Written by bourses
[১৩] প্রাকৃতিক
বেলাডাঙা অনিন্দীতার কাছে যেন এক স্বপ্ন রাজ্য… এখানকার গ্রামের সবুজ-শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা, মনোরম জনপদ দেখে অভিভূত ইংল্যান্ডবাসী অলিভীয়া… অবাক বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, টইটুম্বুর খাল-বিলে নয়নাভিরাম শাপলা পদ্মের দিকে… মুগ্ধ হয়ে শোনে পাখিদের কোলাহল… শিহরিত হয় রাতের অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক আর জোনাকির স্বপ্নীল ওড়াউড়ি…
একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঢাকা গ্রামটি… গ্রামের অপার সৌন্দর্য একইসঙ্গে নইয়নাভিরাম ও বৈচিত্রময়… সে এইক’দিন এখানে থাকতে থাকতে খেয়াল করেছে যে প্রত্যেককটি ঋতুর পরিবর্তনের সাথে তারা পালটে যায় নতুন রূপে, নতুন বৈশিষ্ট্যে… মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে সূর্যের মুখে শোনা এই বাংলারই এক কবির কবিতার কিছু লাইন,
“যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়…”
প্রথমে বুঝতে পারেনি অনিন্দীতা কবিতার মানে, কিন্তু সূর্য তাকে সহজ ভাষায় যখন বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের এই গ্রামের সাথে কবির কবিতার লাইনের যোগসূত্রের, তখন তার মনটা এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠেছিল যেন…
অনিন্দীতা খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষন করে একটা জিনিস বুঝেছে যে, প্রকৃতির আচরণের সাথে তাল মিলিয়ে চলে গ্রামের জীবনযাত্রা… রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বর্ষা, সবকিছুর সাথেই গ্রামের জীবনযাত্রার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক… ঋতু বদলের সাথে সাথে বদলায় গ্রামের রং, রূপ, ল্যাবণ্য…
তাই তো শরতে দেখা যায় শুভ্র মেঘ, কাশফুল, ঝকঝকে নীলাকাশের অপূর্ব সংমিশ্রণ… নদীর তীরে তীরে শুভ্র কাশফুল, গাছে গাছে হাসনাহেনা কিংবা শিউলী, কামিনী, বেলী… বিলে-ঝিলে শাপলার সমারোহে গ্রামটি ঢেকে যায় এক আশ্চর্য রূপমাধুরীতে…
কখনো আবার আনন্দের বার্তা নিয়ে নামে শরতের বৃষ্টি… চারপাশে শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টি হৃদয় মনকে করে তোলে প্রফুল্ল… বৃষ্টি শেষে দিগন্তজুড়ে রংধনু মনের মাঝেও যেন আঁকিয়ে দেয় রং… নরম রোদের সকাল, রঙমাখানো সূর্যাস্ত, রাতের স্বচ্ছ আকাশে চাঁদ কিংবা লাখো নক্ষত্র শরতের সৌন্দর্যকে করে তোলে অপার্থিব… শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবির ভাষায়,
“সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!”
হেমন্তে আবার গ্রামটি পালটে যায় অন্যরকম আবহে… নির্মল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পাকা ধানের উপরে সূর্যের কিরণে চারপাশে বিচরন করে সোনালী আভা… কালের বিবর্তনে দিগন্তজোড়া মাঠ হারিয়ে গেলেও গ্রামের পথে প্রান্তরে হেমন্তের সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনা কখনও… পাতা ঝরার এ ঋতুতে ফোটে কামিনী, অপরাজিতা, গন্ধরাজ, মল্লিকা সহ নানা রকম ফুল… নবান্ন উৎসবের সাথে পিঠা পায়েস আর নদী-নালা, খাল-বিলের হাঁটু ছোঁয়া জলে দেখা যায় মাছ ধরার উৎসব… মাঠ জুড়ে পাকা ধানের সোনালী রূপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের…
শীতে হেমন্তের সাজ খুলে ফেলে গ্রামটা ঢেকে যায় কুয়াশার চাঁদরে… সেই কুয়াশা ভেদ করে সকালের সোনালী রোদ যখন উঁকি দেয়, তখন দেখা মেলে ভিন্ন রকম এক সৌন্দর্যের পশরা… মাঠ জুড়ে হলুদ সরিষাফুল, বিভিন্ন রকম শাক-সবজির বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমারোহ শীতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ… পল্লীকবির ভাষায়,
“ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে”
শীত চলে যাওয়ার পরও গ্রামে কুয়াশার এই দৃশ্য অনেক দিন থেকে যায়… মাঠের পর মাঠ সবুজ ক্ষেত ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুতে ঢেকে থাকতে দেখা যায়… ভোর হতেই গ্রামের কৃষক, জেলে, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষ বেরিয়ে পড়ে তাদের কর্মযজ্ঞে… গ্রামটিতে নানা বর্ণের মানুষের এক সাথে বাস… শান্ত এ গ্রামটিতে হিন্দু, মুসলিম, ফাগদ্দ, দডাভ, গঞ্জু, ভার, দখদড়, দরাধা, প্রভৃতি জনজাতি এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাস করে…
অনিন্দীতা খেয়াল করেছে, গ্রামটির রূপে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষায়… চারদিকে থৈ থৈ জলে গ্রামটা যেন ভেসে থাকে… সে এক অপরূপ দৃশ্য… রিমঝিম বৃষ্টি আর মেঘ বাদলের লুকোচুরিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি… ডালে ডালে ফোটে দৃষ্টিনন্দন কদম… প্রকৃতির এহেন সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে কার?
