মিষ্টি মূহুর্ত [৪র্থ পর্ব][২]

লেখক :— a-man & বিচিত্রবীর্য
Typist :— বিচিত্রবীর্য

চতুর্থ পর্বঃ হৃদমাঝারে

(৩)
দিদির কথা মতো সুচি এই প্রানহীন কংক্রিটের শহরের এক সেরা প্রাইভেট কলেজে ইকোনমিক্স বিষয় নিয়ে B. Com এ ভর্তি হলো । প্রথমদিন বাসের ভিড়ে ধাক্কা খেয়ে গুতোগুতি করে কলেজ গিয়ে ক্লাসরুমে বসলো। প্রায় আশি নব্বই জন ছাত্র ছাত্রী আছে ক্লাসে। সবার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যদি কোন চেনা মুখ পেয়ে যায় এই আশায়। ঠিক সেই সময় সুচির পাশে একটা ছেলে এসে বসে জিজ্ঞাসা করলো “ চিনতে পারছো ? „
ছেলেটার উচ্চতা 5’8 । সুঠাম চেহারা , হাফ হাতা জামার বাইরে বেরিয়ে থাকা মাসল দেখে বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত জিম করে। মুখটা অনেক ছুচালো আর মুখে চাপ দাড়ি গোফ আছে । ছেলেটাকে দেখেই , সুচি এতক্ষণ ধরে যে একটা চেনা মুখ খুঁজছিল সেটা পেয়ে যাওয়ায় খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। গালে টোল ফেলে সুচি বললো “ গৌরব । তিন বোন না কেন ! আমরা তো একই কোচিংয়ে পড়তাম কিন্তু কখনো আলাপ হয়নি । „
“ এখন তো হচ্ছে । আমার নাম গৌরব সিকদার। এখানে এসে একজন চেনা মুখ পেয়ে যাবো সেটা ভাবিনি ! „
“ আমার নাম সুচিত্রা তালুকদার। আমিও একটা পরিচিত মুখই খুঁজছিলাম। „
“ তুমি কোন কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছো ? „
“ এখনও ঠিক করিনি। আসলে তেমন কোন টিচারকে চিনিও না তাই আর ঠিক করে উঠতে পারি নি ! „
“ তাহলে বাসুদেব স্যারের কাছে ভর্তি হয়ে যাও । আমিও ওনার কাছেই পড়ি। খুব ভালো পড়ান…….
গৌরবের কথা শেষ হওয়ার আগেই একজন লোক ক্লাসে ঢুকলো। আর তাকে দেখেই সবাই শান্ত হয়ে কথা বন্ধ করে বেঞ্চে বসে পড়লো। সুচি আর গৌরব বুঝলো ইনিই ক্লাস টিচার।
কলেজ থেকে ফিরে বিকালে দিদিকে বলে সুচি গৌরবের সাথে বাসুদেব স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গেল।
এর কয়েক মাস পরেই আকাশ মাধ্যমিক পরিক্ষার টেস্ট পরিক্ষা দিল। রেজাল্ট বার হওয়ার পর বাবা মা তেমন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। প্রথমে তো স্নেহা দেবী খুব বকলেন “ সব সময় টিভি আর খেলা এই টিভিই হয়েছে যতো নষ্টের গোড়া। „
রাতের খাওয়ার সময় শুভাশীষ বাবু ছেলেকে বললেন “ টেস্ট খারাপ হয়েছে এতে ভেঙে পড়িস না। এখনও সময় আছে , ভালো করে মন দিয়ে পড়ে মাধ্যমিক দে। তুই এর থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে পারবি আমি জানি । „
বাবার কথায় আকাশ কনফিডেন্স ফিরে পেল । যে যে বিষয়ে নাম্বার কম পেয়েছিল সেই ভাষায় গুলো আরও ভালো করে রিভাইজ দিতে শুরু করলো।
এদিকে বিপ্লব বিচ্ছু আকাশের থেকে ভালো রেজাল্ট করায় তার বাবার কাছ থেকে জোর করে একটা ফোন কিনে নিল। ফোন কেনার দিন বিকালে সোসাইটির পার্কের এক কোনে বসে বিপ্লব ফোন ঘাটছিল । এখন খেললেই মা বকবে তাই আকাশের খেলাধুলা বারন। আকাশ সারাদিন পড়ার পর বিকালে হাওয়া খেতে পার্কে এসে দেখলো বিপ্লব ফোন ঘাটছে । হাতে স্ক্রিনটাচ ফোন। বিপ্লবের পাশে বসে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো “ কার ফোন ? কি করছিস ? „
ফোনের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে বিপ্লব বললো “ আজকে কিনলাম । বাবা কিনে দিল । „
কথাটা শুনে আকাশ ভোস করে একটা বড়ো নিশ্বাস ছাড়লো। আকাশের এই নিশ্বাস ছাড়া শুনে বিপ্লব ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি নিয়ে বললো “ দেখবি ? দেখলে মুড ভালো হয়ে যাবে । „
বিপ্লব কি এমন দেখার কথা বলছে যেটা দেখলে মুড ভালো হয়ে যাবে? সেটা ভেবেই গলার স্বরে কৌতুহল মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কি ? „
“ দেখলেই বুঝবি । „ কথাটা বলে বিপ্লব ফোনের গ্যালারি থেকে একটা ভিডিও চালু করে আকাশের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিল । ফোনটা হাতে নিয়ে আকাশ দেখলো ভিডিওতে কোন এক বিদেশিনী সুন্দরী মডেল ক্লাস নিচ্ছে আর ক্লাসে ছাত্র শুধু একজন । হঠাৎ ছাত্রটা খাতা থেকে একটা কাগজ ছিড়ে দলা পাকিয়ে ম্যামের দিকে ছুড়ে মারলো। ম্যাম ছাত্রের দুষ্টুমি দেখে তাকে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। ছাত্র দাঁড়াতেই কিছু একটা দেখে আকাশ “ ইসসস ! কি এসব ? „
খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বিপ্লব বললো “ মজা তো এবার শুরু হয়েছে । তুই দেখ না ! „
আরও কিছুক্ষণ ভিডিও দেখেই আকাশের গা গুলিয়ে উঠলো আর বমি পেতে শুরু করলো। ম্যাম আর ছাত্র কি সব করছে !! আকাশ বিপ্লবের হাতে ফোনটা দিয়ে দিল “ কি এসব? তুই এইসব দেখিস সব সময় ! „
“ এইসবই তো করে বড়োরা নিজেদের মধ্যে। তারপরেই তো বাচ্চা জন্মায়। তুই শুধু হাইটেই বড়ো হলি , কিছুই শিখলি না । „ তারপর একটু ইয়ার্কি করে বিপ্লব বললো “ তোকে আর মানুষ করতে পারলাম না ! „
বিপ্লবের কথা শুনে আকাশের মুখে হাজারো জিজ্ঞাসার কৌতুহল ফুটে উঠলো। আকাশের মুখ দেখে বিপ্লব বললো “ শোন । তোকে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞান দিই। আগে বল মাসিক কি ? „
জীবনবিজ্ঞান বইতে যা পড়েছিল সেটা বলতে শুরু করলো আকাশ “ একজন বয়ঃপ্রাপ্ত সুস্থ মহিলার পঁচিশ থেকে ত্রিশ দিন পরপর শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে সেই ডিম্বাণু, সাথে রক্ত ও মিউকাস শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসে এই পক্রিয়াকে বলে মাসিক রজঃচক্র । „
বিপ্লব এতক্ষণ নিরস মুখ করে আকাশের থেকে বইয়ের সংজ্ঞা শুনে বললো “ হ্যাঁ , এবার এই শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে কিভাবে ? মানে শুক্রাণু তো আমাদের ছেলেদের শরীরে থাকে। এই আমাদের শরীর থেকে মেয়েদের শরীরে যায় কি করে ? „
বিপ্লবের কথার কোন উত্তর আকাশের কাছে নেই। কোন বইতে সে পড়েনি। তাই ভুরু দুটো কোঁচকানো ছাড়া সে আর কিছুই করতে পারলো না। আকাশের মুখ দেখে বিপ্লব বললো “ এই ভিডিওতে যেটা দেখলি ! সেইভাবেই আমাদের শরীরের শুক্রাণু মেয়েদের শরীরে যায়। দেখবি আর একবার ভিডিওটা ? „
আর এই জঘন্য নোংরা জিনিস দেখার কোন ইচ্ছা আকাশের নেই। তাই বিপ্লব ভিডিও চালু করার আগেই আকাশ বিপ্লবের পাশ থেকে উঠে বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করলো । বিপ্লব আকাশের কিছু না বলে চলে যাওয়া দেখে ফিক ফিক করে শরীর নাড়িয়ে কিছুক্ষণ হেসে আবার ফোনের মধ্যে ডুব দিল।
ফ্ল্যাটে ঢুকে হাত পা ধুয়ে আকাশ আবার পড়তে বসলো। পড়তে বসলেও পড়ায় মন বসাতে পারলো না একদম। সামনে বই খোলা থাকলেও মন পড়ে আছে বিপ্লবের ফোনে দেখা ভিডিওতে। ভিডিওতে যা দেখেছিল সেটা মনে পড়তেই গা গুলিয়ে উঠছে কিন্তু ওই ভিডিওটা বারবার মনে করতে ইচ্ছা করছে। রাতে আর পড়ায় মন বসাতে পারলো না আকাশ। রাতে খেয়ে বিছানার উপর গা এলিয়ে দিয়ে ওই ভিডিওটা আবার দেখতে ইচ্ছা হলো আকাশের ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার পরে আবার সেই ভিডিওটা দেখতে ইচ্ছা হলো আকাশের। স্নেহা দেবী ডাইনিং টেবিলে সকালের ব্রেকফাস্ট রাখছিলেন। আকাশ মাকে দেখে গলায় আদর মিশিয়ে আবদার করলো “ মা আমার একটা ফোন কিনে দাও না । „
কথাটা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আকাশের মা বললেন “ টেস্টে এত খারাপ রেজাল্ট করার পর তোর সাহস কি করে হলো ফোন চাওয়ার ! „
মায়ের অগ্নিদৃষ্টি আর শাসানি শুনে দমে গিয়ে , মুখটা বাংলার পাঁচ করে সোফায় বসে পড়লো আকাশ । ঠিক সেই সময় আকাশের বাবা সুট প্যান্ট পড়ে হাতে মোজা নিয়ে আকাশের পাশে এসে বসে মোজা পড়তে পড়তে বললেন “ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট কর। শুধু দামি ফোন না ! সাথে ল্যাপটপ ও কিনে দেবো । „
বাবার কথা শুনে আকাশের চোখটা যেন জ্বলে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং টেবিল থেকে লুচি আর কড়াইশুটির আলুর দম ব্রেকফাস্ট এনে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে খেতে শুরু করলো। এখন তো শুধু খাওয়ার সময়েই টিভি দেখার অনুমতি দেওয়া আছে। বাকি সময় বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে থাকতে হয় । খেতে খেতে আকাশ ভাবতে লাগলো ‘ নতুন উদ্যোমে পড়তে হবে। যে করেই হোক একটা ফোন পেতেই হবে । ‚
এর কয়েক সপ্তাহ পরে সুচির কলেজে ফ্রেসার্স বা নবিনবরণ উৎসব আয়োজিত হলো। এই অনুষ্ঠানে সুচি আরও কয়েকজনের সাথে কয়েকটা মডার্ন গানে নাচলো। বলাবাহুল্য সবচেয়ে নজরকাড়া পার্ফরমেন্স সুচির হলো। সুচির সবকটা নাচ গৌরব নিজের ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে সেভ করে নিল। নাচ শেষ হওয়ার পর গৌরব বললো “ তুমি এতো ভালো নাচো বলনি তো ! „
মুখে মেকি হাসি নিয়ে সুচি বললো “ ওই মাঝেসাঝে একটু আধটু নাচি। মন ভালো থাকে এতে । „
