শেষের পাতায় শুরু [পর্ব ৩] – Bangla Choti Collections

Written by Pinuram

রাত প্রায় সাড়ে নটা। বিকেলের দিকে একবার মায়ের সাথে কথা হয়েছিল, মা বলছিল কোন এক বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে তাই সেই বাড়িতে যাবে। এতদিন দিল্লীতে থেকে দিল্লীর ঠান্ডা অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। কাজের লোক রাতের খাওয়া বানিয়েই গিয়েছিল, খাওয়া সেরে বসে বসে টিভি দেখছিল। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কাল ভোরবেলা ট্রমা সেন্টারে ডিউটি। শীতকাল এলেই গাড়ির এক্সিডেন্ট খুব বেড়ে যায়, রোজ দিন অন্তত দশ বারোটা এক্সিডেন্টের কেস দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। এমন সময়ে ফোন বেজে উঠতেই চমকে যায় রিশু।
ফোনের ওপাশে দিপের আর্ত চিৎকার শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, “দাদাভাই আমার হাত ভেঙ্গে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি এস।”
ভাই বোনকে ভীষণ ভালোবাসে রিশু, ওর দুটো চোখের মনি দুই ভাই বোন। রিশু যখন ডাক্তারি পড়তে দিল্লী যায় তখন দিপের জন্ম হয়, পরাশুনা আর দুরত্তের ফলে দিপকে সেইভাবে বড় হতে দেখতে পারেনি বলে ওর খুব দুঃখ। তাই বাড়িতে এলেই দিপকে নিয়ে পরে থাকত রিশু। ওর ইচ্ছে ছিল দুইজনকে দিল্লীতে নিজের কাছে নিয়ে আসার, কিন্তু ওর নিজের খুব ইচ্ছে মায়ের কাছে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার তাই আর ওদের নিয়ে আসেনি। বেশ কয়েক বছর আগে, যখন রিশু সবে মাত্র এমএস পড়ছে, তখন একবার দিপ সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছিল। ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে তখুনি বাড়ি গিয়েছিল এবং যতদিন না দিপের পা ঠিক হয় ততদিন দিপের পাশে ছিল।
রিশু ধরমর করে উঠে বসে বলে, “কি রে কি করে হয়েছে?”
অন্যদিকে দিপ কপট হেসে, মুখ বেঁকিয়ে কাঁদার ভঙ্গি করে বলে, “আমি বাথরুমে পিছলে পরে গেছি দাদাভাই। ডান হাতের কুনুই খুব ব্যাথা দাদাভাই, দাদাভাই হাত সোজা করতে পারছি না দাদাভাই। তুমি এস তাড়াতাড়ি…”
দিপের এহেন কপট কান্নার ভঙ্গিমা দেখে সবাই মুখ চেপে হেসে ফেলে। রিশু বলে, “মাম্মাকে ফোন দে।”
দিপ কপট ব্যাথায় চেঁচিয়ে ওঠে, “দাদাভাই… প্লিজ এস।”
রিশু, “আচ্ছা তুই মাম্মাকে দে।”
দিপ নাছোড়বান্দা, “তুমি না এলে আমি কিন্তু হসপিটাল যাবো না। লোকে কি বলবে, আমার দাদাভাই এতবড় অরথপেডিক সারজেন আর নিজের ভাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা।”
রিশু কি করবে ভেবে পায় না তাও বলে, “আচ্ছা বাবা, আমি আসছি, তুই মাম্মাকে ফোন দে।”
আম্বালিকা দিপের হাত থেকে ফোন নিতেই অন্যদিক থেকে রিশু বলে, “কি দেখ, কোথায় থাক তোমরা? হটাত করে কি ভাবে বাথরুমে পরে গেল?”