তবে গ্রামটি সবচেয়ে সুন্দর রূপে সাজে বোধহয় বসন্তে… গাছে গাছে নতুন পাতার আগমনে প্রকৃতি সাজে নবরূপে… ফুলে ফুলে চারপাশ হয়ে ওঠে বর্ণিল… পলাশ, মহুয়া, শিমূল, কণকচাঁপা, কৃষ্ণচূড়া, দোলনচাঁপা, বেল সহ অধিকাংশ ফুল ফোটে এই সময়ে… গ্রামের ঝোঁপে ঝাড়ে বসন্ত আনে প্রাণের দোলা…
ছবির মত এই গ্রামটিকে সৃষ্টিকর্তা যেন এঁকেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে… চালতা, বেল, নয়নতারা, কলমি, কামিনী, অপরাজিতা, কাঠালচাঁপা, দোলনচাঁপা, শিমূল, ঝুমকো জবা, শাপলা, জারুল, ঘাসফুল সহ হাজারো প্রকৃতির ফুল গ্রামটির আনাচে-কানাচে, ঝোপে-ঝাড়ে শোভাবর্ধন করে তোলে আপন মহিমায়… মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় শালিক, ময়না, টিয়া, ডাহুক, মাছরাঙা, বক, বউ কথা কও, তিতির, চখাচখি, কাঠঠোকরা, মোহনচূড়া, পাপিয়া, ফিঙে, তোতা সহ হাজারের কাছাকাছি প্রজাতির পাখি… আম, জাম, কাঠাল, লিচু, জাম, করমচা, নারিকেল, সুপারি, তাল সহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ আর লতাপাতার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গ্রামটির মোহনীয়তাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে যেন… অনিন্দীতার মনে হয় যে বাঁশঝাড় কিংবা বটের ছায়ায় বসে পাখির এই কিচির-মিচিরের সাথে একটি লগ্ন তার হৃদয়কে হাজার বছর বাঁচার জন্য আগ্রহী করে তোলার জন্য যেন যথেষ্ট… গ্রামটিতে ঢুকলেই যেন মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে… প্রতিটা বাড়ির দেওয়াল যেন আঁকার খাতার পাতা থেকে উঠে এসেছে…
এখানে এসে বসবাস করতে থাকার পর থেকে সে আর সূর্য, দুজনে মিলে গ্রামের অসংখ্য ছাত্রকে শিল্পকলা শেখানো শুরু করেছিল… আসলে তারা দুজনেই ভেবেছিল, যে শুধু মাত্র নিজেদেরকে শিল্পের মধ্যে না ডুবিয়ে রেখে অন্যদের সাথেও তাদের এই শিল্প সত্তাটাকে ভাগ করে নেবার… তাদের কাছে প্রচুর রঙ তো ছিলোই… তাই চিন্তা করতে করতেই তারা ঠিক করে গ্রামটার সৌন্দর্যায়ন করলে কেমন হয়? কিন্তু সদইচ্ছা থাকলেই তো আর সব কিছু অমনি অমনি ঘটে যায় না… তাই গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা অনুমতি সংগ্রহে নেমে পড়েছিল… তবে জমিদার বংশধর… না তো আর মুখের ওপরে কেউ করবে না, তাই স্বচ্ছন্দে অনুমতি পেতে অসুবিধা হয়নি কারুর কাছ থেকেই… সেই শুরু… মাসের পর মাস তারা লেগে থেকে গ্রামটাকে জলছবি দিয়ে গড়ে তুলেছে একেবারে… শুধু তারাই নয়… তাদের দেখে অনুপ্রেরণায় উদ্ভাশিত হয়ে উঠে কচিকাচা থেকে নব্য যুবক, স্বতঃপবিত্র হয়ে তাদের সঙ্গে কাজে লেগে পড়েছিল… রঙ্গিন করে তুলেছে পুরো গ্রামটাকেই…