নিয়মিত কলেজ যাওয়া , কোচিংয়ে গিয়ে নোটস নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আরও কয়েক মাস কেটে গেল। সুচির প্রতি গৌরব যে দুর্বল সেটা ক্লাসের সবাই বুঝতে পারলো । আর এদিকে আকাশের মাধ্যমিক পরিক্ষা শুরু হয়ে গেল। একদিন কলেজে গিয়ে সুচি শুনলো ম্যাম আজকে আসেননি তাই শেষ ক্লাসের লেকচার হবে না। দুপুরের পরেই আর কোন লেকচার নেই। এই সুযোগে গৌরব ভাবলো ‘ একটু অগ্রসর হলে কেমন হয় ! ‚
বুকটা ঢিবঢিব করতে শুরু করলো গৌরবের। একটু সাহস নিয়ে কথাটা বলেই ফেললো গৌরব “ বাড়ি যাওয়ার কোন তাড়া আছে ? „
“ না , তেমন কোন তাড়া নেই। কেন বলো তো? „
“ তাহলে সিনেমা দেখতে যাবে ? „ জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে এলো গৌরবের।
“ মন্দ হয় না । „
খুব উৎসাহেই সাথে গৌরব বললো “ তাহলে দেরি কিসের। চলো । এখন গেলে দুটোর শো টা দেখতে পাবো। „
তারপর দুজনেই মানিস্কোয়ার এর একটা বাসে উঠে পড়লো। দুপুর বেলা বলে বাসে তেমন ভিড় নেই। বাসে উঠেই ফাকা সিট পেয়ে দুজন পাশাপাশি বসে পড়লো । কিছুক্ষণ পর গৌরভ বললো “ এই বাসটাই সকালের দিকে এমন ভিড় হয় যে দাড়ানো যায় না। „
গৌরবের কথায় সুচি একটা সম্মতিসূচক মাথা দোলালো । সুচির কাছে নিজের দাম বাড়ানোর জন্য গৌরব বললো “ কয়েক মাস পর লাইসেন্স পেয়ে যাবো , তারপর গাড়ি করেই কলেজ যাতায়াত করবো। বাসের এই ভিড় সহ্য হয়না । „
গৌরবের এই কথায় সুচি গৌরবের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার লোকজন দোকানপাট দেখতে লাগলো। সুচি বুঝলো যে গৌরব তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে।
এই কয়েক মাসে সুচি গৌরবকে খুব ভালো করে চিনে নিয়েছে। গৌরবের চরিত্র এখন সুচির কাছে স্বচ্ছ জলের থেকেও পরিষ্কার। ক্লাসে যখনই সময় পায় তখনই নিজের গুনগান করে বেড়ায় গৌরব —– ‘ রোজ তিন ঘন্টা জিমে কাটায় গৌরব। প্রফেশনাল ট্রেনারের কাছ থেকে জিম করে। গৌরবের পুর্বপুরুষ জমিদার ছিল । বাবার অনেক টাকা। এত টাকা যে সাত পুরুষ বসে খেতে পারবে। তবুও গৌরবের বাবা পি জি কর হাসপাতালে ডাক্তারি করে শুধুমাত্র মানুষের সেবা করার জন্য। চেতলাতে একটা ক্লিনিকে সপ্তাহে তিন দিন বসে গৌরবের বাবা। ভিজিট পাঁচশো টাকা। বাবার দুটো গাড়ি আছে। একটা মার্সিডিজ আর একটা বোলেরো। বাবার একমাত্র ছেলে গৌরব। সব সম্পত্তি গৌরব-ই পাবে । দুবার বিদেশ ঘুরে এসছে , একবার আমেরিকা আর একবার জাপান । ‚ বারবার এইসব শুনতে শুনতে কান পচে গেছে সুচির।
রাস্তা ফাকা থাকায় আধ ঘন্টার মধ্যেই তারা মানিস্কোয়ার পৌঁছে গেল। একটা ইংলিশ সিনেমার দুটো টিকিট কাটলো গৌরব। ছশো টাকা দুটো টিকিটের দাম হওয়ায় সুচি তার ব্যাগ থেকে একশো টাকার তিনটে নোট গৌরবের দিকে বাড়িয়ে দিল। সুচিকে টাকা দিতে দেখে গৌরব বললো “ এটা আমার তরফ থেকে ট্রিট । „
গৌরবের কাছ থেকে ট্রিট নেওয়া মানে নিজেকে ছোট করা , তাই গৌরবের কাছ থেকে কোন ধরনের ট্রিট নেওয়ার ইচ্ছা সুচির নেই। তাই গৌরব ট্রিট দেওয়ার কথা বললেও সুচির টাকাটা বাড়িয়েই রইলো। গৌরব বুঝলো সুচি ট্রিট নিতে চায় না। তাই সে সুচির হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে দিল
সিনেমা শুরু হলে দুজনেই সিনেমা দেখতে শুরু করলো। একসন মুভি , মাঝে মাঝে একটা দুটো চুম্বনের দৃশ্য আছে। প্রায় এক ঘন্টা পর নায়কের সাথে নায়িকার বিয়ের দৃশ্য দেখানো শুরু হলো । একটা ফুলের বাগান, বাগানে নাম না জানা বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটে আছে। আর বাগানের মাঝখানে একটা সুন্দর ফাউন্টেন আছে । সেই ফাউন্টেনের মাঝখানে নায়কের বন্ধুরা, নায়িকার বন্ধুরা দাড়িয়ে আছে। তারপর নায়ক নায়িকা এসে পাদ্রির সামনে একে অপরকে চুম্বন করে বিয়ে করলো।
নায়ক নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে ঠোট রেখে চুমু খাওয়া শুরু করতেই , আরামদায়ক চেয়ারের হাতলে রাখা সুচির বামহাতের উপর গৌরব ডান হাতটা রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের গতিতে সুচি হাতটা সরিয়ে নিল । এরপর আরও কুড়ি মিনিট সিনেমা চলার পর ইন্টারভেল শুরু হলো।
ইন্টারভেল হতেই সুচি উঠে হলের বাইরে চলে এলো। মুখটা রাগে পাথর হয়ে আছে। গৌরব সুচির পিছন পিছন এসে করিডরে দৌড়ে সুচির সামনে এসে কান ধরে বললো “ প্লিজ প্লিজ ক্ষমা করে দাও , ওটা ভুল করে হয়ে গেছে। সত্যি আমার কোন খারাপ অভিসন্ধি ছিল না। „
গম্ভীর গলায় সুচি বললো “ দেখো গৌরব ! আমরা শুধু বন্ধু। এর বেশি কিছু নই। তুমি আমাদের বন্ধুত্বটাকে নষ্ট করছো। সরো সামনে থেকে , আমার আর সিনেমা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না । „
ইন্টারভেল হওয়ায় বাকি দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন বাথরুম করতে এলো। তারা হলের বাইরে এসে সুচি আর গৌরবকে দেখতে লাগলো
“ প্লিজ প্লিজ শোন আমার কথা , ওটা ভুল করে হয়ে গেছে। লোক দেখছো , এরকম করো না । সত্যি বলছি। প্লিজ রাগ করো না। আমরা শুধুই বন্ধু এরকম ভুল আর কখনো করবো না। সিনেমাটা দেখো প্লিজ। আমার এই একটা ভুলের জন্য বন্ধুত্বটা নষ্ট করো না প্লিজ ।
গৌরবের কথায় সুচি শান্ত হলো না। একটু ভেবে দেখলো ‘ এই অকালকুষ্মান্ডের জন্য তিনশো টাকা জলে ফেলে দেওয়া যাবে না। ‚ কথাটা ভেবে আবার সিনেমা হলে বসলো। এরপর গৌরব আর একটাও কথা বলেনি। সিনেমা শেষ হওয়ার পর মানিস্কোয়ার এর বাইরে এসে গৌরব বললো “ আমি তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিই । „
“ না । আমি একা যেতে পারবো। „ বলে গৌরবের দিকে না তাকিয়ে একটা বাসে উঠে পড়লো।
বাসটা সোসাইটি পর্যন্ত যায় না। বাস থেকে নেমে একটা অটো ধরে সোসাইটিতে পৌছল সুচি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে এলো । ঘরে এসে জামা কাপড় ছেড়ে একটা কালো টপ আর একটা হাফ প্যান্ট পড়ে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে শুরু করলো সুচি। গৌরব আজ যা করলো তার জন্য মুড একদম ভালো নেই সুচির। গৌরবের থেকে যে দূরে থাকবে তারও উপায় নেই। সবসময় জোঁকের মতো লেগে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সুমি অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসে হাওয়া খেতে লাগলো। একটু ধাতস্থ হয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলে বোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ আকাশের preparation কেমন ? „
সুচি দিদির কথার মানে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুমি সেটা বুঝতে পেরে বললো “ কালকে থেকে তো আকাশের মাধ্যমিক পরিক্ষা শুরু হবে। ওর preparation কেমন ? „
এতক্ষণ পর সুচির মুড ভালো হতে শুরু করলো । সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে সব চুল পিঠের ওপর খোলা ছেড়ে দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই “ কাকি ! „ বলে ডাকলো সুচি। কিন্তু কেউ উত্তর দিল না ।
আকাশের ঘরে উকি মেরে দেখলো আকাশ এক মনে সামনে খুলে রাখা ইংরেজি খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। “ কাকি কোথায় রে ? „
বই থেকে মুখ না তুলেই আকাশ বললো “ সোমা মাসির কাছে গেছে আষাঢ়ে গপ্প দিতে । „ সোমা মাসি হলো জয়শ্রীর মা।
কাকি ফ্ল্যাটে নেই শুনে সুচি একটা মুচকি হাসি দিয়ে আরও একটা চেয়ার নিয়ে আকাশের পাশে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ আকাশের খুলে রাখা ইংরেজি নোটসের খাতার দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ সুচি খাতাটা বন্ধ করে দিল। খাতাটা বন্ধ হতেই আকাশ ভুরু কুঁচকে সুচির দিকে তাকালো । সুচির মুখের হাসি দেখে আকাশের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সুচি দুষ্টুমি করছে। সে আবার খাতাটা খুলে মুখে আওয়াজ না করে পড়তে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর সুচি আবার খাতাটা বন্ধ করে দিলে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আকাশ বললো “ করিস না। পড়তে দে । „
“ তুই যখন আমার মাধ্যমিক পরিক্ষার সময় কানের কাছে বাঁশি নিয়ে প্যাএএএ প্যাএএ করে বাজাচ্ছিলি তখন ! „
সুচির কথায় আকাশ আর কিছু বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ সুচির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে আবার খাতা খুলে পড়তে শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড পর আবার সুচি আবার খাতাটা বন্ধ করে দিলে আকাশ ঝাঁঝিয়ে উঠলো “ উফফফ ! করিস না । এমনিতেই মা রেগে আছে আমার উপর , এসে যদি দেখে তুই এরকম করছিস তাহলে তোকেও বকবে । „ বলে আবার খাতাটা খুলে পড়তে শুরু করলো ।
আকাশের ভয় সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সুচি আবার খাতাটা বন্ধ করে দিলে আকাশ বললো “ দেখ ! মারপিট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই , এবার করলে কিন্তু তোকে তুলে ডাস্টবিনে ফেলে আসবো । „
সুচি মুখটা বেকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো “ উঁউউ ! শখ কতো ! তুলে ডাস্টবিনে ফেলে আসবে। তুলে দেখা একবার ! তারপর তোর কি করি দেখবি…..