ছেলের রাগ দেখে হেসে ফেলে আম্বালিকা তাও রিশুকে শান্ত করে বলে, “আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। আমি যত বলছি যে হসপিটাল নিয়ে যাবো, তোর ভাই কিছুতেই শুনছে না।”
রিশু মাকে বলে, “তুমি ওকে নিয়ে এখুনি হসপিটাল যাও, এসএসকেএম এ নীলেশ আছে আমি ফোন করে দিচ্ছি, আমি কাল সকালের ফ্লাইটে পৌঁছে যাবো।”
দিপ মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “তুমি এখুনি না এলে আমি কোথাও যাবো না। আমার হাত বেঁকে যাক ভেঙ্গে যাক তোমার তাতে কি।”
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে রিশু, একটু ভেবে বলে, “আচ্ছা আমি আসছি তবে তুই হসপিটাল যা আমি নীলেশকে একটা ফোন করে দিচ্ছি ও পৌঁছে যাবে এমারজেন্সিতে।”
মায়ের ফোন রেখে নীলেশকে ফোনে জানিয়ে দেয় ভাইয়ের কথা। ল্যাপটপ খুলে বসে পরে, ভাই নাছোড়বান্দা ওকে ছাড়া কিছুতেই হসপিটাল যাবে না। ফ্লাইট চেক করে দেখে রাত বারোটায় কোলকাতার একটা ফ্লাইট আছে, কোন মতে ল্যাপটপের ব্যাগ আর একটা ছোট ব্যাগে কিছু জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পরে। জামা কাপড় নেওয়ার দরকার পরে না, কারন কোলকাতার বাড়িতে ওর সব কিছু আছে। ট্যাক্সিতে বসে আবার ফোন করে দিপকে, দিপের কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে বেশ চিন্তায় পরে যায়। কি হল, গিয়েই একটা এক্সরে করাতে হবে, রিপোরট দেখেই বুঝতে পারবে কতটা কি হয়েছে। এইচওডি কে ফোন করে দিয়েছিল যে কয়েকদিনের জন্য ছুটি চাই, ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেই সাথে ওর বন্ধু ইন্দ্রজিতকে ফোন করে দেয়। এমবিবিএস এর সময় থেকেই ইন্দ্রজিতের সাথে ওর বন্ধুত্ত, বেশ কয়েক বার ইন্দ্রজিত আর ওর স্ত্রী শালিনী কোলকাতায় রিশুদের বাড়িতে গেছে।
সিকুরিটি চেকের পরে প্লেনের দিকে যেতে যেতে মাকে ফোন করে রিশু, “কি হল কোথায় আছো, হসপিটাল নিয়ে গেলে?”
আম্বালিকা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি ফ্লাইটে বসে গেছিস?”
রিশু, “হ্যাঁ। আমি এবারে ভাইকে নিয়ে আসব আমার কাছে।”
দিপ আর দিয়া, হাতের মুঠো হাওয়ার মধ্যে উঁচিয়ে লাফিয়ে ওঠে, “মিশন একমপ্লিসড মাম্মা, কাজ হাসিল।” মাকে জড়িয়ে ধরে একটু নেচে নেয় দুই ভাই বোন, এবারে ওদের দাদাভাইয়ের বিয়ে হবে প্রিয় ঝিনুক দিদির সাথে।
ছেলের এহেন মনের অবস্থা দেখে আম্বালিকা হেসে ফেলে, “আচ্ছা বাবা নিয়ে যাস, তোর ভাই তোর কাছে থাকবে না ত কি আমার কাছে থাকবে নাকি? বহাল তবিয়েতে আছে তোর ভাই, কিছুই হয়নি তোর ভাইয়ের।” বুক ভরে শ্বাস নিয়ে একটু থেমে বলে, “কিন্তু বাবা ভাইকে যে নিয়ে যাবি তুই ত সারাদিন বাড়িতে থাকিস না, কে দেখবে তোর ভাইকে?”
ভাই ভালো আছে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রিশু, “এত রাতে এইসবের মানে কি? ভাইয়ের কিছু হয়নি মানে?” এতক্ষন ওর মনের মধ্যে অনেক কিছু চলছিল।
আম্বালিকা ছেলেকে শান্ত হতে অনুরোধ করে বলে, “কাল বলছিলাম না যে আমার বান্ধবী পীয়ালির বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্রার বিয়ে।” রিশু ছোট উত্তর দেয়, “হুম”। আম্বালিকা বলে, “তোর জন্যেও একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজেছি, ভাবছি এক সাথেই এক মন্ডপে দুই জনের বিয়ে দিয়ে দেব।”
প্লেনের সিটে বসতে গিয়েও থেমে যায় রিশু, “কি বলছ?”