প্রতিদিনের মত আজও অনিন্দীতা সূর্য আর তিতাসকে সাথে নিয়ে ভোর বেলা বেরিয়েছিল গ্রামের মেঠো পথ ধরে প্রাতঃভ্রমণ সারতে… বেলাডাঙা আসার পর থেকে এটা তার নিত্যদিনের সর্বপ্রথম কাজ, ঘুম থেকে ওঠার পর… বর্ষার বৃষ্টির দিনগুলো বাদ দিলে প্রায় প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে এই গ্রামের মেঠো পথে প্রাতঃভ্রমণ… সকালের স্নিগ্ধ হাওয়ায় নিজের শরীর মন জুড়িয়ে নেওয়ায়… কখনও খোলা প্রান্তর, কখনও শুধু মাত্র মেঠো পথ, আবার কখন তারা চলে যায় গ্রামের পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা নদীর ধারে, মাটির বাঁধ ধরে নদীর শীতল হাওয়া মনটা যেন সতেজ হয়ে ওঠে সারাদিনের জন্য… ভালো লাগে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গ্রামের মানুষগুলো তাদের দেখে যখন সসম্ভ্রমে হাত জোড় করে সরে দাঁড়ায় এক পাশে… বুঝতে অসুবিধা হয় না তার যে এই সন্মান তার ওই বাড়ির বউ হওয়ার প্রাপ্তি… আসলে ঠিক তাকে নয়, সূর্যদের পরিবারকেই গ্রামের মানুষরা সন্মান জানাচ্ছে তাকে উপলক্ষ্য করে… আর সেই সাথে তো তার একটা বিদেশি পরিচিতি আছেই… সোনালী চুলে, শাড়ী পরিহিতা, দীর্ঘাঙ্গী চেহারায় সে যখন দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যায়, তখন আর পাঁচটা বাঙালী বউ মেয়েদের থেকে পার্থক্য তো চোখে পড়েই… দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেলো অনিন্দীতা বেলাডাঙা বাসিন্দা… তাদের পরিবারে তিতাসের আগমনের পরে যেন আরো ভরাট হয়েছে তার দেহ… মেদ জমেছে বাংলার জলবায়ু আর চৌধূরী বাড়ির যত্নে থাকতে থাকতে শরীরের বেশ কিছু জায়গায়… তাতে যেন তার সৌন্দর্য আরো কামনামেদুর হয়ে উঠেছে… টান করে পরে থাকা পরনের শাড়ীর আড়ালে দেহের তরঙ্গের উচ্ছলতা যেন আরো বেশি করে টানে সকলের দৃষ্টি… প্রতিটা পদক্ষেপে নিতম্বের ঝলকানি, যে কোন হৃদয় আলোড়িত করে তুলতে বাধ্য… শাড়ির আঁচলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া ভরাট স্তনের অবয়ব দেখে চোখ ফেরানো একটু কষ্টসাধ্যই বলা চলে…
তিতাস তার জীবনে আসার পর থেকে অনিন্দীতার জীবনে এসেছে এক বিশাল পরিবর্তন… আগের তার সেই মনের ক্ষোভ দুঃখ যেন কোন এক জাদুবলে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে… পরিবারে মেনে না নেবার খেদের বিন্দু মাত্র লেশ অবশিষ্ট নেই আর… তার গর্ভধারণের খবর পেয়ে রুদ্রনারায়ণ নিজে উপস্থিত হয়েছিলেন বেলাডাঙায়… সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছিলেন অবহেলিত, নির্বাশিত পুত্রবধূকে কন্যাসম মমতায়… তাদের মাঝের সমস্ত দ্বিধা দন্দ যেন নির্বিশেষে পরিণত হয়েছিল বাপ মেয়ের স্নেহের বন্ধনে… তিতাস এর সাথে তারও ঠাঁই হয়েছে কলকাতার বাড়িতে এর ফলে, কিন্তু রুদ্রনারায়ণের শত অনুরোধেও তারা একেবারে কলকাতায় গিয়ে বসবাস করা শুরু করে নি… আসলে ততদিনে এখানকার গ্রামের মাটির গন্ধের সাথে মিশে গিয়েছে অনিন্দীতার জীবনযাত্রা… একাত্ম হয়ে গিয়েছে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের সাথে… তাই ইঁটকাঠবালির সাম্রাজ্যে আর নতুন করে ঘর বাঁধার ইচ্ছা জাগেনি তার মধ্যে কিছুতেই… সূর্যও অনিন্দীতার মনের ইচ্ছাকে সন্মান জানিয়ে থেকে গিয়েছে বেলাডাঙায়, সপরিবারে… হয়তো মাঝে মধ্যে তারা গিয়ে থেকে এসেছে কলকাতায়, কিন্তু একেবারে কখনই নয়, তাদের শিকড় যেন এই বেলাডাঙাতেই প্রতিথ হয়ে গিয়েছে… প্রথম প্রথম রুদ্রনারায়ন চেষ্টা করেছিলেন