সুচির কথা শেষ হওয়ার আগেই আকাশ সুচিকে কোলে তুলে নিল । সুচি মুখ দিয়ে শুধু “ এএএএইইইইই ! „ বলে চিল্লিয়ে উঠলো ।
আকাশ যে তাকে সত্যি সত্যি কোলে তুলে নেবে এটা সুচি ভাবেইনি । আকাশ তাকে কোলে তুলে নিলে সুচি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আকাশ সুচিকে ঘরের বাইরে এনে লিভিংরুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘটনাটা ঘটতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো মাত্র।
আরও কয়েক সেকেন্ড লাগলো সুচির ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটতে। যখন সম্পূর্ণরূপে হুশ ফিরে পেল তখন তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। আর কান গরম হয়ে উঠলো। দাত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সোফা থেকে উঠে ঘরের বাইরে যেতে লগলো সুচি । ঘরের বাইরে আসতেই দেখলো আকাশের মা সিড়ি ভেঙে উপরে উঠছেন।
সুচিকে ঘরের বাইরে আসতে দেখে আকাশের মা বললেন “ কালকে ওর পরিক্ষা। এখন আর ওকে জ্বালাস না। „
সুচি ডান গালের উপর পড়ে থাকা কয়েকটা চুল কানের পিছনে দিয়ে বললো “ ও ভিতর দিয়ে দরজা দিয়ে দিয়েছে। „ কথাটা বলে সুচি নিজের ঘরে ঢুকে গেল ।
ভুরু কুঁচকে আকাশের মা মনে মনে বললেন ‘ দরজা দিয়ে দিয়েছে ! ‚ তারপর ফ্ল্যাটে ঢুকে আকাশের ঘরের দরজায় টোকা নিয়ে বললেন “ এই ভর সন্ধ্যায় দরজা দিয়ে দিয়েছিস কেন ? „
আকাশ চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে বললো “ ওই সুচি এসে বারবার খাতা বন্ধ করে দিচ্ছিল তাই দরজা দিয়ে দিয়েছি „
“ থাক । আর দরজা দিতে হবে না। ও চলে গেছে । „
এদিকে সুচি নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে মায়ের সাথে টিভি দেখতে বসে গেল। টিভির উপর চোখ থাকলেও মনটা টিভির পর্দায় নেই। তার মন পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া মিষ্টি মূহুর্তে । ‘ কিভাবে পালকের মতো ওকে কোলে তুলে নিয়েছিল আকাশ ‚ এটাই বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
কিছুক্ষণ পর সমরেশ বাবু অফিস থেকে ফিরে এলে সুচি উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলো সুমি টেবিলে বসে একটা উপন্যাস পড়ছে। সুমি সুচিকে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো “ কি বললো ও ? „
‘ এই খেয়েছে ! ওর preparation কেমন সেটাই তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি ! ‚ “ ভালো বললো। মন দিয়ে পড়ছে। „ বানিয়ে বানিয়ে বলে দিল সুচি।
বোনের উত্তর শোনার সময় তার মুখের দিকে তাকিয়েই ভুরু কুঁচকে গেল সুমির । সুচির ঠোঁটে হাসি আর গালে রক্তিম আভা সুমি স্পষ্ট দেখতে পেল। কথাটা বলে সুচি খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে বুকের নিচে একটা বালিশ রেখে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর যে ফোনটা পেয়েছিল সেটাই ঘাটতে শুরু করলো। সুমি মাঝে মাঝে বই থেকে চোখ তুলে বোনের দিকে তাকিয়ে বোনের ঠোঁটের হাসি আর গালের রক্তিম আভা দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সুমি জিজ্ঞাসা না করে আর থাকতে পারলো না “ তুই হাসছিস কেন ? „
ফোন থেকে মুখ তুলে সুচি বললো “ আমি ! কই নাতো ! „
“ হ্যাঁ । তুই হাসছিস । „
“ হঠাৎ আমি কেন হাসতে যাবো ! „
সুমি আর কোন কথা বাড়ালো না। খাওয়ার সময় সুমি বোনের সামনে বসে খেতে খেতে বোনকে দেখতে লাগলো। এখন আর সেই রক্তিম আভা টা না থাকলেও ঠোঁটের হাসিটা এখনও আছে “ হ্যাঁ তুই হাসছিস । „
“ তুই চুপচাপ খা তো ! তখন থেকে হাসছিস কেন ? হাসছিস কেন ? বলে মাথাটা ধরিয়ে দিলি। „
সুমি আর কিছু বললো না। রাতে খাটে শুয়ে আজকে সিনেমায় দেখা বিয়ের দৃশ্যটা স্বপ্নে একটু অন্য ভাবে দেখলো সুচি । একটা বিশাল বড়ো গোলাপ ফুলের বাগান । নানা রঙের গোলাপ ফুল আছে তাতে , হলুদ , নীল , গোলাপি , লাল , কালো আরও কত রঙের। আর সেই গোলাপের বাগানের মাঝখান একটা দুই তিন ফুটোর চওড়া রাস্তা , রাস্তার উপর লাল কার্পেট বিছানো আছে। রাস্তাটা শেষ হচ্ছে বাগানের মাঝখানে একটা বিশাল বড়ো রাজপ্রাসাদের সামনে। আর সেই রাস্তায় আকাশ তাকে কোলে করে নিয়ে হাটছে। উদ্দেশ্য হলো সেই রাজপ্রাসাদের ভিতরে যাওয়া। সিনেমায় বিয়ের সময় নায়ক নায়িকা যে কালো ট্যাক্সিডো আর সাদা গাউন পড়ে ছিল সেই পোশাক স্বপ্নে আকাশ আর সুচি পড়ে আছে।
ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সুচি তার দিদিকে বেশ ভালো করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো । এদিকে সারাদিনে অফিসের ক্লান্তির জন্য গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা সুমি জেগে গেল। অন্ধকার ঘরে ঘুম জড়ানো চোখে আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না যে সুচি পাশ বালিশ মনে করে তাকেই জড়িয়ে ধরেছে। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে সুমি সুচিকে গা থেকে ছাড়িয়ে সরিয়ে দিল। দিদির ধাক্কায় সুচি উল্টো দিকে ফিরে পাশ বালিশটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও স্বপ্ন দেখায় বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটলো না সুচির ।
সকালে অফিস যাওয়ার তাড়াহুড়োয় সুমি বোনকে যে রাতের জন্য কয়েকটা কথা বলবে সেটা ভুলে গেল। এর কয়েক সপ্তাহ পর আকাশের মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। তার কয়েক সপ্তাহ পরে মাধ্যমিক এর রেজাল্ট বার হলে স্টার মার্কস পেয়ে পাস করলো আকাশ। আকাশের টেস্টের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় যে মা আকাশকে উঠতে বসতে কথা শোনাতেন সেই মা মাধ্যমিকে ছেলের রেজাল্ট ভালো হওয়ায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কপালে মুখে চুম্বনের বর্ষা করিয়ে দিলেন। নিজের দেওয়া কথার জন্য আকাশকে অফিস যাওয়ার সময় একটা স্যামসাং এর দামী ফোন আর সাথে একটা আপেলের ল্যাপটপ কিনে দিতে হলো শুভাশীষ বাবুকে ।
শোরুম থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তায় আসতে আসতে ফোন আর ল্যাপটপ এর জন্য আকাশের পা আর মাটিতে পড়ছে না। ‘ কখন বাড়ি ফিরে ফোন ঘাটবো ! ‚ এটা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠলো সে। ফ্ল্যাটে ঢুকে এই প্রথম ঘরের দরজা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিলো সে। দুপুরে খাবার সময় ছাড়া আর সারাদিন ঘরের বাইরে এলো না। স্নেহা ভুরু কুঁচকে তাকালেও কিছু বললেন না। খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে 3G internet connection এ দ্রুত নেট সার্ফিং এর মজা সে নিতে শুরু করলো। কয়েক মিনিটে মোবাইলের যাবতীয় খুটিনাটি সিস্টেম সে শিখে নিল।
কলেজ থেকে ফিরেই সুচি আকাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে , ভেজিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে আকাশের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো “ কি করছিস ? „
সুচি দরজায় ধাক্কা দেওয়া মাত্রই আকাশ ফোনে একটা গাড়ির রেসের গেম চালু করে দিয়েছিল। আকাশকে চুপচাপ ফোনে গেম খেলতে দেখে সুচি আবার জিজ্ঞাসা করলো “ ফেসবুক ডাউনলোড করেছিস ? „
“ না । „
ভুরু কুঁচকে মুখে বিরক্তি নিয়ে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ তাহলে কি করলি সারাদিন ? „
“ গেম খেলছিলাম আর ফোনের সেটিংস করছিলাম । „
“ তুই আর তোর খেলা। দে । „ বলে আকাশের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল। আকাশ “ এই ! এই ! „ বলে ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সুচির হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে পারলো না।
সুচি ফোনটা নিয়ে close all tab করতে গিয়ে দেখলো আকাশের সদ্য চালু করা গেম tab এর পিছনেই যে tab টা আছে সেখানে xnxx লেখা আছে। লেখাটা পড়েই সুচির ভুরু কপালে উঠে কুঁচকে গেল আর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল । xnxx এর ট্যাবটা খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে গর্জিয়ে “ লম্পট , জানোয়ার কোথাকার সারাদিন এইসব দেখছিলি তুই ! „ কথাটা বলে ঠাসসস করে একটা চড় বসিয়ে দিল আকাশের গালে ।
আকাশও সজোড়ে একটা চড় মারতে গেলো “ আমি দেখছি তাতে তোর কি ? „
বালিশ তুলে আকাশের চড়টা আটকে সুচি বললো “ নোংরা জিনিস দেখছিস আবার মুখের উপর তর্ক করছিস! „ কথাটা বলে সুচি আকাশের ঘামচাতে গেল।
সুচির বড়ো বড়ো নখের জন্য আকাশের গালে দুটো আঁচড়ে গেল । ডান গালে ঠিক কানের পাশে দুটো সরু সরু আঁচড়ের দাগ ফুটে উঠলো। এদিকে আকাশও সুচির মুখ খামচাতে গেল কিন্তু নখ না থাকায় তেমন সুবিধা করতে পারলো না।
ঘরের ভিতর থেকে দাপাদাপির শব্দ আর সুচির মুখের গালাগালি শুনে স্নেহা দেবী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন খাটের বিছানা অগোছালো , বালিশ নিচে পড়ে আছে। আর খাটের উপর সুচি আকাশকে কামড়াতে যাচ্ছে আর কামড়ানোর হাত থেকে বাচার জন্য আকাশ সুচির মুখটা দুরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে আর বলছে “ রাক্ষস , নরখাদক ! কোথা থেকে শিখেছিস মানুষের মাংস খাওয়া ? „
আর সহ্য করতে পারলেন না স্নেহা দেবী “ এইইইইই ! „ বলে গর্জিয়ে উঠলো
“ কি শুরু করলি তোরা ! থাম বলছি ! রোজরোজ তোদের এইসব আর ভালো লাগে না ! কবে বড়ো হবি তোরা ? „ প্রায় চিল্লিয়ে কানের মাথা খেয়ে কথাগুলো বলে আকাশকে টেনে সরাতে লাগলেন।
ওদিকে কাকিকে আসতে দেখে সুচি আকাশকে ছেড়ে দিয়ে খাটে বসে হাঁপাতে শুরু করলো । আকাশও সুচিকে ছেড়ে দিয়ে খাট থেকে উঠে নিচে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে শুরু করলো । এদিকে মা আসার পর থেকেই আকাশের বুকটা ঢিবঢিব করতে শুরু করলো। যদি সুচি মাকে বলে দেয় তাহলে আর আস্ত রাখবে না।
ঠিক এই সময়ে স্নেহা দেবী ছেলের গালে সুচির দুটো নখের আঁচড় দেখতে পেলেন। আকাশের মুখটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার পর চোখ ঠিকরে বার হয়ে এলো। মুখটা পাথরের মতো শক্ত করে সুচিকে ধমকিয়ে উঠলেন “ সবকিছুর একটা সীমা থাকে সুচি ! তোর সাহস কি করে হলো আমার ছেলের মুখে ওইভাবে আঁচড়ানোর ? „
কাকি যেন তাকে কিছুই বলেনি এমন ভাব করে খাট থেকে আকাশের ফোনটা তুলে কাকির চোখের সামনে ধরে বললো “ দেখো ও কি দেখছিল ! „
“ ইসসসস এতো বড়ো বেইমান এই সুচি আগে জানতাম না। মাকে বললি কেন ! এবার কি হবে… এবার নির্ঘাত মা আমার পিঠের চামড়া তুলে তারপর শান্ত হবে ! „ এই কথাটা ভেবেই ঘর থেকে পালানোর চেষ্টা করতে লাগলো আকাশ ।
বাঙালির মায়ের শুধু দুটো অস্ত্র যথেষ্ট তার ছেলেকে প্যাঁদানোর জন্য। এক হলো হাতের খুনতি আর দুই হলো পায়ের জুতো। কিন্তু এই মুহুর্তে স্নেহা দেবীর হাতে খুনতি ছিল না এমনকি পায়ে জুতোও ছিল না। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকা 5’6 ইঞ্চি উচ্চতার আকাশের চুল মুঠো করে ধরে পিঠে তিন চারটে কিল চড় দমম দমম শব্দে বসিয়ে দিলেন “ নির্লজ্জ ! বেহায়া ! দিনদিন জানোয়ার তৈরি হচ্ছিস ! কোথা থেকে শিখেছিস এইসব দেখা ? „
“ মা প্লিজ এইবারটি ক্ষমা করে দাও আর কখনো দেখবো না। কথা দিলাম। „ কথাটা বলতে মাথা উঁচু করতেই মায়ের হাতের আরও দুটো চড় ঠাসসসস ঠাসসস করে আকাশের গালে বসে গেল ।
“ কোথা থেকে এসব দেখা শিখেছিস বল ? জানোয়ার , রকে বসে আড্ডা দে যা । পড়াশোনা আর করতে হবে না । „ বলে আরও দুটো চড় বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে। আকাশের দুই গাল একটা টমেটোর থেকেও বেশি লাল হয়ে উঠেছে।
