Written by Nirjon Ahmed
অভয়ারণ্য!
রুদ্রাভাবি বললেন, “ধানমন্ডির বাসাটা অনেক খোলামেলা, জানো। রাস্তার একদম পাশে। কোন গলি পার হতে হয় না!”
আমি মলিন মুখে বললাম, “এত টাকা ভাড়া, বাড়তি সুবিধা তো পাবেনই!”
রুদ্রাভাবিরা বাসা চেঞ্জ করে ধানমন্ডির দিকে চলে যাচ্ছেন। উকিলসাহেব আট বছর ধরে এখানে পড়ে আছে। এখন পশার বেড়েছে, ইনকাম আগের চারগুণ। পুরান ঢাকার এই দমবন্ধ পরিবেশে থাকবেন কেন?
রুদ্রাভাবি নিজের আঁচল ঠিক করতে করতে বললেন, “তোমার মুখটা এমন হয়ে আছে কেন? আমি মাঝেমাঝে আসব!”
আমি কিছু বললাম না। ভাবির কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম মনেমনে। ভাবি নিজের বৌয়ের মতো হয়ে গেছিলেন যেন। উকিল বেশিরভাগ সময় চেম্বারে কাটান, আমার কাছে ভাবির আসা যাওয়া ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যখন চাইতেন আসতেন। ভাবির সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর থেকে, তার স্বামীর চেয়ে আমিই বেশি চুদেছি।
এখন একঘেয়ে লাগে ভাবি ডাঁশা দুধদুইটাও। মনে হয়, ওর ভোদার প্রতিটা বালা আমাকে চেনে। এখন আর আগের মতো ভাবি আসার সাথে সাথেই আমার বাড়া লাগিয়ে আকাশমুখী হয়ে ওঠে না। ভাবি চুষে চুষে বড় করান। এভাবে আর চুলবে কতোদিন?
ভাবি বললেন, “আমি ডাকলে তুমি যাবে না?”
বললাম, “এখনকার মতো যখন তখন কি পারব যেতে? আপনি আসতে পারবেন?”
“সে হবে না! কিন্তু আমাদের যোগাযোগ তো থাকছেই! আর সৈকতের স্কুল তো বদলানো হয়নি। এবছরটা আমাকে এদিকে প্রতিদিন ওকে নিয়ে আসতেই হবে!”
ভাবি আমার বাড়া থেকে টিস্যু দিয়ে মুছে দিলেন তার ভোদার রস। আমি প্যান্টের বেল্ট লাগালাম।
শাড়িটা ঠিকঠাক করে, মুখের লিপস্টিক ঠিক আছে কিনা আয়নার দেখে নিয়ে, ভাবি বেরিয়ে গেলেন। স্বামীকে চেম্বার থেকে নিয়ে নতুন বাসা দেখতে যাবেন। কয়েক ট্রাক মাল এর মধ্যে চলে গেছে এবাসা থেকে। সেসব ঠিকঠাক জায়গায় রাখা হচ্ছে কিনা, কোনকিছু খোয়া গেল কিনা, দেখভাল করবেন।
ক্লাস বিকেল তিনটায়। আড়াইটায় গোসল করে ক্লাসের বইখাতা ব্যাগে পুরছি, মৃন্ময়ী ফোন দিল।
“আজ ক্লাসের পর ফ্রি আছো তুমি?”, মৃন্ময়ী বলল।
“কেন বলতো?”
“ভাইয়ার বাসায় যাব। অনেকদিন থেকে যেতে বলে, যাই না!”
“আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছো?”, বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
বলল, “হ্যাঁ। তুমি যাবে কিনা বলো!”
বললাম, “যাব। তোমার তো ভাই আবার পুলিশ!”
মৃন্ময়ী “ক্লাসে আসো” বলে ফোনটা রেখে দিল।
বাসার নিচের গলিতে একটা ট্রাকে রুদ্রাভাবিদের মালপত্র তোলা হচ্ছে। এই নিয়ে বোধহয় ৩য় ট্রাক! ভাবি বোধহয় গোটা নিউমার্কেটটা বাড়ির ভিতরে এনে রেখেছেন।
ক্লাসে ঢোকার আগে নীলার সাথে দেখা হয়ে গেলো। আগের মতোই রাফটাফ দেখাচ্ছে ওকে। পোশাক বরং আগের চেয়ে বোল্ড। আমাকে বলল, “কী রিদম সাহেব? ইদানীং মৃন্ময়ীর সাথে খুব লটরপটর চলছে দেখি!”
লজ্জায় কানদুটো গরম হয়ে গেলো। আমাকে জড়িয়ে মৃন্ময়ীকে নিয়ে কেউ কথা বলেনি আগে। সবাই জানে, আমি মৃন্ময়ীর লীগের না। মৃন্ময়ী ম্যানইউ হলে, আমি আবাহনী কিংবা শেখ রাসেল। ওর সাথে আমার প্রেম? কল্পনাও করেনা কেউ। কিন্তু নীলার চোখে ধরা খেয়ে গেছি আমি!
বললাম, “এভাবে বলছিস কেন? এমনিই…”
নীলা আমার পিঠ চাপড়ে বলল, “ফল করিসনা, বোকাচোদা। দেখতে এমন শরৎচন্দ্রের নায়িকা, বাস্তবে এমন নাও হতে পারে! পরে বাপ্পারাজের মতো ‘প্রেমের নাম বেদনা’ গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হবে!”
আমি বললাম, “ধুর। কী যে ভাবিস না! কোথায় ও, আর কোথায় আমি!”
নীলা বলল, “বোকাচোদা, আমি কি বারণ করলাম নাকি? বরং বলছি, চালায় যা। কিন্তু একটু সামলে!”
ক্লাসে ঢুকতেই প্রথমবেঞ্চ থেকে মিষ্টি করে হাসল মৃন্ময়ী।
ক্লাস শেষে মৃণ্ময়ীর সাথে টিএসসি পর্যন্ত এলাম রিক্সা নিতে। রিক্সায় বসে বললাম, “ভাইয়ের বাসা থাকতে তুমি মেসে থাকো কেন?”
মৃন্ময়ী বলল, “স্বাধীনতা! সারাজীবন অভিভাবকের চোখেচোখে থাকব! জানো, বাসায় থাকতে আব্বু আমাকে স্কুলে পর্যন্ত একা যেতে দিত না! ড্রাইভ করে প্রতিদিন আনা নেওয়া করত!”
মৃন্ময়ীর বাবা ওকে গাড়িতে করে স্কুলে রেখে আসত আর আমি তিন কিলো সাইকেল চালিয়ে গার্লস স্কুলের মেয়েদের দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে স্কুলে যেতাম। বিস্তর ক্লাস ডিফ্রেন্স!
“কোথাও যেতে দিত না আমাকে। স্কুল আর বাড়ি। বান্ধবীর বাড়ি যেতে দিত না। খুব করে ধরলে, আব্বু বান্ধবীদের বাসায় নিয়ে আসত!”, আবার বলল ও।
কার্জন হলের সামনে মৃন্ময়ী রিক্সা থামাতে বলল। নেমে বলল, “ভাইয়া ছাদবাগান করেছে। দাঁড়াও, ওদের জন্য একটা ক্যাকটাস নিয়ে যাই!”
কার্জন হল থেকে হাইকোর্ট যাওয়ার রাস্তার ধারেধারে ফুলফলের গাছের দোকান। মৃন্ময়ী একটা ক্যাকটাস কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ভালোভাবে যত্ন করলে, এগুলা অনেক বড় হয় জানো?”
আমি নেতিবাচক মাথা নাড়লাম। মৃন্ময়ী বলল, “আমার কী শখ, জানো?”
“কী?”
“আমার যখন নিজের বাড়ি হবে, সেই বাড়িতে কয়েক বিঘা জুড়ে একটা বাগান করব। এমন গাছ লাগাব, যেসব গাছে পাখি বাসা করে। ওখানে রাজ্যের পাখি এসে বাসা করবে। আমি ওদের দেখাশুনা করব।”
বললাম, “গৃহপালিত পাখি!”
মৃন্ময়ী বলল, “আরে গৃহপালিত না। আমি ওদের দেখাশোনা করব বলতে, কাউকে ওদের ক্ষতি করতে দেব না। নাম দেব “মৃণ্ময়ী অভয়ারণ্য”! কেমন হবে বলতো?”
আমি মৃন্ময়ীর মুখের দিকে তাকালাম। কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখ বড় হয়ে গেছে, মুখে এসেছে আনন্দের জ্যোতিঃ, স্বপ্নের কথা বলার সময়, মানুষের মুখ এমন দীপ্ত হয়ে যায়?
বললাম, “তোমাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি জানো? এমন ভিন্নধারার চিন্তা কোনদিন মাথায় আসেনি আমার!”
মৃন্ময়ী লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকাল। বললাম, “আমার তোমার মতো কোন স্বপ্নই নেই। আমি জাস্ট ভেসে চলছি স্রোতের সাথে!”
“কোন স্বপ্ন নেই?”, জিজ্ঞেস করল মৃন্ময়ী।
ভেবে দেখলাম, আমি রবীন্দ্রনাথের গান স্বপ্ন দেখি। অতিসাধারণ স্বপ্ন।
“জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।”
স্বপ্ন দেখি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে অফিসেই, মৃন্ময়ী ফোন করে আমাকে বলছে, “আসতে হবে না তোমার, অফিসেই থাকো। অফিসে কোন মেয়ে কলিগের প্রেমে পড়েছো বুঝি?”
বলব এসব? আমার নিম্নমধ্যবিত্ত স্বপ্নে মৃন্ময়ীর স্থান হবে?
বললাম, “খুব গোপন একটা স্বপ্ন আছে আমার। কোন একদিন তোমাকে বলব। বলবোই!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ না?”
“আজ না!”
মৃন্ময়ীর ভাই কমলাপুর এলাকায় থাকে। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়াটা মৃন্ময়ীই দিল। ভদ্রতা দেখিয়ে ভাড়া দেব, সেটাকাও পকেটে নেই।
দরজায় নক করতেই দারুণ চেহারার একজন দরজা খুলে “আমরা তো কেউ নই, ফোন করে আনতে হয় তোমাকে” বলেই মৃন্ময়ীকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এ রিদম?”
আমি মাথা নেড়ে হাসলাম। ভিতরে ঢুকলাম আমরা। আর গোব্দাগাব্দা একটা বাচ্চা ছেলে “ফুপি!” বলে দৌড়ে এলো মৃন্ময়ীর কাছে।
আমি সোফায় গিয়ে বসলাম। মৃন্ময়ী বলল, “ভাইয়া কোথায়? আমাকে আসতে বলে ভাইয়া নিজেই নাই!”
মৃন্ময়ীর ভাবি বলল, “ইয়াবার একটা চালান ধরেছে নাকি! জানিস না, তোর ভাইয়া দিনরাত এগুলা নিয়ে পড়ে আছে। বাড়িতে আত্মীয় আসল, কী আমার কোন দরকার, ওর পাত্তা নাই!”
মৃন্ময়ীর ভাবিকে অপ্সরা বললে কি কম বলা হবে? দুজন সুন্দরী নারীর মাঝে আমি রাবণ বসে করছি কী?
আমাকে বললেন, “তোমরা কথা মৃন্ময়ী প্রায়ই বলে আমাকে। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল!” কথা বলেই কিচেনে চলে গেলেন তিনি।
কী বলে মৃন্ময়ী আমার কথা? বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেয়?
মৃন্ময়ী এসে আমার পাশে বসল। বলল, “আমার ভাবি একটু বেশি কথা বলেন। কিন্তু খুব ভাল। তুমি খারাপভাবে নিও না আবার!”
আমি ‘না না। খারাপভাবে নেব কেন?” বলে তীব্র আপত্তি জানালাম।
একগাদা নাস্তা আমাদের সামনে এনে রাখলেন উনি। আমাকে বললেন, “তুমি খুব ধার্মিক বুঝি?”
বুঝতে না পেরে বললাম, “মানে?”
