখছিল তারা । সেই সময় আকাশকে স্নেহা দেবী ফোন করলেন — কোথায় তোরা ? ফিরবি কখন ?
আকাশ — একটু দেরি হবে ফিরতে । তুমি চিন্তা করো না। যদি বেশি রাত হয় তাহলে খেয়ে নিও । রাখছি
ফোনটা রেখে দিয়ে , আটটায় দিকে হাল্কা কিছু খেয়ে দুজনে সিনেমা দেখতে চলে গেল ।
সিনেমা শুরু হওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পরেই আকাশ বিপ্লবের কথা মত চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি কয়েকজন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে একান্ত মূহুর্ত কাটাতে ব্যাস্ত। তাদের কে দেখে আকাশের মনে ফুল ফুটে উঠতে বেশি সময় লাগলো না । প্রেম মাখা দৃষ্টিতে পাশের সিটে তাকাতেই দেখলো সুচি রাগী দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছ , আর তার হাতে ধরা ফোনে কাকি বলে একটা নাম্বার ফুটে আছে ।
আকাশের মনে যে প্রেমের ফুল ফুটেছিল সেটা নিমেষে শুকিয়ে গেল। সে সুচির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সিনেমা দেখতে লাগলো। সুচি ফোনটা রিসিভ করে বলেদিল যে , “ একটু দেরি হবে । তোমরা খেয়ে নাও । „
এদিকে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে সুচেতা দেবী একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে , “ দুজন কোথায় ? „
স্নেহা দেবী বললেন , “ সিনেমা দেখতে গেছে । ফিরতে রাত হবে । „ বলা বাহুল্য এটা শোনার পর সুচেতা দেবী মোটেও খুশি হলেন না । ছোটবেলা থেকে অবাধ্য সুচি এখনও নিজের মর্জি মত চলছে । এটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না ।
সাধারণত কোন বাঙালী পরিবারে বড়ো কোন কিছু ঘটলে , বাড়ির মহিলাদের মুখে সবসময় সেই ঘটনার পুণঃ সম্প্রসারন শোনা যায়। কিন্তু সুচির ওই ঘটনার পর বা ওই ঘটনা নিয়ে এই একমাস কেউই কোন কথা বলে নি। পাড়া প্রতিবেশীরা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল কিন্তু বারবার সুচি আর আকাশের মা কথাটা চেপে গেছেন। বলতে গেলে যে একটা ভয় পেয়ে বসে , গলার ভিতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে আছে মনে হয়। আর সেদিন রাতের ওই ভয়ংকর খুনি হুমকিটা মনে পড়ে যায় ।
রাতের খাওয়া খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। সুচি আর আকাশের সিনেমা শেষ হলো পাক্কা বরোটায় । বাইক করে বাড়ি ফেরার সময় সুচি মনে মনে ভাবতে লাগলো , ‘ হে ঠাকুর , পুলিশের ঝামেলায় যেন জড়িয়ে পড়তে না হয়। ,
মনে মনে পুলিশের ভয় পেলেও মধ্যরাতের কলকাতার রাস্তার সৌন্দর্য সুচিকে কিছুটা হলেও শান্ত করে দিল। রাস্তার ফুটপাতে এক পায়ে দাড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের লালচে আলোয় রাস্তাটাও লাল রঙের হয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশের বাড়ি গুলোর বেশিরভাগ ঘরে লাইট নিভে গেলেও কয়েকটা তে এখনও আলো জ্বলছে। আর কিছুদূর পরপর পেট্রোল পাম্পের সাদা আলো রাস্তা এসে পড়ছে। কয়েকটা কুকুর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ঝিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা তো আকাশের বাইককে উদ্দেশ্য করে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠছে। আর মেঘহীন আকাশের তারাদের ঝিকিমিকি আলো এই কৃত্রিম সৌন্দর্যের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিছু অবদান রাখছে ।
সুচির খুব ইচ্ছা হলো এই মনোরম পরিবেশে আকাশের হাত ধরে রাস্তায় হাটতে। কিংবা ফুটপাতের চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে ভাঁড়ের গরম চায়ে ফু দিয়ে খেতে , কিংবা বাইকের পিছনে বসে বসেই , দুই হাত দুই দিকে ফেলে নিজের স্বাধীনতা জানান দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এত রাতে বাড়ি ফিরলে মা নিশ্চয়ই বকবে তাই মনের সব ইচ্ছা আপাতত দমন করে রাখাই ভালো।
এদিকে আকাশের পেটে খিদের জন্য ছুঁচো দৌড় শুরু হয়েছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। যেটার জন্য নাইট শো প্ল্যান করেছিল সেটা তো হলোই না ! এখন বাড়ি ফিরে মায়ের বকা খেতে হবে সেটা আর এক। 23 বছরের জীবনে কখনো এত রাত অব্দি বাড়ির বাইরে সে থাকে নি। তাই মায়ের বকুনি খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বাকি রাস্তাটা নির্বিঘ্নে আসার পর , সোসাইটিতে ঢুকে নিজেদের বিল্ডিংয়ের নিচে এসে আকাশ বাইকটা পার্ক করলো । স্নেহা দেবী উপর থেকেই তার ছেলের Yamaha বাইকের আওয়াজ শুনে পেলেন । বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে আর বৌমা ফিরেছে। ফোনটা অন করে তিনি দেখলেন , একটা বাজতে আর চোদ্দো মিনিট বাকি ।
কিছুক্ষণ পরেই আকাশের মা ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলেন। সুচির কাছে বাড়ির এক্সট্রা চাবি আছে সেটা তখনই মনে পড়ে গেল। আকাশের মা মনে মনে বললেন , “ আজ ঘুমিয়ে নিক। কালকে কথা বলবো । „
কিন্তু সেটা হলো না। কিছুক্ষণ পরেই রান্নাঘরের খুটখাট আওয়াজে তিনি বুঝলেন যে দুজনে খালি পেটে আছে। আকাশের মা চুপচাপ খাট থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেখলেন , আকাশ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে আর সুচি দুটো থালায় রুটি সাজাচ্ছে।
সুচি আর আকাশ মাকে দেখে চমকে উঠলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। এখন যতো চুপ থাকা যায় ততই ভালো , তাই দুজনেই মুখে কুলুপ এঁটে দিল। আকাশের মা এসে সুচিকে বললেন , “ বস আমি দিচ্ছি। „
সুচি চুপচাপ গিয়ে আকাশের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। আকাশের মা দুজনের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন , “ ভেবেছিলাম আমার ছেলে ছোট হলেও তুই বড় , তুই সামলে নিবি। কিন্তু তুইও আকাশের কথায় গা ভাসিয়ে দিবি এটা জানতাম না। তাহলে কি লাভ হলো তোর সাথে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে। এতো রাত করে বাড়ি ফিরলে পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে সেটা ভেবেছিস তোরা …..