আম্বালিকা বুঝতে পারে এইবারে একটা ঝড় শুরু হবে, তাও ছেলেকে বলে, “তুই আয় সব বলছি। দিপের কান্না না শুনলে তুই আসতিস না তাই বদমাশটা ওই ভাবে তোকে ডেকে এনেছে।”
শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “আমি দিপের এবারে সত্যি হাত ভেঙ্গে দেব।”
প্লেন দিল্লীর মাটি ছাড়তেই এক বিমান সেবিকা এসে ওদের জলের বোতল দিয়ে যায়। সেই সুন্দরী বিমান সেবিকার বুকের নেম প্লেট দেখে থমকে যায় ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, “চন্দনা”। একবার সেই বিমান সেবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই হেসে ফেলে। পাঁচ বছর আগের এক ভীষণ বর্ষার বিকেলে দেখা হয়েছিল এক সুন্দরী ললনার সাথে, নাম তার চন্দনা নয়, সেই ললনার নাম ছিল চন্দ্রিকা পশুপতি। মাছের বাজারে দেখা, সি আর পার্কের মাছের বাজারে অনেকেই আসে মাছ কিনতে। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা তবে আকাশ দেখে মনে হয়নি যে হটাত করেই বৃষ্টি নামবে। কাজের মেয়েটা শুধু নিরামিশ রান্না করে যায়, গতবার মা এসে ওকে হাতে ধরে মাছ ভাজা বানাতে শিখিয়ে গেছে। এমনিতে মা যখন আসে, তখনি এক গাদা মাছ কিনে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়। কাটা রুই ছাড়া আর কি বানাবে সেই কিনে মাছের বাজার থেকে বাইরে আসতেই ঝমঝমিয়ে তুমুল বৃষ্টি নামে। বাজার থেকে ওর বাড়িটা বেশি দূরে নয়, ভেবেছিল এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে। পরের দিন রবিবার ছিল, হসপিটাল যাওয়ার ছিল না, তখন ওর ওপিডিতে ডিউটি ছিল। বৃষ্টির জন্য একটা দোকানের শেডে বেশ কয়েক জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী গোলগাল গড়নের মেয়ের দিকে ওর নজর যায়, পরনে সালোয়ার কামিজ, পিঠ ছাড়িয়ে লম্বা বেনুনি, গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও চেহারার গড়নে একটা মাধুর্য আছে। বৃষ্টির ছাঁটে কামিজ একটু ভিজে গেছে, তাও নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্য সব লোকের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করে সেই সেডের নিচে দাঁড়াতে যেন সেই ললনার মনে দ্বিধা জাগে। রিশু আড় চোখে বার কয়েক ওর দিকে দেখে, তৃতীয় বার দেখতেই দুইজনার চার চোখ এক হয়ে যায়। রিশু অসহায়ের মতন একটু হাসি দেয় ওকে দেখে, প্রত্যুত্তরে ললনা ভুরু কুঁচকে রিশুর দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ঠিক সেই সময়ে রিশুর পাশের বাড়ির একজন ওকে দেখে চিনতে পেরে বলে, “আরে ডাক্তারবাবু যে, কি মাছ কিনলেন ইলিশ না পমফ্রেট?”