“এতো বড় দাঁড়ি রেখেছো? নামাজকালাম নিয়মিত পড়?”, বুঝিয়ে বললেন উনি।
মৃন্ময়ী হেসে ফেলে বলল, “তুমিও না ভাবি? ওটা স্টাইল।”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ী বলল, “ভাবি নিজে ইসলামি স্টাডিজের ছাত্রী। ঐ জিহাদের কাহিনী পড়তে পড়তে নিজে তালেবানি হয়ে গেছে! কথায় কথায় উহুদ খন্দক নিয়ে আসে!”
মৃন্ময়ীর ভাবি বললেন, “মৃন্ময়ী, এভাবে বলতে হয় না!”
মৃন্ময়ী বলল, “বলব না তো কী! তুমি এমন করে বললে, সবাই তোমার স্বামীর মতো হুজুর হবে?”
মৃন্ময়ীর ভাই যে হুজুরপ্রকৃতির এটা তো বলেনি আগে। আমি কিনা এই হুজুরের কাছে নীলার ব্যাপারটা নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। লর্ডের বদলে নীলাকেই তাহলে জেলে পুড়ে দিতেন তিনি!
মৃন্ময়ীর ভাবি বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস। ইসলাম নিয়ে জ্ঞান তোদের আরো বেশি থাকবে। তা না, মুখে আল্লাবিল্লার নাম নাই!”
আমি বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই বুঝি, মৃন্ময়ী বলল, “ছাদের বাগানটা দেখবে? চল ছাদে যাই!”
গোব্দাগাব্দা ছেলেটার নাম জুলফিকার রহমান। এতো সুন্দর একটা ছেলের এমন ভয়ঙ্কর নাম! আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিতে পর্যন্ত ভয় করছে!
মৃন্ময়ীকে বললাম, “তোমার ভাবি এতটা কনজার্বেটিভ, আমাকে আসতে বলল যে!”
মৃন্ময়ী হেসে বলল, “আমার ভাবি আসলে যে কি, সেটা এত সহজে বুঝবে না। এত্ত ভাল আমি কাউকে চিনি না। মনে কোন কথা ধরে রাখতে পারে না!”
তারপর জুলফিকারকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে এলেই সবকিছু বলি ভাবিকে। ক্যাম্পাসের কথা, মেসের কথা, তোমার কথা! তাই ভাবির তোমাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল!”
জিজ্ঞেস করলাম, “আমি আসছি, তোমার ভাই জানে?”
মৃন্ময়ী বলল, “নাহ!”
গলার জল শুকিয়ে যাওয়ার মতো উত্তর। সেই দাড়িওয়ালা হুজুর যদি আমাকে দেখে রেগে যায়? যা শালা, এ কোথায় গলা বাড়িয়ে দিলাম!
“যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল”
মাসুদ বলল, “তুই আর কতক্ষণ ব্যাট করবি? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি আউট হ না ভাই!”
অনেকক্ষণ ব্যাট করছি আমি। মসুদ আউট করতে পারছে না আমাকে কিছুতেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বল দেখা যাচ্ছে না ভালো। তাও বল করে যাচ্ছে মাসুদ। আমাকে আউট না করা পর্যন্ত বাড়ি যেতে দেব না ওকে। আমার দিকে বল ছুঁড়ল মাসুদ, আমি জোরে ব্যাট হাঁকালাম, বলটা ছোট মাঠের উঁচুনিচু পেরিয়ে আমাদের পুকুরে গিয়ে পড়ল। বললাম মাসুদকে, “তাড়াতাড়ি তুল! অন্ধকার হয়ে গেছে!”
আমি পুকুরপাড়ে এলাম। বলটা পুকুরের মাঝে ভেসে আছে। মাসুদের দিকে তাকালাম আমি। হাত দিয়ে ডাকার ইশারা করতেই, মাসুদ পুকুরের দিকে না এসে উল্টো দৌড় মারল। আমি ডাকছি মাসুদকে, মাসুদ শুনছে না আমার কথা। এক দৌড়ে রসিকদের বাড়ি পেরিয়ে গেলো মাসুদ, অদৃশ্য হয়ে গেলো বাঁকটা ঘুরতেই। বলটা তুলবে কে তাহলে? আমার বলটা ওখানেই থাকবে? এই অন্ধকারে ঐ পানাপুকুরে আমাকে নামতে হবে? কান্না পাচ্ছে আমার। এতক্ষণ বল করলাম মাসুদকে। ও আমাকে ব্যাটিং না দিয়েই চলে গেল?
কীসের শব্দে ঘোরটা ভেঙ্গে গেলো। এই আধোঘুমে স্বপ্ন দেখছিলাম নাকি! ব্যালকনি দিয়ে দুপুরের রোদ এসে পায়ে পড়েছে। আমার টেবিলের উপর একটা বেড়াল। উৎসুক মুখে তাকাল আমার দিকে। এ আবার এলো কোনদিক দিয়ে? খেয়েছে নাকি কিছু?
ঠাণ্ডা লাগছে ভরদুপুরেও। ক্লাস ছিল, যাইনি। কাল মৃন্ময়ীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে বাস পাইনি অনেকক্ষণ। সাইন্সল্যাবে এসে কাকভেজা হয়ে যে বাসটা পেয়েছি সেটাও নামিয়ে দিয়েছে আজিমপুরে। কাঁপতে কাঁপতে বাসায় আসতে হয়েছে হেঁটে। এসেই ঘুমিয়েছিলাম ভেজা কাপড় ছেড়ে। সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, মনে হচ্ছিল কেউ এসে গলাটিপে ধরছে বারবার, বন্ধ হয়ে আসছিলো নিঃশ্বাস। ভোরের দিকে এতো ঠাণ্ডা লাগছিল, বিছানার চাদরটা জড়িয়ে নিয়েছি গায়ে। সকালে মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছিলাম না। দারোয়ানকে ফোন করে নিচ থেকে খাবার আনিয়েছি, ওষুধও।
মা খুব বাড়ি যেতে বলছে কয়েকদিন ধরে। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে নাকি। মা আজ ফোন দিলে বলব জ্বরের কথা? বলব “স্বপ্নে দেখেছি তুমি আমার মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছো”? মা ঠিক থাকতে পারবে আমার এই সামান্য অসুস্থতার কথা শুনে?
মৃন্ময়ী কী করছে এখন? সকালে ফোন দিয়েছিলো ও। আধোঘুম আধোজাগরণে কথা বলেছিলাম ওর সাথে। অথচ ফোনটা বেজেই যাচ্ছিলো। পরে বুঝেছি, রিসিভ না করেই কথা বলেছি ওর সাথে! ফোনটা কানে পর্যন্ত তুলিনি।
মৃন্ময়ী মনযোগ দিয়ে ক্লাস করছে এখন, বরাবরের মতো প্রথম বেঞ্চে বসে? নোট করছে স্যারের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ কথা? আর মাঝেমাঝে চুল সরিয়ে নিচ্ছে মুখ থেকে?
চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। উঠলাম গা থেকে কাঁথা সরিয়ে। শুয়ে থাকলে আবার ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখব!
চায়ের কাপ হাতে বিছানায় বসেছি, ফোনটা বেজে উঠল আবারও। মৃন্ময়ী।
“সকাল থেকে কয়েকবার ফোন দিলাম। ধরলে না। ক্লাসেও আসোনি!”, বলল মৃন্ময়ী।
“ক্লাসে আমি নেই, লক্ষ্য করেছো?”, বললাম আমি।
“লক্ষ্য করব না? কাল বাসায় ফিরেছো কিনা সেটাও জানাওনি। ঘুমানোর আগে কল দিলাম, সুইচড অফ বলল!”
চায়ে চুমুক দিলাম আমি। আড়াইটা বাজে, সিদ্ধার্থ স্যারের ক্লাস শেষ হয় এসময়েই সপ্তাহের এই দিনে। ক্লাস থেকে বের হয়েই কি কল দিয়েছে মৃন্ময়ী? ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বের হয় ও। আজ আমি যাইনি বলে, একা বেরিয়ে এসেছে ক্লাস থেকে?
বললাম, “ঘুমিয়েছিলাম!”
“আমিতো বারোটার সময়ও একবার কল দিলাম! দুপুর পর্যন্ত ঘুম?”, বিস্ময় প্রকাশ করল মৃন্ময়ী!
“জ্বর এসেছে। সারাদিন ঘুমাচ্ছি!”
“জ্বর এসেছে আর আমাকে জানাওনি? তোমাকে কে বলেছিল ভিজে আমাকে পৌঁছে দিতে?”
“আমার খুব ভালো লাগছিল তোমার সাথে রিক্সায় বসে থাকতে!”
মৃন্ময়ী তার সুরেলা গলায় বলল, “এখন তার ফল বোঝো! ওষুধ খেয়েছো?”
“খেয়েছি!”
ফোনের ওপাশে কার সাথে যেন কথা বল ও। তারপর “আচ্ছা, আমি যাচ্ছি তোমার ওখানে। থাকো তুমি” বলে আমাকে হতবাক করে দিয়ে ফোনটা রেখে দিল ও!
সত্যিই আসবে মৃন্ময়ী? আমার মতো একটা লক্ষ্যহীন ভ্যাগাবন্ড ছেলে, যে মরে পড়ে থাকলে মা ছাড়া যায় আসবে না কারো, তার দেহের উত্তাপ সামান্য বেড়েছে এতদূর পথ এই রোদে রিক্সায় আসবে ও? উঠবে সিঁড়ি ভেঙ্গে এই আটতলা?
আজ সূর্য কি আলো ছড়াচ্ছে একটু বেশি? এতো আলোকিত হয়ে উঠল কেন ঘরটা?
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মনে হলো, বমি করে ফেলব। এর মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে চা’টা। সিংকে চাটুকু ফেলে দিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। মনে হলো, তলিয়ে যাচ্ছি বিছানায়।
আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা জানিনা, দরজার খটখট শব্দে উঠে বসলাম ধড়মড় করে। এর মধ্যেই এসে গেল ও?
দরজা খোলার আগে আয়নায় নিজের দিকে তাকালাম আমি। অনেকদিনের না কাটা দাড়ি আর লম্বা চুলে বখাটেই লাগছে বরাবরের মতো। গেঞ্জির কলারটা ঠিক করে দরজা খুলে দিলাম।
মৃন্ময়ী ঘরে ঢুকেই বলল, “আমাকে একটা বার ফোন করে জানাতে পারলে না? ধরো এটা রাখো…”
মৃন্ময়ী মাল্টা নিয়ে এসেছে আমার জন্য! বললাম, “এগুলা আবার কী?”
ও বলল, “অসুস্থ মানুষকে দেখতে গেলে ফল নিয়ে যেতে হয়!”
বললাম, “সামান্য জ্বর হয়েছে। আর তুমি আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিলে! জ্বর কোন রোগ নয়, জানো?”
মৃন্ময়ী আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “জানি না। জ্বর নিয়ে গুগলে সার্চ করিনি কোনদিন।”
আমার কপালে হুট করে হাত দিল মৃন্ময়ী। বলল, “হুম জ্বর আছে। সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে!”
ছটফট করতে করতে ঘরের মাঝখানে চলে এলো ও। ওর কাঁধের ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, “বই দুটো নিয়ে আসলাম ফেরত দেব বলে। তুমি তো ক্লাসেই এলে না!”
“না গিয়ে ভালোই করেছি!”, খুব আস্তে বললাম আমি।
বইদুটো রেখে চকিত তাকাল ও আমার দিকে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল, “কিছু বললে?”
“উঁহু!”
“কাল তুমি অতদূর আমাকে রাখতে গেলে কেন?”‘
“তোমার সাথে থাকতে ভাল লাগছিল যে?”
“ভাল লাগলেই হলো? আর কোনদিন উঠবে না আমার সাথে রিক্সায়?”
বসল ও ঘরের একমাত্র চেয়ারটায়। আমিও বিছানায় বসে বললাম, “আর যদি কোনদিন সুযোগ না পাই! আর যদি কোনদিন বৃষ্টি না আসে!”