আকাশের মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে সুচি পাথর হয়ে গেল । পুরো ব্যাপারটাই যে তার ঘাড়ে এসে পড়বে সেটা সে ভাবেনি। এখন আকাশের ছেলেমানুষির জন্য তাকে বকা খেতে হচ্ছে। এইটুকু একটা ঘটনার জন্য এত কথা শুনতে হবে সেটা সুচি স্বপ্নেও ভাবেনি। দুটো পরিবার অনেক অংশে আধুনিক হলেও , সিনেমা দেখে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরাটা আধুনিকতার মধ্যে পড়ে না। আর এমনিতেও সুচি এবাড়ির বৌমা । তাই চুপ থেকে শুনে যাওয়াটাও শ্রেয় ।
আকাশের মা দুজনের জন্য রুটি আর ভেন্ডির তরকারি দুটো প্লেটে সাজিয়ে দুজনকে খেতে দিয়ে বললেন , “ খাওয়া হয়ে গেলে , জল দিয়ে একবার থালা দুটো ধুয়ে রেখে দিস। সকালে মেজে দেবো । „ বলে তিনি ঘুমাতে চলে গেলেন।
এদিকে আকাশের মায়ের কথা গুলো শোনার পর সুচির আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলো। খেতে গিয়ে রুটির টুকরো বারবার গলায় আটকে যাচ্ছিল।
আকাশ মাঝে একবার ‘ সরি , বলেছিল কিন্তু সুচি কোন উত্তর দেয়নি । দেওয়ার ইচ্ছা তার নেই। খাওয়া হয়ে গেলে থালা দুটো একবার ধুয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণ পর সুচির নিরবতা আকাশের মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। তাই সে বললো , “ আমি সত্যিই ভাবিনি যে মা তোমাকে এত কথা শোনাবে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও । এরকম আবদার , জেদ আর কখনো করবো না । „ বলে সুচিকে নিজের কাছে টানতে গেল।
সুচি এক ঝটকায় আকাশের হাত ঢেলে সরিয়ে দিয়ে বললো , “ আমাকে ছোঁবে না তুমি ! „
এখন সুচির রাগ কমার অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। তাই আকাশ আর কথা না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
পরবর্তী কয়েকদিনে আকাশের জীবন পুরো উলটপালট হয়ে গেল। একটা বাঁধা ধরা নিয়মে তার দৈনন্দিন জীবন বেঁধে গেল। বাড়ি থেকে অফিস , অফিস থেকে বাড়ি , এই হলো ওর জীবন । এমনকি প্রায় রোজ বাড়ি ফেরার পথে ফুটপাতের বিভিন্ন স্টলে ফুচকা , এগরোল , পকোড়া , ভেলপুরি , পাপরিচাট জাতীয় ফার্স্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাসটাও তাকে ছাড়তে হলো। কথায় আছে যা হয় ভালোর জন্যেই হয়। এখন সুচি ওই ঘটনা ভালোর জন্যেই হয়েছিল এরকম মনে করে। না হলে যে তার স্বামী তার কথা শুনতোই না। এবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার করার স্বপ্ন সুচি দেখতে পারে। সেই স্বপ্ন টাকেই সে সফল করার চেষ্টা করতে লাগলো। তাই মনে মনে সে বেশ খুশি।
এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর , অফিসের টিফিন ব্রেক হওয়ার কিছু আগে , সিদ্ধার্থ আকাশের বাবার কেবিনে এসে ঢুকলো। কোন অনুমতি না নিয়েই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে বসে বললো , “ আর একবার ভেবে দেখো। এতে তোমারই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা …
আকাশের বাবা নির্বিকার চিত্তে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। সিদ্ধার্থ একভাবে তাকিয়ে থেকে , নিরুপায় হয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে , তার থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করলো। সেটা আকাশের বাবার বাড়িয়ে রাখা ডান হাতে দিয়ে বললো ,“ কেউ তো ভয়ে কিছু বলতেই চাইছিল না । তার পর একজনকে হাত করে , তাকে কিছু বকশিশ দিতে , সে কিছুটা হলেও বললো । মোট চার জন ওর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তিন জনকে সরকারি উকিল বানিয়ে অন্য জেলায় ট্রান্সফার করিয়ে দিয়েছে। এই একজনই আছে যার কিছু করতে পারে নি …..
আকাশের বাবা ভিজিটিং কার্ডটি নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলেন তাতে লেখা আছে ‘ মোঃ. শেখ , এডভোকেট হাইকোর্ট , । পিছনে টেলিফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। আকাশের বাবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কার্ডটা দেখার সময় , সিদ্ধার্থ না বলে থাকতে পারলো না , “ তুমি আগুন নিয়ে খেলতে চাইছো। হাত পুড়বেই। „
আকাশের বাবা উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , “ এটা আমার মেয়ের প্রশ্ন ! „
এরপর আর বোঝানোর কোন মানে হয় না। ঠিক সেই সময় সুচি টিফিন কৌটো নিয়ে কেবিনে ঢুকলেই দুজনেই চুপ হয়ে গেল। সুচিকে কে ঢুকতে দেখে সিদ্ধার্থ উঠে চলে গেল। এখন সুচিই তিনজনের জন্য টিফিন আনার দায়িত্ব নিয়েছে। আর তিনজনে একসাথে বসে লাঞ্চ করে ।
টিফিন খেয়ে সুচি আর আকাশ চলে গেলে , আকাশের বাবা ভিজিটিং কার্ডে দেওয়া নাম্বারে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর , অপর প্রান্ত থেকে খুব গম্ভীর একটা স্বর ভেসে এসে এলো , “ হ্যালো , কে বলছেন ? „
আকাশের বাবা — আপনি কি মোঃ .শেখ ….
শেখ — হ্যাঁ আমিই সেই ব্যাক্তি। আপনি কে বলছেন।
লোকটার গলার স্বরে কর্কশতা এতোটাই তীক্ষ্ণ যে আকাশের বাবা কিছুটা হলেও বিরক্ত হলেন । আকাশের বাবা বললেন — আমি DS import & export কোম্পানির মালিক শুভাশীষ মিত্র বলছি …
শেখ — DS import , শুভাশীষ মিত্র ! … আপনার মেয়ের সাথেই কি ওই ক্রিমিনাল টা এ্যাসিড ….
এতোটা শুনে আকাশের বাবা আকাশ থেকে পড়লেন। এ কি করে সম্ভব ? এই ঘটনার কথা তো তার সোসাইটিরই বেশিরভাগ কেউ জানে না। তাহলে এই লোকটা জানলো কি করে ? এই ঘটনার কথা তো সবসময় চেপে যাওয়া হয়েছে । তাহলে এই লোকটা জানলো কি করে ?
আকাশের বাবার এইসব চিন্তার মাঝে অপর প্রান্ত থেকে মোঃ শেখের কন্ঠস্বর শোনা গেল। কিন্তু এবার আর সেই কন্ঠে কর্কশতা নেই। তার বদলে হাসি দেখা দিয়েছে। শেখ — আমি ভাবিনি আপনি ফোন করবেন। ভেবেছিলাম ভয় পেয়ে একজন ভিক্টিমের জীবন যাপন করবেন। এখন আপনি আমায় ভুল প্রমাণিত করলেন।
আকাশের বাবা এতক্ষণ যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। এই লোকটাকেই তো তার দরকার। এরকম লোককেই তো তিনি খুঁজছিলেন। তাই উতলা হয়ে আকাশের বাবা বললেন — সব কথা ফোনে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে !
শেখ — তা , ভালো তো। আজ পাঁচটার দিকে ময়দানে চলে আসুন না। ওই মহামেডান ক্লাবের বিপরীতে যে মাঠটা আছে , ওখানে আমায় পেয়ে যাবেন। আর আমার পার্সোনাল নাম্বার টা নিন ।
আকাশের বাবা বুঝতে পারলেন না ময়দানে কেন ? — ময়দানে ?
শেখ — হ্যাঁ , ওই কোর্ট শেষ হলে ওখানে একটু হাঁটতে যাই আরকি !
আকাশের বাবা — ঠিক আছে আমি ওখানে পৌঁছে ফোন করবো ।
শেখ — ওকে
ফোনটা রাখার পরেও কথাটা আকাশের বাবার মাথায় ঘুরতে লাগলো , ‘ ওই লোকটা কিভাবে এতকিছু জানতে পারলো ? জানার তো কথা নয় ! ,
সাড়ে চারটের আগেই আকাশের বাবা অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন । ঠিক সময় মতো রেড রোডে পৌঁছে তিনি ফোন করলেন । একবার রিং হতেই অপর প্রান্ত ফোনটা রিসিভ করলো , “ হ্যাঁ ভিতরে আসুন । দেখুন একটা গাছের নিচে আমি বসে আছে ….
আকাশের বাবা মহামেডান ক্লাবের বিপরীত মাঠের মুখে গাড়িটা পার্ক করার সময় দেখলেন যে পাশে একটা সাথা BMW পার্ক করা আছে । নিজের গাড়িটা লক করে মাঠে ঢুকে দেখলেন সত্যি একজন বসে আছে । কিছুদূরে দুটো বাচ্চা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে । আর একজন দূর থেকেই তাদের উপর নজর রাখছে । আকাশের বাবা গাছের নিচে বসে থাকা লোকটার কাছে এগিয়ে যেতেই , লোকটা বললো , “ বসুন । „
আকাশের বাবা গাছের নীচে ঘাসেই বসে পড়লেন । কোর্ট প্যান্ট পড়ে মাটিতে বসতে বসতেই একবার ভালো করে লোকটাকে দেখে নিলেন । লোকটা সাধারণ জামা প্যান্ট পড়ে আছে । একটা নীল রঙের জামা আর কালো প্যান্ট । বয়স আন্দাজ আকাশের বাবার মতোই হবে । উচ্চতাও প্রায় একই । মুসলিম বলে চেনা যাবে না । কারন মুখে দাড়ি নেই । পুরো ক্লিন সেভ করা । আর অতিরিক্ত ফর্সা । দেখতে সুদর্শন। চুল ছোট করে ছাঁটা ।
প্রথমেই আকাশের বাবা প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলেন না , “ আপনি জানলেন কি করে যে আমার মেয়ের ….