রিশু একটু হেসে উত্তর দেয়, “কাটা রুই, ইলিশের দিকে ত হাত দেওয়া যাচ্ছে না।”
হেসে ফেলে সেই ভদ্রলোক, “আপনি মশাই এমএসএর ডাক্তার তাও বলবেন যে ইলিশে হাত দেওয়া যাচ্ছে না? তাহলে ত মশাই আমাদের কুচো চিংরি খেয়ে থাকতে হয়।”
হেসে ফেলে রিশু, “আরে না না, আসলে আমি ঠিক মাছ রান্না করতে জানি না, মা আসলে তবেই মাছ খাওয়া হয়।”
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই রিশু বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই একটু ভিজলেও ক্ষতি নেই। কিছুদুর যেতেই পেছনে বেশ কয়েক জন লোকের মিলিত আওয়াজ পায়, সেদিকে তাকিয়ে একটা জটলা দেখে। ওর বুঝতে দেরি হয় না, যে এই বর্ষার রাস্তায় কারুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। ডাক্তার মানুষ তাই স্বভাব বশত এগিয়ে যায় জটলার দিকে। সেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাইক এই বর্ষার মধ্যে ঠিক সময়ে ব্রেক লাগাতে না পারায় পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দিয়েছে যার ফলে মেয়েটা রাস্তায় পরে যায়। বাইকের লোকটাকে সবাই মিলে ধরে খুব বকাঝকা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, মেয়েটার ভেজা কামিজের পেছনে রাস্তার নোংরা লেগে গেছে, পরনের চাপা লেগিন্সটাও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। হাঁটুর জায়গায় লেগিন্সের বেশ কিছুটা ছিঁড়ে গেছে, দেখেই বুঝতে পারে হাঁটুতে চোট লেগেছে, কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে তবে বেশি নয়। ডাক্তারি চোখে জরিপ করে নেয় মেয়েটাকে।
রিশুর সেই চেনাজানা লোকটা ওই জটলার মধ্যেই ছিল, ওকে দেখে বলল, “আরে ডক্টর বাবু ত।”
সেই শুনে বাকিরা একটু তফাতে সরে গেল। ডাক্তারির অভ্যেসবশত রিশু মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় কোথায় লেগেছে?” মেয়েটা কপাল আর কুনুই দেখিয়ে দিতে, রিশু ওর কপাল আর কুনুই দেখে বলে, “তেমন বিশেষ কিছু হয়নি একটু ফারস্ট এড করলেই ঠিক হয়ে যাবে।” মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “পাশেই আমার বাড়ি, যদি যেতে চান তাহলে আমি ফারস্ট এড করিয়ে দিতে পারি।”
চেনাজানা লোকটা রিশুর পরিচয় দিতেই বাকিরাও সমস্বরে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এত বেশ ভালো কথা।”
মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল রিশু, “আমার বাড়ি যেতে কি আপত্তি আছে?”
ব্যাথা হওয়া সত্তেও কোন রকমে একটু হেসে উত্তর দেয় মেয়েটা, “না না তা নেই।” হাটার জন্য পা বাড়াতেই বুঝতে পারে হাঁটুতেও বেশ লেগেছে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বলে, “হাঁটুতেও ব্যাথা, ঠিক ভাবে হাঁটতে পারছি না।”
পাশ দিয়ে একটা অটো যাচ্ছিল, সেটাকে থামিয়ে দিয়ে রিশু আর মেয়েটা সেই অটোতে উঠে পরে। অভ্যেস বশত রিশু জিজ্ঞেস করে, “আর কোথায় কোথায় লেগেছে ঠিক করে বলুন।”
মেয়েটা একটু হেসে বলে, “ধুপ করে ওইভাবে পরে গেছি তাই পেছনেও লেগেছে।” তারপর ডান হাত বাড়িয়ে দেয় রিশুর দিকে, “আমি চন্দ্রিকা, এই কাছেই আমার বাড়ি।”
রিশুও চন্দ্রিকার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “অম্বরীশ, এমএসএ আছি।”
সেই শুরু চন্দ্রিকা আর রিশুর পরিচয়ের সুত্রপাত।

