Written by bourses
[২০] সংশয়
পাতা ওল্টায় পর্ণা… একটার পর একটা… প্রথম যেদিন চন্দ্রকান্তার নামটা শুনেছিল, সেদিন একটা অদ্ভুত ঈর্শা যে মনের গভীরে উঁকি দেয় নি, সেটা সে অস্বীকার করে না… তারপরও চন্দ্রকান্তাকে নিয়ে খুব একটা ভাবেনি ও, আর ভাববেই বা কেন? ওর জীবনের সাথে কোন সম্পর্কই তো নেই এই চরিত্রের… কিন্তু… কিন্তু ডায়রিগুলো হাতে পাবার পর… সেগুলোর মধ্যে উঁকি দেবার পর, কেন জানে পর্ণা, চন্দ্রকান্তা চরিত্রটার সাথে একটা আত্মীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছে… প্রথম যখন ডায়রি খুলে বসেছিল, তখন তার মনের মধ্যে একটা মেয়েলী কৌতুহল বই আর কিছুই ছিল না, কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, যতগুলো পাতা সে পড়েছে, ততই যেন একটু একটু করে চন্দ্রকান্তাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে… তাকে আরো বেশি করে জানার আগ্রহ একটা নেশার মত চেপে বসেছে তার মনের মধ্যে…
২৯/৪, বৃহষ্পতিবার
আমি জানি আজকাল আমি একটু বেশিই একগুঁয়ে হয়ে উঠেছি… আগে তো জেদি ছিলামই, কিন্তু মা চলে যাবার পর থেকে যেন আমার ভেতরের সেই একগুঁয়েমীটা আরো বেড়ে গিয়েছে… মাঝে মাঝে আমি যে অনাবস্যকই জেদ ধরে বসে থাকি, সেটা নিজেও বুঝি, কিন্তু সেই সময়টাতে কিছুতেই নিজেকে যেন নিজের বশে রাখতে পারি না… মাথার মধ্যে আমার কথার উপরে কেউ নেতিবাচক কিছু বললেই যেন আগুন জ্বলে ওঠে সাথে সাথে… আর এটা আরো হয়েছে আমার দাদুর অকৃত্রিম প্রশ্রয়ে… হ্যা, আমার বলতে দ্বিধা নেই… দাদু আমায় যথেষ্ট বেশিই মাথায় তোলে, সব ব্যাপারে… আর সেটা আমি বেশ উপভোগও করি সময় সময়… যতই হোক, আমি বাড়ির প্রথম সন্তান… বাপিদের উত্তরসুরি হিসাবে… আর সেই জন্যই যেন দাদুর কাছে আমার সব কিছুরই মাফ… দাদু যেন চোখে ঠুলি পড়ে থাকে আমার জন্য… দেখেও দেখে না কিছু… আর এটার ফলে যেন আমি আরো বেশি করে দূরন্ত হয়ে উঠছি, যত দিন যাচ্ছে…
দূরন্ত, তবে অসভ্য নয় কিন্তু… লেখা পড়ায় আমি স্কুলে কখনও সেকেন্ড হই নি… বরাবর ফার্স্ট গার্ল… আর সেটাই আমার কাছে আরো একটা যেন বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি করেছে… কেউ কিছু বললেই আমি আমার রেজাল্ট দেখিয়ে দিই… হু হু বাবা… আমি ফার্স্ট গার্ল, পড়াশুনা করে তবে যা করার করি… আর এখানেই সবাই যেন হেরে বসে থাকে… ইচ্ছা থাকলেও কিছু বলতে পারে না আমার ওপরে… শুধু বাপি আর জ্যেম্মার ব্যাপারটা আলাদা… ওরা এখনও কি আমায় বাচ্ছা মেয়েই ভাবে? তাই তো মনে হয় আমার… আর সেটা ভাবলেই মাথাটা আমার যেন আরো গরম হয়ে যায়… চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে সবাইকে যে আমি বড় হয়ে গিয়েছি… আমি আর বাচ্ছাটি নেই… কিন্তু, সত্যিই কি তাই? গুলিয়ে যায় কেমন এক এক সময়… আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখি, কেমন যেন বদল ঘটে যাচ্ছে আমার দেহের, আমার মুখের, আমার সারা শরীরের মধ্যে… গালের ওপরে একটা দুটো করে ব্রণর সুস্পষ্ট উপস্থিতি… ওগুলো দেখলেই কেমন ভয় লাগে আমার… ভয়? নাকি এক বিচ্ছিরি অস্বস্থি… ইচ্ছা করে ঠেলে সরিয়ে দিই গালের