লোকটা একটা মুচকি হেসে বললো , “ আমার নাম মোঃ রহমত শেখ । „
“ ও সরি । „ বলে আকাশের বাবা নিজের পরিচয় দিলেন । আকাশের বাবা রহমত নামটা শুনে একটু অবাকই হলেন । এই নামটা তো চাচার … তবে এক নামের অনেক লোক থাকতে পারে তাই অবাক হয়ে লাভ নেই ।
পরিচয় পর্ব শেষে রহমত আকাশের বাবার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করলো , “ আমার জীবনের প্রথম , একবারে প্রথম কেস ছিল ওটা । ওর একা একজনের এসিস্ট্যান্ট ছিলাম । তারপর নিজের প্র্যাকটিস শুরু করি । প্রথমেই ওই ক্ষমতালোভী জন্তু আর ওর দুই ছেলের বিরুদ্ধে একটা রেপ কেস লড়ি । তখন পঙ্কজ বিধায়ক হয়নি । একটা মেয়েকে ওর ভাইয়ের সামনেই রেপ করে ওই পলাশ ওর এক বন্ধু আর ওর জানোয়ার দাদা । একমাত্র সাক্ষী ছিল মেয়েটার ভাই । কিন্তু ওরা ওই ছেলেটাকে হসপিটাল থেকেই কিডন্যাপ করে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে মেরে দেয় । পঙ্কজের পলিটিক্যাল কেরিয়ার বলে কথা । ওই কেসটা মানে আমার জীবনের প্রথম কেস আমি হেরে গিয়েছিলাম । „ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মোঃ শেখ । , “ জীবনের প্রথম কেস হেরে যাওয়াটা আজও ঠিক মেনে নিতে পারিনি । সেই দিন থেকে ওদের ওপর নজর রেখে দিয়েছি । ওদের প্রতিটা মুভমেন্টে আমার নজর আছে । তবুও বারবার সাক্ষীর অভাবে বেঁচে যায় ওরা । „
আকাশের বাবা অবাক হয়ে বললেন , “ আপনি আমাকে প্রথম আলাপেই বিশ্বাস করে এতগুলো কথা বলছেন ! „
“ আমি লোক চিনতে ভুল করিনা মি.মিত্র । আপনার মেয়ের উপর ওই জানোয়ারটা এসিড ছুড়েছিল , তাই আপনি আমার কাছে এসেছেন । তাই আপনাকে বিশ্বাস করাই যায় । সেদিনের ওই ঘটনাটা আমার জানতে একটু দেরি হয়ে গেছিল । না হলে আমিই আপনার কাছে যেতাম সাক্ষী নিতে । কিন্তু এখন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করবো সেটাই বুঝতে পারছি না । আপনি তো স্ট্যাম্প পেপারে সই করে দিয়েছেন । „
“ ওটা স্ট্যাম্প পেপার ছিল না । একটা সাদা কাগজ ছিল । আর একটা কেস উইথড্র এর কাগজ । আর ওতে লেখা ছিল পলাশ ওই কাজ করে নি । আমাদের চিনতে ভুল হয়েছে । তাই আমরা কেস তুলে নিচ্ছি । এরকম কিছু … „ এতোটা বলেই আকাশের বাবা পকেট থেকে ফোনটা বার করলেন । তারপর একটা অডিও চালিয়ে দিলেন । ময়দানের শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে , একটা শান্ত খুনি আওয়াজ ভেসে উঠলো — শুনুন কান খুলে । এবারের বিধানসভায় আমি CM candidate হয়ে দাড়াচ্ছি । যদি আপনার বা আপনার মেয়ের জন্য আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় তাহলে সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। এখন যা বলছি শুনুন। বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা খুলুন আর সে যে কাগজ গুলো দিচ্ছে তাতে সই করুন । আর আমার ছেলে আপনাদের কখনো ডিস্টার্ব করবে না।
বোঝাই যাচ্ছে আকাশের বাবা পঙ্কজের কথা রেকর্ডিং করেছিলেন । সব শুনে মোঃ শেখ বললো , “ আপনি হয়তো জানেন না , অডিও কিংবা ভিডিও ক্লিপিংস কে কোর্টে সাক্ষ্য হিসাবে মানা হয় না । „
“ হ্যাঁ কিন্তু যদি আমরা বলি যে , আমাদের হুমকি দিয়ে কাগজে সই করিয়ে কেস তুলে নিতে বাধ্য করেছিল । তখন তো এটাতে সাক্ষ্য হিসাবে মানবে । „
“ আপনার সাহস আছে মি.মিত্র । „ কথাটা না বলে থাকতে পারলো না মোঃ শেখ । তারপর কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে পশ্চিম দিকে হেলে যাওয়া সূর্যের অস্ত দেখতে দেখতে বললো , “ আপনি কি চান ? আমি আপনার হয়ে কেস লড়ি ? „
“ তাইতো এলাম । „
“ এ চেষ্টা আমি বহুবার করেছি মি.মিত্র । বারবার অসফল হয়েছি । প্রত্যেকবার সাক্ষীকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় আর সাক্ষী পিছিয়ে যায় । কতো না জানি রেপ করেছে ওরা । সাধারণ ঘরের মেয়েগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হোটেলে নিয়ে গিয়ে …. রেপ , মোলেস্ট , ইভটিজিং আরও কত কি । আমারই কয়েকজন কলিগ ওর বিরুদ্ধে কেস লড়তে চেয়েছিল । কিন্তু তাদের তো ….. জানেন ! ওই বিধায়ক একটা বেআইনী এক্টিভিটির সাথে জড়িত । বেআইনী ভাবে কোটি কোটি টাকা রোজগার করে এবং সেগুলো ভোটের সময় ব্যাবহার করে । এই নিয়ে দুবার ইনকাম ট্যাক্স এবং একবার সিবিআই এর রেড হয়ে গেছে ওর বাড়িতে । কিন্তু কোন কিছুই হাতে আসেনি । বারবার তারা অসফল হয়েছে । ওর একটা এনজিও আছে যেখানে লোকে ডোনেশন দেয় । সেটাকেই সে বারবার গার্ড করে বেঁচে গেছে । কিন্তু এতো টাকা ডোনেশনের মাধ্যমে আসতে পারে না । আসা সম্ভব নয় । একবার ওই বেআইনী কাজটা জানতে পারলে হয় । গলায় দড়ি পড়াতে বেশি সময় লাগবে না । „ এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো মোঃ শেখ । তারপর তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো ।
আকাশের বাবা সব শুনে একটু অবাক হলেন । কিন্তু এতে নতুন কি ! একটা বেআইনী ইনকাম সোর্স থাকাটাই তো স্বাভাবিক । কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন , “ এক কাজ করলে হয় না ! মানে যদি আমার মেয়ের মতো আরো কয়েকজনের সাক্ষ্য জোগাড় করা যায় । ক্রাইম তো কম করে নি ওই পশুগুলো । „
“ চেষ্টা করে লাভ নেই । ওরা সবাই ভিক্টিমের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । „
আকাশের বাবা বললেন , “ আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি । „
মোঃ শেখ যেন কথাটা শুনে খুশিই হলো , “ করবেন ! „
আকাশের বাবা উৎসাহিত হয়ে বললেন , “ অবশ্যই । „
“ আমার জানা মতে মোট তিন জন আছে । তাদের মধ্যে একজনকে রেপ করা হয়াছিল । আর দুজনের সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় পরিবারকে পুড়িয়ে মেরে দেয় । পরের দিন খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে হেডিং বেরিয়েছিল , গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে মৃত্যু পুরো পরিবারের । „
আকাশের বাবা একটু হলেও দুঃখ পেলেন । পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মেরে দিয়েছিল ভাবতেই আকাশের বাবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো , “ কেউ বেঁচে নেই ? „
“ আছে । একটা পরিবারের ছোট ছেলে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো । আর একটা পরিবারের বড় মেয়ে বাইরে কাজের সূত্রে গেছিল । এই দুজনই বেঁচে আছে । „
“ তারা এখন কোথায় ? „
“ যাকে রেপ করেছিল তার নাম শালিনী । সে তো এই পার্ক স্ট্রিটে বিয়ে করে সংসার করছে । যে মেয়েটা বাইরে গেছিল কাজের সূত্রে সে এখানে এসে এইসব দেখে আবার চলে যায় । তারপর আর ফেরেনি । আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কিন্তু সে রাজি হয় নি । আর যে ছেলেটা হোস্টেলে ছিল সে তো এখন আমেরিকায় । „