কাকির রুদ্রমূর্তি দেখে সুচি প্রথমেই ভয় পেয়ে গেছিল। আকাশকে বেধড়ক পেটা খেতে দেখে সুচি মনে মনে বললো ‘ কাকিকে বলা একদম ঠিক হয়নি। ‚
সুচি কথাটা ভাবতে ভাবতে খাট থেকে নেমে আকাশের মাকে শান্ত করার জন্য বললো “ কাকি ! কাকি প্লিজ আর মেরো না । „
সুচিকে অগ্রাহ্য করে আরও দুটো চড় বসিয়ে দিলেন আকাশের গালে । সুচি এবার আকাশের মাকে একটু টেনে সরাতেই আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে দৌড় মারলো ।
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে মায়ের এলোপাতাড়ি চড় কিল এর জন্য দাগ পড়ে যাওয়া গালে হাত বোলাতে বোলাতে ফুসতে ফুসতে আপনমনেই বললো “ এক নম্বরের বেইমান। বন্ধুর নামে কলঙ্ক। মাকে বলার কি দরকার ছিল ! নিজে বাঁচার জন্য মাকে বলে দিল । এরপর আর একটাও কথা বলি কি না দেখ ! বন্ধুত্বই রাখবো না। „
আরও নানা ধরনের কথা বলে সুচিকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে নিচে নেমে পার্কে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার হয়ে আসলে সোসাইটির গেট দিয়ে বাবার জাগুয়ার গাড়িটা ঢুকতে দেখলো । এদিকে আকাশ টেস্টে যা খারাপ রেজাল্ট করেছিল তার থেকেও খারাপ রেজাল্ট বিপ্লব বিচ্ছু মাধ্যমিকে করলো। তাই তার ঘর বাইরে বার হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
তারও কিছুক্ষণ পর চুপচাপ উপরে উঠে দেখলো ফ্ল্যাটের দরজা ভেজানো আছে। আকাশ দরজাটা হাল্কা করে ঢেলে ভিতরে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে দরজার ছিটকিনি দিয়ে দিল । ছিটকিনি দিতে গিয়ে ডান তর্জনীর উপর চোখ পড়তেই সুচির উপর রাগ আরও বেড়ে গেল। ডান হাতের তর্জনীতে সুচির পছন্দ করে দেওয়া আংটিটা এখনও আছে। আংটিটার উপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রাগে ফুসতে ফুসতে তর্জনী থেকে আংটিটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের এক কোনায়। আংটিটা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পাশেই রাখা পড়ার টেবিলের উপর পড়লো।
রাতে শুভাশীষ বাবু খেতে বসলে দেখলেন শুধু তার জন্যেই খাবার বাড়া আছে। ভুরু কুঁচকে স্ত্রী কে জিজ্ঞাসা করলেন “ তোমরা খাবে না ? „
খুব রুক্ষ স্বরে আকাশের মা বললেন “ না । খিদে নেই । „
আকাশের বাবা স্ত্রীর কন্ঠ শুনেই বুঝলেন যে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে “ কিছু হয়েছে ? আকাশ কিছু করেছে ? „
আকাশের কথা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে স্নেহা দেবী বললেন “ তোমার অতো জেনে কি হবে ? বাড়ির কোন খবরটা রাখো তুমি ! কি হচ্ছে কি না হচ্ছে কোনও দিনও জানতে চেয়েছো ? তুমি খেয়ে নাও। আমার খিদে নেই । „
শুভাশীষ বাবু আর কথা বাড়ালেন না। কথা বাড়ালে আরও অনেক কথা হয়তো শুনতে হবে তাই তিনি একাই খেতে শুরু করলেন। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর তিনি খাটে শুয়ে পড়তেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন। এর কিছুক্ষণ পর স্নেহা দেবী আকাশের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন “ এই খেয়ে নে । „
ভিতর থেকে আকাশ রাগী কন্ঠে বলে উঠলো “ আমার খিদে নেই । „
এবার স্নেহা শান্ত কোমল স্বরে বললেন “ মার না খেতে চাইলে চুপচাপ এসে খেয়ে নে । „
মারের ভয়েতে নাকি মায়ের এই কোমল মমতার স্বরের জন্য আকাশ খাট থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লো। আকাশ বসলে স্নেহা দেবী আকাশের জন্য খাবার বেড়ে দিলেন। শুধু একজনের খাবার দেখে আকাশ বললো “ তুমি খাবে না । „
“ না , আমার খিদে নেই । „
“ তাহলে আমারও খিদে নেই । „ আকাশ কথাটা বলে হাত দুটো ভাজ করে এক দৃষ্টিতে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশের কথা শুনে স্নেহা দেবী কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিজের জন্যেও খাবার বাড়তে শুরু করলেন । খাওয়া হয়ে গেলে আকাশের মা আকাশকে সোফায় বসিয়ে গালে ডেটল লাগিয়ে দিলেন ।
এর কিছুদিন পর স্নেহা দেবী আকাশ কে ফোন দিয়ে দিলেন। ফোন হাতে পেয়েও সুচির উপর আকাশের রাগ বিন্দুমাত্র কমলো না। দু সপ্তাহ কেটে গেল কিন্তু আকাশ সুচির সাথে একবারও কথা বলে নি। মুখের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত
এই কয় দিনে সুচির অনুশোচনা হলো যে ‘ কাকিকে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ‚
দুই সপ্তাহ পর সুমির অফিসে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি পড়লো। তাই সবাই মিলে ঠিক করা হলো শুক্রবার রাতের ট্রেনে পুরী ভুবনেশ্বর গিয়ে ঘুরে আবার বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে ফিরবে। তাহলে শুক্রবার আবার সুমি আবার অফিস যেতে পারবে। সমরেশ বাবুও মেয়েদের মন রাখার জন্য অফিসে ছুটির আর্জি দিলেন। ছুটি মঞ্জুর ও হয়ে গেল।
শুক্রবার সুচি একটু তাড়াতাড়িই কলেজ থেকে ফিরলো। সোসাইটিতে ঢুকে দেখলো সোসাইটির মাঠে দেখলো আকাশ খেলছে। কিছুক্ষণ সুচি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আকাশও সুচির দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার ফিল্ডিংয়ে মনোনিবেশ করলো।
আকাশের এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় সুচির মনটা হুহু করে উঠলো। ফ্ল্যাটে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলো একটা ছোট পাত্রে প্রায় পনের কুড়িটা বকফুল আছে। আর পাশেই সুচেতা দেবী দাঁড়িয়ে বেসন গুলছে । বকফুল দেখেই সুচির চোখ চকচক করে উঠলো “ এখন বকফুলের বড়া/পকোড়া করছো ! যেতে দেরি হবে না ? „
“ তোর বাবা আসার আগে আমার হয়ে যাবে। আর এখন কিছু না বানালে তো ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকবি । „
মোট ছয় দিনের জন্য যাচ্ছে পুরী। এই পুরো সময়ে আকাশের সাথে একবারও কথা হবে না। এই কিছুক্ষণ আগে আকাশ যেভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিল সেটা ভেবে সুচি ভাবলো ‘ ওর রাগ ভাঙানো দরকার। ‚ কথাটা ভেবেই মায়ের সাহায্য করতে শুরু করলো সুচি।
বকফুলের বড়া/পকোড়া বানানো হয়ে গেলে একটা প্লেটে নিজের ভাগের পাঁচটা বড়া/পকোড়া নিয়ে আকাশের ফ্ল্যাটে চলে এলো। আকাশ সবে ফুটবল খেলে বাড়িতে ঢুকে হাত পা ধুয়ে সোফায় এসে বসেছে। সুচি আকাশের পাশে বসে প্লেটটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিল “ এনে । খা । „
আকাশ সুচির দিকে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিমোটের বোতাম টিপে টিভি চালিয়ে দিল । আকাশের অবজ্ঞায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সুচি একটা বড়া/পকোড়া তুলে আকাশের মুখের সামনে ধরে বললো “ রাগ করিস নি। দেখ , তোর জন্য নিজের হাতে বানিয়ে এনেছি । „
সুচির বাড়িয়ে রাখা ডান হাতটা ঠেলে আকাশ রাগে ফুসতে ফুসতে বললো “ মায়ের হাতে মার খাইয়ে এখন বড়া খাইয়ে ঢং করতে এসছিস ? „
সুচিকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য বাঁ হাতে আলতো করে ধরে রাখা প্লেটটা ঠং ঠং আওয়াজ করে মেঝেতে পড়ে গেল আর সব বকফুল এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। এই হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য দুজনেই প্রস্তুত ছিল না। সুচি কিছুক্ষণ নিজের হাতে বানানো বড়া গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে প্লেটটা তুলে নিজের ঘরে চলে এলো।
ঘরে যেতে যেতে রাগে ফুসতে ফুসতে সুচি বললো “ এক নম্বরের জানোয়ার তৈরি হচ্ছে। কিছুদিন পর তো চিড়িয়াখানায় যেভাবে লোকে টিকিট কেটে পশু দেখতে যায় ঠিক সেইভাবে একেও টিকিট কেটে লোকে দেখতে আসবে। „
কিছুক্ষণ পর আকাশ যখন শান্ত হলো তখন নিচে পড়ে থাকা বড়া গুলোর দিকে তাকিয়ে অনুশোচনা হলো ‘ এই প্রথম ও নিজের হাতে কিছু বানিয়ে এনেছিল। এইভাবে ফেলে দেওয়া উচিত হয়নি । ‚
রাতে সুচেতা দেবী ঘর বন্ধ করে স্নেহা দেবীকে বললেন “ এই নাও চাবি। আমরা আসছি। একটু দেখো ঘরটা। „
স্নেহা দেবী হেসে বললেন “ তোমরা নিশ্চিন্তে এসো । আর সাবধানে যেও। „
একটা ট্যাক্সি ধরে সুচি সপরিবারে হাওড়া স্টেশনে পৌছে সেখান থেকে পুরী যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরলো । সকালে পুরী পৌঁছে একটা সুমির বুক করে রাখা হোটেলে চেক ইন করে সমুদ্র তটে চলে এলো সবাই।
আকাশ ঘুম থেকে ওঠার পর মনটা আরও বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো গতকাল সন্ধ্যার ঘটনার জন্য। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ফেসবুক খুলে সুচিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। তিন ঘন্টা পর আবার ফেসবুক খুলে আকাশ দেখলো তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট সুচি একসেপ্ট করেনি । আর প্রোফাইলে সুচি সমুদ্র উপকূলে বালির উপর বসে, দাড়িয়ে, জলে পা ডুবিয়ে, সূর্যের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ফটো ছেড়েছে।ফটো গুলো দেখে আকাশের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। ‘ ওরা পুরী কখন গেল ? ‚ আকাশ সেই সব ফটোতে লাইক দিয়ে একটা কমেন্ট করে দিল —- একবারও বললি না তো পুরী যাচ্ছিস !
কয়েক ঘন্টা পর আবার ফেসবুক খুলে আকাশ দেখলো ঠিক তারই কমেন্টের নিচে জয়শ্রী লিখেছে — বাহ্ সুন্দর দেখাচ্ছে। আর জয়শ্রীর কমেন্টের রিপ্লাইতে সুচি লিখেছে–thank you. কিন্তু আকাশের কমেন্টের কোন রিপ্লাই সুচি দেয়নি । কমেন্টের কোন রিপ্লাই না পেয়ে আকাশ বুঝলো সুচি এখনও রেগে আছে।
পরের দিন সুচি কোনার্কের মন্দিরের কয়েকটা ফটো দিয়েছে। আর কোনার্কের মন্দিরের গায়ে লাগানো পাথরে খোদাই করা বড়ো চাকাটা সুচি ঠেলে ঘোরাতে চাইছে এরকম একটা ফটো দিল। ফটোটার নিচে জয়শ্রী কমেন্ট করেছে — কিরে! ঘুরলো চাকা ?
আকাশ এবার ‘ যদি রেগে গিয়ে কমেন্টের উত্তর দেয় ‚ সেই আশায় রাগানোর জন্য কমেন্ট লিখলো — ওই রথে করেই স্বর্গে চলে যা আর আসতে হবে না এখানে । মা যাতে সন্দেহ না করে তাই মায়ের সামনে সোফায় বসে সারাদিন ফেসবুক খুলে বসে রইলো। এখন স্কুল ছুটি তাই সারাদিন আর কোন ব্যাস্ততা নেই। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে বলে মাও আর বকছেন না, তাই সারাদিন ফোন খুলে পড়ে রইলো আকাশ। বারবার স্ক্রোল করতে লাগলো শুধু একটা রিপ্লাইয়ের আশায়। পরপর সবার কমেন্টের রিপ্লাই সুচি দিল কিন্তু আকাশের কমেন্টের রিপ্লাই দিল না । কলেজের নতুন বন্ধু বান্ধীদের কমেন্টের রিপ্লাই কিন্তু আকাশের কমেন্টের রিপ্লাই সুচি দিল না। সুচির বয়েই গেছে আকাশের মতো জানোয়ারের কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়ার।
পরের দিন puja Done বলে সুচি একটা পোস্ট করলো। এবার আরও একটু রাগানোর জন্য আকাশ লিখলো— এতো পাপ করেছিস যে এই একটা পুজায় কিছু হবে না। তার জন্য যজ্ঞ করতে হবে ।
কিন্তু এটারও কোন রিপ্লাই সুচি দিল না। মোট সাত দিন পুরী ভুবনেশ্বর থেকে চিল্কা হ্রদ দেখে আরও কয়েকটা ফটো আপলোড করলো সুচি। মায়ের সাথে,বাবার সাথে দিদির সাথে ফটো তুলে আপলোড করলো । প্রত্যেকটা ফটোর নিচে আকাশ একটার বেশি বিভিন্ন ধরনের কমেন্ট করে সুচিকে উত্যক্ত করার চেষ্টা করলো শুধুমাত্র একবার রিপ্লাই পাওয়ার আশায়। কিন্তু একটা কমেন্টেরও রিপ্লাই সুচি দিল না। এই কয়দিন আকাশের ঘুম মাথায় উঠেছে। সবাইকে রিপ্লাই করছে কিন্তু শুধু ওর কমেন্টের রিপ্লাই দিচ্ছে না এটা ভেবে ভালো ঘুম হচ্ছে না আর । দিন আর কাটতে চাইছে না যেন !