ওপরে উঁচিয়ে ওঠা ব্রণগুলোকে… ওগুলো যেন এক একটা বয়সন্ধির জ্বলন্ত উদাহরণ… আমার সারল্যে ভরা মিষ্টি মুখের ওপরে যেন পাপের ছোঁয়া… পাপ? কিসের পাপ? আমি তো কখনও কোন অন্যায় করি নি? তাহলে? তাহলে কেন আমার গালেই ঐ গুলোর আবির্ভাব ঘটেছে? যদি পরে না মিলিয়ে যায়? তাহলে কি আমি কদাকার হয়ে যাব দেখতে? আমার এই সুন্দর মুখটা আর আগের মত সুন্দর থাকবে না? ভাবলেই যেন ঘেমে ওঠে আমার কপাল… আচ্ছা… নয়না বা আয়েশাদেরও কি আমার মতই গালে ব্রণ দেখা দিয়েছে? অনেকদিন দেখা হয় নি ওদের সাথে… কোলকাতায় আসার পর থেকে নিজের পড়াশুনা আর স্কুল নিয়েই কেটে গেছে দিনগুলো… কেমন আছে ওরা কে জানে? ভিষন ইচ্ছা করে ওদের কাছে দৌড়ে চলে যেতে… সেই দিনগুলোর অভাব যেন বড় বেশি করে মনে পড়ায় আজকাল…
কেন জানি না আজকাল একটা অদ্ভুত অস্বস্থি কাজ করে আমার মনের মধ্যে… হ্যা… অস্বস্থিই… আমার মত ডাকুবুকো মেয়েরও ভয় করে, অস্বস্থি হয়… এটা কেমন, সেটা ঠিক বোলে বোঝাতে পারবো না আমি… এটা কারুকে বা কিছুকে ভয় পাওয়া নয়… এটা একেবারে একদম মনের মধ্যের একটা অন্য অনুভূতি… কেন এ ভয় বা অস্বস্থিটা এলো, বা কোথা থেকে এলো, জানি না… কিন্তু এসেছে… আমার মনের মধ্যে, আমার চিন্তায়, আমার স্বপ্নে… চেষ্টা করি এই অনুভূতিটাকে ভুলে যেতে… নিজেই নিজেকে বোঝাই, ভয় একমাত্র ভীতুদের হয়, আমি তো অনেক সাহসী… কিন্তু যত ওটাকে নিয়ে ভাবি, ততই যেন আরো বেশি করে চেপে ধরে আমায়… নিজেই বুঝতে পারি আমি আর আগের আমি নেই… অনেকটা বদলে গিয়েছি সেই আমিটা… আর সেটা বুঝেই যেন আরো বেশি করে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি… কথায় কথায় মাথাটা আরো বেশি করে গরম হয়ে যায় সবার উপরে আমার… না চাইলেও… নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে…
এই তো সেদিন… আমার ঘর আমার মত করেই রাখি আমি… যেমন খুশি ভাবে… সে হোক না অগোছালো… আমারই তো ঘর!… কিন্তু জ্যেম্মা সেদিন দুম করে ঢুকে পড়লো আমার ঘরে… আচ্ছা বাবা, এসেছো বেশ করেছো… কিন্তু তাই বলে এই সব বলে বসবে? … আমার ঘরটা নাকি একেবারে খোয়াড়ে পরিণত করে রেখেছি আমি… এটা মানা যায়? কেন? আমি আমার ঘরটাকে আমার মত যা খুশি করে রাখতে পারবো না শুনি? কে বলেছে যে সব সময় মেয়ের ঘর গোছানোই থাকবে? আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গোছাতে শুরু করে দিলো ঘরটাকে জ্যেম্মা… আমার পড়ার টেবিল, আমার বিছানা, আমার বসার জায়গাটা… এমনকি আমার আলমারীটা পর্যন্ত… কি প্রয়োজন ছিল সেটার? বুঝি না বাবা এদের এই ধরণের আদিখ্যেতার… একান্ত জ্যেম্মা বলেই বোধহয় কিছু বলতে পারলাম না, নচেৎ… আমি অবস্য তারপরেই আমার দরজার বাইরে একটা কাগজে প্যাস্টেল কালার দিয়ে লিখে সেঁটে দিয়েছিলাম… “ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার আগে পার্মিশান প্রয়োজন”… “আমার ঘর, আমার খুশি মত রাখবো, এটা কারুর ভালো লাগুক বা না লাগুক”…