“ তাহলে শুধু ওই পার্ক স্ট্রিটের মেয়েটাই ভরসা । „ কথাটা বলে আকাশের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ।
মোঃ শেখ বললো , “ আর যদি আপনি আপনার মেয়েকে এই বিপদে ফেলতে চান তাহলে সেও । „
“ আমি কোন পরোয়া করিনা । ওই নরকের পোকা গুলো এইভাবে ভদ্র সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে ! আর না জানি কত মেয়ের জীবন নিয়ে খেলবে । এইভাবে চলতে দেওয়া যায় না । আমি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলবো । ও যদি রাজি হয় তাহলে সুচিকেও রাজি করাবো । „
“ সুচি কে ? „
“ সুচিত্রা মিত্র । আমার মেয়ে । মানে আমার ছেলের স্ত্রী । ওর মুখেই …
“ ওওও । „ সুচিত্রা কে চিনলেও ডাকনাম সুচিকে মোঃ শেখ চিনতো না । সে কিছুক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো । সূর্য প্রায় ডুবে গেছে বলা যায় । হঠাৎ সে বলে উঠলো , “ এখন আমায় বাড়ি ফিরতে হবে । আপনি এক কাজ করুন । রবিবার আসুন , দুজনে যাবো । „
আরো কিছুক্ষন কথা বলে আকাশের বাবা বাড়ির রাস্তা ধরলেন । আজ এক নতুন শক্তি , উদ্দোম তার রক্তে বইতে শুরু করলো ।
এর দুই দিন রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর পর সুচি আবার সেই স্বপ্নটা দেখলো । সে একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে । আশেপাশে কেউ নেই । দূর থেকে একটা ছেলে ছুটে আসছে । সুচি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে কিন্তু কেউ আসছে না । ছেলেটা কাছে এসে হাতে ধরে থাকা বোতলের জল ছুঁড়ে দিল সুচির মুখে ।
সুচি ধড়মড় করে উঠে বসলো । খাটে বসে দ্রুত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ছাড়তে লাগলো । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে । হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করছে তীব্র বেগে । কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে সে আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছে ।
সুচি একটা নিশ্চিন্তের ঢোক গিলতেই আকাশ উঠে বসলো । ঘুম জড়ানো চোখে নাইট বাল্বের আলোয় সে সুচির মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতো পেলো । পাশের টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে , ছিপি খুলে , সুচির দিকে বাড়িয়ে দিতেই সুচি এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে নিল ।
জল খেয়ে ধাতস্থ হওয়ার পর আকাশ জিজ্ঞেস করলো , “ আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছো ? „
সুচি কিছু না বলে আকাশকে জড়িয়ে ধরলো । আকাশও কথা না বাড়িয়ে সুচিকে বুকে টেনে নিল । এই নিয়ে দুবার সে এই দুঃস্বপ্নটা দেখলো । কেন বারবার সে এই দুঃস্বপ্নটা দেখছে সেটা জানে না । আর কতবার দেখতে হবে সেটাও জানা নেই । এখনও পর্যন্ত এই ব্যাপারটা আকাশ বাদে কেউ জানে না । সুচিই বলতে বারণ করে দিয়েছে । অযথা সবাই চিন্তা করবে ।
কিন্তু এইভাবে তো দিন কাটানো যায় না । সুচি আকাশের বুকে মাথা রেখে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল । বহু আগেই এটা করা উচিত ছিল । যদি করতো তাহলে এই দিন হয়তো দেখতে হতো না ।
পরের দিন অফিস থেকে ফেরার সময় সুচি আকাশকে বললো , “ শোভাবাজার চলো । „
আকাশ জিজ্ঞেস করলো , “ শোভাবাজার কেন ? „
“ চলো না । বলছি । „
শোভাবাজারের একটা গলির ভিতর ঢুকে , নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে , একটা বাড়ির সামনে বাইক পার্ক করতে আকাশ দেখলো সেটা একটা ক্লিনিক । ডাক্তারের ক্লিনিক নয় , একজন সাইকায়াট্রিস্ট এর ক্লিনিক । একটা বোর্ডে লেখা আছে , ড. পিয়ালি গুপ্তা , সাইকায়াট্রিস্ট । নিচে কিছু ডিগ্রি লেখা আছে কিন্তু সেগুলোর মানে আকাশ জানে না ।
সাইনবোর্ডে নাম পড়ে আকাশ খুব অবাক হলো , “ এখানে কি দরকার ? „
সুচি বাইক থেকে নেমে বললো , “ এপয়েন্টমেন্ট আছে তাই । „
“ কিন্তু কি দরকারে ? „
“ আমার দুঃস্বপ্ন আর বদমেজাজী স্বভাবের জন্য । যদি এটা কয়েক বছর আগে করতাম তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো । তুমি প্লিজ মা বাবা কে বলো না । এক ঘন্টার ব্যাপার প্লিজ ম্যানেজ করে নিও ।„
সুচির কথায় আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । সুচির এই সিদ্ধান্তে তার কিছু বলার নেই । কি বলবে সেটাই তো জানা নেই । যদি এর জন্য দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই । তাই আকাশ চুপচাপ সুচির পিছন পিছন গিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে রইলো । যতক্ষন না তার ট্রিটমেন্ট শেষ হয় । বলা বাহুল্য সুচির এই ট্রিটমেন্টের কথা ঘুনাক্ষরেও সুচি আর আকাশের পরিবার জানতে পারলো না ।
রবিবার দুপুর গড়াতেই , আগের দিনের কথা মত আকাশের বাবা মোঃ শেখের সাথে ধর্মতলায় দেখা করলেন । সেখান থেকে দুজনে গেলেন শালিনীর বাড়িতে । পার্ক স্ট্রিটের একটা বড়ো বিল্ডিংয়ে তিনটে ঘরের একটা ফ্ল্যাটে শালিনীর বসবাস । ডোরবেল বাজানোর পর যে মহিলা দরজা খুললো তার বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ তো হবেই । দরজা খুলে প্রথমে আকাশের বাবা কে চিনতে না পারলেও মোঃ শেখকে শালিনী ঠিক চিনতে পারলো , “ আপনি ? „
মোঃ রহমত শেখ মৃদু হেসে বললো , “ হ্যাঁ , আমি । চিনতে পেরেছো দেখে খুশি হলাম । „
শালিনী দরজার একপাশে সরে গিয়ে বললো , “ আসুন । ভিতরে আসুন । „
ঘরের ভিতরে ঢুকে শালিনীর দেখিয়ে দেওয়া সোফায় দুজনে বসতেই শালিনী জিজ্ঞাসা করলো , “ আপনারা কি নেবেন ? চা , কফি …..
মোঃ শেখ বললো , “না আমরা এখন কিছু নেবো না । তুমি একটু বসো । তোমার সাথে কথা আছে । „
শালিনী একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে বললো , “ কি কথা সেটা আমি জানি । আর তার উত্তর-ও আপনি জানেন । তাহলে সময় নষ্ট করছেন কেন ? „
মোঃ শেখ একবার উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে , আকাশের বাবাকে দেখিয়ে বললো , “ ইনি কিছু কথা বলতে চান , সেটা অন্তত শোন । „
মোঃ শেখের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের ঘর থেকে একজন ছত্রিশ সাঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষ বেরিয়ে এলো । তার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে পুতুল নিয়ে খেলা করছে । এই লোকটাই হয়তো শালিনীর স্বামী । সে একবার সোফায় বসে থাকা দুজন কে আড়চোখে দেখে নিয়ে অন্য একটা ঘরে চলে গেল ।
শালিনীর স্বামী চলে গেলে আকাশের বাবা বললেন , “ আমি এনার কাছ থেকে তোমার ব্যাপারে শুনেছি । তোমায় তুমি করেই বলছি কারন তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট । আমি জানি না তোমায় কি বলবো কিন্তু তুমি তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কি কিছু করবে না ….