শুক্রবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে ট্যাক্সি ধরার আগে সুচি স্টেশনের একটা ফটো দিয়ে লিখলো Back to kolkata. লাইনটা পড়েই আকাশের চোখ জ্বলে উঠলো। দেড় ঘন্টা পর সুচেতা দেবী আকাশের মার কাছে থেকে চাবি নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন ।
ঠিক সেই সময় আকাশ এসে লিভিংরুমের সোফায় বসে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার খোলার শব্দ আর সাথে সুমির একটা কথা শুনতে পেল — এবার অফিসের জন্য দৌড়াও আবার সেই বাড়ি-অফিস অফিস-বাড়ি শুরু হয়ে গেল।
এর দশ মিনিট পর আকাশ সোফা থেকে উঠে সুচির ফ্ল্যাটে ঢুকে সুচির ঘরে চলে এলো। তখন দুই বোন গায়ের ওড়না বিছানায় ফেলে ফ্যানের হাওয়া খাচ্ছিল। আকাশ ঢুকেই খাটের উপর বসে থাকা সুচির দিকে তাকিয়ে বললো “ তুই আমার কমেন্টের রিপ্লাই দিস নি কেন ? „
“ অমানুষদের সাথে আমি কথা বলি না । „ আকাশের দিকে না তাকিয়ে ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বার করতে করতে বললো সুচি।
আকাশ বুঝলো সেই বকফুলের জন্য সুচি এখনও রেগে আছে “ আচ্ছা আমি কান ধরে ক্ষমা চাইছি । আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দে । „
তবুও সুচির রাগ কমছে না দেখে আকাশ বললো “ এবার কি উঠবোস করবো! „ সুচিকে নিরুত্তর দেখে আকাশ বললো “ নে কান ধরে ওঠবোস করছি । এবার তো ক্ষমা করে দে । „
তিন বার কান ধরে ওঠবোস করার পর সুচির ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি নিয়ে বললো “ থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না । „ বলে ব্যাগ থেকে একটা জিভে গজার প্যাকেট বার করে আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিল ।
আকাশ বুঝলো যে অভিনয়ে কাজ হয়েছে। ঠোটটা দুই গালে যতোটা ছড়ানো যায় ততোটা ছড়িয়ে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।
আকাশের চলে যাওয়ার পর সুচি সুমির দিকে তাকিয়ে দেখলো সে চেয়ারে বসে একমনে তাদেরকেই দেখছে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সে কি ভাবছে, কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে যে সে কিছু একটা ভাবছে “ কি ভাবছিস ? „
সুমি চেয়ারে বসে ফ্যানের হাওয়া খেতে খেতে এতক্ষণ তার বোন আর আকাশ কেই দেখে যাচ্ছিল। আকাশের ওঠবোস করার সময় সুচির মুখে যে হাসিটা দেখা দিয়েছিল সুমি সেই হাসিটা চিনতে পেরেছিল। মনে মনে বলেছিল — হ্যাঁ এটা সেই হাসি। সেই আকাশের পরিক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে সুচি এই হাসিটাই হাসছিল। এতক্ষণ সেই হাসিটাই লক্ষ্য করে বোনের প্রশ্নের উত্তরে খুব আস্তে শান্ত স্বরে জবাব দিল — “ আমার ভীষণ ভয় করছে । „
“ ভয়! কেন! কিসের ভয় ? „ ভয়ের কথা শুনে সুচি নিজেই ভয় পেয়ে গেল।
কিছু একটা বলতে গিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুমি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো “ নটা বাজতে যায় আর আমি এখনও রেডি হয়নি। ইসস অফিস যেতে দেরি হলে আবার কথা শুনতে হবে। „বলে স্নানঘরে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল।

(৪)
পুরী থেকে আসার দুই দিন পর , সুচি কলেজ থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে , খাটে শুয়ে ফোন ঘাটতে ঘাটতে বিশ্রাম নিতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর কোচিংয়ের জন্য যেতে হবে । সুচি আর সুমির ঘরটা বেশি বড়ো না। ঘরের একদম মাঝখানে তিন জন পাশাপাশি শুয়ে আরামে ঘুমানো যায় এমন একটা পুরনো আমলের সেগুন কাঠের খাট। খাটের ওই পাশে একটা পুরানো আমলের আলনায় দুই বোনের জামাকাপড় রাখা আছে। আলনার ঠিক পাশেই আছে পড়ার টেবিল। আর খাটের এই পাশে একটা আলমারি। আলমারির দরজায় বড়ো কাঁচ লাগানো আছে। আর আলমারির পাশে ছোট একটা টেবিলে মেকআপের জিনিসপত্র। ওটাই ড্রেসিংটেবিল হিসাবে ব্যাবহার করে দুই বোন।
কিছুক্ষণ পর সুমি অফিস থেকে ফিরে এলো। ফ্রেশ হয়ে খাটে বসে বোনকে জিজ্ঞাসা করলো “ দিন কেমন কাটলো ? „
এরকম প্রশ্ন সুমি কখনোই সুচি কে করেনি , তাই সুচি ভুরু কুঁচকে বললো “ তেমন কিছু না। রোজকার মতোই ! „
“ ও । „ বলে ড্রেসিংটেবিলে গিয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করলো ।
এবার সুচি দিদিকে জিজ্ঞাসা করলো “ হঠাৎ এই প্রশ্ন ! কখনো তো জিজ্ঞাসা করিস না ! „
“ না এমনি ! জানতে ইচ্ছা হলো তাই । কেন ! জিজ্ঞাসা করতে পারি না বুঝি ? „
দিদির কথায় সুচির মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল। একমনে দিদিকে দেখতে শুরু করলো সুচি। আজকে যেন একটু বেশিই সময় নিয়ে চুল আঁচড়িয়ে যাচ্ছে “ কি হয়েছে বলতো ? নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে । „
মুখে হাসি নিয়ে সুমি বললো “ কিছু হয়নি। কি আবার হবে ! „
“ না সত্যি বল ! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ! কেউ কি তোকে প্রোপজ করেছে ? „ বলে সুচি খাট থেকে উঠে দিদিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ।
সুমি হেসে উঠে বললো “ প্রোপজ করে নি , তবে ডিনারের জন্য জিজ্ঞাসা করেছে একজন । „
কথাটা শোনার পরেই সুচির উৎসাহ দেখার মতো হয়ে উঠলো “ তুই কি বললি ? „
“ ডিনার তো করাই যায় । তাই হ্যাঁ বললাম। „
সুচি আরো ভালো করে দিদিকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো “ কে ? দেখা একবার জামাইবাবুর ফটো । „
“ এখনই জামাইবাবু বলে দিলি ! আগে ওর চরিত্র দেখবো। ভিতরটা পরিষ্কার কিনা দেখবো , তারপর এগিয়ে যাবো । „ বলে সুমি ফোন থেকে একটা গ্রুপ ফটো বার করে বোনকে দেখিয়ে বললো “ এই যে , এ । আমাদের অফিসেই কাজ করে । কৌশিক হালদার নাম । „
সুচি ঠোট বেকিয়ে বললো “ কালো আর একটু মোটা । „
বোনের কথা শুনে সুমি ঠোটে হাসি নিয়ে বললো “ আমি এমন একজনকে জীবনসঙ্গী বানাতে চাই যে আমাকে সম্মান দিয়ে ভালোবাসবে। ভালোবেসে দয়া করবে না। গায়ের রঙ নিয়ে আমি করবো ? আমিও তো কালো। „
দিদির কথায় সুচি দমে গেল “ ওসব ঠিক আছে । বলছি কালকে একটু সেজেগুজে যাস। এইভাবে যাস না। „
সুমি এবার স্বরটা একটু গম্ভীর করে বললো “ আমার দ্বারা ওটা হবে না। আমি তোর মতো ফর্সা নই , হয়তো তোর মতো সুন্দরও নই । আমি কালো। আর এটাই ওকেও মেনে নিতে হবে , যেমন আমি মেনে নিয়েছি । „
দিদির এই সাহসি চরিত্রটাই তো সুচির ভালো লাগে। সুমি মনে করে ওর সৌন্দর্য হলো ওর ইন্টেলিজেন্স , সৎ নির্ভিক বচনভঙ্গি । এটাই তো সুচির গর্ভ। শুধু সুচির নয় সাথে সুচির মা বাবারও গর্ভ । দিদির মুখে এইসব শুনে সুচি ভালো করে সুমিকে জড়িয়ে ধরে বললো “ আমি সাজিয়ে দেবো তোকে। না করলে আলাদা ঘরে শুবি এবার থেকে । „
বোনের হুমকি শুনে সুমি রাজি না হয়ে পারলো না “ আচ্ছা ঠিক আছে। সাজিয়ে দিস তোর ইচ্ছা মতো। „
এর ঠিক দুই দিন পর সকালে , আকাশের লিভিংরুমে ঢুকে সোফায় বসে থাকা আকাশের চোখের সামনে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নাচিয়ে সুচি বললো “ যাবি ঘুরতে ? „
আকাশ মজা করে বললো “ তোর বিশ্বাস নেই ! ফেলে দিবি । „
“ তোর কি মনে হয় ! আমি এটা ঘুষ দিয়ে বানিয়েছি ? „
“ তোর বিশ্বাস নেই। করতেই পারিস । „
কিছুক্ষণ আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সুচি বললো “ একবার চল আমার সাথে ! তাহলেই বুঝতে পারবি আমি ঘুষ দিয়ে পেয়েছি নাকি নিজের যোগ্যতায় । „ তারপর মিচকি হেসে বললো “ সত্যি কথাটা বলা না যে একটা মেয়ের পিছনে বসতে লজ্জা পাচ্ছিস । „
এই শেষ কথাটায় আকাশের ইগোতে লাগলো “ ঠিক আছে দেখবো কেমন ভালো চালাস ! এখন যাবি নাকি ? „
“ এখন কেন হাঁদারাম ! বিকালে যাবো । বিকালে রেডি হয়ে থাকিস। „ কথাটা বলে সুচি নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল।
বিকাল হতেই সুচি আকাশের ঘরে হাজির হলো। খোলা চুল , পড়নে আছে তার চিরাচরিত সালোয়ার আর লেগিন্স , কাঁধে লম্বা স্ট্রাপের ছোট একটা হ্যান্ড ব্যাগ আর হাতে একটা হেলমেট। ঘরে ঢুকেই দেখলো আকাশ তার আপেলের ল্যাপটপে কোন একটা সিনেমা দেখছে “ চল । আর দেখতে হবে না । এসে দেখবি। এখন না বেরলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে । „
আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কোথায় যাবি ? „
“ এখনও ঠিক করিনি । আশেপাশেই কোথাও যাই চল । „
আকাশ সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ shutdown করে গেঞ্জির উপর একটা কালো শার্ট আর একটা জিন্স পড়ে চুল আঁচড়িয়ে ঘরের বাইরে চলে এলো। এতো সেজেগুজে দুজনকে বার হতে দেখে স্নেহা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন “ কোথায় চললি তোরা ? „
আকাশ মায়ের কথায় ইয়ার্কি করে বললো “ আজকে লাইসেন্স পেয়েছে। তাই কেমন চালায় সেটাই দেখাতে চাইছে । „
ছেলের কথায় স্নেহা দেবী হাসতে হাসতে সুচিকে বললেন “ সাবধানে চালাবি আর সন্ধ্যার আগে ফিরবি । „