মৃন্ময়ী চোখের দিকে তাকাল। হাসল মিষ্টি করে। বলল, “আর যদি কোনদিন বৃষ্টি না হয়, দেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। লোকে না খেয়ে মরবে আর তুমি আমার সাথে রিক্সায় ঘোরার কথা ভাবছো?”
হঠাত প্রসঙ্গ পাল্টে ও বলল, “তোমাকে আমার হিংসা হয় জানো? তোমার এতো বই!”
ছোটপাখির মতো ছটফটে মৃণ্ময়ীর চোখদুটো উড়ে বেড়াচ্ছে যেন আমার পুরো ঘরে। বইয়ের তাকদুটো দেখছে বারবার।
বললাম, “তুমি চাইলে সব বই দিয়ে দেব, জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র ছাড়া!”
“জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র দেবে না কেন?”, চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।
বললাম, “জানি না। ওটা তুমি কিনে নিও!”
মৃন্ময়ী উঠে সন্দীপনের উপন্যাস সমগ্রটা হাতে নিয়ে বলল, “ওটা আছে আমার কাছে!”
খুব মন দিয়ে বইটা দেখতে লাগল ও। ওর সদাচঞ্চল চোখ নিবদ্ধ হলো সন্দীপনের উপন্যাসের পাতায়।
“তুমি কেন এলে মৃন্ময়ী?”
মৃন্ময়ী বই থেকে চোখ তুলে বলল, “বই ফেরত দিতে! আজ এই বইটা নিয়ে যাব!”
সন্দীপনের উপন্যাস সমগ্রের প্রথম খণ্ডটা তুলে দেখালো ও।
বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি। মনটা খারাপ হয়ে গেল একটু, শুধু আমাকে দেখতে, আমার কপালে হাত রেখে উষ্ণতা মাপতে আসেনি তাহলে ও?
এডমিশন টেস্টে পরীক্ষায় একটা এমসিকিউ এর উত্তর জেনেও ভুল অপশন পূরণ করেছিলাম বেখেয়ালে। আর এক নাম্বার বেশি পেলেই বাংলায় ভর্তি হতে পারতাম আমি! কী হতো যদি ভুল না দাগাতাম? বাংলায় ভর্তি হলে পরিচিত হতে পারতাম মৃণ্ময়ীর সাথে? চিনতাম ওকে? সেই একটা ভুল উত্তর কতোটা পাল্টে দিয়েছে জীবনের মোড়!
মৃন্ময়ী আমার পাশে এসে বসেছে। বলল, “মাল্টা কেটে দেব? খাবে?”
বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না! তুমি বসে থাকো এখানে!”
মৃন্ময়ী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ওর উষ্ণ হাত আমার চুলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমার চোখে ছায়া পড়ছে ওর হাতের।
“চুলটা কেটোনা। তোমাকে বড় চুলেই ভাল লাগে!”, বলল মৃন্ময়ী।
আমি চোখ বন্ধ করে ওর হাতের আমার কপাল ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব করতে লাগলাম। হঠাত মনে হলো, বুকটা কাঁপছে, গলার ঠিক কাছে উঠে এসেছে হৃদপিণ্ডটা।
উঠে বসলাম আমি। মৃন্ময়ী হাতটা সরিয়ে নিল। বললাম, “তুমি এত সুন্দর কেন?”
“খুব সুন্দর?”
“তোমার এত বড়বড় চোখ- দীঘির মতো!”
মৃন্ময়ী আলতো হেসে বলল, “সিনেমা যে করতো বাচ্চা মেয়েটা, ঐ দীঘির মতো?”
বললাম, “সবুজ শ্যাওলার দীঘির মতো!”
মৃন্ময়ী চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। বললাম, “ক্লাসে তোমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকি আমি!”
মৃন্ময়ী বলল, “সিজি খারাপ- সেটার দোষ আমাকে দিচ্ছো?”
বললাম, “তুমি খুব সুন্দর মৃন্ময়ী!”
শুয়ে পড়লাম আবার। মৃন্ময়ী মাথায় আর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না। আমি আবার বলে, “জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকলাম বোধহয়। কিছু মনে করো না!”
মৃন্ময়ী হঠাত ঝুঁকে পড়ল আমার উপর। ওর চুল এসে মুখে লাগল আমার। ওর চোখদুটো আমার চোখে রাখল ও। বলল, “তোমার চোখ হলুদ হয়ে গেছে!”
এতো কাছে মৃন্ময়ী, যেন শব্দ পাচ্ছি নিস্বাসেরও। এত কাছ থেকে, শুধু দেখতে পাচ্ছি ওর মুখের অংশটুকু। ওর মুখের রেখা, চোখের পাপড়ি, ঠোঁটের উপরে নাকের বাম পাশের তিলটা- সাদা পৃষ্ঠায় কলমের ছোট বিন্দুর মতো একা।
সরে গেলো মৃন্ময়ী। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল ও। বললাম, “কাল আমার চোখ লাল ছিল বৃষ্টিতে ভেজার পর! তুমি তখন দেখলে না কেন?”
“কী হলো তখন দেখলে?”, একহাতে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করল মৃন্ময়ী!
“তাহলে জিজ্ঞেস করতে, নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতো “তোমার চোখ এতো লাল কেন?”
নিচের দিকে তাকাল ও। লজ্জা পেয়েছে কি?
ফোনটা বেজে উঠল আমার। নীলা ফোন করেছে। মৃন্ময়ী ফোনটা দিল আমার হাতে।
“তুই একটু ক্যাম্পাসে আসতে পারবি?”, ওপাশ থেকে নীলা বলল।
মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে, বললাম, “আমার জ্বর রে। এখন ক্যাম্পাসে যাব?”
নীলা বলল, “বিশাল সমস্যা হয়ে গেছে রে। তুই আয় না!”
“কী হয়েছে? খুলে বল তো?”
নীলা বলল, “তুই আয়। বলছি। ফোনে বলতে পারব না। প্লিজ আয়!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তখনকার বেড়ালটার মতো উৎসুক নয়নে তাকিয়ে। বললাম, “নীলা ক্যাম্পাসে যেতে বলছে। খুব নাকি দরকার!”
মৃন্ময়ী সাথে সাথেই বলল, “তুমি এই শরীর নিয়ে যাবে?”
“কিচ্ছু হয়নি, মৃন্ময়ী। যেতে পারব।”
“আমি যাই তোমার সাথে?”, বলল ও। রাজ্যের ব্যাকুলতা নিয়ে বলল কথাটা।
“তুমি যবে?”, ইতস্তত করলাম আমি, “তোমাকে বাসা যেতে হবে না?”
মৃন্ময়ী বলল, “আমার সারাদিন বাসায় থাকতে ভালো লাগে না! আমি গেলে কি সমস্য হবে?”
“নাহ! সমস্যা আবার কীসের?”
জুতাটা পায়ে গলিয়েই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম আমি। মৃন্ময়ী সন্দীপনের উপন্যাস সমগ্রের খণ্ডটা ব্যাগে ভরল।
কোনভাগ্যে মৃন্ময়ী এলো আজ এখানে। আর আমাকে কিনা যেতে হচ্ছে ক্যাম্পাসে! নীলার সমস্যা হওয়ার আর সময় পেল না?
নীলা কলাভবনের সামনে আছে। কলাভবন বলতেই ৬০ টাকা চেয়ে বসল রিকশাওয়ালা। দামাদামি করলাম না। আর রাস্তাটাও কম না।
রিক্সায় উটতেই মৃন্ময়ী বলল, “নীলার সাথে তোমার খুব বন্ধুত্ব, না?”
“হুম। খুব ভাল বন্ধু ও!”
প্রসঙ্গ বদল করল ও। বলল, “ঢাকায় থাকতে ভাল লাগে?”
বললাম, “ভাল লাগা খারাপ লাগার মাঝামাঝি লাগে। আমি আসলে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আছি! আই ডোন্ট ওয়ানা বি হেয়ার ফরএভার!”
ইংরেজিটা ঠিকঠাক বললাম তো?
মৃন্ময়ী বলল, “আমিও থাকতে চাই না এখানে। আমার বাড়ি থেকে পদ্মা খুব কাছে। জানো?”
“কত দূরে?”
“সাত-আট কিলো। মাঝেমাঝেই পদ্মার পাড়ে যাই মা বাবা সহ। তুমি পদ্মা দেখেছো?”
বললাম, “হ্যাঁ। কয়েকবার।”
“আমি পদ্মার কাছাকাছি কোন শহরে থাকতে চাই!”
“তোমার নামটা নদী হলে পারত!”
“কেন?”
“তোমার চোখদুটো নদীর মতো বিক্ষিপ্ত চঞ্চল!”
কিছু বলল না মৃন্ময়ী।
আমারা ফুলার রোডে এসে পৌঁছলাম। মৃন্ময়ী বলল, “ফুলার রোডটাকে আমার খালের মতো মনে হয়!”
“চলো ভাবি, ফুলার রোডটা খাল। আর আমরা নৌকায় বসে আছি!”
মৃন্ময়ী বলল, “উম্মম… মন্দ না। আর আমাদের রিক্সার হুডটা নৌকার ছই!”
সলিমুল্লাহ হলের রেইনট্রি থেকে পাতা ঝড়ে পড়ছে বাতাসে। একটা হলুদ পাতা, উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে মৃন্ময়ীর হাতে এসে পড়ল।
মৃন্ময়ী বলল, “নৌকা বাওনি কোনদিন?”
“না। সুযোগ পাইনি!”
বেরসিক রিকশাওয়ালা টানছে খুব জোড়ে। নামিয়ে দিলেই ব্যাটা ৬০ টাকা পাবে। রিক্সাটা ফুলার রোড ছেড়ে ভিসি চত্বরে এলো ঝড়ের গতিতে।
শ্যাডোর সামনে নামলাম আমরা।
নীলাকে রিক্সা থেকেই দেখেছি আমি। বটগাছটার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। মৃন্ময়ী নীলাকে দেখে বলল, “ওর কি কিছু হয়েছে?”
“এসো হে গোপনে”
ছাদটা আমার ছাদের সমানই। কিন্তু আমার ছাদ থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়, এখানে, সূর্য ডুবছে আরেকটা বিশাল বিল্ডিং এর আড়ালে। ছাদজুড়ে চেনা অচেনা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। একটা আমগাছে বেশ গুটি ধরেছে।
মৃন্ময়ী বলল, বাড়ির ছাদের এতক্ষণ আম্মু উঠে গেছে। আমার ছোটবোন হয়তো বই নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে!”
আমি মৃন্ময়ীর দিকে তাকালাম। হালকা বাতাসে উড়ছে ওর চুল। বললাম, “তুমিও ছাদে পড়তে?”
বলল, “ভোরে পড়তাম। তারপর রোদ উঠলে ঘরে চলে যেতাম!”
তারপর আবার বলল, “আমাদের বাড়ির পিছন থেকে যতদূর চোখ যায় মাঠ। এখন তো ধানের সিজন। যতদূর চোখ যায় সবুজ। আর সূর্য যখন উঠত, লাল গোল বলের মতো…”
বাক্যটা শেষ করল না মৃন্ময়ী! বললাম, “সদ্যোদিত সূর্যের লাল কিরণ তোমার মুখে যখন পড়ত, কেমন দেখাতো তোমাকে?”
মৃন্ময়ী বলল, “কীভাবে জানব? আমি কি দেখেছি নাকি!”
বললাম, “আমার দেখার ইচ্ছে করছে!”
মৃন্ময়ী বলল না কিছু। একটা গোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। গোব্দা ছেলেটা মৃন্ময়ীকে বলল, “ফুপি, তুমি যেখানে থাকো, ওখানে ছাদে বাগান আছে?”
মৃন্ময়ী ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “নাই, বাবা। ওখানে ছাদে কাপড় শুকায়!”
“উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উনতিরিশে এসে
গর্ভবতী হলো, তার মোমের মতো দেহ
…যন্ত্রণার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক।”
হঠাত করে সুনীল গাঙ্গুলির এই কবিতাটা মনে পড়ল। ছ্যাঃ ছ্যাঃ এখন মৃন্ময়ীর সাথে আছি, ছাদে, সূর্যাস্ত দেখা না গেলেও এসেছে তার আভা, বাতাস দিচ্ছে বেশ, এখন এমন কবিতা মনে পড়তে হবে? রবীন্দ্রনাথের ছাদ নিয়ে কবিতা নেই কোন? এতো বিষয় নিয়ে লিখলেন, আকাশ পাতাল মাটি, বাদ রাখলেন না কিছু আর ছাদ নিয়ে নেই? নাকি আমিই পড়িনি?
মৃন্ময়ী আমার কাছাকাছি এলো? কাছাকাছি এলো নাকি এগিয়ে এলো? এমন দূরত্বে তো আসেই সবসময়। এখন এখানে, এই ছাদে নিরালা, যদিও গোব্দাটা আছে, এই স্বাভাবিক দূরত্বকেই কাছাকাছি মনে হলো কেন?
বলল, “চুপ করে আছো যে? ভাবছো কিছু?”
বললাম না, “সুনীলের একটা কবিতা মনে পড়েছিল। তাড়িয়ে দিলাম কবিতাটা!”
মৃন্ময়ী বলল, “কবিতা তাড়ানো যায়?”
“যায় না?”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। আমার মাথায় একটা কবিতা ঘুরছে সকাল থেকে। তাড়াতে পারছি না!”
“কী কবিতা?”, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“আবুল হাসানের নিঃসঙ্গতা কবিতাটা পড়েছো?”
“অতটুকু চায়নি বালিকা, এই কবিতাটা?”
মৃন্ময়ী বলল, “হ্যাঁ। “এক জলের খনি/ তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো/ একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!”
বললাম, “এই কবিতাটা কেন ঘুরছে? তোমারও ইচ্ছে করছে, কেউ তোমাকে রমণী বলুক?”
মৃন্ময়ী বলল, “আরে না না। এমনি। অকারণে মনে পড়ছে সকাল থেকে। আমি অনেকদিন আবুল হাসান পড়িই নাই!”
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি মৃন্ময়ীকে, এতোটা কাছে ও। অথচ ছুঁতে পারব না! পাখিদের ভাষা নেই, নিঃসঙ্গ কোন ঘুঘু যখন ডাকে দুপুরবেলা, পুরুষ ঘুঘু বুঝে যায়, খুঁজছে তাকেই। তাদের যোগাযোগের জন্য শব্দের দরকার হয় না। আর বাংলা ভাষার এতো শব্দ থাকতেও, নিজেকে মৃণ্ময়ীর সামনে প্রকাশ করতে পারছি না! এত শব্দ, এত ব্যাকরণ, এত শব্দ, বাক্য, ভাষার ত্বত্ত থেকে লাভ কী?
মৃন্ময়ী বলল, “গরমকালের বিকেল এতো দীর্ঘ হয়!”
“ছোট হলে ভাল লাগত?”
মৃন্ময়ী আমার সামনে পায়চারী করতে করতে বলল, “আগে, মানে ছোটবেলায় ভাবতাম, দিন হলো স্বামী আর রাত তার স্ত্রী! বিকেল ছোট হলে দিন তার স্ত্রীর কাছে তাড়াতাড়ি যেতে পারে!”
হেসে ফেললাম আমি। বললাম, “এখনো ওমন ভাবো?”
মৃন্ময়ী বলল, “ভাবিনা। মাথায় চলে আসে। কে যে আমাকে ওটা শিখিয়েছিল!”
পুরো ছাদে শুধু একটাই ফুলের গাছ, সেটাও গোলাপ। ছাদজুড়ে বিভিন্ন ফলের গাছ। পেয়ারা থেকে লেবু পর্যন্ত আছে। মৃন্ময়ীর ধার্মিক ভাই যে ফুলের সৌন্দর্য বুঝতে অপারগ, সে আর বলতে হয় না। এই কাঠমোল্লা পরিবারে মৃন্ময়ীর জন্ম হলো কী করে?
লেবুগাছটায় অসময়ে ফুল ফুটেছে। তীব্র মিষ্টি সুগন্ধ এসে ঢুকছে নাকে। মৃন্ময়ী লেবু গাছটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমার বাগানে আমি বাতাবীলেবুর গাছও লাগাব একটা। বাতাবীলেবুর ফুলের গন্ধ কেমন নেশা লাগানো, জানো?”
মৃন্ময়ীর চিন্তা এত সহজ কেন? ও ধরেই নিয়েছে, বিশাল বাগান হবে ওর আর সেখানে একটা বাতাবীলেবুর গাছ হবে! আমি কেন পারিনা এত সহজ করে ভাবতে? কেন মনে হয়, জীবনটা সহজ হবে না?
মৃন্ময়ীকে প্রজাপতির মতো লাগছে এখন। ও যেন ছাদের গাছেগাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ গাছের পাতা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে অন্য গাছে!
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে পৃথিবীতে। দিন রাত্রির সন্ধিক্ষণের অদ্ভুত মৃদু লালচে আলোয় মৃণ্ময়ীর মুখটা মোমের আলোর মতো আদুরে।
“আরেকটু পর অস্ত যেও সূর্য, ওকে দেখতে দাও প্রাণভরে!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চুপচাপ কী দেখছো?”
“কিছু না!”
আকাশের দিকে হঠাত তাকিয়ে মৃন্ময়ী বলল, “ঐ দেখ, এক ঝাঁক বক! ঢাকায় ওরা কী করে বলতো? এখানে তো পুকুর নেই কোন?”
আমি জবাব দিলাম না কোন। এসব প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। মৃন্ময়ী সারাজীবন, প্রতিদিন প্রতিবিকেলে আমাকে এমন অবাক প্রশ্ন করতে পারে না? কেন পারে না?
গোব্দা ছেলেটা বলল, “ফুপি, আম্মুর কাছে যাব!”
“দুদু খাবে?”, বলতে ইচ্ছে করল আমার। বয়স হয়েছে সাতআট বছর, আর বলছে আম্মুর কাছে যাবে! গ্রামের এই বয়সের ছেলেদের বাপমায়েরা মারতে মারতে সন্ধের পর বাড়িতে নিয়ে আসে খেলার মাঠ থেকে। আর ছেলেরা মায়ের থেকে দূরে দূরে হেঁটে বাড়ি ফিরে মারের হাত থেকে বাঁচতে। আর এ সন্ধ্যে হতে না হতেই “আম্মুর কাছে যাব!”
মৃন্ময়ী বলল, “চল, ভাইয়া এসেছে নাকি দেখি!”
মৃন্ময়ীর পিছন পিছন আমি ওদের বসার ঘরে গিয়ে বসলাম। মৃন্ময়ীর গলা শুনতে পেলাম, কিচেনে গিয়ে ভাবিকে বলছে, “তুমি কী শুরু করেছো এসব? এখন মাছ কুটছো মানে? এসব করতে হবে কেন?”
মৃন্ময়ী ফিরে এসে বলল, “ভাইয়া ইলিশ মাছ নিয়ে এসে দিয়ে নাকি আবার নিচে গেছে। ভাবি এখন সেই মাছ রান্না করবে, খাবো আমরা, যাব তার পরে!”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “এতক্ষণ থাকতে হবে?”
মৃন্ময়ী বলল, “উপায় নেই!”
মৃন্ময়ী ভাবিকে সাহায্য করতে কিচেনে চলে গেলো। আমি এখন করব কী? গোব্দা জুলফিকার মায়ের মোবাইল নিয়ে ঘুতাঘুতি করছে, আমি ওর গালটা টিপে দেব?
অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। নিচে গিয়ে একটা সিগারেট টেনে আসা যায়। মৃন্ময়ীকে বলে নিচে নামলাম আমি।
বাসায় নিচেই একটু দূরে দোকান। সিগারেটটা ধরিয়েছি, নীলা কল দিল।
“মৃণ্ময়ীর সাথে রিক্সায় কোথায় গেলি রে?”
বললাম, “তুই জেলাস গার্লফ্রেন্ডদের মতো করছিস কেন রে?”
নীলা বলল, “ভাট শালা। তোকে নিয়ে আবার জেলাসি। শোন, তোর কাছে লুতফার নাম্বার আছে?”
“আছে। কেন?
“ওর নাম্বারটা টেক্সট কর তো আমাকে!”
ফোন কেটে কন্টাক্টস থেকে লুতফার নাম্বার বের করছি, কীসের ধাক্কায় ফোনটা রাস্তায় পড়ে গেলো!
যে শালা ধাক্কা দিয়েছে তার থামার নাম নেই কোন। ফোনটা চট করে তুলে বললাম, “এই যে ভাই, চোখের সমস্যা থাকলে ডাক্তার দেখান। অন্ধের মতো রাস্তায় হাঁটাচলা করেন কেন?”
লোকটা থামল এবারে। আমার দিকে ক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে বলল, “কী বললেন?”
বললাম, “চোখকান খোলা রেখে হাঁটুন। ঢাকার রাস্তা, বোঝেন তো। অল্প বয়সে বৌ বিধবা হবে নাহলে!”
সে উদ্ধত ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “চোখকান খোলা রাখব মানে? রাজার মতো করে রাস্তার অর্ধেক দখল করে সিগারেট টানবেন আর আমাকে আপনাকে সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?”
“আপনার তো সামান্য কমনসেন্সও নাই। ধাক্কা দিয়ে মোবাইল ফেলে দিলেন। সরি বলার ভদ্রতাটুকু দেখালেন না। রাজা তো আপনি!”, বললাম আমি।
ছেড়ে দেয়ার পাত্র আমিও নই। এই টেকো মধ্যবয়সী পার্ভাটটাকে ডাস্টবিনের ময়লায় পুতে রাখতে পারি, চাইলে।
“তোর বয়স কত রে, ছোকরা? সমস্যা কী তোর?”, অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল লোকটা।
আমি সিগারেটে টান দিয়ে ভোঁস করে ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, “তুই তুকারি করবি না, মাদারচোদ। বয়স যতই হোক, তোর মতো টাক্লাকে ট্যাকল করা জন্মের আগেই শিখে আসছি!”
লোক জড়ো হয়ে গেল সামান্য এই কয়েকটা কথা চালাচালিতেই। দুজন এলাকারই ছেলে এসে থামাল আমাকে, কয়েকজন মুরুব্বির কথায়, সে মধ্যবয়স্কও ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।
টং এর দোকানটা থেকে আরেকটা সিগারেট নিয়ে ধরালাম। কোন শালা যেন থামাতে এসে সিগারেটটা নিয়ে নিয়েছে! নীলাকে লুতফার নাম্বারটা পাঠালাম। ফোনের স্ক্রিনটায় স্ক্রাচ পড়েছে।
“আরে রিদম, তুই এইহানে?”, বলতেই চমকে তাকালাম পিছনে। রিক্ত সহাস্যবদনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি প্রায় উচ্চস্বরেই বলে উঠলাম, “আরে দোস্ত, আসছিলাম একটা কাজে। একটা মাদারচোদের সাথে লাগছিল একটু আগে। তুই থাকলে ব্যাটার মুখটার ম্যাপ পাল্টে দিতাম!”
“কেন কী হইছে?”, জিজ্ঞেস করল রিক্ত।
ঘটনাটা বললাম পুরোটা। শোনার পর রিক্ত বলল, “আবে এহব ম্যাটার না। কমলাপুর এলাকার সব হালায় চোটঠা। স্টেশন এইহানে না? তোর মানিব্যাগ ঠিক আহে কিনা দেখ, অনেকসোমায় ধাক্কাটাক্কা দিয়া মানিব্যাগ নিয়া যায়গা। বুঝতাও পারবি না!”