শালিনীর আকাশের বাবাকে থামিয়ে রহমতের দিকে চেয়ে বললো , “ এ কথা বহুবার এই ইনি আমায় বলেছেন । আর বহুবার আমি বলেছি আমার এখন একটা সংসার আছে । স্বামী আছে । একটা মেয়ে আছে । আমি এই ন্যায় অন্যায় খেলতে গিয়ে এদের কোন বিপদে ফেলতে পারবো না । „
আকাশের বাবা উত্তেজিত হয়ে বললেন , “ তুমি কি চাওনা এইসব বন্ধ হোক । ওরা যদি এইভাবে রাস্তায় খোলা ঘুরে বেড়ায় তাহলে না জানি আরও কত মেয়ের সর্বনাশ করবে । তুমি কি এইসব মেয়েদের জন্য এগিয়ে আসতে পারবে না ! „
শালিনী ভুরু কুঁচকে বললো , “ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার মেয়ের সাথে ওরা কিছু একটা করেছে । আমি জানতে চাইনা ওরা আপনার মেয়ের সাথে কি করেছে । যদি সত্যিই কিছু করে থাকে আপনার মেয়ের সাথে , তাহলে আপনার মেয়েকে এগিয়ে আসতে বলুন না ! „
এর উত্তরে আকাশের বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন । কিন্তু তখনই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সুচির কান্নাভেজা চোখ । আর মুখে এসিডের ক্ষত ….. সঙ্গে সঙ্গে চোখটা বন্ধ করে নিলেন তিনি ।
শালিনী আকাশের বাবার মুখভঙ্গি দেখেই সব বুঝতে পারলো , “ দেখলেন ! আপনিও আপনার মেয়েকে এগিয়ে আসতে দিতে চান না । আপনিও ভয় পাচ্ছেন । যেদিন আপনি আপনার মেয়েকে এগিয়ে আনতে সাহস করবেন সেদিন আসবেন । এখন আসতে পারেন । „
এরপর আর ওখানে বসে থাকা অসভ্যতার লক্ষণ । তাই দুজনেই উঠে ঘরের বাইরে চলে এলেন । ঠিক তখন ভিতর থেকে কিছু আওয়াজ আকাশের বাবা আর মোঃ শেখের কানে এলো । ভিতরে শালিনী তার স্বামীর সাথে কথা বলছে । কথা শুনে মনে হচ্ছে শালিনীর স্বামী চায় যে শালিনী লড়ুক ।
কথাগুলো শুনে একবার একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা দুজন নিচে নেমে এলেন । রাস্তায় আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মোঃ শেখ আকাশের বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বললো , “ দেখুন আপনি চেষ্টা ভালো করেছেন । আপনি আপনার মেয়েকে সাক্ষী হিসাবেও আনতে রাজি সেটা আমি জানি , কিন্তু আপনার মেয়ে এখন সুখে সংসার করছে । করতে দিন । „
তারপর কিছুক্ষন থেমে বললো , “ আমি মুসলিম । ধার্মিক না হলেও এটা মানি , নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করি যে , একটা মানুষ খারাপ করতে করতে একটা সময় তার সাথেও খারাপ হতে শুরু করে । আমাদের এখন ওটারই অপেক্ষা করতে হবে । „
এবার আকাশের বাবা রাগে ফেটে পড়লেন , “ ওই পশুটা কয়েক বছর পর মুখ্যমন্ত্রী হবে । ভাবতে পারছেন কি করবে তখন ! „
“ আমি জানি মি.মিত্র । কিন্তু তখন ওর হাত বাঁধা হয়ে যাবে । তখন না চাইতেও কিছু করতে পারবে না । আবার লুকিয়ে করতেও পারে । আপনার সাথে দেখা হয়ে সত্যি হয়ে খুব ভালো লাগলো । „ বলে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল ।
মোঃ শেখের সাথে হ্যান্ডশেক করে আকাশের বাবা বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরলেন । মাথায় তার একটাই কথা ঘুরছে । একবার আকাশ কথার ছলে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছিল , “ যারা অপরাধ করে আর যারা অপরাধ সয় , দুজনেই সমান দোষী । „ কথাটা বারবার আকাশের বাবার মাথায় এসে আঘাত করতে লাগলো । এর জন্য বার দুই তিনি গাড়ি চালানোয় অমনোযোগী হয়ে উঠলেন ।
বাড়ি ফিরে তিনি ছাদে মাদুর পেতে সুচির বাবার সাথে দাবা খেলতে বসলেন । কিন্তু দাবা খেলায়ও তার অমনোযোগ দেখে সুচির বাবা বললেন , “ কি হয়েছে ? মন কোথায় তোর ! „
আকাশের বাবা আনমনে নিজেকে তিরষ্কার করে বললেন , “ সেদিন সই করাটা একদম উচিত হয়নি আমার । „
“ বাজে বকিস না । তুই যা করেছিস তা আমাদের মুখ চেয়ে করেছিস । সেই পরিস্থিতিতে ওটাই আমাদের জন্য মঙ্গল ছিল । „
“ কিন্তু একজন ভিক্টিমের জীবন যাপন করছি আমরা । „
“ আর কি করার আছে বল ! তুই চেষ্টা তো কম করলি না । এখন সুচির মুখ চেয়ে পিছিয়ে এলি । মাঝেমাঝে নিজের মঙ্গলের জন্য পিছিয়ে আসা দোষের নয় শুভো । কৃষ্ণ-ও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতো । এইজন্য ওকে রাণছোড় বলা হয় । তুই এই নিয়ে আর ভাবিস না । উপরে ভগবান আছে । সে তোর চেষ্টা দেখেছে । তোর পরাজয়ও দেখেছে । এখন ওকেই সব করতে দে । „
কথায় আছে সময় সব ক্ষতের মহাঔষধ । এখানেও তাই হলো । আকাশ সুচির অফিস , আর সুচির সপ্তাহে দুই বার নিয়মিত সাইকায়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে আরও আড়াই মাস কেটে গেল । সুচিকে তার সাইকায়াট্রিস্ট কিছু যোগব্যায়াম করতে দিয়েছে । সেটাই সে নিয়মিত করে । আর নাচটা কন্টিনিউ করতে বলেছে । এতেই নাকি তার রাগ অনেকটা কন্ট্রোলে ছিল । কোন ওষুধ আপাতত দেয়নি । বলা বাহুল্য এরপর সুচি আর কোন দুঃস্বপ্ন দেখেনি ।
এদিকে সুমির তিন মাস প্রেগন্যান্ট হতেই সুমির মা তাকে জোর করে , পাকাপাকি ভাবে এখানে নিয়ে এলেন , দেখাশোনা করার জন্য । সুমির সাথে এলো তার একমাত্র মেয়ে প্রজ্ঞা ‌। মা শান্ত শিষ্ট হলেও মেয়ে মোটেও শান্ত শিষ্ট নয় । প্রথম রাতেই দিম্মার কাছে ঘুমানোর বায়না জুড়লো । সুমির মাও একমাত্র নাতনির আবদার ফেলতে পারলেন না । দিম্মার কাছে শুয়েই সে সন্তুষ্ট হলো না । তাকে গল্পো শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হলো । মায়ের কাছে শুয়ে মায়ের সব গল্পো নাকি তার শোনা হয়ে গেছে ।
পরের দিন থেকে সে দুই পরিবারকে মাতিয়ে রাখতে শুরু করলো । একবার এই ফ্ল্যাট তো একবার ওই ফ্ল্যাট । দুটো ফ্ল্যাটে সর্বত্র তার যাতায়াত । মাঝে মাঝে সে বায়না করে মাসির সাথে ঘুমাবে । তাই বাধ্য হয়ে বা বলা ভালো খুশি হয়ে সুচি তাকে নিজের কাছে এনে ঘুমায় ।
এবারের পূজাতে প্ল্যান ছিল বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে । কিন্তু সুমির দেখভাল করার জন্য সুমির মাকে এখানে থাকতেই হবে । আর সুচেতা দেবী না গেলে স্নেহা দেবীও যেতে চাইলেন না । তাই পূজাটা কলকাতাতেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল সবাই ।
মহালয়া আসতে সবাই চাইলো সুচি নাচুক । তাই সুচি অষ্টমী নাচলো । বিয়ের পর এই প্রথম সে নাচলো । প্রথম পুরস্কার নেওয়ার পর তার মনটা খুশিতে ভরে উঠলো । এদিকে মাসির নাচ দেখে প্রজ্ঞা বায়না জুড়লো যে সে নাচ শিখবে । সুচি প্রজ্ঞার কথা শুনে প্রজ্ঞার গালে একটা হামি খেয়ে বললো , “ মাঝপথে ভালো লাগছে না বলবি না তো । „