কাকির কথায় সুচি বললো “ এই আশেপাশেই যাবো । বেশিক্ষণ লাগবে না । „
তারপর দুজনেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। পিছন থেকে দুজনেই শুনলো স্নেহা দেবী “ দুগ্গা দুগ্গা „ বললেন ।
নিচে নেমে বিল্ডিংয়ের সামনেই দাড় করিয়ে রাখা স্কুটির উপর উঠে সুচি হেলমেট পড়ে নিল। স্কুটি স্টার্ট দিলে আকাশ পিছনে বসে পড়লো “ কোথায় যাবি ? „
একটু ভেবে নিয়ে সুচি বললো “ গঙ্গায় যাবি ? বিকালে খুব সুন্দর মিষ্টি হাওয়া বয় ওখানে । „
সুচির প্রস্তাবে আকাশ বললো “ গঙ্গার ঘাট ! তাহলে প্রিন্সেপ ঘাট চল । „
গন্তব্য স্থান ঠিক হতেই সুচি স্কুটি চালিয়ে দিল। রাস্তা ফাকা এখন , তাই কুড়ি পচিশ মিনিটেই দুজনে প্রিন্সেপ ঘাপ পৌছে গেল। প্রিন্সেপ ঘাট পৌঁছে একটা ফাকা জায়গা দেখে সুচি স্কুটি স্ট্যান্ড করে দিল “ কেমন চালাই বল ? „
একজন পরিদর্শক এর মতো করে সুচিকে নাম্বার দেওয়ার ভঙ্গি করে আকাশ বললো “ দুটো সিগন্যালে দেরিতে ব্রেক চেপেছিস আর তিনটে গাড্ডায় স্পিডে চালিয়েছিস বাকি ঠিক আছে । „
কি বলবে এই খচ্চরটাকে সেটাই ভেবে পেল না সুচি ! তাই প্রসঙ্গ পাল্টে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ খাবি কিছু ? „
“ হ্যাঁ , তবে আগে একটু বসে হাওয়া খেয়ে নিই তারপর খাবার খাবো । „
তারপর দুজনেই গঙ্গার ঘাটে এসে বসলো। দুপুর পড়ে গিয়ে বিকাল হয়ে এসছে আর গঙ্গার হাওয়া শীতল হয়ে এসছে। শীতল হাওয়া দুজনের মুখের উপর পড়তেই দুজনের মনকে ঠান্ডা করে দিল । তাকিয়ে দেখলো মাঝ গঙ্গায় একটা নৌকায় একটা মেয়ে বসে আছে। আর তার বয়ফ্রেন্ড ডিএসএলআর দিয়ে ফটো তুলে দিচ্ছে। আরও কয়েকটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে এদিক ওদিক। আর সেইসব নৌকার মাঝিরা দাড় টেনে যাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রমে। আর গঙ্গার ওইপাড়ের আকাশটা কমলা রঙ ধরে নিয়েছে। সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। এইসব দেখতে দেখতে দুজনের সময় কাটতে লাগলো। প্রায় আধঘন্টা কেটে যাওয়া পর সুচি বললো “ ওঠ এবার । „
আকাশ পকেট থেকে ফোন বার করে দেখলে আধঘন্টা হতে যায় “ চল ঝালমুড়ি খাই । „
দুজনেই ঝালমুড়ির ঠেলা গাড়ির সামনে এলো। সুচি বললো “ দু জায়গায় দাও । ঝাল একটু বেশি করে দেবে । „
ঝালমুড়ি নিয়ে দুজনে প্রিন্সেপ ঘাটের বিখ্যাত স্ট্রাকচারের ভিতর এসে একটা বেঞ্চের কাছে এলো । বেঞ্চের বেশির ভাগ জায়গায় পাখিরা হেগে রেখেছে। একটা ভালো জায়গা দেখে দুজনে গায়গায়ে বসে ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। হঠাৎ আকাশ ঝালমুড়ি খাওয়া বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে কিছু দূরের একটা বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুচিও সেদিকে তাকাতে দেখলো একটা বেঞ্চের উপর একটা ছেলে বসে আছে। আর ছেলেটার কোলের উপর একটা মেয়ে বসে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না দুজনের। কারন মেয়েটার চুলে দুজনের মাথাটা ঢাকা আছে। বোঝাই যাচ্ছে দুজনে কিস করছে। আকাশ সেই দৃশ্য এক দৃষ্টিতে উপভোগ করছে দেখে সুচি রেগে গিয়ে ঝাঝিয়ে উঠে বললো “ অসভ্য। তোর মতো লম্পটের সাথে দেখছি কোথাও যাওয়া যাবে না । „
আকাশ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো “ আমি কি করলাম ? ওরা খুল্লাম খুল্লা করছে তাতে দোষ নেই আর আমি দেখলেই দোষ ? আমিই অসভ্য ? „
“ তোকে নিয়ে বার হওয়াই আমার দোষ হয়েছে । „ কথাটা বলে রেগে লম্বা লম্বা পা ফেলে সুচি যেখানে স্কুটি স্ট্যান্ড করে রাখা আছে সেখানে হাটা দিল। আকাশও সঙ্গে সঙ্গে সুচির পিছন নিল। সুচি স্কুটি স্ট্রার্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ লাফিয়ে পিছনের সিটে বসে পড়লো। সুচি একটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্কুটি চালিয়ে দিল।
আসার সময় যে রাস্তা অতিক্রম করতে কুড়ি পচিশ মিনিট লেগেছিল এখন অফিস আওয়ার শেষ হতে সেই রাস্তা দিয়ে আসতে এক ঘন্টা লেগে গেল। সোসাইটিতে পৌছনোর আগেই দুজনের মুখ গাড়ির নোংরা ধোয়ায় কালো হয়ে চ্যাটচ্যাটে হয়ে উঠলো। সোসাইটি পৌছে বিল্ডিংয়ের নিচে স্কুটি দাড় করাতেই আকাশ নেমে উপরে উঠে গেল। সুচি স্কুটি বন্ধ করে স্ট্যান্ড করতেই দেখলো বাবা অফিস থেকে ফিরে এসছে। সুচি বাবার অফিস ব্যাগটা নিয়ে নিল। দুজনেই উপরে উঠতে উঠতে সিড়িতে সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন “ কোথায় গেছিলি দুজনে ? „
“ ওই প্রিন্সেপ ঘাটে গেছিলাম ঘুরতে । „
মেয়ের মুখে সব শুনে সমরেশ বাবু চুপ মেরে গেলেন। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে খবর দেখতে দেখতে চা খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ডাকলেন “ সুমি । „
নিজের ঘর থেকে সুমি বললো “ হ্যাঁ বাবা আসছি । „
কিছুক্ষণ পর সুমি এসে ঘরের চৌকাঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কিছু বলবে বাবা ? „
সুমির বাবা খাটের খালি অংশ দেখিয়ে বললেন “ বস । „
সুমি গিয়ে বাবার পাশে বসতে সমরেশ বাবু বললেন “ সুচি তো তোর সাথে সব কথা শেয়ার করে । তোর কথা শোনেও। তুই একটু বোঝা ওকে ….
এতোটা বলে সুচির বাবা থেমে গেলেন। সুমি বুঝতে পারলো যে বাবা কিছু একটা বলতে গিয়ে সঙ্কোচে আর বলতে পারছে না “ কি বোঝাবো বাবা ? „
কিছুক্ষন পর সমরেশ বাবু আবার বলতে শুরু করলেন “ আমি ওকে সেই ছোট থেকে বোঝাচ্ছি কিন্তু ও বুঝতে চাইছে না ! তোর বোন যে পরিবারের সাথে ঘোরে ! তারা পরিবার , সম্পর্ক , ভালোবাসার থেকে অর্থ , যশ , সম্পত্তিকে এগিয়ে রাখে । ওদের কাছে সম্পর্কের কোন মূল্য নেই । আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ আমাদের সাথে ওদের যায় না। কোন ধরনের সম্পর্ক হয় না ওদের সাথে আমাদের……
কথাগুলো বলতে বলতে সুমির বাবা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এতক্ষণে সুমি বুঝলো বাবা কি বলতে চাইছে। ঠিক এই ভয়টাই তো দুদিন আগে পেয়েছিল সে “ তুমি শান্ত হও বাবা। আমি বোনকে বুঝিয়ে বলবো । ও ঠিক বুঝবে । „
“ বুঝলে ভালো। না হলে …… আর বলতে পারলেন না সুচির বাবা ।
বাবাকে শান্ত করে সুমি নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে দেখলো সুচি খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কানে হেডফোন দিয়ে ফোন ঘাটছে। কিছুক্ষণ বোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুমি। কিভাবে বলবে ? কিভাবে বোঝাবে ওকে সেটাই ভেবে পেল না সুমি। কিছুক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিশ্বাস ছেড়ে সুমি বললো “ আকাশ কোন স্ট্রিম নিয়ে ভর্তি হবে কিছু বলেছে তোকে ? „
সুচি অবজ্ঞার সুরে বললো “ না । ওর ওইসবে হুশ নেই । „
সুচির কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসে পড়লো “ কার হুশ নেই ? „
“ তোর হুশ নেই ! কোন স্ট্রিম নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হবি সেটা ভেবেছিস ? „ সুচির গলার স্বরে আকাশের জন্য ওর চিন্তা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেল।
আকাশ ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বললো “ ওটা নিয়ে আর ভাবনার কি আছে ! সাইন্স নিয়ে ভর্তি হবো । „
আকাশের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে সুমি আর চুপ থাকতে পারলো না “ এখন যে স্ট্রিম নিয়ে ভর্তি হবি , সেই স্ট্রিমের বিষয় নিয়েই কিন্তু কলেজে পড়তে পারবি । তাই ঠান্ডা মাথায় ভাব কলেজে কি নিয়ে পড়বি । „
আকাশ তার ডোন্ট কেয়ার ভাবটা বজায় রেখে বললো “ আমার তো জন্মের পরেই সব ঠিক করে দেওয়া আছে। কলেজ শেষ করে বাবার ব্যাবসা দেখবো । তাই MBA নিয়েই পড়বো । „
আকাশের কথা শুনে সুমি বুঝলো যে সত্যি আকাশের কাছে আর কোন অপশন নেই “ তাহলে যে কোন স্ট্রিম নিয়েই পড় । কোন অসুবিধা হবে না। „
সুমির কথা শেষ হতেই আকাশ সুচির দিকে ফিরে আফসোস করে বললো “ তোর জন্য আজ ফুচকা খাওয়া হলো না ! „
কয়েক সপ্তাহ পরে আকাশ একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়ে গেল। আকাশকে কোন স্কুলে ভর্তি করা যায় সেই প্রসঙ্গ উঠলে আকাশের বাবা বললেন “ এখন আর সরকারি স্কুলে তেমন পড়া হয়না। ইংলিশ মিডিয়াম-ই ভালো । „
আকাশের মা ব্যাঙ্গ করে বললেন “ সারাজীবন বাংলা মিডিয়ামে পড়ে এখন শেষ বেলা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে ! বুদ্ধি কোথায় রেখে এসছো তুমি ? বোর্ড আলাদা , পড়াশোনার ধরন আলাদা , কিভাবে করবে ও ? „
স্ত্রীর ব্যাঙ্গ গায়ে মেখে আকাশের বাবা বললেন “ এই জন্যেই আমি ক্লাস ফাইভে ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হতে বলেছিলাম । তোমার ছেলেই জেদ ধরেছিল সুচির স্কুলে পড়বে । আর মাও ওর জেদে সায় দিয়েছিল । „
মায়ের কথা উঠতে স্নেহা দেবী রেগে গেলেন “ ওওওও । এখন মায়ের দোষ হয়ে গেল …….