জ্যেম্মা কি আর দেখেনি নোটিসটা? দেখেও কি হলো? যেন কোন বিদেশি ভাষায় লেখা ওটা… গুরুত্বই দিলো না একেবারে? ফের পরদিন ঘরে ঢুকে দিব্বি ঘর গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল? এটা কি? আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? আমি যে বড় হচ্ছি, সেটা অন্তত বোঝা তো উচিত তার, নাকি? কি করে বোঝাবো তাকে যে আমারও একটা প্রাইভেসির প্রয়োজন… এই ভাবে দুম করে আমার ঘরের মধ্যে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে না… জেম্মা বোঝে না ঠিকই, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় আজকাল আমার আর বাড়ির আর সবার মাঝে একটা সুক্ষ্ম পর্দার আবরণের উপস্থিতি অনুভব করি… একটা দূরত্ব… আমার থেকে অন্যদের… এটাই কি তবে বড় হয়ে ওঠার লক্ষ্মণ? কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে আমি সত্যিই বাড়ির আর সবার থেকে সরে যেতে চাই! কিন্তু না চাইলেও যে একটা কেমন নিজস্বতায় থাকতে ভালো লাগে আমার… আর সেটা ভাবলেই আমার কেমন যেন শুধু শুধু কান্না পায়… বুকের মধ্যেটায় কেমন যেন একটা অস্বস্থি হয়… হয়, কিন্তু তাও বুঝতে পারি যে সত্যিই আমি বদলে যাচ্ছি একটু একটু করে… পরিবারের থেকে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে চোখের আড়ালে…
আচ্ছা! বাপিও কি এটাই ভাবে? আগের মতই কি আমায় সেই তিতাসই ভাবে? তবে আমি কেন একটা অদ্ভুত অস্বস্থি বোধ করি, বাপি আগের মত আমার মাথার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিলে? আমার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করলে? সেটাও কি ওই স্বচ্ছ পর্দার উপস্থিতির ফলে? কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বাপির আমার প্রতি যেন একটু বেশিই স্নেহময়? বুঝতে পারি না… অথচ কিছুদিন আগে, আমি হটাৎ পা মচকে পড়ে গিয়েছিলাম হল ঘরের মধ্যে মেঝেতে জল ছিল বলে… আগে হলে বাপি দৌড়ে এসে আমায় তুলে নিতো, কিন্তু সেদিন কি অদ্ভুত ভাবে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে রইল… এলো না আমার কাছে, তুলে ধরল না আমায়… কাকুমনি আমায় তুলতে আসতে, তাকেও তুলতে দিলো না… গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “তিতাস এখন বড় হয়েছে, ও নিজের পায়েই উঠে দাঁড়াবে, তোমাকে হেল্প করতে হবে না…” আমার না শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল… কান্না পেয়ে গিয়েছিল বাপির কথা শুনে… চুপ চাপ উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম, কারুর সাথে কোন কথা না বলে… ঘুরেও তাকাই নি বাপির মুখের দিকে… রাগে, অপমানে, অভিমানে…
এর কিছুদিন পর শ্রেয়াদের বাড়িতে আমার ওর জন্মদিনের নেমন্তন্ন ছিল… ওরাও আমাদের মতই বেশ বর্ধিষ্ণ পরিবারের… ওদের বাড়িতে প্রায়ই খুব পার্টি হয়… তাই ওর জন্মদিনের পার্টিতেও আমায় ফোন করে নেমন্তন্ন করেছিল শ্রেয়া… আমি গিয়ে জ্যেম্মাকে শ্রেয়ার বাড়ি যাবার কথা বলতে জ্যেম্মা বলল, “যাও, আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু সন্ধ্যে আটটার মধ্যে যেন বাড়িতে ঢোকা হয়…”
শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল আমার… এমনি সময় বলা হয় আমি নাকি বড় হয়ে গিয়েছি… কিন্তু এখন তাহলে কেন? ফোঁস করে উঠেছিলাম জ্যেম্মার ওপরে, “কেন? কেন আটটার মধ্যে ফিরতে হবে আমায়? আটটার মধ্যে কি আমার অন্য বন্ধুরা চলে যাবে নাকি? অন্তত ওরা যাওয়া অবধি তো থাকতে পারি আমি শ্রেয়াদের বাড়ি… আমি তো বড় হয়ে গেছি, তাই না? তাহলে কেন আমি থাকতে পারবো না আর একটু রাত অবধি?”
শুনে জ্যেম্মা বলে ওঠে, “তুমি কি মনে কর এখন তুমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছ তিতাস? একটা কথা মাথায় রাখো, তুমি এখনও সেই বড়টি হয়ে ওঠো নি… যে তুমি নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে… তুমি এখন একটা বয়ঃসন্ধির মধ্যে রয়েছ…”
আমার মাথাটা কি ঠিক রাখা যায় এর পরেও? থাকেও নি… মাটিতে পা দাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আমি, “আমি বড় হয়েছি জ্যেম্মা… আমি চাইনা আমায় তোমরা ছোট বাচ্ছার মত ট্রিট করো…”
শুনে জ্যেম্মার মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছিল… এই ভাবে জ্যেম্মাকে কখনও কথা বলতে দেখিনি আমি আগে… কঠিন গলায় বলে ওঠে আমায়, “তাহলে শুনে রাখো তিতাস, কোন পার্টি নয়… তোমাকে যেতেই হবে না যদি না আমার কথা শুনে ফিরে আসতে পারো… কোন প্রয়োজন নেই যাবার… আমি চাই না তুমি এই বয়সে এসে বয়ে যাওয়া মেয়ের মত বড় হয়ে ওঠো…”
শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল… কিন্তু আমারও জেদ… আমিও যায় নি শ্রেয়ার পার্টিতে… গোঁজ হয়ে বসেছিলাম নিজের ঘরের মধ্যে চুপ করে, সারাটা সন্ধ্যে… বেরোওনি ঘর থেকে একবারের জন্যও…
পরের দিনও সারাটা দিন আমি জ্যেম্মার সাথে কথা বলিনি… একবারের জন্যও না… বিকেলবেলা আমার ঘরে জ্যেম্মা এসে হাজির… আমি দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম, কিন্তু জ্যেম্মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে আদর করে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি… জ্যেম্মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিই…
জ্যেম্মা আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “দেখো তিতাস, তোমার এই বয়সটা বড্ড খারাপ… এই বয়সে একটা মানুষের উচিত নিজের আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা… সেটা যদি না করতে পারো, তাহলে আর সে সুযোগ পরে পাবে না হাজার চেষ্টা করলেও… ততক্ষনে দেখবে হাত থেকে সময়টা কখন বেরিয়ে চলে গিয়েছে… সময় একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না…”
এটাই তো আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা! হয় আমি বড় হয়েছি তা নয় তো আমি ছোট আছি… দুটো তো এক সাথে হতে পারে না, না? তাহলে বাড়ির লোকেরা আমায় কোন চোখে দেখে? বড়? নাকি বাচ্ছা? নাকি দুটোই? সব কেমন গুলিয়ে যায় আমার কাছে… আর সেইটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সংশয় যেন… আমি জানি, আমার এ সংশয় কেটে যাবে, যদি বাড়ির লোকগুলো আমায় শুধু মাত্র বড় বলেই মেনে নিতো, কিন্তু তা তো নয়! তারা তো সেটা করবে না… কারন তাদের মনেও নিশ্চয় একটা সংশয় আছে, একটা ভয় আছে আমায় নিয়ে… তা নয়তো দুই রকম ব্যবহার করে কেন আমার সাথে তারা?