চন্দ্রিকার আদি বাড়ি কইম্বাটুরে, ওর বাবা কর্মসূত্রে চেন্নাই থাকেন। চন্দ্রিকা দিল্লীতে একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। সিআর পার্কের কাছেই এক ফ্লাটে কয়েকজন বান্ধবী পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকে। তামিল মেয়ে তাই মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। রিশুও জানায় যে বাঙ্গালীদেরও মাছ খুব প্রিয় কিন্তু ও মাছ রান্না করতে পারে না। সেটা শুনে খুব হেসেছিল চন্দ্রিকা, বলেছিল ওর জন্য মাছ বানিয়ে খাওয়াবে। সামান্য পরিচয় থেকে কয়েক দিনের মধ্যে এক মিষ্টি ভালোলাগার ভাব এসে যায় চন্দ্রিকা আর রিশুর মধ্যে। মাঝেই মাঝেই ফোনে কথাবার্তা হয়, হসপিটালের কাজের চাপে কোন কোন দিন যদিও বা রিশু ফোন করতে ভুলে যায় কিন্তু চন্দ্রিকা একদম ভোলে না। চন্দ্রিকা মাঝে মাঝেই অফিস থেকে বেড়িয়ে চলে আসত হসপিটালে রিশুর সাথে দেখা করতে।
এমবিবিএস এর পরে রিশুর ইচ্ছে ছিল কোলকাতা ফিরে গিয়ে ওইখানের কোন মেডিকেল কলেজ থেকে এমএস করে। মায়ের শাসনের ফলে ছোট বেলা থেকে পড়াশুনায় রিশুর মাথা খুব ভালো, এইইমস এই পরীক্ষা দিল আর এক বারেই পেয়ে গেল অরথপেডিক নিয়ে এমএস করার। মাম্মা আর পাপা খুব খুশি হয়েছিল, দিয়া একটু মন মরা হয়ে গিয়েছিল কারণ দাদাভাইকে আরো বেশ কয়েক বছর দিল্লীতে থাকতে হবে শুনে।
সেদিন ছিল রবিবার কিন্তু রিশুর ছুটি ছিল না, এমারজেন্সিতে ডিউটি ছিল সেদিন ওর। বাইরে কাঠফাটা রোদ, এমারজেন্সিতে একের পর এক পেসেন্ট এসেই চলেছে। দুপুরের পরে মিটিং রুমে অন্য বন্ধুদের সাথে বসে একটু আড্ডা মারছিল এমন সময়ে একজন এসে ওকে বলে যে এমারজেন্সিতে একটা মেয়ে ওর খোঁজ করছে। কৌতূহল জাগে, এই কাঠ ফাটা রোদ্দুর মাথায় করে দিল্লীর এই গরমে কোন মেয়ে ওর জন্য এমারজেন্সিতে অপেক্ষা করছে। বাইরে বেড়িয়ে এসে চন্দ্রিকাকে দেখে অবাক হয়ে যায় রিশু।
জিজ্ঞেস করে, “এই সময়ে তুমি এখানে?”
মিষ্টি হেসে চন্দ্রিকা উত্তর দেয়, “তুমি ত আর নিজের থেকে মাছ খেতে পার না তাই কাল পমফ্রেট কিনেছিলাম সেটা তোমার জন্য এনেছি।”
রিশু হেসে ফেলে, আসে পাশের বেশ কয়েক জন ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। রিশু চন্দ্রিকাকে বলে, “বিকেলে আসতে পারতে, এই রোদ্দুর মাথায় করে এই গরমে আসার কি দরকার ছিল।”
চন্দ্রিকা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানি কণ্ঠে বলে, “দেখা করতে এসেছি বলে তোমার অসুবিধে হচ্ছে যাও আমি চলে যাচ্ছি।”
রিশু ওর হাত ধরে ফেলে, “যা বাবা আমি কখন বললাম যে আমি রাগ করেছি।”
চন্দ্রিকা নাক কুঁচকে হেসে বলে, “আমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব?”
মাথা চুলকে আশেপাশে দেখে রিশু বলে, “এমারজেন্সি ডিউটি, এ ছেড়ে ত যেতে পারব না চন্দ্রিকা। তবে…” বলে ওর হাত ধরে এমারজেন্সি থেকে বেড়িয়ে এসে বলে, “চল ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।”
ক্যান্টিনের দিকে যেতে যেতে চন্দ্রিকা জিজ্ঞেস করে, “খুব চাপ দেখছি?”
মাথা দোলায় রিশু, “বিশাল চাপ, নাওয়া খাওয়ার পর্যন্ত সময় থাকে না একদম। একের পর এক পেসেন্ট আসতেই থাকে এখানে। এই দেখ পরশু দিন একজন পা ভেঙ্গে এসেছিল, পাঁচ ঘন্টা টানা অপারেশান করে চোদ্দটা স্ক্রু লাগিয়ে হাড় জোড়া লাগাতে হয়েছে।”
চোখ বড়বড় করে বলে চন্দ্রিকা, “পাঁচ ঘন্টা!”