ঝগড়া আরও কিছুক্ষণ চললো কিন্তু আকাশ আর শুনলো না ।
কয়েক দিন পরেই কাধের এক দিকে ব্যাগ ঝুলিয়ে , মাথায় জেল মেখে চুল ব্যাক ব্রাশ করে , পারফিউম মেখে স্কুলে চলে গেল। দুই দিন পর সুচি কলেজ যেতে গিয়ে আকাশের সাথে দেখা হলো। আকাশের রুপ লক্ষ্য করে সুচি বললো “ এতো সেজেগুজে স্কুলে পড়তে যাচ্ছিস ! নাকি কলেজে আড্ডা দিতে ? „
আকাশ হাটতে হাটতে বললো “ মায়ের মতো কথা বলিস না তো ! এখন সবাই এইভাবেই স্কুলে যায় । „
কলেজ যাওয়ার তাড়াহুড়োতে আর কথা এগোলে না , কিন্তু সারাদিন সুচির মনটা খচখচ করতে লাগলো ‘ নিশ্চয়ই মেয়ে বন্ধু বানিয়েছে অনেক । স্কুলে যাওয়ার নাম করে নিশ্চয়ই তাদের সাথেই ফূর্তি করছে । ‚ সুচি এইসব ভাবতে লাগলো কলেজে বসে ।
বিকালে একেবারে কোচিং করে বাড়ি ফিরলো সুচি। এসে দেখলো সুমি চলে এসছে। ফ্রেশ হয়ে খাটে শুয়ে ফেসবুক খুলে আকাশের ফ্রেন্ডলিস্ট দেখতে বসলো। বেশ কয়েকটা মেয়ের প্রোফাইল দেখলো। সদ্য ফ্রেন্ড হয়েছে। আর সবার বায়োতে আকাশের স্কুলের নাম লেখা আছে। মানে আকাশের স্কুলেই পড়ে এই মেয়েগুলো। আর থাকতে পারলো না সুচি। দিদিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলো “ আকাশের অবস্থা দেখেছিস ! এমন সেজেগুজে স্কুলে যায় যেন স্কুল না কোন ম্যাগাজিনের ফটোশুটে যাচ্ছে ! আর তিন দিনেই কতোগুলো বান্ধবী বানিয়েছে দেখ ! „
কয়েকদিন আগে সমরেশ বাবু সুমিকে বোনকে বোঝানোর জন্য যে কথাগুলো বলেছিল , আজ বোনের কথা শুনতে শুনতে ওর উৎসাহ আর হাল্কা ঈর্ষা দেখে সেই কথা গুলোই সুমির মাথাতে বারবার আঘাত করতে শুরু করলো। সেদিন কথাগুলো না বলতে পারলেও আজকে যেন সুচি নিজেই সুমিকে কথাটা বলার সুযোগ করে দিল “ তুই কি ওকে ভালোবাসিস ? „
দিদির প্রশ্ন শুনে প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুমির দিকে তাকিয়ে থাকার পর হো হো করে সুচির অট্টহাস্যের শব্দে ঘরটা কেঁপে উঠলো “ কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছিস ! „
বোনের অট্টহাসিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে গম্ভীর স্বরেই সুমি জিজ্ঞাসা করলো “ তাহলে ওকে স্টক করছিস কেন ? আর ওর সবকিছুতে ওকে এতো কন্ট্রোল করিস কেন ? „
“ আমি কোথায় ওকে স্টক করছি ! আমিতো শুধু…… আর কিছু বলতে পারলো না সুচি । কারন আর কিছু নেই বলার মত ।
বোনের হঠাৎ চুপ করে যাওয়া দেখে সুমি এবার খাটের উপর এসে সুচির পাশে বসলো “ তিন চারদিন আগে বাবা আমাকে ডেকে তোকে বোঝাতে বলেছিল । কি বোঝাতে বলেছিল জানিস ? „
সুমি নিজেই প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিতে শুরু করলো “ বলেছিল তোকে ছোটবেলা থেকে বোঝাচ্ছে যে ওই পরিবারের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ না হতে । কিন্তু তুই শুনিস নি। ওই পরিবারের লোক সম্পর্ক , ভালোবাসা , পরিবারের থেকে টাকা , যশ আর খ্যাতিকে বেশি প্রায়োরিটি দেয়। ওদের সাথে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের কোন ধরনের সম্পর্ক হয় না। তুই কিন্তু আর বাচ্চা না ! কলেজে পড়িস। ম্যাচিউর হয়ে গেছিস । তাই বলছি তুই কি ওকে ভালোবাসিস ? „
সুচি এবার একটু জোড় করে মুখে হাসি এনে বললো “ বাজে কথা বলিস না। কাকি মোটেও ওরকম না । আর আমি কেন ওই ছ্যাচড়া ছোট লোকটাকে ভালোবাসতে যাবো । ওকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না । এক নম্বরের জন্তু । „
বোনের কথা শুনে সুমি বললো “ তুই আমাকে মিথ্যা বলছিস ঠিক আছে কিন্তু নিজেকে তো সত্যিটা বল । „
সুচি এবার রেগে গিয়ে বললো “ সত্যি একটাই , তুই বাজে বকছিস । „ বলে খাট থেকে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল ।
এইভাবে হঠাৎ এরকম একটা কথা উঠে আসবে সেটা সুচি ভাবেনি। হয়তো জীবনের সবথেকে বড়ো সত্যি কথাটা এইভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করবে সেটা সুচির মন ভাবেনি। মনের সবথেকে প্রিয় ও ভালোলাগার বিষয় নিয়ে এই ভাবে মুখোমুখি সম্মুখীন হয়ে সুচি এখন অপ্রস্তুত। তাই অপ্রস্তুত হয়ে একটাই প্রশ্ন বুকের মধ্যে নিয়ে লিভিংরুমের সোফায় গিয়ে বসলো সুচি। বারবার একটা কথা নিজেকে বলতে লাগলো , নিজের মনকে বোঝাতে লাগলো ‘ এরকম কোন ব্যাপার নেই। আকাশ আমার শুধু বন্ধু। ওর সাথে ঘুরতে ভালো লাগে । কথা বলতে ভালো লাগে । একসাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে । ব্যাস এর বেশি কিছু না। ‚ কিন্তু সুচির মন বারবার বলতে লাগলো ‘ তুই মিথ্যা বলছিস । ‚
পরবর্তী কয়েকটা দিন মাথার মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো । সুমির করা প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু । এই মন আর মাথার দ্বন্দ্বে সুচি খিটখেট আর চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গেল। গালে গর্ত হয়ে টোল পড়ে সেই হাসিটার জৌলুস কোথাও যেন হারিয়ে গেল। আগের মতো হুটহাট আকাশের ঘরে এমনকি আকাশদের ফ্ল্যাটে যাওয়া বন্ধ করে দিল। বাবা মা মনে করলেন যে এটা হয়তো পড়ার চাপে হচ্ছে। আকাশ সুচির এই পরিবর্তনে খুব খুশি হলো। আর কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না , কোনকিছুতে বাঁধা আসে না।
আরও কয়েক সপ্তাহ পর পূজা শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছরের মতো আকাশের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো সুচি। নিজেকে এতো বোঝানোর পরেও কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করলো সুচি। সেই প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবে আর আকাশের সাথে মিশতে দিচ্ছে না। পূজা শেষ হতেই একদিন রাতে আকাশ এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই সুমি কে উদ্দেশ্য করে বললো “ তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট রাখতে হবে সুমিদি । „
সুমি আকাশের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। ভুরু কুঁচকে বললো “ রিকোয়েস্ট ! „
“ আমাকে পড়াতে হবে । „
সুমি মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বললো “ না ! না ! একদম না । আমার সময় নেই । আমাকে রেহাই দে । „
আকাশ করুন সুরে বললো “ প্লিজ , প্লিজ , এরকম করো না। দেখো ! কোচিংয়ে কোন পড়া হয়না , শুধু নোটস দিয়ে খালাস । এই কয় মাসে একটাও চ্যাপ্টার বুঝতে পারিনি । „
“ তাহলে অন্য টিচার দেখ । „
আকাশ গলায় সেই করুন সুরটা বজায় রেখে বললো “ সব টিচারই এরকম করছে । ফিজিক্স এর টিচার 1200 নিচ্ছে , বাংলা আর ইংলিশের টিচার 900 করে নিচ্ছে , ম্যাথ আর কেমিস্ট্রির টিচার ও 1200 নিচ্ছে । কিন্তু বোঝানোর বেলায় নোটস দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে । প্লিজ তুমি এরকম করো না। প্রতিদিন পড়াতে হবে না । মাঝে মাঝে যে চ্যাপ্টার বুঝতে পারবো না , সেটাই বুঝিয়ে দেবে। একমাত্র তুমিই ভরসা । „
নাছোড়বান্দা আকাশের কথা শুনে সুমি বললো “ ঠিক আছে। তবে কয়েকটা শর্ত আছে ! „
সুমির রাজি হওয়াতে আকাশ খুব খুশি হলো। চোখে মুখে খুশি ফুটিয়ে তুলে, ঠোটে হাসি নিয়ে বললো “ সব শর্তে রাজি । „
আকাশের অবস্থা দেখে সুমি না হেসে পারলো না “ আগে শর্ত গুলো তো শোন । „
“ বলো । „
সুমি কিছুক্ষণ ভেবে নিজের শর্ত গুলো বলতে শুরু করলো “ আমি কোন ফিজ নেবো না । মাঝে মাঝেই রাজ্যের নানা প্রান্তে যেতে হয় তাই কোন রুটিন মেনে পড়াতে পারবো না। আর কাউকে বলতে পারবিনা যে আমি তোকে পড়াচ্ছি । „
আকাশ সম্মতিসূচক একটা মাথা নেড়ে বললো “ ok. „
এখন সুচি সবকিছু ভুলে আবার আকাশের সাথে মিশতে শুরু করেছে । নিজেকে বুঝিয়েছে বেস্টফ্রেন্ড ছাড়া কিছু না । পরের বছরের শুরুতেই কলেজের ফাংশনের জন্য সুচি পার্লারে যাবে ঠিক করলো। দুপুরের দিকে পার্লার একটু ফাঁকা থাকে তাই দুপুরে আকাশের ঘরে এসে খাটের উপর উল্টে পড়ে থাকা আকাশকে টেনে তুলে বললো “ চল আমার সাথে পার্লারে । „
দুপুরবেলা একি হাঙ্গামা আবার “ আমি পার্লারে যাবো কেন ? „
সুচি ভুরু নাচিয়ে বললো “ আমি একা একা যাবো না তাই । „
সুচির আবার আগের স্বভাব ফিরে পেতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই সময়টা আকাশের জীবনে ছিল স্বাধীনতা। মুক্তো সে। কিন্তু হঠাৎ আবার পুরানো সুচিকে ফিরে পেয়ে আকাশ কোথাও যেন খুশি হলো। স্বাভাবিক জীবনের মজাই আলাদা। তাই সুচি যখন টেনে খাট থেকে তাকে নামালো তখন আবার সেই আগের মতো বিরক্তি মিশিয়ে আকাশ বললো “ প্যান্টটা তো পড়তে দে । নাকি হাফ প্যান্টে যাবো ? „
“ পড়ে নে । „ বলে সুচি খাটের উপরেই বসে পড়লো।
আকাশ দিদিমার ব্যাবহার করা পুরানো আমলের আলনা থেকে একটা ফুল প্যান্ট পড়ে , বেল্ট পড়ে নিতেই সুচি আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পনেরো মিনিট মতো স্কুটি চালিয়ে একটা ভালো ইউনিসেক্স পার্লারের সামনে স্কুটিটাকে দাড় করালো সুচি। এখানে ছেলেদের জন্য ওয়েটিং রুমে বসার বন্দোবস্ত করা আছে। ভিতরে ঢুকে ওয়েটিং রুমে বসে পড়লো দুজনে । আকাশ সুচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কতক্ষণ লাগবে ? „
“ আধঘন্টা মতো । বেশি না । „
দুই মিনিট পরেই সুচি উঠে চলে গেল। এতক্ষণ পর আকাশ খেয়াল করলো ছোট্ট ওয়েটিং রুমে আরও একজন ছেলে বসে আছে । বয়স তেইশ চব্বিশ হবে। একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো “ এই প্রথম ? „
আকাশ প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আকাশের মুখের ভাব বুঝতে পেরে ছেলেটা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলো “ গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এই প্রথম পার্লারে এলে ? „
আকাশ বুঝলো যে ছেলেটা তাকে আর সুচিকে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভাবছে । আর এমনিতেও আকাশের উচ্চতা আর মুখের কঠিনতা দেখে অনেকেই তার বয়স বুঝতে পারে না। ক্লাসের বন্ধুরা এমনকি টিচাররাও কয়েকবার বুঝতে পারে নি আকাশের বয়স। আকাশ এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে “ হ্যাঁ এই প্রথম। জোর করে ধরে এনেছে । „
ছেলেটা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো “ দেখে বোঝা যাচ্ছে । এখন বসে থাকো কয়েক ঘন্টা । „
আকাশ ছেলেটার মুখে সময় শুনে আকাশ থেকে পড়লো “ কয়েক ঘন্টা ! „
“ আমি তো দেড় ঘন্টা হলো বসে আছি । তুমি চাইলে ম্যাগাজিন পড়তে পারো। সময় কাটবে । „
আকাশ উঠে ছেলেটার পাশ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল । ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন চুলের স্টাইল দেখতে লাগলো। বিভিন্ন পোজে মডেলদের ফটো আছে। তারপর ফোন বার করে গেম খেলতে শুরু করলো। গড়ানোর ব্যাবস্থা থাকলে একটু গড়িয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেই ব্যাবস্থা নেই দেখে আকাশ আবার ম্যাগাজিন তুলে ফটো গুলো দেখতে লাগলো । ঠিক তখনই সুচি সামনে এসে বললো “ তোকে চাপদাড়িতে ভালো মানাবে । „
আকাশ মাথা তুলে দেখলো সুচি দাড়িয়ে আছে। সুচির কথাটা শুনে আকাশ ম্যাগাজিনে দেখলো একটা মডেলের চাপ দাড়ির দিকেই ইঙ্গিত করছে সুচি। ফটোটা দেখে , ম্যাগাজিন টা রেখে , পার্লারের বাইরে চলে এলো। সুচিত্রা বাইরে এসে স্কুটিটাকে ঠেলে রাস্তায় আনতে লাগলো। তখন আকাশ মজা করে বললো “ ভিতরে যে দাদাটা বসে আছে , সে কি ভাবছিল জানিস ! আমাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ভাবছিল। „
কথাটা শুনেই সুচির বুকটা ধড়াস করে উঠলো। সুচির মনে হতে লাগলো যতো দ্রুত সম্ভব এখান থেকে যাওয়া দরকার । সঙ্গে সঙ্গে স্কুটিতে বসে পড়লো সুচি । আকাশ হাসতে হাসতে সুচির পিছনে বসে পড়লো “ কি করালি ? „