তাঁর পুত্রবধূ আর নাতনিকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখার, কিন্তু শেষে বুঝতে পেরেছিলেন যে শিল্প মনষ্ক সূর্য বা অনিন্দীতা যে মাটির স্বাদ একবার পেয়েছে, সেখান থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আসার ক্ষমতা তাঁরও নেই… তাই আর জোর খাটাননি তিনিও… শুধু হুকুম জারি করে গিয়েছেন যেন মাঝে মধ্যে তারা তাঁর নাতনিকে নিয়ে কলকাতায় কাটিয়ে যায়… যতই হোক, তিতাস বংশের প্রথম সন্তান বলে কথা… বিপ্রনারায়ণএর আগে বিবাহ সম্পন্ন হলেও সে তখনও পর্যন্ত বাবা হয়ে ওঠে নি… তিতাসের মাথায় হাত রেখে তার নাম করনও রুদ্রনারায়ণই করেছিলেন, চন্দ্রকান্তা… তাঁর বংশের বড় রাজকুমারী…
“এই জানো, আমার না একটু…” বলতে বলতে চুপ করে যায় অনিন্দীতা…
তিতাসকে কাঁধের ওপরে চাপিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভ্রু তুলে প্রশ্নের চোখে তাকায় সূর্য… “কি হলো? চুপ করে গেলে কেন? কোন প্রবলেম?”
মাথা নাড়ে অনিন্দীতা… “না, মানে তেমন কিছু নয়…” তারপর একবার এদিক সেদিক দেখে নিয়ে বলে, “এখান থেকে বাড়ি তো বেশ দূর, না? বেশ অনেকটাই পথ…”
“তা তো বটেই… কেন?” ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে সূর্য… তারা ততক্ষনে নদীর বাঁধের ওপরে উঠে এসেছে… ইচ্ছা ছিল আজকে সূর্যদয় দেখাবে ছোট্ট তিতাসকে বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে, নদীর জলের মধ্যে থেকে সূর্যদয় কতটা স্বর্গীয় লাগে সেটা…
“আসলে…” বলতে বলতে ফের চুপ করে যায় অনিন্দীতা… সূর্যের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে একটা প্রচন্ড দ্বিধা মনের মধ্যে কাজ করছে অনিন্দীতার…
এগিয়ে এসে অনিন্দীতার পীঠের ওপরে হাত রেখে বলে, “আরে, বলই না… কি হয়েছে? আমার কাছে বলতে অসুবিধা কোথায়?” খেয়াল করে যে অনিন্দীতা রীতিমত ঘামছে যেন… কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভা… পীঠের ওপরে যেখানে হাত রেখেছে সে, সেখানটাও বেশ ভেজা… নিশ্চয় ঘামে… এই সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া এতটা তো ঘামা উচিত নয়… ভেবে সেও একটু অস্থির হয়ে ওঠে… তিতাসকে ঘাড়ের ওপর থেকে মাটিতে নামিয়ে ভালো করে তাকায় অনিন্দীতার দিকে… “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
ভাবতে ভাবতে এবারে সূর্যও একটু চিন্তায় পড়ে যায়… কারন বেলাডাঙায় তখনও কোন ভ্যান গাড়ি বা ওই ধরনের কোন যানবাহনের চল হয়ে ওঠেনি… গ্রামের লোকেরা সাধারনতঃ পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করে থাকে… শহরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তখন দূরের বড় রাস্তায় গিয়ে বাস ধরতে হয়… সেটাও সকালে আর বেলায়, দিনে দুবার মাত্র পাওয়া যায়… তাদের অবস্য এতটা কষ্ট করার দরকার পড়ে না, কারন তাদের নিজস্য গাড়ি রয়েছে, কিন্তু গ্রামের পথে হটাৎ করে প্রয়োজন পড়লে কোন গাড়ির ব্যবস্থা হবার সম্ভবনাই নেই…
“আমি ঠিক আছি… তোমায় অত চিন্তা করতে হবে না… তুমি চলো তো…” মাথা নেড়ে হাঁটা দেয় অনিন্দীতা… পেছন পেছন তাকে অনুসরন করতে থাকে সূর্য তিতাসের হাত ধরে…