রিশু মাথা দোলায়, “পাঁচ ঘন্টা, তবে আমি করিনি। আমি এসিস্টেন্ট ছিলাম।”
ডাক্তারদের ক্যান্টিন অন্যদিনের তুলনায় সেদিন অনেক ফাঁকা ছিল, বেশির ভাগ টেবিলেই জোড়ায় জোড়ায় বসে প্রেমিক দম্পতি। চন্দ্রিকা ফিক করে হেসে রিশুকে বলে, “এখানেও প্রেম চলে দেখছি।”
হেসে ফেলে রিশু, “যা বাবা, প্রেমের জন্য কি আর জায়গার দরকার পরে নাকি? দরকার পরে দুই বিটিং হারট, এক সাথে ধুক ধুক করা দুই হৃদয়।”
লাজুক হেসে রিশুর বাম বাজু জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমারটা কি বলে তাহলে?”
চন্দ্রিকার কাজল কালো বড় বড় দুই চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “তুমি বল কি বলে।”
ওই ভাবে তাকাতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় চন্দ্রিকা, নরম ঠোঁট দাতে চেপে চোখ নামিয়ে বলে, “ওই ভাবে একদম আমার দিকে তাকাবে না। চল ওদিকে গিয়ে বসি।”
রিশু মুচকি হেসে কাছে টেনে বলে, “কি এমন দেখালে যে অমন করে দেখতে পারি না।”
রিশুর বুকের ওপরে আলতো চাঁটি মেরে বলে, “ধ্যাত শয়তান। ডাক্তারদের ভালো ভাবেই জানা আছে, কত সুন্দরী নার্স সুন্দরী মেয়ে ডাক্তারদের সাথে কত কিছু কর।”
হেসে ফেলে রিশু, কথাটা একদম আমুলক মিথ্যে নয়, ওর ব্যাচের অনেকের একাধিক সম্পর্ক, সে ছেলেই হোক অথবা মেয়েই হোক, তবে রিশু একটু আলাদা ছিল, বুকে না ধরলে কাউকে সেখানে স্থান দিত না। বিশেষ করে ওর কোনদিন ইচ্ছে ছিল না যে ওর স্ত্রী অথবা প্রেমিকা একি পেশায় নিযুক্ত হোক। তাই কোনদিন কোন নার্স অথবা কোন ডাক্তারের সাথে ওর কোন ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না, ওদের ব্যাচের মধ্যে পড়াশুনায় বেশ নাম ছিল ওর আর বড্ড ঘরকুনে আর মায়ের নেওটা বলে বদনাম ও ছিল। একটা খালি টেবিল দেখে দুইজনে বসে পরে। আসে আসে পাশের অনেকেই চেনা জানা, তার মধ্যে কয়েকজন ওর ব্যাচমেট। ওদের দেখে কয়েক জন চোখের ইশারা করে, তার উত্তরে রিশুও চোখের ইশারায় জানিয়ে দেয় নিজের প্রেমের কথা।
পাশাপাশি বসে রিশুর বাজুর ওপরে ঝুঁকে পরে চন্দ্রিকা, রিশুর বাম কাঁধের ওপরে মাথা রেখে নিচু গলায় বলে, “তোমার ছুটি কখন হবে?”
রিশু উত্তর দেয়, “দেরি আছে গো।”
বেশ কিছুক্ষন দুইজনেই চুপ করে একে অপরের সানিদ্ধ্য উপভোগ করে। বেশ কিছুক্ষন পরে মাছের কথা খেয়াল পরে চন্দ্রিকার, সঙ্গে সঙ্গে টিফিন খুলে বলে, “ইসসস দেখেছ, তোমার জন্য সব ভুলে যাই। পম ফ্রেট এনেছিলাম।”
টিফিন বক্স খুলতেই মাছের গন্ধ নাকে ভেসে আসে, “বেশ ভালো রান্না করেছ দেখছি। আর কি কি পার?”
মাছের একটু টুকরো ভেঙ্গে রিশুর দিকে উঁচিয়ে বলে, “খেয়ে দেখ তাহলে।”
এইভাবে সবার সামনে চন্দ্রিকার হাত থেকে মাছ খেতে ভীষণ লজ্জা করে রিশুর, “আমি নিজে খেতে পারি।”
মুচকি হাসে চন্দ্রিকা, “আমার হাত থেকে খেতে লজ্জা করছে?”