নিচু স্বরে সুচি বললো “ বেশি কিছু না । শুধু ফেসিয়াল আর ভুরু ফিলাপ করালাম । „
“ এদিকে ঘোর । „
সুচি পিছন দিকে মুখটা ঘোরাতেই আকাশ সুচির মুখের উপর মুখটা এনে সুচির ভুরু দেখতে শুরু করলো। আকাশের নাকের গরম নিশ্বাস সুচি নিজের মুখের উপর অনুভব করতে শুরু করলো। আকাশের ঠোটটা আর একটু দুরে আছে। সুচির হৃদপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড ভুরু দেখে আকাশ বললো “ হ্যাঁ আগের থেকে একটু বেশি কালো দেখাচ্ছে । „
সুচি সঙ্গে সঙ্গে সামনে মুখ ঘুরিয়ে আনলো। কেউ একজন সুচির ভিতর থেকে বলতে শুরু করলো “ তুই এই ছেলেটাকে ভালোবাসিস। „ আবার সেই মনের দ্বন্দ্ব শুরু হতেই সুচি স্কুটিটাকে স্পিডে চালিয়ে দিল।
এতদিনে অনেক কষ্টে সুচি নিজেকে বুঝিয়েছে । কিন্তু এখন নিজেকে যতো বোঝাচ্ছে ততো যেন কষ্ট বাড়ছে । ওই প্রশ্নটা আর নিজের ভেতর থেকে আসা উত্তরটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। বিকালে কলেজ ফাংশনে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা নাচ গান করে নটার আগে বাড়ি ফিরলো সুচি। এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে।
পরবর্তী কয়েক মাস মাঝেমাঝে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ওই প্রশ্নটা ফিরে আসছে । আগের থেকে সুচি অনেক শান্ত হয়ে এসছে। একটা প্রশ্ন যে তাকে এইভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে সেটা কখনোই ভাবে নি সুচি। কিন্তু আবার নিজেকে বোঝাচ্ছে এরকম কিছুই না , আকাশ শুধু বন্ধু। নিজেকে বারবার মিথ্যা বলার পর একটা কষ্ট হতে শুরু করলো সুচির। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। ভিতরে যাই হোক বাইরে সেটা কাউকে লক্ষ্য করতে দিচ্ছে না সুচি।
আকাশ ক্লাস ইলেভেনে খুব ভালো নাম্বারে পাস করে ক্লাস টুয়েলভে উঠলো । আগের মতোই সপ্তাহে এক দুবার সুমির কাছে পড়তে আসতে লাগলো আকাশ। একদিন ঘরে ঢুকে বই খাতা বার করার পর সুচি আর সুমি দুজনেই আকাশের ডান কাঁধের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করলো । মনে হলো যেন ডান কাঁধে ব্যাথার কারনে ডান হাতটা আসতে আসতে নাড়াচাড়া করছে সে ।
“ কি হয়েছে কাঁধে ? „ প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলো না সুচি।
আকাশ স্বর নামিয়ে বললো “ চুপপপ আস্তে । „
“ কি হয়েছে কাঁধে সেটা বলবি তো । „ খুব রাগী আর গম্ভীর স্বরে সুচি জিজ্ঞাসা করলো ।
আকাশ নিরুপায় হয়ে বললো “ মাকে বলবি না বল । „
“ না , বলবো না । তুই বল কাঁধে কি হয়েছে । কেউ মেরছে ? „
আকাশ হেসে বললো “ আমাকে মারবে এমন সাহস কারোর নেই। বাইক থেকে পড়ে গিয়েছিলাম । „
ভুরু কুঁচকে মুখে হাজার প্রশ্নের চিহ্ন ফুটিয়ে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ বাইক থেকে ! কার বাইক ? কখন ? কিভাবে পড়লি ? „
আকাশ বলতে শুরু করলো——- আজকে আমাদের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল । তাই ঠিক করেছিলাম স্কুল থেকে ফেরার পর রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেলিব্রেট করবো। সেই মতো স্কুল থেকে ফিরে বাড়ি এসে চলে গেছিলাম বন্ধুর বাড়ি। ওর বাইক আছে কিন্তু লাইসেন্স হয়নি। তাই ওর বাইকেই চড়ে অলিগলি দিয়ে যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে। মাঝপথে একটা বেশ পাঁচ ছয় ফুট সরু গলির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা বিড়াল সামনে চলে এলো। আমার বন্ধু স্পিডে চালাচ্ছিল। হঠাৎ ব্রেক চাপতে বাইকটা তো পড়লোই তার সাথে আমিও রাস্তায় ডান কাঁধের উপর ভর করে পড়লাম । রাস্তায় পড়ে ছয় সাত দূরে গড়িয়ে গেলাম ।
এতক্ষণ শুনেই সুচি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো “ আর যাবি না ওর বাইকে । ঠিক মতো চালাতে পারে না ! উঠিস কেন ওদের বাইকে ? „ কথাটা বলেই সুচি সুমির দিকে তাকালো। সুচি দিদির দিকে তাকিয়েই চোখ নিচে নামিয়ে নিল। সুমি এক দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশ সুচির রাগকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বললো “ ও ভালোই চালাতে পারে। দূর্ঘটনা তো যে কারোর সাথেই ঘটতে পারে। ওই বিড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে সামনে চলে এসছিল তাই। মাকে বলবি না কিন্তু। „
তারপর প্রায় আধঘন্টা পড়ে আকাশ চলে গেল । আকাশ চলে যেতেই সুমি বললো “ এখনও সময় আছে সুচি ! স্বীকার করে নে। ও যখন ওই দূর্ঘটনার কথা বলছিল তখন আমি তোর চোখে ভয় দেখেছি। স্বীকার করে নে বোন আমার । „
সুচি শান্ত স্বরে বললো “ স্বীকার করার কিছু নেই দি। ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ভয় পেয়েছিলাম। „
সুমি সুচিকে আরও চেপে ধরলো “ নিজেকে মিথ্যা বলিস না। শোন আমার কথা। স্বীকার করে নে । হয়তো কষ্ট পাবি কিন্তু একটু কম কষ্ট হবে , চোখের জল একটু কম পড়বে, দুঃখ একটু কম পাবি। স্বীকার করে নে। „
সুচি এবার রাগি আর বিরক্তি মিশিয়ে বললো “ তোর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। বাবা তোকে ভাংচুং বুঝিয়েছে । আর তুইও বাবার কথায় নাঁচছিস । „ কথাটা বলে সুচি মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করলো ।
এতো লুকোচুরি খেলার পরেও শেষ রেহাই হলো না আকাশের। ডানহাতি হওয়ার জন্য রাতে ডিনার খাওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। বাবা মা দুজনেই লক্ষ্য করে বললেন “ কি হয়েছে কাঁধে ? „
আকাশ একটু ভয় পেয়ে বললো “ ও কিছু না । একটু লেগেছে। „
আকাশের মা সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে আকাশের জামা খুলে দেখলেন কাঁধে বেশ কিছুটা ছড়ে গেছে “ এটাকে একটু লেগেছে বলে ! „ তারপর আকাশের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “ দেখো তুমি কতোটা ছড়ে গেছে । „
তারপর আবার আকাশের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন “ সত্যি বল কার সাথে মারপিট করে এসছিস ? „
আকাশ জামাটা ঠিক করতে করতে বললো “ মারপিট করতে যাবো কেন ? ওই বিকালে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম । তখন লেগেছে। ও তুমি বেশি চিন্ত করো না তো । „
স্নেহা দেবী আরও রেগে গিয়ে বললেন “ চিন্তা করো না ! খুব বড়ো হয়ে গেছিস , তাইতো ! „
এখন আর আগের মতো বকাঝকা করাও যায় না , আর মারাও যায় না। সত্যি আকাশ বড়ো হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ষোল সতেরো বয়স তো হয়ে গেল। পরম যত্নে ঘায়ে মলম লাগিয়ে তারপর খেতে বসলেন স্নেহা দেবী ।
সবকিছু আগের মতো চললেও সুচির ভিতরটা আর আগের মতো নেই। সুচি নিজের জন্মদিনে কলেজ গেল না। বাড়িতেই কাটালো দিনটা। সুমি গতকাল অফিসের কাজে দুদিনের জন্য নদীয়া গেছে। জন্মদিনে দিদি অনুপস্থিত তাই সুচির একদম ভালো লাগছিল না। বিকাল বেলা স্কুল থেকে ফিরে ভালো জামা কাপড় পড়ে আকাশ সুচির ফ্ল্যাটে হাজির হলো । সুচিকে উদাস মনে টিভি দেখতে দেখে আকাশ বললো “ তুই এখনও তৈরি হোস নি ! „
“ আমার আজ ভালো লাগছে না। দিদি নেই। „
“ ওইসব বললে তো চলবে না। বিপ্লব আর জয়শ্রী দি অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে নে । আমি অপেক্ষা করছি। „
নাছোড়বান্দা আকাশের হাবভাব দেখে সুচি ঘরে গিয়ে একটা জিন্স আর টপ পড়ে ঘরের বাইরে এলো। তারপর আকাশ কে নিয়ে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে পৌছল। প্রতিবছর আলাদা আলাদা রেস্টুরেন্ট সুচির জন্মদিন সেলিব্রেট করা হয়। কিন্তু লোক সংখ্যা পাঁচ জনের বেশি কখনোই হয় না। সুচি, সুমি, বিপ্লব, জয়শ্রী আর আকাশ। এই সেলিব্রেট মূলত আকাশের উৎসাহেই করা হয়। রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলো একটা ছোট গোল টেবিলে জয়শ্রী আর বিপ্লব বিচ্ছু একটা 2 pound এর কেক সাজিয়ে বসে আছে। আলো পাশে আরও অনেকে বসে আছে। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের মধ্যেই ব্যাস্ত । সুচি চেয়ারে বসতেই বিপ্লব বিচ্ছু একটা ব্লাস্টার ফাটিয়ে বললো “ happy birthday সুচিদি। „
সুচি “ থ্যাঙ্ক ইউ „ বলে কেক কাটতে শুরু করলো। সবাই happy birthday গানটা গেয়ে সুচিকে উইশ করলো। কেক কাটার পরেই প্রথম টুকরোটা অটোমেটিক বাঁদিকে বসে থাকা আকাশের মুখের দিকে বাড়িয়ে দিল সুচি। তারপর গিফ্ট দেওয়ার পালা এলো। জয়শ্রী একটা বই উপহার দিল। বিপ্লব বিচ্ছু একটা দামী পেন উপহার দিল। আর আকাশ দিল কয়েক হাজারের একটা দামী বিদেশী কোম্পানির mackup kit । উপহারটা দেখে সুচির ডান দিকে বসে থাকা জয়শ্রী সুচির কানে কানে বললো “ খুব ভাগ্য করে এমন একটা বন্ধু পেয়েছিস। আমি কিংবা বিপ্লবও ওর বন্ধু। কিন্তু আমাদের জন্য কখনো ও এতো খরচ করে না। খুব lucky তুই । „
জয়শ্রীর কথাটা যে সুচি আগে কখনো শোনে নি এমন নয়। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল আর এখন আলাদা। সর্বপরি তখন সুমির করা প্রশ্নটা ছিল না। এখন আছে। সুমি প্রশ্নটা করার পর থেকে সুচির মনে হতে শুরু করেছিল যেন আশেপাশের সবাই তাকে এটাই বোঝাতে চাইছে যে তুই ওই 5’9 ইঞ্চির আকাশ নামের ছেলেটাকে ভালোবাসিস। যাকে তুই মাঝেমাঝেই অসভ্য , লম্পট , চিড়িয়াখানার জন্তু বলে সম্বোধন করিস তাকে তুই ভালোবাসিস।
সুচির কলেজ কোচিং , আকাশের স্কুল আর কোচিংয়ের মধ্যে দিয়ে বছর পার হয়ে গেল। সুচি নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছে যে বাবা দিদি ভুল ভাবছে। পরের বছর আকাশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হলে সুমির দৌলতে স্কুলে দশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলো আকাশ। আর এদিকে সুচিও খুব ভালো গ্রেড পেয়ে B.Com পাস করলো। পরিক্ষায় এতো ভালো নাম্বার পেয়ে আকাশ বায়না করলো যে একটা বাইক কিনে দিতে। ছেলের আবদার শুনেই স্নেহা দেবী রেগে গিয়ে বললেন “ না , ওই দু চাকা চালাতে হবে না। খুব দূর্ঘটনা ঘটে ওতে। „
মায়ের রাগী স্বর শুনে আকাশ আর আকাশের আবদার মিইয়ে গেল। কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা উঠলে সবাই ভাবতে শুরু করলো কোথায় ভর্তি করা যায়। অফিসে শুভাশীষ বাবুর চিন্তিত মুখ দেখে সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো “ কি এতো ভাবছেন বলুন তো সকাল থেকে? „
“ ওই আকাশকে কোন কলেজে ভর্তি করাবো সেটাই ভাবছি। „
“ তা বেশ তো লন্ডনে পাঠিয়ে দিন। আমিও তো আমার মেয়েকে ওখান থেকেই পড়াচ্ছি । এই পোড়া দেশের সার্টিফিকেটের দাম নেই। „
কথাটা ভালো লাগলো আকাশের বাবার। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কথাটা বললেন। আকাশের মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “ তুমি তো সারাদিন অফিসে কাজ করে দূরে থাকো। বাড়িতে আমি আর আমার ছেলে থাকি। ছেলেটাকেও আমার কাছ থেকে দূর পাঠিয়ে দেবে । „
কথাটা এমন ভাবে আকাশের মা বললেন যেন তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে । তাই আকাশের বাবা আর কিছু বললেন না। আঠারো উনিশ বছর সাংসারিক জীবন করেও আকাশের বাবা এখনও এই মহিলাকে বুঝতে পারেন নি। আকাশের মা কখন কোন কথায় কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা একটা বড়ো ধাঁধা আকাশের বাবার কাছে।
কয়েক দিন পর সকালে আকাশ সুচির ঘরে ঢুকে ঘাটের উপর গড়িয়ে বললো “ তোর কলেজে ভর্তি নিয়েছি । আজকে বাবা গেছে ডোনেশন আর ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে । BBA নিয়ে ভর্তি হচ্ছি। তোর স্কুটিতে যাবো একসাথে আগের মতো । „

More বাংলা চটি গল্প

Leave a Comment