বেশ কয়েক পা যাওয়ার পরে ফের থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অনিন্দীতা… ঘুরে সূর্যের দিকে পিছিয়ে এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ায় সে… জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে বলে, “জানো… আমার না… আই মিন আই নীড টু রিলিজ… ইট হ্যাজ বিকেম আর্জেন্ট…”
ঘামতে থাকা মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে সূর্য… “মানে তুমি পায়খানা করবে? হে ভগবান… সেটা বলতে এত কুন্ঠা?”
সূর্যকে ওই ভাবে হাসতে দেখে মাথা গরম হয়ে যায় অনিন্দীতার… কিন্তু পেটের মোচড়ে সেটা অনেক কষ্টে প্রশমিত করে রাখে সে… কাঁচুমাচু মুখে বলে, “হ্যা… পেয়েছে অনেকক্ষন… কিন্তু ভেবেছিলাম বাড়ি পৌছে যাবো, কিন্তু এখন আর চেপে রাখা যাচ্ছে না… কি করি বলো তো?”
“কি করবে আবার… করবে…” তারপর একটা হাত নদীর দিকে প্রসারিত করে দিয়ে নাটকের ভঙ্গিতে বলে ওঠে… “হে সুন্দরী… তুমি এই প্রকৃতির কোলে, নদীর ধারে, শাড়ি তুলিয়া, পৎ পৎ করে মলত্যাগ করিবে… আর আমরা দুই বাপ বেটি মিলিয়া সেটি অবলোকন করিব…” বলে ফের হা হা করে হাসতে থাকে…
শুনে লজ্জায় কান লাল হয়ে ওঠে অনিন্দীতার, কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সে লজ্জা সরিয়ে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকায় সূর্যের দিকে… “এখানেই? কেউ আসবে না তো?”
“আসলেই বা? ক্ষতি কি? দেখবে চৌধূরী বাড়ির মেজরানী নদীর জলে তার মল ভাসিয়ে দিচ্ছে…” চোখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয় সূর্য…
অন্য সময় হলে মুখ ঘুরিয়ে হয়তো বাড়ির দিকে হাঁটা দিত অনিন্দীতা, কিন্তু এখন তার যা পরিস্থিতি, তাতে সূর্যের কথা গায়ে না মেখে তাকায় সে এদিক সেদিক… দেখে নেয় কেউ আসছে কিনা… তারপর তরতর করে বাঁধের ঢাল বেয়ে নেমে যায় নীচের দিকে… নদীর দিকে পেছন ফিরে শাড়ি সায়া গুটিয়ে, কোমর থেকে পরণের প্যান্টি টেনে নামিয়ে দিয়ে বসে পড়ে সমস্ত লাজলজ্জা মাথায় তুলে…
তিতাসের হাত ধরে বাঁধের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখে সূর্য… ততক্ষনে নদীর ওপরে সূর্যদয় ঘটে গিয়েছে… সূর্যালোকের লাল আলোর ছটা এসে পড়েছে কাপড় গুটিয়ে রাখা নগ্ন ফর্সা মাংসল উরু আর নিতম্বের ওপরে… যেন আরো বেশি করে প্রাকৃতিক দেখতে লাগে সেই মুহুর্তে অনিন্দীতাকে সূর্যের…
মুখ তুলে সূর্যকে তার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো যেন লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় অনিন্দীতার ফর্সা মুখ… সূর্য জানে, স্বল্প রাগে কিম্বা উত্তেজনায় প্রথম প্রকাশটা পড়ে অনিন্দীতার খাড়া নাকের পাটায়… আর এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় না… ফর্সা নাকের পাটা লাল হয়ে যায় তার… কিন্তু উঠে আসতেও পারে না সে হুট করে… ফের তাই মাথা নিচু করে নিয়ে নজর সরাবার চেষ্টা করে সূর্যের সামনে থেকে…