বললাম, “না না। ঠিক আছে।”
রিক্ত ঢাকার স্থানীয়। ফিল্ম বানানোর ভূত মাথায় নিয়ে ঘোরে। আমার সাথে দেখা হলেই সিনেমার দুরবস্থা, বর্তমান ফিল্মমেকাররা যে কত নিচু মানসিকতার, এরা যে সিনেমার বালটাও বোঝে না, এসব নিয়ে ঝাড়া আধঘণ্টা লেকচার মারবে ঢাকাইয়া আঞ্চলিকে।
রিক্ত বলছিল, “সেদিন একটা নাটক দেখলাম বুঝলি। বাংলাদেশের থ্রিলার নাটক। ডেভিড ফিঞ্চাররে গোলাইয়া মাখাইয়া নাটক বানাইছে। ফিঞ্চারের গোয়াও মারছে, নাটকেরও মারছে!”
ফিঞ্চারের হলিউডি গোয়ার নাগাল বাংলাদেশের পরিচালক কীকরে পেল ভাবতে ভাবতেই মৃন্ময়ী ফোন দিল। রিসিভ করতেই বলল, “তুমি কোথায়? ভাইয়া এসেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে যাব!”
ফোনটা দিয়ে রিক্তের ফিল্মক্লাস থেকে রেহাই দিল বলে, মৃন্ময়ীকে ধন্যবাদ জানাতে হবে!
রিক্তের থেকে বিদায় নিয়ে মৃণ্ময়ীর ভাইয়ের বাসার সিঁড়ি বেঁয়ে উঠতে লাগলাম। দরজা খুলে দিল মৃন্ময়ীই।
বলল, “কোথায় গিয়েছিলে? একটা সিগারেট টানতে এতক্ষণ লাগে?”
ওকে ঘটনাগুলো বলতে যাব, ঘরের সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো আমার। রাস্তার সেই টেকো লোকটা এখানে কী করছে!
মৃন্ময়ী লোকটাকে বলল, “ভাইয়া, এ রিদম। ও নিচে গিয়েছিলো একটু!”
আমার মনে হচ্ছিল, পা অবশ হয়ে গেছে আমার, একটুও নড়ার সামর্থ নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, শুকিয়ে গেছে গলা।
টেকোটাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে বিস্মিত চোখে। ভয়ে ভয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। মৃন্ময়ীর ভাবি এসে বললেন, “খাবার রেডি। ডাইনিং এ আসো। মৃন্ময়ীর ছটফটানির জন্য মাছটা রান্নাই করতে পারলাম না। কী হবে একটু দেড়ি করে গেলে?”
মৃন্ময়ীর ভাই বলল, “ওরা খাক। আমি এত তাড়াতাড়ি খাব না!”
টেকোটার সাথে এক টেবিলে বসে খেতে হবে না জেনে বুকে বল পেলাম খানিকটা। ও বসলে, ভাতের দলা আমার গলা দিয়ে নামতো না।
মৃন্ময়ী আর আমি খেতে বসলাম। এত আইটেম কার জন্য রান্না করেছেন ভাবি? মাংসই আছে তিন প্রকার। মাছ ভাজা, ডিম, বেগুন ভাজা, বুটের ডাল, আচার, আলুর চপ! টেকোটা বোধহয় ভাবছে, ওকে প্রায় মারতে গিয়ে ওর টাকারই খাবার খাচ্ছি!
মৃন্ময়ী খেলো অল্প। খাব না খাব না করেও কয়েক প্লেট ভাত উড়িয়ে দিলাম। মাংসের বাটি অর্ধেক ফাঁকা হলো, ডিমের বাটিটা শূণ্য। মাছাভাজা আমি কম খাই বলে তিনচার পিস খেয়েছি। ভাবলাম, রাস্তার যা হবার হয়েছে। রান্না যেহেতু করেছে, ইগো দেখিয়ে না খেয়ে নষ্ট করে লাভ কী?
খাওয়া শেষ করে টেকোটার সামনে বসতে হলো। মৃন্ময়ীর ভাই আমাকে বলল, “একসাথে পড় তাহলে?”
“হ্যাঁ!”
“ভালোভাবে পড়াশুনা করো। এখনকার ছেলেপেলে তো পড়ার চেয়ে মাস্তানিটা বেশি করে। স্টুডেন্ট পাওয়ার! যেখানে সেখানে হই হট্টগোল। এসব করে পড়াশুনা করে কখন ওরা?”
কথাগুলা যে সাধারণ ছাত্রের উদ্দেশ্যে বলা নয়, এসব ন্যায়বাক্য বর্ষিত হচ্ছে আমার উপরেই, বুঝতে খুব জ্ঞানী হতে হয় না।
মৃন্ময়ী বলল, “ও ছাত্রলীগ করে না, ভাইয়া যে যেখানে সেখানে মারামারি করবে!”
ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে বাম করে? নাস্তিকদের সাথে গাঞ্জা খায়?”
মৃন্ময়ী বলল, “এমন করে কেন বলছো? বামরা শুধু নেশা করে, তোমাকে কে বলল? সময়ের সাহসী ছেলেরাই বাম করে। ও অবশ্য সক্রিয় নয়!”
মৃন্ময়ীর ভাই বলল, “ওসব বলিস না। বামদের আমার চেনা আছে।”
রাস্তায় ঝগড়া করার সময় টেকোটার দাড়ি লক্ষ্য করিনি আমি। এখন কথা বলতে বলতে যেভাবে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে, তাতে সেদিকে নজর না গিয়ে উপায় নেই। ব্যাটা নির্ঘাত ছাত্রজীবনে শিবির করত!
মৃন্ময়ীর ভাই উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেল। মৃন্ময়ী বলল, “ভাইয়ার কথায় কিছু মনে করো না। ও একটু বেশি রক্ষণশীল!”
মৃন্ময়ী ভাইয়া ভাবির সাথে কথা বলতে ঘরের ভেতর চলে গেল আমাকে রেখে! জীবনে এমন পরিস্থিতে পড়তে হবে, কে জানত!
মৃন্ময়ী বেড়িয়ে এসে বলল, “চল যাই। রাত আটটা বেজে গেছে!”
মৃন্ময়ীর ভাবি “থেকে গেলে কী হয়”, “তুই তো আসিসই না” টাইপের কিছু কথা বললেন দরজায় দাঁড়িয়ে। ওর ভাই এলোই না মৃন্ময়ীকে বিদায় দিতে।
বাইরে বাতাস উঠেছে খুব। বৃষ্টি হবে নাকি? রিক্সায় উঠে কয়েকটা গলি পার হয়েছি, আমার ধারণা সত্যি করে বৃষ্টি নামলো হুড়মুড় করে। রিকশাওয়ালা মামা আমাদের তাড়াহুড়ো করে পলিথিন দিলেন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
মৃন্ময়ী বলল, “এই ফিরে যাবে নাকি? এভাবে গেলে তো ভিজে যাব!”
বললাম, “কী হয়েছে শুনবে? তারপর বলো, ফিরে যাবে না এভাবেই যাবে!”
মৃন্ময়ী বলল, “কী হয়েছে?”
ঘটনাটা বললাম পুরো। মৃন্ময়ী বলল, “ও মাই… তাই তো ভাবি, ভাইয়া তোমার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? ছিছি… কী হলো বলতো!”
বললাম, “আমার কী দোষ? কে জানত ও তোমার ভাই হবে?”
মৃন্ময়ী বলল, “আরে দোষ কে দিচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? তোমাকে আনলাম ভাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তুমি কিনা অলমোস্ট মারামারি করে বসে আছো ভাইয়ার সাথে!”
অপরাধীর মতো চুপচাপ থাকলাম আমি। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পলিথিন আমাদের পুরো ঢাকতে পারছে না। আর গলিগুলোতেও জ্যাম লেগেছে!
মৃন্ময়ী বলল, “আমার ভাবির রান্না কেমন লাগল?”
বললাম, “মার্ভেলাস। তোমার ভাই বাইরে বসে না থাকলে সব খেয়ে ফেলতাম!”
মৃন্ময়ী বলল, “পেটুক কার্তিক!”
মৃন্ময়ীর মুখে ফোঁটাফোঁটা পানিতে ভিজে গেছে। ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল আমাদের। মৃন্ময়ী বলল, “কী?”
“তোমার মুখ ভিজে গেছে!”
“তোমারও!”
রাস্তার পাশের দোকানগুলো থেকে আসা আলোয় মৃণ্ময়ীর চোখগুলো দেখে গ্রামের দীঘির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার দিকেই মুখ করে আছে ও। আমার ঠোঁট আর ওর ঠোঁটের দূরত্ব কতো? এই দূরত্ব পেরুতে পারব কোনদিন?
মৃন্ময়ী বলল, “আমি তোমাকে কোথায় নামিয়ে দেব বলো?”
বললাম, “কোথাও না। রিক্সা সরাসরি ধানমন্ডি যাবে!”
মৃন্ময়ী বলল, “মানে? তারপর তুমি আসবে কীভাবে?”
বললাম, “আমার আসার চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আমি চলে আসব!”
“তোমাকে যেতে হবে না বেকার অতোদূর। আমি পারব যেতে!”
“বেঁকার যাচ্ছি না তো। তোমার কোম্পানি আরেকটু পেশি পাব, তাই যাচ্ছি! তোমার সাথে রিক্সায় আরেকটু বেশিক্ষণ থাকতে আমি তারচেয়ে কয়েকগুণ রাস্তা হেঁটে আসতে পারি মধ্যরাতে!”
মৃন্ময়ী আবার তাকাল আমার মুখের দিকে। বলল, “প্রায় কবিতার লাইন হয়ে গেল!”
গুলিস্তানে জ্যাম পাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বোধহয় ফাঁকা হয়ে গেছে রাস্তাঘাট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এড়িয়ে পেরিয়ে রিক্সা চলল সায়েন্সল্যাবের দিকে। নিউমার্কেটের ভিড় নেই বললেই চলে, কিছু ক্রেতা ওভারব্রিজ দুইটায় ঠাই নিয়েছে। বাতাসে মাঝেমাঝেই আমাদের পলিথিন উড়ে যেতে চাইছে, ভালো করে ধরে রাখতে হচ্ছে তাই।
মৃন্ময়ী প্রায় লেগে আছে আমার দেহে। ওর ফরাসী পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি। ও আছে গুটিসুটি মেরে, ঠাণ্ডা লাগছে কি?
বলল, “তুমি ফিরবে কেমন করে?”
বললাম, “তুমি বরং এটা না ভেবে আমাকে একটা কবিতা শোনাও।”
মৃন্ময়ী বলল, “কবিতা? আমি আবৃত্তি করতে পারি না যে?”
“তুমি বললেই আবৃত্তি হয়ে যাবে, মৃন্ময়ী। সেটা আবৃত্তির হবে মানদণ্ড!”
মৃন্ময়ী হাসল একটু। বলল, “তারচেয়ে গান গাই একটা?”
আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসা, “গাইতে পারো?”
মৃন্ময়ী বলল, “উঁহু পারি না। কিন্তু গাইতে ইচ্ছে করছে!”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু। চোখ বন্ধ করল মৃন্ময়ী। বৃষ্টির ছাটায় ভিজে গেছে ওর চোখের পাপড়ি। আমাদের রিক্সার পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল কয়েকটা বাস, ট্রাক, সিএনজি ও প্রাইভেট কার হর্ন বাজিয়ে। চোখ খুলল না মৃন্ময়ী। প্রার্থনার স্বরে, গাইতে শুরু করল ও-
“যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, নিয়ো গো, নিয়ো গো,
আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।
একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রুপে-
দিয়ো গো, দিয়ো গো,
আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া।
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা…”
“একমাস সতেরো দিন পর!”
মৃন্ময়ীকে দেখে হতচকিয়ে গেল নীলা। ওকে আশা করেনি এসময়ে। নীলা বোধহয় সমস্যায় পড়লেই চুল টানে, রাস্তায় শুকাতে দেয়া খড়ের মতো যথেচ্ছা এলোমেলো ওর চুল। নীলা মৃন্ময়ীকে দেখে হাসার চেষ্টা করল একটু। সে চেষ্টায় ঠোঁটটা কাঁপল শুধু, হাসি ফুটল না।
আমাকে ইশারা করে একদিকে টেনে নিয়ে গেল নীলা। বলল্ “বোকাচোদা, ওকে আনছিস কেন?”