রিশু হেসে বলে, “মাছের সাথে আমি কিন্তু তাহলে হাত ও খেয়ে নেব।”
দুজনে মিলে গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। খাওয়া শেষে রিশু ওকে বলে, “এবারে আমাকে যেতে হবে।”
মুখ শুকনো হয়ে যায় চন্দ্রিকার, খানিক আবদার করে বলে, “আচ্ছা কি আর করা যাবে, আমি এখানে তোমার জন্য তাহলে অপেক্ষা করি আর কি করব।”
হেসে ফেলে রিশু, “পাগল নাকি তুমি, বাড়ি যাও আমার কতক্ষনে ডিউটি শেষ হবে জানি না।”
দুইজনের মধ্যে কারুর ইচ্ছে ছিল না সেদিন একে অপরকে ছেড়ে যায়, কিন্তু চন্দ্রিকা জানে, রিশু একজন ডাক্তার রোগীদের প্রতি ওর দ্বায়িত্ত সব থেকে আগে। ক্যান্টিন ছেড়ে বেড়িয়ে করিডোর ধরে দুইজনে পাশাপাশি হেঁটে চলে গল্প করতে করতে। হটাত পাশের একটা খালি ঘরের মধ্যে রিশু ওকে টেনে নিয়ে যায়। আচমকা খালি ঘরের মধ্যে টেনে আনার কারণ বুঝতে পারে না চন্দ্রিকা, রিশুর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কি হল হটাত।
চন্দ্রিকার অপেক্ষাকৃত পাতলা কোমর দুই বলিষ্ঠ হাতে জড়িয়ে ধরে রিশু, বুকের কাছে টেনে ফিসফিস করে বলে, “তোমার কিছু খাওয়ানর ছিল তাই না।”
দুই দেহের মাঝে হাত নিয়ে এসে রিশুর প্রসস্থ বুকের ওপরে হাতের পাতা মেলে ওর দিকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা এই ছিল তোমার মনে…”
কথাটা আর শেষ করতে পারে না চন্দ্রিকা, রিশুর মাথা নেমে আসে চন্দ্রিকার মুখের ওপরে। চন্দ্রিকার সারা মুখের ওপর অনবরত বয়ে চলে রিশুর উষ্ণ প্রেমের শ্বাস। আসন্ন চুম্বনের অপেক্ষায় নিমিলিত হয়ে যায় চন্দ্রিকার চোখ জোড়া, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর। রিশুর ঠোঁট নেমে আসে চন্দ্রিকার ঠোঁটের ওপরে। ঠোঁট জোড়া মিলিত হতেই চন্দ্রিকা রিশুর মাথার চুল দুই হাতে আঁকড়ে ধরে গভির করে নেয় সেই চুম্বন। প্রেমে বিভোর দুই প্রেমিক প্রেমিকা হারিয়ে যায় নিজেদের মধ্যে।
বেশ কিছুক্ষন পরে ঠোঁট ছেড়ে চন্দ্রিকা ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে বলে, “একা পেয়ে বেশ বাগিয়ে নিলে তাই না?”
নাকের ওপরে নাক ঠেকিয়ে আদর করে উত্তর দেয় রিশু, “এইভাবে চুরি না করলে আর দিতে নাকি?”
প্রসস্থ ছাতির ওপরে আলতো প্রেমের চাঁটি মেরে বলে চন্দ্রিকা, “এইবারে আর দেরি হচ্ছে না তাই না?”