“বৌরানী হাগছে নাকি রে বাবু?” একবারে ঘাড়ের ওপরে প্রশ্নটা শুনে চমকে ওঠে সূর্য… চমকে ওঠে নীচে মলত্যাগ করতে থাকা অনিন্দীতাও… তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় সে কোমর থেকে কাপড়টাকে খানিকটা নামিয়ে নিয়ে… কিন্তু সরে দাঁড়াতে পারে না পরিষ্কার হবার সময় পায়নি বলে…
মাথা ফিরিয়ে তাকাতে চোখাচুখি হয় সূর্যের সাথে শুকুর আলির… রাসেদার স্বামীর… এই ভাবে এই লোকটি মাটি ফুঁড়ে এসে উদয় হতে পারে, সেটা তাদের দুজনের কেউই কল্পনা করতে পারে নি…
সূর্য জানে যে রাসেদা অনিন্দীতার খুবই কাছের মানুষ… তাদের মধ্যের সম্পর্কের কথা তার অজানা নয়… কিন্তু তাই বলে এই পরিস্থিতিতে শুকুরকে ঠিক মেনে নেওয়া সম্ভব নয় যেন… রাসেদা হলে কথাটা অন্য ছিল, কিন্তু সেখানে শুকুর!
সূর্য বা অনিন্দীতা অপ্রস্তুত হলেও শুকুরের মুখের মধ্যে কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই… একেবারে সহজ মুখে প্রশ্নটা করে অপেক্ষা করে উত্তরের আসায়… যেন এটাই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার…
ইতিমধ্যে অনিন্দীতা পা বাড়াবার উপক্রম করে পরিষ্কার না হয়েই… কারন এখন শুকুর আলির সামনে নিশ্চয় সে সৌচকর্ম করতে যাবে না…
তাকে এগোতে দেখে হাঁ হাঁ করে ওঠে শুকুর আলি… “উটা কি করিস বৌরানী? উটা কি করিস… তুই ছুঁছুঁ না করি উঠে আসছিস যে? কাপড়ে ল্যাইগা যাবে যে…” তারপর সূর্যের দিকে ফিরে বলে ওঠে, “তু বাবু বিটিকে ইখানেই সামলা কেনে… আমি যায়ে ছুছু করি দিই আসি…” বলে কারুর কোন অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করে না সে… তরতর করে সূর্যের পাশ কাটিয়ে বাঁধের ঢাল বেয়ে নেমে যায় অনিন্দীতার কাছে একেবারে… “বোস বৌরানী তুই লদীর ধারে… আমি তোকে ছুঁছুঁ করায় দি কেনে…”
অনিন্দীতা হাঁসবে না কাঁদবে বুঝে পায় না… রাসেদার সহর তাকে সৌচকর্ম করিয়ে দেবে? এটা হয় নাকি? বারন করবে কি মুখের তার তখন কোন কথাই যোগায় না যেন… শুধু একবার মুখ তুলে তাকায় বাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্যের দিকে…
সূর্য ততক্ষনে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে এসেছে… এটা সে সত্যিই আগে ভেবে দেখেনি… যা দুরন্ত মেয়ে তিতাস তাদের, এখানে, এই ভাবে যদি সে তাকে বাঁধের উপরে একলা রেখে নেমে যেত, সত্যিই তো… তাদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে এখান সেখানে তো চলে যেতেই পারতো তিতাস… আর অনিন্দীতারও এই ভাবে খোলা মাঠে নদীর জলে গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে বৌদের মত তো সৌচ কর্ম করার অভিজ্ঞতা নেই… হটাৎ করে পরিস্থিতির চাপে সে নেমে গিয়েছে বাঁধ থেকে সত্যিই… কিন্তু নিজে একা কি করেই বা পরিষ্কার হতো সে?… এটা ভাবতে ভাবতেই মাথার মধ্যে তার তখন একটা সুযোগ ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিয়েছে… অনিন্দীতার সাথে তার চোখাচুখি হলে সে শুধু মাথাটাকে দুবার হেলিয়ে সন্মতি জানায় ওপর থেকে… তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীচে দাঁড়ানো দুজনের দিকে… প্যান্টের মধ্যে থাকা পুরুষাঙ্গের তখন যেন ইষৎ আন্দোলনের ছোঁয়া…