জ্যেম্মা আমায় বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাত রাখে পীঠের ওপরে… কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে, “দেখ তিতাস, তোমার এই বয়সটায় আমাদের উচিত তোমায় শাসনের মধ্যেই রাখার… সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল… ততদিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত না তোমার কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল বোঝার ক্ষমতা হচ্ছে… আমি বুঝতে পারি, এখন তোমার স্বাধীনতা পাবার ইচ্ছা জাগে সর্বক্ষন মনের মধ্যে… কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবে, স্বাধীনতা কখন এমনি এমনি এক দিনে আসে না… স্বাধীনতা তখনই উপলব্ধি করতে পারবে, যখন তুমি যথেষ্ট বড় হয়ে উঠবে, সব কিছু বুঝতে শিখবে…”
“কিন্তু সেটা কবে?” আমি জ্যেম্মার বুকের মধ্যে থেকে প্রশ্ন করি…
বাপি বোধহয় আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল… কারণ আমার প্রশ্নের উত্তরটা বাপির কাছ থেকেই আসে… বাপি ঘরে এসে আমার পাশে এসে বসে… তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বলে, “দেখ তিতাস, সব কিছুর একটা সময় লাগে… কখন দেখেছিস, ফুল থেকে একেবারে একটা ফল তৈরী হতে? বা বছর না ঘুরতেই তুই পরের ক্লাসে উঠেছিস? ঠিক তেমনই, সেটাও সেই রকমই মনে কর… আমি বুঝতে পারি, তোর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সংশয়টা… দেখ, আমাদের মনেও কিন্তু তোর মতই একটা ভয় আছে, তোকে নিয়ে… তাই আমাদের এক সাথে সেই সংশয়, সেই ভয়টার বিরুদ্ধে লড়তে হবে, সেটাকে জয় করতে হবে, তাই না মা?” তারপর একটু থেমে আবার বলে বাপি, “এই বয়সটায় না অনেক, অনেক প্রলোভন এসে হাত বাড়ায়… সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলেই বিপদ, আর সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাদের এক সাথে থাকতে হবে… যখনই তোর কোন প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগবে, সোজা আমার বা জ্যেম্মার কাছে চলে আসবি… একজন বন্ধুর মত সব কিছু খুলে জিজ্ঞাসা করবি… কোন সংকোচ না রেখে মনের মধ্যে… আমাদেরকেও তোর বন্ধু বলে ভাববি সব সময়, তাহলেই দেখবি আর কোন ভয়, আর কোন সংশয় থাকবে না মনে… আর আমরাও কথা দিচ্ছি, তোর মনের যা কিছু প্রশ্ন, যা কিছু সংশয় উঠে আসবে, তা মিটিয়ে দেবার ভার আমাদের… একেবারে বন্ধুর মত…
জ্যেম্মা আমায় আরো ভালো করে নিজের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলে, “আমিও তাই তো বলি, আমিও তোমার বন্ধু… তাই না তিতাস?”
জ্যেম্মার বুক থেকে মাথা তুলে হাতের উল্টো পীঠ দিয়ে চোখ মুছে হেসে ফেলি আমি… মাথা নেড়ে বলে উঠি, “হু… আমরা সবাই একে অপরের বন্ধু… আমরা আর কখনও কোনদিন একে অপরের সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না… রাগ দেখাবো না…”
বাপি হেসে আমার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে… আমি আবার জ্যেম্মার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে আদর খেতে থাকি…