প্রজ্ঞা মিষ্টি গলায় বললো , “ না , আমি বলবো না । আমি তোমার মত নাচ শিখতে চাই । একদম তোমার মত । „
সুচি হেসে আরও একটা হামি খেয়ে বললো , “ ঠিক আছে । তোকে একদম আমার মত নাচ শেখাবো । „
সুমির দেখাশোনা করতে করতে , প্রজ্ঞার সাথে খেলতে খেলতে আর প্রজ্ঞাকে নাচ শেখাতে শেখাতে ডিসেম্বর মাস চলে এলো । একদিন দুপুর বেলা , অফিসে সবে টিফিন ব্রেক শেষ হয়েছে , তখন সুচির ফোনে সুচির বাবা ফোন করলেন । সুচি ওয়াসবেসিনে হাত ধুতে গেছিল । এসে ঘুরিয়ে ফোন করতেই সুচির বাবা বললেন , “ তোর দিদি হসপিটালে আছে । ডিলিভারি হবে । যদি পারিস তো আয় । „
আকাশকে আর আকাশের বাবাকে কথাটা বলতেই আকাশের বাবা বললেন , “ অপেক্ষা করছিস কেন ! যা। আর শোন , আবার অফিসে এসে কাজ করার দরকার নেই । ওখান থেকে বাড়ি চলে যাবি। „
আকাশের বাবার কথা মতো সুচি আকাশকে নিয়ে হসপিটালে চলে এলো । হসপিটালে আসতেই প্রজ্ঞা সুচির কোলে উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো , “ মায়ের কি হয়েছে ? „
কৌশিক বললো , “ আমি ওকে মায়ের কাছে রেখে আসতে চেয়েছিলাম । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! „
সুচি প্রজ্ঞাকে বললো , “ কিছু হয়নি দিদির । তোর ভাই আসবে । তাই …
কথাটা বলতে বলতে সুচি থেমে গেল । মনে মনে বললো , ‘ সত্যি ছেলে হবে কি না সেটা তো জানা নেই । কিন্তু যদি মেয়ে হয় ! প্রজ্ঞা তো ভাইয়ের আশায় বসে আছে । হে ঠাকুর ! এই ছোট্ট মেয়েটার প্রার্থনা রেখো । „
প্রজ্ঞা বললো , “ কখন আসবে ? „
“ এইতো আর কিছুক্ষন পর ডাক্তার বেরিয়ে আসবে । „
দেঢ়ঘন্টা পর যখন নার্স বেরিয়ে এসে বললো ছেলে হয়েছে তখন সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠলো ।
আরো প্রায় এক ঘন্টা পর সবাই ot তে ঢুকতে পারলো । কৌশিক গিয়ে হাসি মুখে সুমির পাশে বসলো । সুচির বাবা নবজাতককে কোলে তুলে নিলেন । সুমির ছেলের মুখটা দেখে সুচির বুকটা কেমন একটা কেঁপে উঠলো । ঠিক কি কারনে এরকম অনুভুতি হলো সেটা সে বুঝতে পারলো না ।
সুমির ছেলেকে সবাই কোলে নিয়ে আদর করার কিছুক্ষন পর কৌশিক আকাশকে ইয়ার্কি মেরে বললো , “ কি হে , এবার তোমরাও একটা নিয়ে নাও । বেশি দেরি করো না । „
আকাশ লজ্জা পেল কিন্তু কিছু বললো না । বাইকে করে বাড়ি ফেরার সময় আকাশ সুচিকে বললো , “ কৌশক দা ইয়ার্কি ও মারতে পারে । „
সুচি আনমনে বসে ছিল । আকাশের কথা তার কানে গেল না । বাড়ি ফিরেও সে কোন এক জগতে হারিয়ে রইলো । খাওয়া দাওয়া করে ঘুমানোর আগে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সুচি হঠাৎ বললো , “ আমি তৈরি । „
আকাশ সুচির কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না , “ কি বলছো ? কিসের জন্য তৈরি ? „
সুচি উঠে এসে আকাশের পাশে বসে , আকাশের হাত ধরে বললো , “ আমি মা হতে চাই । „
আকাশ সুচির কথা শুনে সত্যিই আকাশ থেকে পড়লো । মেয়েদের মন না বুঝতে পারলেও সে এটা বুঝতে পারলো যে , সুমির ছেলেকে দেখেই সুচির এই ইচ্ছা জেগেছে । আকাশ কিছুক্ষন সুচির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললো , “ আমি তৈরি নই । মানে আমি ঠিক এতো দায়িত্ব ! বাবার দায়িত্ব ! ….
সুচি আকাশের হাতটা আরো ভালো করে ধরে বললো , “ আমিও তৈরি নই । কেউ তৈরি থাকে না । কিন্তু আমি পারবো । আমি চাই । আমি জানি তুমিও পারবে । „
সুচির কথায় আকাশের মনোবল শক্ত হলো । ইয়ার্কি করে বললো , “ কিন্তু আমি জানি না সন্তান কিভাবে নিতে হয় ? „
সুচি লাজুক হেসে বললো , “ আচ্ছা জি ! „
আকাশ ইয়ার্কি করেই বললো , “ তুমি বড় , তুমিই শিখিয়ে দাও আমায় , কিভাবে সন্তান নিতে হয় । „
আকাশের কথা শেষ হতেই সুচি আকাশের গলা টিপে ধরে বললো , “ বদমাইশি করার আর জায়গা পাওনি ! „
এর তিন দিন পর রবিবার ছিল । তাই আকাশের ঘুম একটু দেরিতেই ভাঙলো । ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সুচি ঘরে এসে ঢুকলো । সুচিকে দেখে আকাশ একটা হাই তুলে বললো , “ গুড মর্নিং । „
সুচি এর উত্তরে কিছু বললো না । শুধু মুখে লাজুক হাসি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো । আকাশ সুচির হাবভাব দেখে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি হয়েছে ? „
সুচি লাজুক হেসে মাথা উপর নিচ করলো । আকাশ সঙ্গে সঙ্গে খাট থেকে নেমে সুচিকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ সত্যি ! „
সুচি আবার মাথা উপর নিচ করলো । তারপর ড্রেসিং টেবিল থেকে প্রেগনেন্সি কিটটা নিয়ে আকাশকে দেখিয়ে দিল । আকাশ দেখলো তাতে দুটো দাঁড়ি টানা আছে । আকাশের ইচ্ছা হলো সুচিকে চাগিয়ে তুলে নাচতে । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো , “ মাকে বলেছো ? „
সুচি আকাশের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো , “ লজ্জা করছে । তুমি বলো । „
“ বারে ! আমার লজ্জা করে না বুঝি । তুমি বলো । „
“ আমি পারবো না । তুমি বলো । „
তো এই ‘ তুমি বলো , তুমি বলো ’ করতে করতে কাউকেই কথাটা বলা হলো না । তবুও খবরটা চাপা রইলো না ।
এই তিন দিনে অবশ্য সুমি তার একমাত্র ছেলের নামকরণ করে ফেলেছে । সুমির ছেলের নাম “ প্রত্যয় । „ প্রত্যয় জন্মানোর পরেও সুচেতা দেবী আরও দুই তিন মাস সুমিকে এখানেই রেখে দিতে চাইলেন । কৌশিকের এতে কোন আপত্তি নেই ।
পরের বছর পড়তেই সুচির বাবা রিটায়ার্ড করলেন । এখন তিনি বাড়ি বসেই সময় কাটাতে লাগলেন। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের একদিন সকালে , সুচি ব্রেকফাস্ট বানানোয় মাকে সাহায্য করছিল । সুচি সবে উপরের তাক থেকে হলুদের কৌটা টা পাড়তে গেছে তখনই সে চোখের সামনে অন্ধকার দেখলো । চারপাশটা যেন তার চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করলো । সুচির চোখ মুখের অবস্থা দেখে পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের মা সুচিকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললেন , না হলে সুচি পড়েই যেত ।