সূর্যের মনোভাব যেন বুঝতে অসুবিধা হয় না অনিন্দীতারও… সূর্যের থেকে একটা সুক্ষ্ম তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে আসে অনিন্দীতার দিকে… মুচকি হাসি খেলে যায় অনিন্দীতার ঠোঁটে… শুকুর আলির অলক্ষ্যে… একবার চুতুর্দিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে তাকায় শুকুর আলির দিকে সে… সেখানে, শুকুরের মুখে কোন অস্বাভাবিকতা নেই… যেন একদম স্বাভাবিক একটা কাজ করার জন্যই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে তার পাশে…
আর একবার মুখ তুলে তাকায় সূর্যের দিকে অনিন্দীতা… নিরবে তাদের চোখে চোখে কথা হয়ে যায় যেন… তারপর শাড়ির নীচটা ধরে রেখে পা ফাঁক করে সরে আসে পড়ে থাকা মলকে পাশে ফেলে…
ধীরে ধীরে কাপড়টাকে ধরে গুটিয়ে তুলতে থাকে ওপর দিকে… একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকে ফর্সা পায়ের গোছ, হাঁটু, উরু… চোখ থাকে তার শুকুর আলির চোখের ওপরে… দেখার চেষ্টা করে তার শরীরের উন্মোচনে কোন রূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় কি না…
একটু পরেই হাল্কা সোনালী লোমে ঢাকা যোনি বেদী সমেত ভরাট নিতম্ব উদ্ভাসিত হয়ে পড়ে শুকুর আলির চোখের সন্মুখে… সকালের প্রথম সূর্যের আলোয় তা যেন রূপের ডালি নিয়ে বর্তমান… কিন্তু অবাক হয়ে যায় অনিন্দীতা… তার এহেন অঙ্গাবরণের ক্রমাঙ্গয়ের উন্মোচনে যেন কোন প্রভাবই পড়ে না শুকুর আলির চোখের তারায়… একেবারে এতটা নির্লিপ্ত একটা মানুষ থাকতে পারে, সেটা যেন ভাবতেই পারে না অনিন্দীতা…
“এবার বোস কেনে… বাবু উহা তোর লগে দাঁড়ায় আছে… তোরে সাফাই কররি দিই…” বলতে বলতে অনিন্দীতার কাঁধে হাত রেখে চাপ দেয় একটু তাকে বসে পড়ার জন্য…
উদলা নিম্নাঙ্গে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে নদীর পাড়ে অনিন্দীতা… আর শুকুর আলিও একটু এগিয়ে এসে ঝুঁকে যায় সামনের দিকে… একটা হাত নদীর জল তুলে পরিষ্কার করে দিতে থাকে অনিন্দীতার পায়ুদ্বার… একবার… দুবার… তিনবার…
নিজের পায়ুদ্বারে শুকুরের আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে সারা শরীর শিরশির করে ওঠে অনিন্দীতার… ওই ভাবে বসেই আরো একবার মুখ তুলে তাকায় বাঁধের ওপরের দিকে… যেখান থেকে সূর্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তাদেরই দিকে…
চমকে ওঠে অনিন্দীতা আচম্বিতে তার যোনির মুখে শুকুরের আঙুলের ডগার স্পর্শ পেয়ে… কিন্তু সেটা সেকেন্ডের কয়েক ভগাংশের জন্য যেন… বুঝতে অসুবিধা হয় না তার যে সেটা একেবারে অনিচ্ছাকৃত…
“লেহঃ… হই গেছে রে… এবার ঘরকে যা দিকি কেনে… ঘরকে গিয়া এট্টু ভালো করি পরিসকার করি লিস…” বলে ওঠে শুকুর আলি… হাতে নদীর থেকে মাটি নিয়ে ঘসে জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেয়… তারপর যেন কিছুই হয় নি, এই ভাবেই সোজা বাঁধের ওপরে উঠে সূর্যকে একবার নমষ্কার করে হাঁটা দেয় তার পথে… দুটো তথাকতিত সভ্য মানুষকে হতচকিত রেখে দিয়ে…