“কী হয়েছে বল তো? ও জানলে সমস্যা নাই, অনেক ওপেন মাইন্ডেড মেয়ে ও!”
নীলা তারপর কী মনে করে বলল, “ও জানলেই বা কী? জানবেই তো!”
মৃন্ময়ী অবাক চোখে আমাদের দেখছে। খানিকটা কি বিব্রতও?
নীলা মৃন্ময়ীর কাছে গেল হেঁটে। আমি বললাম, “তুই কিন্তু বলছিস না! কী সমস্যা বলবি তো নাকি?”
নীলা বলল, “লর্ডকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!”
“মানে?”, আমি প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই বিচলিত প্রশ্ন করল মৃন্ময়ী। জিজ্ঞেস করল, “ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেন?”
নীলা আমাদের সামনেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপে হাঁটতে লাগল। বলতে লাগল, “সবাই এখন আমাকে নিয়ে কী ভাববে বলতো?”
“কেন পুলিশ ধরেছে?”, বিস্মিত আমার জিজ্ঞাসা!
“তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন? বুঝিস না, বোকাচোদা?”, ক্ষেপে নিয়ে চিৎকার করে বলল নীলা। আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বৃদ্ধা একজন। ভ্রুকুটি করে তাকালেন তিনি নীলার দিকে।
মৃন্ময়ী বলল, “আই ক্যান হেল্প, নীলা। আমার ভাইয়া পুলিশে আছে!”
নীলা বলল, “কাল রাতে ধরেছে ওকে। আমি জানতাম না। আজ কোর্টে চালান করে দিছে!”
বললাম, “করেছেটা কী? মার্ডার টার্ডার করল নাকি? তুই ক্লিয়ারলি বলবি, প্লিজ, এমন সাসপেন্সে না রেখে?”
মৃন্ময়ী আছে বলেই বোধহয় নীলা বলতে চাইছে না সরাসরি। বললাম, “মৃন্ময়ী কাউকে কিছু বলবে না, নীলা। তুই বল!”
নীলা ইতস্তত করল খানিক। তারপর বলল, “কাল রাতে, আমি শুনেছি আজ দুপুরে, লর্ড নাকি কোন ছেলেকে নিয়ে হোটেলে গেছিলো। বুঝলি তো? হোটেলের কর্মচারী নাকি পুলিশকে ফোন দিয়েছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে!”
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলল, “পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেন? কী করেছে ওরা?”
নীলা প্রায় চিৎকার করে বলল আবার, “লর্ড গে, মৃন্ময়ী। বোঝো না, দুইটা ছেলে ঢাকায় বাসা থাকতেও হোটেলে যায় কেন?”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল মৃন্ময়ী। কিছুক্ষণ কথাই বলল না ও। আমি বললাম নীলাকে, “তুই এটা নিয়ে চিন্তা করছিস কেন?”
নীলা বলল, “তুই এতো বোকা কেন, রিদম? এখন আমার কথা উঠবে! সবাই জেনে যাবে ব্যাপারটা। এই খবরটা কার থেকে পাইছি, জানিস? আমার খালাতো বোনের কাছ থেকে। কেউ জানে না, আমরা ব্রেকাপ করছি। ও ফোন দিয়ে বলল যখন…” বাক্যটা শেষ করল না নীলা। বিক্ষিপ্ত হাঁটতে লাগল আবারও।
মৃন্ময়ী লর্ডের গে হওয়ার ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি বোধহয়। বলল, “ও গে হলে… আমার মাথাতে আসছেই না ব্যাপারটা…!”
কিছু বললাম না আমি। নীলা বলল, “এই বালের দেশে, বুঝলি, আমি আর থাকবোই না!”
হাতপা ছুঁড়তে লাগল নীলা। বলতে লাগল, “এখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করবে, তোর বফ গে, তুই জানতি না? তুই গে এর সাথে প্রেম করেছিস! আমি কী করব, রিদম?”
নীলার কথা কানেই আসছে না আমার। রাগ হচ্ছে খুব, কার উপর রাগ হচ্ছে, জানি না। এদেশে শিশুকে ধর্ষণ করে ধর্ষকেরা ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্য, নির্বাচন পর্যন্ত করে। আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নিজের পূর্ণ সম্মতিতে বদ্ধ ঘরের ভেতর কী করেছে, তাই নিয়ে পুলিশের, সমাজের, ধর্মের মাথাব্যথা? কী ক্ষতি করেছে লর্ড? চাঁদাবাজি, ছিনতাই করেনি, দুর্নীতি করেনি, ঘুষ খায়নি, মারপিঠ করেনি। কেন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে অপরাধী হয়ে? যৌনতা পুরোপুরি নিজেস্ব ব্যাপার, এ নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা কেন?
নীলা বলল, “আমি লর্ডের সাথে দেখা করব!”
অবাক হয়ে বললাম, “কী করবি দেখা করে?”
নীলা বলল, “জানি না কী করব!”
মৃন্ময়ী বলল, “তুমি ভেঙ্গে পড়ো না, নীলা! সব ঠিক হয়ে যাবে!”
নীলা ক্ষেপে গিয়ে বলল, “বাল ঠিক হবে। বাল। আমি ভেবেছিলাম, কেউ জানবে না ও গে। এখন কী হবে? সবাই যে আমাকে জিজ্ঞেস করবে?”
মুখটা করুণ হয়ে গেল মৃন্ময়ী। নীলা এত জোরে চিৎকার করে কথাটা বলেছে! কিন্তু মৃন্ময়ী আবার স্বাভাবিক হতে সময় নিল না। বলল, “তুমি কি লর্ডকে ব্লেইম করছো, নীলা?”
নীলা বলল, “আমার সাথে প্রেম করার জন্য ওকে ব্লেইম করব না?”
মৃন্ময়ী বলল, “সেটা ও খুব ভুল করেছে। কিন্তু ওর সমকামী হওয়াটাকে দোষের কিছু ভাবছো না তো?”
নীলা বলল, “না। করি না। এটায় ওর হাত নেই!”
মৃন্ময়ী বলল, “তাহলে শান্ত হও, নীলা। গে হওয়া নিয়ে লজ্জা পাওয়াই উচিত না, জানো? ভারতেই তো সমবিবাহ লিগ্যাল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে লর্ডকে গে হওয়ার জন্য লজ্জিত হতে হতো না!”
নীলা বলল, “আমার ভাল লাগছে না কিছু!”
“একটু র্যাশনালি চিন্তা করো, নীলা!”, বলল মৃন্ময়ী। “গে হওয়ার জন্য কারো লজ্জিত হওয়া উচিত নয়!”
নীলা বলল, “এটা ইউরোপ নয়, মৃন্ময়ী! এটা বাংলাদেশ! একটা সাম্প্রদায়িক খোঁয়াড়!”
আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “দোস্ত, তুই কি বোরকা পরে আছিস?”
নীলা আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
বললাম, “মানে, তুই বোরখা পরে নাই। তুই জিন্স পরে আছিস। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ, ৮০% মানুষ, তারও বেশি হতে পারে, তোর বোরখা সাপোর্ট করবে না। তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস?”
নীলা বলল, “না!”
বললাম, “৯৯% মানুষ হয়তো লর্ডকে সাপোর্ট করবে না এদেশে। কিন্তু তার মানে এটা না ও ভুল, ওর লজ্জা পাওয়া উচিত। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা, যৌনস্বাধীনতা কী জানেই না। সেই মূর্খ লোকেরা কী ভাববে, সেটা ভেবে প্যানিকড হচ্ছিস কেন?”
মৃন্ময়ী বলল, “Let them think whatever they want! You don’t need to be ashamed because of their ignorance!”
নীলা বলল, “অনেকেই জানে, লর্ড আমার বফ। ওরা ওর গে হওয়ার খবরটা যখন পাবে, আমার সম্পর্কে কতকিছু বলে বেড়াবে ভাব!”
মৃন্ময়ী বলল, “ওদের বলতে দাও! যাদের কাজ কাম নাই, তারাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে। ওরা এমনিতেও অনেক কথা বলবে কারণ বিচিং করাই ওদের প্যাশন!”
মৃন্ময়ীর কথায় কিছুটা শান্ত হলো নীলা। বলল, “লর্ডকে দেখতে যাব না তাহলে?”
মৃন্ময়ী বলল, “ও কোথায় আছে, আমরা জানি না। আর গেলে তোমাকে দেখে ও আরো বিব্রত হবে!”
নীলাকে মাঝে রেখে হাঁটতে লাগলাম আমরা। লাইব্রেরির সামনে এসে মৃন্ময়ী বলল, “লাইব্রেরিতে এত লোক পড়ছে! ওদের উপর একটা জরিপ চালালে দেখবে, যৌনস্বাধীনতায় কেউ বিশ্বাসই করে না! এত পড়ে লাভ কী তাহলে?”
কেউ জবাব দিলাম না মৃন্ময়ীর কথায়।
অনেকক্ষণ এই পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। মৃন্ময়ী একসময় বলেই বসল, “আমার মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে, এই দেশ ছেড়ে চলে যাই! অন্য কোথাও!”
আকাশে অদ্ভুত এক আলো তখন।
ভাবছিলাম, কোন অপরাধ না করেও, শুধু মাত্র রাষ্ট্রের মূর্খতায় একজন এই আকাশ দেখতে পারছে না। কারাগারের অন্ধকারে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার চোখ। এমন আঁধারেই লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল সে তার পরিচয়, হয়তো চেয়েছিল, এ জন্মটা লুকিয়ে চুরি করে কাঁটিয়ে পরের জন্মে নাগরিক হবে স্বাধীন মুক্ত দেশের। রাষ্ট্র তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ঘৃণাভরা একগাদা চোখের সামনে…
“ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতেরো দিন পর
অযথা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর
তুমি হও নদীর মতো গভীরতা, ঠাণ্ডা, দেবদূতী
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
-হিমযুগ/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রুদ্রাভাবী তার ছেলের স্কুলের সামনে আমাকে যেতে বলেছিলেন এগারোটায়। বারোটায় আমার ক্লাস আছে। এগারোটায় ওর স্কুলের সামনে যেতেই দেখলাম ভাবি তার বয়সী আরো কয়েকজনের সাথে গল্প করছেন।
আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, “শুকিয়ে গেছো!”
“জ্বর ছিল দুতিনদিন ধরে। কেমন আছেন আপনি?”
বললেন, “ভালো। বাসাটা গোছাগুছি করতে গিয়ে অবস্থা নাজেহাল!”
সুখী সুখী লাগছে আজ রুদ্রাভাবিকে। পরেছেন ঝলমলে এক শাড়ি। দুধদুইটা ব্লাউজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে লাল কাপড় দেখা ষাঁড়ের মতো।
ভাবি বললেন, “তোমার ওখানে যেতে চাচ্ছি কয়েকদিন ধরে। কিন্তু সময়ই পাইনি!”
নিজেকেই অবাক করে দিয়ে আমি বললাম, “আমাদের বোধহয় থামা উচিত!”
রুদ্রাভাবি অবাক বিস্ময়ে বললেন, “মানে?”
বললাম, “আমার আর ভাল লাগছে না এভাবে।”
রুদ্রাভাবির সুখী সুখী মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো নিমেষেই। বললেন, “আমাকে ভাল লাগছে না আর?”
আমি বলার মতো পেলাম না খুঁজে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এই যে গল্প করছি দাঁড়িয়ে ভাবির সাথে পুরান ঢাকার এক স্কুলের সামনে, একজোড়া চোখ আড়াল থেকে দেখছে আমায়। অবিশ্বাস ঘনিয়ে এসেছে সেই চোখে। বিস্ফোরিত সেই চোখ আহত, ব্যথিত ও নির্বাক। আমার অস্বস্তি লাগছে, ইচ্ছে করছে, ছুটে চলে যাই ভাবির সামনে থেকে।
রুদ্রাভাবি বললেন, “কারো প্রেমে পড়েছো?”