যথারীতি আকাশের মা চিল্লিয়ে উঠলেন । মায়ের আওয়াজ শুনে আকাশ দৌড়ে রান্নাঘরে চলে এলো । সুচির অবস্থা দেখে ভয়ে তার হাত পা কেঁপে উঠলো । সঙ্গে সঙ্গে সুচিকে কোলে তুলে , ঘরে এনে খাটে শুইয়ে দিল । আকাশের মা জলের বোতল এনে বারবার সুচির চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন । ইতিমধ্যে আকাশ একজন ডাক্তারকে ফোন করে ফেলেছে । পাশের ফ্ল্যাট থেকে সবাই চলে এসেছে । সবার মুখেই দুঃশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ।
প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর সুচির জ্ঞান ফিরলো । জ্ঞান ফিরতেই নানা প্রশ্নবাণে সে জর্জরিত হয়ে পড়লো । সুচি শুধু বললো , “ হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেছিল । „
এর আরও কুড়ি মিনিট পর ডাক্তার এসে পৌঁছালো । সে কিছুক্ষন সুচির নাড়ি দেখে , চোখ দেখে বললো , “ খুব দুর্বল । এটা মোটেও ভালো কথা নয় । ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে হবে । „
ঘরের বাইরে এসে ডাক্তার বললো , “ ও প্রেগন্যান্ট । তাই ওরকম হয়েছে । একটু দেখভাল করুন আর খাওয়ান ভালো করে । „
এরপর বলা বাহুল্য যে ঘরে একটা খুশির হাওয়া বয়ে গেল । সুচি প্রেগন্যান্ট । সে মা হতে চলেছে । আর আকাশ বাবা । সবাই এতে খুব খুশি । খবরটা পাওয়ার পর প্রথম প্রথম তো আকাশের মা সুচিকে অফিস যেতেই দিচ্ছিলেন না । সুচি একরকম জোর করেই অফিস যেতে শুরু করলো । এখন থেকেই বাড়িতে বসে থাকলে পরে সমস্যা হবে ।
কিছুদিন পর সুচির প্রথম রেগুলার চেকআপের রিপোর্ট আনতে যাওয়ার পর ডাক্তার আকাশ আর সুচিকে বললো , “ আপনারা কি চান ? ছেলে নাকি মেয়ে । „
সুচি আর আকাশ তো রিতিমত অবাক । কোনো ডাক্তার তো সাধারনত এই ধরনের প্রশ্ন করে না । তাহলে ! সুচি একবার আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো , “ যাই হোক আমরা খুশি । ছেলে হলেও আর মেয়ে হলেও সমান খুশি । „
“ আরো একটা সুখবর আছে । „ বলে ডাক্তার খবরটা দিয়ে দিল ,“ একটা নয় । দুটো । আপনি যমজ সন্তানের মা হতে চলেছেন । এই দেখুন রিপোর্ট । „
আকাশ টেবিল থেকে রিপোর্টের ফাইলটা তুলে নিয়ে প্রথমেই আল্ট্রাসনোগ্রাফির পেজটা দেখলো । সত্যি সেখানে দুটো মাথা দেখা যাচ্ছে । ফটোটা দেখে আকাশ বোবা হয়ে গেল । প্রথমে একটা সন্তানের সুখই সে সামলে উঠতে পারছিল না , আর এখন দুটো । কি বলবে সে ভেবে পেল না । ভাষা হারিয়ে ফেললো । এদিকে সুচিরও একই অবস্থা ।
বাড়ি ফিরেই সে নির্লজ্জের মতো মাকে খবরটা দিয়ে দিল । স্নেহা দেবীর চোখে জল চিকচিক করে উঠলো । সুচির কপালে চুমু খেয়ে একটা টিকা লাগিয়ে দিলেন ।
এতদিন জোর করে সুচি অফিস গেলেও এই খবরটা শোনার পর স্নেহা দেবী আর সুচিকে অফিস যেতে দিলেন না । এরপর হু হু করে দিন কাটতে লাগলো । সময় যে এতো দ্রুত কাটতে পারে সেটা আকাশ আগে জানতোই না । সারাদিন ঘর থেকে লিভিংরুমের টিভি আর লিভিংরুম থেকে বাথরুম , এটাই হলো সুচির জীবন । আর মাঝে মাঝে বাবার সাথে দাবা খেলা তো আছেই প্রথম কয়েক মাস নিচে নেমে পার্কে ঘুরতে পারলেও দুই মাস যেতে যেতেই সেটাও বন্ধ হয়ে গেল । এরপর সে ছাদে উঠে পায়চারি করা শুরু করলো ।
চতুর্থ মাসে সুচির ডাক্তার তাকে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে বললো । বেশি করে ফলমূল খেতে বললো । এটা শোনার পরেই বাড়ির তিন পুরুষ এতো এতো ফলমূল আনা শুরু করলো যে সবাই মিলে খেয়েও কুলোতে পারলো না । তাই দুই দিন অন্তর অন্তর একজন করে ফল আনার সিদ্ধান্ত নিল । দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা মাস গেল । ডাক্তার সুচিকে চেকআপ করার পর বললো , “ ডেলিভিরি হতে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি সময় লাগবে । টুইনস তো ! তাই এটাই স্বাভাবিক । „
সুচি মাঝেমাঝে তার বেড়ে ওঠা পেটের উপর হাত বুলোয় । আর বলে ওঠে , “ আর কয়েকমাস পরেই তোরা বাইরের জগত দেখবি । আমায় মা বলে ডাকবি । খবরদার দুষ্টুমি করবি না । আমি কিন্তু খুব রাগী । „ বলে নিজেই হেসে ওঠে ।
অষ্টম মাসের এক সন্ধ্যা বেলায় , ছাদের উপর মাদুর পেতে সুচি আকাশের বুকে পিঠে দিয়ে বসে আছে । আগষ্ট মাসে একটু বৃষ্টি হওয়ায় হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ আছে । তাই আকাশ সুচিকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে আছে । গতকাল ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় আজ আর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই । খোলা আকাশে তারা দেখতে দেখতে , একটা উজ্জ্বল তারার দিকে আঙুল দেখিয়ে সুচি বললো , “ দিম্মা বলতো ওই তারাটা হলো দাদু । „
আকাশও সুচির কথাতে বললো , “ আর ওই পাশেরটা কে বলোতো ? „
“ ওটা দিম্মা । আর পাশেরটা বাদশা । জানো , আমি ঠিক করেছি আমাদের সন্তান হওয়ার পর আমরা বাদশার মতো আর একটু কুকুর নেবো । আমরা যেভাবে বাদশার সাথে খেলে বড়ো হয়েছি সেইভাবে আমাদের সন্তানরাও বড়ো হবে ‌। „
“ অবশ্যই । কোন এক সিনেমায় শুনেছিলাম — আমরা দুই বার মরি । একবার আমাদের মৃত্যু হলে । আর একবার যেদিন আমাদের নাম শেষ বারের মত কেউ বলে । দিম্মা , দাদু আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবে । আজীবন । „
আরও কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হাওয়া বাড়তেই আকাশ সুচিকে সযত্নে হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনলো ।
পরের দিন সকালেই খবরের চ্যানেলে বার হলো — এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মাননীয় বিধায়ক পঙ্কজ সহায়ের বড়ো ছেলের মৃত্যু । রোজ সকালের মত ময়দানে জগিং করতে যাওয়ার সময় এক পাঞ্জাব লড়ি এসে ধাক্কা মারে । তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় বলে বিশেষ সূত্রের খবর ‌।
এক্সিডেন্টে মৃত্যু হতেই পারে , এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই । কিন্তু দুই সপ্তাহ পর মোঃ শেখ উতলা হয়ে আকাশের বাবাকে ফোন করলেন । ফোন ধরতেই মোঃ শেখ বলে উঠলো , “ ওটা দূর্ঘটনা ছিল না । „ তার গলায় কিছুটা খুশি আর কিছুটা উত্তেজিত হওয়ার সুর স্পষ্ট ।
আকাশের বাবা কিছুই বুঝতে পারলেন না , “ কোন দূর্ঘটনার কথা বলছেন ? „
“ পলাশের দাদার কথা বলছি । দূর্ঘটনায় একবার মাত্র ধাক্কা লাগে । কিন্তু এখানে তিনবার ধাক্কা লেগেছে । এটা দূর্ঘটনা হতে পারে না । কেউ একজন ওকে খুন করেছে । আল্লাহ এতদিন পর … „
“ কিন্তু কে করেছে সেটা ?