অন্যদিকে তাকালাম আমি। ভাবি বললেন, “বুঝেছি।”
তারপর বললেন, “অনেক কথা বলার ছিলো তোমাকে। থাক সেসব আর বলবো না।”
রুদ্রাভাবির গলা ভাঙ্গা শোনাচ্ছে কী একটু? মনে হচ্ছে, বিষণ্ণ ঘুঘুর ডাক শুনছি ঘোর দুপুরে। বললেন, “বেস্ট অফ লাক! আমি তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করব না কোনদিন!”
উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন রুদ্রাভাবি। রুদ্রাভাবির মন খারাপ থাকবে আজ।
“সমাপ্তি”
শার্টের গায়ে চকচকে নতুন বোতামের মতো আকাশের গায়ে সেটে আছে তারারা। মৃন্ময়ী বলল, “আপু-মৃন্ময়ী নাকি অপু-লীলা?”
“কঠিন প্রশ্ন!”
“উত্তর দিতেই হবে। স্কিপ করার উপায় নেই!”
মৃন্ময়ীর মুখ দেখতে পাচ্ছি না তরল অন্ধকারে। আছি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের নির্জনতায়। গার্ড এসে কয়েকবার উঠতে বলেছে, আমরা নাছোড়বান্দা, তারা না ফোঁটা পর্যন্ত উঠব না।
মৃন্ময়ী শুয়ে পড়েছিল, ঘাসে মাথা রেখে। বলেছিলো, “শুয়ে পড়ো তুমিও!”
আমিও শুয়ে পড়েছিলাম ওর পাশে। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হচ্ছিল ধীরে, আকাশটা নেমে এসেছিলো কালো চাদর জড়িয়ে। দূরে, মাঠের গেটে একটা উজ্জ্বল লাইট জ্বলছিল শুধু।
একটা একটা করে তারা ফুটতে শুরু করেছিলো। মৃন্ময়ী বলেছিল, “মনে হচ্ছে জীবনানন্দের কবিতা রিলাইভ করছি আমরা!”
“কোন কবিতা?”
“…আধ ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কতোদিন তুমি
হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো
বসেছ আমার কাছে এইখানে- আসিয়াছে শটিবন চুমি
গভীর আঁধার আরো- দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত
আসা-যাওয়া আমরা দুজনে বসে- বলিয়াছি ছেঁড়াফোঁড়া কতো
মাঠ ও চাঁদের কথাঃ ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছে তো।”
মৃন্ময়ী মৃদু স্বরে বলেছিল কবিতাটা। আমি বলেছিলাম, “শটিবন আর নেই!”
“ফিঙ্গা দেখিনি কোনদিন আমিও!”
আকাশের তারারা ভোরের পাখিদের মতো ঘুম ভেঙ্গে উঠছিলো যখন মেঘ ফুঁড়ে, তাকিয়েছিলাম তার দিকে। বলেছিলাম, “একশো বছর আগে যদি কোন জোনাকি জ্বলা শটিবনে দেখা হতো আমাদের!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়েছিল, বলেছিল, “আর আমার পরনে থাকতো হলুদ শাড়ি!”
মৃন্ময়ীর মুখ তখনও দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। শুধু বুঝতে পারছিলাম, তার মুখের নিকটত্ব। চোখ বন্ধ না করেই, ওর অন্ধকার মুখের তরল অবয়বের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় দেখেছিলাম সেই দৃশ্য!
তারা ফুটলে, মৃন্ময়ী আমাকে তারাগুলো দেখিয়ে বলেছিল, “এর মধ্যে কোনটা তারাটা চেনো?”
বলেছিলাম, “সন্ধ্যাতারা ছাড়া কোনটাই না!”
মৃন্ময়ী বলেছিল, “আমিও!” তারপর বলেছিল, “আমার দাদু আমাকে সপ্তর্ষিমন্ডল চিনিয়েছিল। দাদু মারা গেছেন অনেকদিন। আমি ভুলে গেছি!”
ব্যথিত হয়েছিলাম আমি। বলিনি কিছুই। শুধু মনে হয়েছিল, কী যে মনে হয়েছিলো…
তখনই প্রশ্নটা করলো মৃন্ময়ী- “আপু-মৃন্ময়ী নাকি অপু-লীলা?”
আমি বলেছি, “কঠিন প্রশ্ন!”
উঠে বসল মৃন্ময়ী। বলল, “কী হলো, বল!”
আমি কোনদিন তুলনা করিনি এভাবে। বললাম, “অপু-মৃন্ময়ী! তবে মত পাল্টে যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে!”
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মৃন্ময়ী বলল, “আমিও পারব না কোন একটা বেছে নিতে। কেন যে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন মাথায় আসে!”
“যত অদ্ভুতই হোক, সব প্রশ্ন দ্বিধাহীন করো আমাকে!”
মৃন্ময়ী বলল, “সমাপ্তির একটা অংশ আছে না, যেখানে নৌকায় বাবার কাছে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৃন্ময়ী যা দেখে সেটা নিয়েই অপুকে প্রশ্ন করে আর অপু জানুক না জানুক সে প্রশ্নের উত্তর দেয়? মৃন্ময়ী সেটা সত্য সরল মনে বিশ্বাস করে?”
বললাম, “হ্যাঁ। আছে।”
মৃন্ময়ী বলল, “তুমি আবার আমাকে অপুর মতো সব প্রশ্নের উত্তর দেবে না তো? জানা বা না জানো?”
“মৃন্ময়ী কিন্তু অপুর সব কথা বিশ্বাস করেছিল। তুমি আমার সব উত্তর বিশ্বাস করবে সন্দেহাতীতভাবে?”
মৃন্ময়ী বলল না কিছু। হাঁটতে লাগলো গেটের দিকে। মাঠ ত্যাগ করার আগে তাকিয়ে দেখলাম আকাশের দিকে। কোটি কোটি বছরের পুরনো আকাশ- আমার আগে, কতজন- কত বেদুঈন, কত কবি, কত বাঙ্গালী কিশোরী আর কিশোর এবং বিধবারা তাকিয়েছে এ আকাশের দিকে। কেউ ভেবেছে আরেক জগতের কথা, কেউ কাল্পনিক ঈশ্বরে ছায়া আকাশে দেখে হয়েছে ভীত। সেই সব আদিম ও আধুনিক লোকেরা, মিলিয়ে গেছে ছেলেবেলার মতো।
বেড়িয়ে এলাম আমরা খেলার মাঠ থেকে।
মৃন্ময়ী হঠাত আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে, যেন পথরোধ করেছে ও, জিজ্ঞেস করলো, “হেমলতাকে মনে আছে তোমার?”
আমি নামটা শুনে হতচকিয়ে যাই। নামটা খুঁজতে চেষ্টা করি স্মৃতি মেলে, বলি, “কোন হেমলতার কথা বলছো?”
মৃন্ময়ী বলে, “অপরাজিততে অপু একটা কারখানার উপরতলায় বাসা নিয়েছিল। ওর পাশের বাড়ির একটা মেয়ে, দেখত ওকে প্রতিদিন। একদিন ও জানালায় লিখেছিল, “হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে”। মনে আছে?”
হঠাত মনে পড়ায় আনন্দিত হয়ে উঠি আমি। বলি, “হ্যাঁ, মনে আছে!”
মৃন্ময়ী আমার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বলে, “আমি না খুব চাইতাম অপু ওকে বিয়ে করুক!”
জিজ্ঞেস করি, “কেন চাইতে?”
মৃন্ময়ী বলে, “জানি না। কী রোম্যান্টিক না?”
আমি কিছু বলি না। মৃন্ময়ী আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
“এই যে প্রতিদিন তোমাকে ডাকি বিকেলবেলা। প্রতিদিন সন্ধ্যাটা আমি আজব সব কথা বলে নষ্ট করি। বিরক্ত লাগে তোমার?”, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মৃন্ময়ী।
“বিরক্ত? তোমার মনে হয় বিরক্ত হই আমি?”, উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই।
মৃন্ময়ী মাথার চুল দুলিয়ে বলে, “উঁহু!”
হাঁটতে থাকি আমরা। এলোমেলো কথারা উড়ে আসে, ঘিরে ধরে, হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমার কানে মৃন্ময়ীর স্বর লেগে থাকে। মাঝেমাঝে হাঁটার সময়, অসাবধানতা আমাদের দুজনের হাতের সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়, কাঁধের সাথে লেগে যায় কাঁধ। মৃন্ময়ী লজ্জিত চকিত আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি তাকাই ওর বিচলিত বিস্মিত চোখের মেঘলা অন্ধকারে।
নীলা আর লর্ডের কথা মাঝেমাঝে আলোচনা করি আমরা। মৃন্ময়ী জিজ্ঞেস করে, “লর্ডের খবর জানো কিছু?”
বলি, “জানি না। খুব খারাপ হয়েছে ওর সাথে!”
মৃন্ময়ীর গতি মন্থর হয়, বলে, “আমরা কিছু করতে পারলাম না। আন্দোলন করা উচিত ছিল!”
কিছু বলি না আমি। মৃন্ময়ী নিজেই বলল, “কী হতো আন্দোলন করে? আমাদের কথা শুনতো কেউ? কিচ্ছু হতো না!”
বলি, “লর্ড ছাড়া পাবে মনে হয়। ভাল উকিল ধরলেই হবে!”
মৃন্ময়ী বলে, “সে জানি। কিন্তু ছাড়া পেতে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হবে ওদের। বলতে হবে, যুক্তি দেখাতে হবে, ওরা কিছু করেনি, কোন কারণে হোটেলে ছিল। কিন্তু কেন? ওরা তো ক্ষতি করেনি কারোর! তাহলে মিথ্যে বলতে হবে কেন মুক্তির জন্য? আমরা একবিংশ শতকে এসেও কেন ব্রিটিশদেই সেই আদিম আইনে বাঁচব?”
লর্ডের কথা উঠলেই বিচলিত হয়ে যাই আমি, অপরাধবোধ কাজ করে। মনে হয়, এমন সময়ে আহমেদুল্লাহ বা অন্য কোন ছেলের হাত ধরে হাঁটতে পারত ও। অংশ হতে পারত এই কোলাহলের। কোন ক্ষতি হতো না কারো। ওর দেবতার মতো মুখ উজ্জ্বল হতে পারত হাস্যধারায়। কথা বলতো আমারই মতো এলোমেলো খাপছাড়া। অথচ… কোথায় ও?
আমি সাবধানে ও চাতুর্যের সাথে লর্ডের ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দেই আর মৃন্ময়ীকেও ধরিয়ে দেই অন্য প্রসঙ্গ। লর্ডের প্রসঙ্গ উঠলেই মৃন্ময়ীর মুখটা গনগণ করে, মনে হয়, অদৃশ্য কারোর সাথে ঝগড়া করে ও। বিতর্ক করে জোর গলায়। তখন ওর প্রতিবাদী মুখে কোমলতা থাকে না।
মৃন্ময়ী আঙ্গুল দিয়ে কী যেন নির্দেশ করে আকাশের দিকে। রোকেয়া হলের মাথায় চাঁদ ওঠেছে। বলে, “খুব চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে আমার!”
“আমার ছাদে যাবে, মৃন্ময়ী?”, জিজ্ঞেস করি আমি।
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকায়। বলে, “যাব!”
আমরা একটা রিক্সা নেই। রিক্সা ছুটতে শুরু করে। মৃন্ময়ী বলে, “তোমার কি একটাই শার্ট?”
“না তো।”
মৃন্ময়ী বলে, “তাহলে একটা শার্টই বারবার পর কেন?”
আমার শার্ট লক্ষ্য করে ও? ও মনে মনে চায়, আমি পোশাক পাল্টে দেখা করি ওর সাথে? আমাকে কল্পনায় দেখার সময়, এই শার্টটা পছন্দ হয় না ওর?
“কাল অন্য শার্ট পরব!”
মৃন্ময়ী বলল, “তোমাকে একটা শার্ট গিফট করব আমি!”
আমার নিজেকে হুট করেই ব্যর্থ মনে হয়। আমার মনে হয়, আমি মৃন্ময়ীর যোগ্য নই! মৃন্ময়ীর গিফট করা শার্ট মানাবে না আমার দেহে! লর্ডের ব্যাপারটা নিয়ে ফেসবুকে অনেক লিখেছে ও। অনেক পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছে, যদিও ছাপা হয়নি সেসব। অনেক হুজুর ওকে হুমকি দিয়েছে, আমাদের ক্যাম্পাসেরই ইসলামের ইতিহাসের এক ছাত্র নগ্নভাবে অসংস্কৃত নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছে যুক্তিতে না পেরে। আমি কিছুই করিনি।
আমার বাড়িওয়ালার টুপি আর দাড়িওয়ালা মুখের অসহনীয় কুৎসিত হাসিটা মনে পড়েছিল। আমি তার হাত তরবারি দেখতে পেয়েছিলাম কল্পনায়। মনে হয়েছিল, সারাটা দেশ এদের মতো লোক দিয়েই ভরে গেছে। রাস্তায় মোড়ের দোকানদারকে আমার মনে হয়েছিল জল্লাদ, আমি রাস্তায়, মোড়ে, গলিতে, বাজারে, শপিংমলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুলে ও কলেজে, প্রেমিকার সাথে রিক্সায়, হোটেলে, বেশ্যাপাড়ায় শুধু ধার্মিক জল্লাদ দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল, বাংলাদেশটা হয়ে উঠেছে যেন আমার ধর্মপ্রাণদের উর্বর প্রজননক্ষেত্র।
আমি না লিখতে পেরে, প্রতিবাদ না করতে পেরে বিমর্ষ হয়েছিলাম। নিজেকে বেড়ালের মতো নিরীহ মনে হয়েছিল। আমি আমার ঘরে, সেই চিলেকোঠায় ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম।
এখন মৃন্ময়ীর পাশে বসে, মনে হচ্ছে, ও অক্ষম একটা ছেলের সাথে বসে আছে।
আমার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুটে মৃন্ময়ীর কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।
রিক্সা ঠিক বাসার সামনে নামিয়ে দেয় আমাদের। আমরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠি। একটা নতুন কাপল উঠেছে আমার পাশের ফ্লাটে। স্বামীটার সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে গটগট করে নেমে যান।
ছাদে উঠতে মৃন্ময়ী বলে ওঠে, “ইসস, কী বাতাস!”
হাওয়ায় চুল ওড়ে ওর। একটা লাইট জ্বলছে। বলে, “আলোটা নিভিয়ে দাও। চাঁদের আলো আসবে দেখব!”
আমি ওর শান্ত মুখ দেখে, নিজের অক্ষমতা ও প্রতিবাদে অংশ না নেয়ার গ্লানির মথা ভুলে যাই। মনে হয়, একা কিছু করতে পারব না আমি। ভাবি, এখনো রাষ্ট্র মৃন্ময়ীকে কেড়ে নেয়নি আমার থেকে। এখনো চাঁদের আলো করেনি নিষিদ্ধ।
আলোটা নিভিয়ে দেই আমি। জিজ্ঞেস করি মৃন্ময়ীকে, “আজ কি পূর্নিমা?”
মৃন্ময়ী বলে, “জানি না। তবে এই চাঁদ শুক্লপক্ষের!”
জিজ্ঞেস করি, “কীভাবে বুঝলে?”
বলে, “মনে হচ্ছে। এত আলো, দেখছো না? মনে হচ্ছে, চাঁদ থেকে আলো অবিরল ঝড়ে পড়ছে!”
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়াই আমরা। আমার হঠাত গান গাইতে ইচ্ছে করে। গুনগুনিয়ে উঠি, “চাঁদ নেমে আসে/ আমার জানলার পাশে/ ঘুম ছুঁয়ে ভাসে/ চাঁদেরই গান…”
মৃন্ময়ী বলে, “থামলে কেন? গাও!”
“তুমি শুনতে পেয়েছো? আমি তো ভাবলাম মনে মনে গাচ্ছি!”
মৃন্ময়ী হাসে। বলে, “তোমার কণ্ঠ ভাল না!”
বলি, “তোমার কণ্ঠ খুব সুরেলা। তুমি গাও না!”
মৃন্ময়ী বলে, “আমার গান শুনতে ইচ্ছে করছে। গাইতে না। তুমি বেসুরো গলাতেই গাও!”
আমি অর্ণবের গানটা, যেটা আমার মোটেও পছন্দের নয়, শুধু পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে গেয়ে উঠেছি, গাইতে শুরু করি। গলা মেলায় মৃন্ময়ী। আমি থেমে যাই। মৃন্ময়ী একা গাইতে থাকে। ওর কণ্ঠ ভেসে যায় হাওয়ায়। ভেসে ভেসে পাশের ফ্ল্যাটের দেয়ালে লাগে, হাওয়ায় হাওয়ায় দূরের বড় বিল্ডিংটায় চলে যায়। জানালায় মুখ রেখে যে কিশোর বা কিশোরী চাঁদ দেখছে, তার কানেও পৌঁছে যায়।
আমি বলি, “সরি, মৃন্ময়ী!”
মৃন্ময়ী বলে, “কেন?”
বলি, “সমকামীদের অধিকার নিয়ে যখন তুমি প্রতিবাদ করেছিলে, তখন আমি চুপ করে ছিলাম। আমি প্রতিবাদে অংশ নিলে, ফেসবুকে দুই লাইন লিখলেও হয়তো, অনেকেই প্রতিবাদ শুরু করত।”
মৃন্ময়ী বলে, “তোমার আজকের রাতটা কেমন লাগছে?”
“অদ্ভুত আর কাব্যিক!”
মৃন্ময়ী বলে, “তুমি লিখলে, প্রতিবাদ করলে, এমন কাব্যিক রাত দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না! ধর্মপ্রাণরা তোমাকে জীবিত রাখবে না!”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তুমি লিখছো যে!”
মৃন্ময়ী বলে, “আমিও লিখব না আর। আমাকেও হুমকি দিয়েছে। আমার ভাই সেদিন ফোন দিয়ে বকেছে!”
আমার মৃন্ময়ীর ভাইয়ের দাড়িওয়ালা মুখটা মনে পড়ে। ভয় করে হঠাত আমার। যদি মৃন্ময়ীর অবস্থা হয় অভিজিৎ রায়দের মতো? যদি এমন জোছনায় আর না থাকে ও? আমার সাথে না থাকুক, না থাকে যদি পৃথিবীতেই? যদি এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে না নিঃশ্বাস নেয় আর?
আমার খুব ভয় করতে থাকে। আমার ইচ্ছে করে মৃন্ময়ীকে জড়িয়ে ধরতে। বলি, “তুমি আর লিখো না! লিখতে হবে না। তোমাকে বাঁচতে হবে, মৃন্ময়ী! মৃত বিপ্লবীদের দরকার নেই আর!”
মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে, “আমি লিখব না আর। প্রতিবাদ করব না। আমি সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকব। এমন চাঁদের আলো দেখব!”
চাঁদ আজ অকৃপণ। যখন মাঠে ছিলাম দুজনে, তখন হয়ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ওঠার। ছাদটা আলোয় ভরে যায়। মনে হয়, কত কিছু মনে হয়… পুকুরে গোসল করতে ইচ্ছে করে, গোল্লাছুট খেলতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে… ইচ্ছে করে…
মৃন্ময়ীর সাদা ওড়না উড়ছে। এসে লাগছে মাঝেমাঝে আমার গায়ে।
ও সঙ্গলোভী বিড়ালের মতো দাঁড়িয়েছে আমাকে গেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি চুলের আড়ালে ওর মুখের একটা অংশ। ইচ্ছে করছে ওকে আমার দিকে তাকাতে বলি। যেন, দেখতে পাই ওর মুখটা এই অদ্ভুত অচেনা আলোয়।
“মৃন্ময়ী?”, ডাকি আমি।
“উম্মম”, জবাব দেয় ও। তাকায় আমার দিকে। আমি ওর মুখে হাত দেই। চুলগুলো সরিয়ে দেই ওর মুখ থেকে। বলি, “চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে না আর। এখন তোমার মুখটা দেখব শুধু চাঁদের আলোয়!”
চোখ বন্ধ করে ও। মনে হয়, চাঁদের আলো শুধু পরেছে ওর মুখেই। বাকিসব, এই ছাদ, ছাদের উপরের কবুতরের খোপগুলো, দড়িতে টাঙ্গানো সায়া, শার্ট আর জাঙ্গিয়া, ঢেকে গেছে অন্ধকারে। আমি ঠোঁটটা এগিয়ে দিয়েও সরিয়ে নেই। সাহস পাই না। আমার নিঃশ্বাস লাগে ওর মুখে। চকিতে চোখ খুলে মৃন্ময়ী। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে, নিজের ওড়না ঠিক করতে করতে বলে, “ব্যালকোনিতে চলো!”
ভয় দানা বাঁধে আমার বুকে। বুকটা দুরুদুরু করে। রাগ করেনি তো মৃন্ময়ী? আমি কি খারাপ কাজ করেছি? আমার চুমু দিতে চাওয়ায় কি আহত হয়েছে ও?
আমরা দ্রুত নেমে আমার ঘরের সামনে আসি। হাত চালিয়ে দরজা খুলে আলো জ্বেলে দেই। মৃন্ময়ী খুব আস্তে ঘরের ভেতরে ঢোকে।
বলে, “আলো নিভিয়ে জানালা খুলে দাও! চাঁদের আলো আসুক ঘরে!”
আমি ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালা খুলে দেই। জানালা দিয়ে ম্লান চাঁদের আলো ঘরে ঢোকে…
বলি, “ব্যালকনির লাইট নেভানো আছে। চাঁদ দেখা যাবে না। তবে চাঁদের আলো আসবে!”
অন্ধকারে মৃন্ময়ীকে দেখতে পাই না আমি। তবে বুঝতে পারি, আমার দিকে তাকিয়ে ও বলছে, “তুমি যাও। আমি আসছি!”
আমি ব্যালকনিতে আসি। চাঁদের আলোয় পবিত্র হচ্ছে চারপাশ। এ আলো কি গঙ্গাজল? এ আলোর দিকে যারা তাকাবে না, মুগ্ধ হবে না দেখে, তারা মানুষ খুন করতে পারে, দুর্নীতি করতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে, বৃদ্ধকে ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠতে পারে চলন্ত বাসে। চাঁদটাকে আকাশে স্থায়ী করে বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। আমার রাষ্ট্রের পতিদের এই চাঁদের আলো দেখাতে ইচ্ছে করে, চাঁদের আলোয় ওদের গা ধুইয়ে দিলে, শুদ্ধ হতে পারে ওরা…
মৃন্ময়ী কী করছে ঘরে? আসছে না কেন? বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছি, চুমু দিতে চেয়ে?
হঠাত পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে তাকাই আমি। আর পিছনে ফিরতেই, কীসের যেন মৃদু ধাক্কায় পিছিয়ে যাই একটু। একরাশ চুল আমার মুখে এসে লাগে, একটি ভেজা উষ্ণ ঠোঁট আজকের শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো, দস্যুর মতো, অবিরল চুমু দিতে থাকে আমার মুখে আমাকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে।
মৃন্ময়ী বলে, “আমাকে বেঁচে থাকতে হবে! অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে!”
দ্রুত নিঃশ্বাস নিয়ে বলে মৃন্ময়ী। ওর নিঃশ্বাসের উত্তাপে আমার ঠোঁট পুড়ে যায়, আমি জড়িয়ে ধরি ওকে। ডুবে যেতে থাকি ওর দেহে। বলি, “তোমাকে আমার সাথে বেঁচে থাকতে হবে, মৃন্ময়ী! অনেকদিন, অনেকবছর!”
মৃন্ময়ী আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো নিবিড়ভাবে।
***সমাপ্ত***
**লেখককে ডিরেক্ট ফিডব্যাক জানাতে চাইলে তার মেইলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।[email protected]