“ সেটা এখনো জানতে পারি নি আমি । আপাতত একজন পাঞ্জাবী খুনটা করেছে বলে খবর পেয়েছি । „
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আকাশের বাবা ফোনটা রেখে দিল । মনে মনে তিনি খুশি হলেও পলাশের দাদার থেকে যদি পলাশ মরতো তাহলে তিনি আরো বেশি খুশি হতেন । এই খবরটা তিনি বাড়ির কাউকে দিলেন না ।
এরপর দেখতে দেখত আরো দুই মাস কেটে গেল । অক্টোবর মাসের এক মধ্য রাতে প্রচন্ড ব্যাথায় সুচির ঘুম ভেঙে গেল । সুচির আর্তনাদে আকাশ ধড়মড় করে উঠে বসলো । ঘরের লাইট জ্বালিয়ে আকাশ জিজ্ঞেস করলো , “ কি হয়েছে ? „
“ হবে । ব্যাথা করছে খুব । ওয়াটার ব্রেক করেছে ‌। „
আকাশ বিছানায় তাকিয়ে দেখলো সত্যি ওয়াটার ব্রেক করেছে , “ কিন্তু এখনো তো দুই দিন বাকি । „
সুচি রেগে গিয়ে চিল্লিয়ে বললো , “ আমি কি জানি এখন হচ্ছে কেন ? হসপিটালে নিয়ে চলো । „
আকাশ সঙ্গে সঙ্গে , “ মা দরজা খোল বলে চিল্লিয়ে উঠলো । „ তারপর সুচিকে কোলে করে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো । স্নেহা দেবীর ঘুম সুচির চিল্লানোতেই ভেঙে গেছিল । তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিলেন । আকাশ সুচিকে ফ্ল্যাটের নিচে নামতেই আকাশের বাবা গাড়ির চাবি নিয়ে চলে এলেন । তারপর আকাশ সুচিকে নিয়ে পিছনের সিটে বসলো । আর আকাশের বাবা ড্রাইভ করে নিয়ে গেলেন । কুড়ি মিনিটের মধ্যেই তারা নার্সিংহোমে পৌঁছে গেলে সুচিকে ot তে ভর্তি করে দেওয়া হলো । তারপর অপেক্ষা করা ছাড়া কোন কাজ নেই । তাই আকাশ আর আকাশের বাবা অপেক্ষা করতে লাগলেন । কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সুচির বাবা সুচির মা আর আকাশের মাকে নিয়ে নার্সিংহোমে চলে এলেন ।
তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে । ছটা বেজে গেছে কিছুক্ষন আগে । সিফ্ট চেঞ্জ হয়েছে বলে কয়েকজন নতুন ওয়ার্ডবয় এসে যোগ দিল । একজন এসে ওটির বাইরে টিভি চালিয়ে দিল । তারপর নিজের রোজকার রুটিং মতো ফ্লোর মুছতে শুরু করলো ।
দশ মিনার পর ছেলেটা খবরের চ্যানেল চালিয়ে দিতেই এক মহিলা রিপোর্টার বলে উঠলো , “ আজ মধ্যরাতে পার্টি করে বার হওয়ার পর এক আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হলো প্রখ্যাত বিজনেস ম্যান একমাত্র ছেলে ইন্দ্রজীৎ এর । সে এবং তার বন্ধু পলাশ সহায় পার্টি করে নাইট ক্লাব থেকে বার হচ্ছিল । তখনই এই আততায়ীর আক্রমণ বলে খবর । ঘটনাস্থলেই ইন্দ্রজীৎ এর মৃত্যু হয় এবং পলাশের পায়ে আততায়ী গুলি করে । …..
এতোটা শোনার পর সুচেতা দেবী আর আকাশের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন । সুচির বাবা একবার আকাশের বাবার দিকে তাকালেন ।
এর ঠিক এক ঘন্টা পরেই আকাশের বাবার ফোন বেজে উঠতেই , আকাশের বাবা পকেট থেকে ফোন বারে দেখলেন মোঃ শেখ ফোন করেছে । তিনি একপাশে সরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন ।
বেশ কিছুক্ষন পরও তখন আকাশের বাবা ফিরলো না তখন আকাশ গিয়ে দেখলো যে তার বাবা চুপিচুপি কথা বলছে । সে চলে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু বাবার মুখে পলাশ নামটা শুনতে পেয়েই সে চুপিচুপি বাবার কথা শুনতে লাগলো ।
বাবা বলছে — কেউ তো শাস্তি দিচ্ছে । আইনি ভাবে যে সাজা দেওয়া সম্ভব নয় সেটা তো আমি আপনি চেষ্টা করে দেখলাম ।
অপরপ্রান্ত কি বলছে সেটা আকাশ শুনতে না পেলেও বাবার কথা সে শুনতে পেল । বাবা বলছে — আইনি ভাবে আর সম্ভব নয় । আপনি চেষ্টা করলে করুন । যদি প্রয়োজন হয় আমি আছি । আপাতত যে নিজের হাতে রাজদন্ড তুলে নিয়েছে তাকে তার মত কাজ করতে দিন । এবার পলাশ মরলেই হয় ।
আকাশ এরপর চলে এলো । আর শুনলো না । খুশিতে চোখে জল চলে এসেছে । তবে এটা সত্যি খুশির জল নাকি বাবার সাথে কয়েক মাস কথা বন্ধ করে দেওয়ায় অনুশোচনার জল সেটা সে বুঝতে পারলো না ।
আরও প্রায় পাঁচ ছয় ঘন্টা পর নার্স এসে বললো , “ আপনারা চিন্তা করবেন না । সময় একটু লাগে । নরমাল ডেলিভারি করা যাবে বলে ডাক্তার ওটাই করাচ্ছেন । „
আরও দুই ঘন্টা পর ভিতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ সবাই শুনতে পেলো । সাত মিনিট পর আরো একজনের কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে এলো । সুচেতা দেবীর চোখের জল বাঁধ মানছে না । একদিকে আবার দাদি হওয়া আর একদিকে পলাশের ওই ঘটনা ।
দেঢ় ঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললো , “ যমজ হবে সেটাতো আপনারা জানতেন । একজন ছেলে আর একজন মেয়ে হয়েছে । ছেলেটা প্রথম । সাত মিনিট আগে । আর মেয়েটা পরে । আপনারা ভিতরে যান । নার্স সব বলে দেবে । „
হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকেই দুই মা দুজনকে কোলে তুলে নিল । দুজনেই ঘুমাচ্ছে । কিন্তু কিছুক্ষন আগে এদের কান্নার আওয়াজ বাইরে শোনা যাচ্ছিল । আকাশ গিয়ে সুচির পাশে গিয়ে বসলো । সুচি আধবোজা চোখে আকাশের হাত ধরলো । আকাশ চোখের জল মুছে আস্তে আস্তে বাবার কথা , পলাশের পায়ে গুলি লাগার কথা বলে দিল ।
সুচি সব শুনে বললো , “ জানি আমি । যেদিন আমি ছাড়া পাই । যেদিন তুমি সকাল বেলা নার্সিংহোমে এসছিলে সেদিনকেই বাবা আমায় সব বলে দিয়েছিল । „
আকাশ অবাক হয়ে বললো , “ তুমি আমায় জানাও নি কেন ? „
“ জানলে কি করতে ? এমনিতেও বাবা তোমায় বলতে বারন করে দিয়েছিল । „
এদিকে আকাশের মা আর সুচির মায়ের মধ্যে কম্পিটিশন লেগেছে যে সন্তান দুটো কার মতো দেখতে হয়েছে । একবার বলেন দিম্মার তো একবার সুচির । কিন্তু গালে টোল নেই । দুজনেই সুচির মত ফর্সা । দুজন আইডেন্টিকাল টুইনস হয়েছে ।
এক দিন পরেই দুই নবজাত শিশুকে নিয়ে সুচি আকাশ বাড়ি চলে এলো । ঠিক যেমন আকাশের বাবা আকাশের মায়ের হাত ধরে পরমযত্নে আকাশকে এই বাড়িতে এনেছিলেন । তেমনি আকাশও সুচির হাত ধরে পরমযত্নে তার দুই সন্তানকে সোসাইটিতে নিয়ে আসলো । নবজাত দুই শিশুর নাম রাখা হলো “ প্রবীর আর প্রমীলা „ ।
এক সপ্তাহ পরে একটা বড়ো পার্টি দেওয়া হলো । সোসাইটির কমিউনিটি হলে একটা রাজসিংহাসনে সুচি আর আকাশ দুজনকে নিয়ে বসে আছে । সবাই এসে আশীর্বাদ করছে । প্রজ্ঞা একসাথে তিন ভাইবোন পেয়ে খুব খুশি । কিছুক্ষন পর ক্যামেরাম্যান বললো “ একটা ফ্যামিলি ফটো প্লিজ । „
শুধু বলার অপেক্ষা । সবাই এসে সুচি আকাশের সোফার পিছনে দাঁড়িয়ে পড়লো । মাঝখানে কৌশিক তার পাশে সুমি । ডান দিকে আকাশের মা বাবা আর বাঁ দিকে সুচির মা বাবা । আর সিংহাসনে মাঝখানে প্রজ্ঞা বসে আছে প্রত্যয় কে নিয়ে । তার দুই পাশে সুচি আর আকাশ তাদের প্রবীর আর প্রমীলা কে নিয়ে বসে আছে । দুজনকে বালগোপালের মত সাজান হয়েছে । ক্যামেরাম্যান ক্যামেরার এঙ্গেল ঠিক করে রেডি বলতেই সুচি মিষ্টি গলায় বলে উঠলো , “ say cheese „
Click

More বাংলা চটি গল্প

Leave a Comment