হেসে ফেলে রিশু, “ডিউটি না থাকলে সারাক্ষন এইভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম।”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় চন্দ্রিকা, “আচ্ছা বাবা সে যখন হবে তখন দেখব কতক্ষন আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।”
চন্দ্রিকাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না রিশু, কিন্তু বারেবারে ফোন আসায় ওকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিল এমারজেন্সিতে। প্রথম চুম্বনে হারিয়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দে সেদিন আর কাজে মন বসেনি রিশুর। চন্দ্রিকার সাথে রাতের বেলা অনেকক্ষণ কথা বলেছিল, বলেছিল নিজের বাড়ির কথা, দিয়া আর দিপের কথা। রিশু জানিয়েছিল যে এমএস শেষ করার পরে ওর কোলকাতা ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, চন্দ্রিকা একটু দ্বিধাবোধ করেছিল সেই শুনে।
মাকে সব কিছু বললেও রিশু প্রথমে চন্দ্রিকার কথা লুকিয়ে গিয়েছিল, ওর মনে একটা দ্বিধা ছিল যে চন্দ্রিকা দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে, মা মেনে নেবে কি না সেটা সন্দেহ ছিল। ভেবেছিল এমএস করার পরে মাকে জানাবে সব কথা। কিন্তু মায়ের মন, আম্বালিকার চোখ একদিন রিশুর মনের কথা পড়ে ফেলে। চন্দ্রিকার সাথে দেখা হওয়ার বেশ কয়েক মাস পরের ঘটনা। ওকে অবাক করে দেবে বলে সেবার রিশুকে না জানিয়ে দিপ আর দিয়াকে নিয়ে দিল্লী আসে আম্বালিকা। বাড়ির একটা চাবি ওর কাছে থাকত তাই রিশুর অবর্তমানে বাড়িতে ঢুকতে ওদের কোন অসুবিধে হয়নি। সেদিন লেকচারের পরে চন্দ্রিকার সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সিনেমা দেখার পরে একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। দরজায় তালা দেখতে না পেয়েই বুঝতে পেরেছিল যে মা এসেছে। দরজায় টকটক করতেই ছোট দিপ দরজা খুলে এক লাফে ওর কোলে উঠে যায়।
দিয়া দৌড়ে এসে দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, “কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল।”
এইভাবে না বলে আগে কোনদিন ওর মা দিল্লী আসেনি তাই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল রিশু। আম্বালিকা মাতৃ স্নেহে বড় ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “একদম রোগা হয়ে গেছিস। কাজের মেয়েটা কি ঠিক করে রান্না করে যায় না নাকি?”
মায়ের শিতল হাতের ছোঁয়ায় হৃদয় কাতর হয়ে ওঠে, কিন্তু ছোট ভাই বোনের সামনে এমন ভাবে আদর খেতে খুব বাধে তাই হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “ধ্যাত তুমি না প্রত্যেক বার এক কথা বল। সেই ভাবে দেখতে গেলে আমি এতদিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতাম।”
রাতের খাওয়ার সময়ে রিশু বিশেষ কিছু খেতে পারে না কারণ চন্দ্রিকার সাথে রাতের খাওয়া খেয়েই ফিরেছে। পেট খারাপের অজুহাত দেয় কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে আম্বালিকার মনে সন্দেহ হয়। রাতের খাওয়ার পরে অন্য সব বারের মতন দিপ আর দিয়া ওর ঘরেই ঘুমিয়ে পরে। দিপ আর দিয়া ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আম্বালিকা রিশুকে বসার ঘরে ডাকে।
রিশু মনে মনে প্রমাদ গোনে, “কি হয়েছে বল।”
আম্বালিকা রিশুকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বান্ধবীর নাম কি?”
মায়ের কাছে ধরা পড়তেই রিশু থতমত খেয়ে, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাতের নখ খুটতে খুটতে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বলে, “বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছলাম বললাম ত।”
রিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “নাম কি ওর যার সাথে সিনেমা দেখতে গেছিলি?” ধরা পরে গেছে রিশু। “তোর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি তুই হা করলে হাসবি না হাঁচি দিবি।”
মাকে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রিশু, “না মাম্মা সত্যি শুধু মাত্র ভালো বান্ধবী।”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “কি নাম সেই বান্ধবীর যার জন্য আমার ছেলের কান লজ্জায় লাল হয়েছে?”
রিশু উত্তর দেয়, “চন্দ্রিকা পশুপতি, তামিল মেয়ে, কৈমবাটুরে বাড়ি।”
ধরা পরে গেছে রিশু, আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই মায়ের কাছে চন্দ্রিকার পরিচয় দেয়, কোথায় থাকে কোথায় চাকরি করে ইত্যাদি। উত্তরে আম্বালিকা ওকে বলে যে আগে এমএস ঠিক ভাবে পাশ করতে হবে তবে চন্দ্রিকার সাথে দেখা করতে চায়। পরের দিন চন্দ্রিকাকে সাথে নিয়ে আসে মায়ের সাথে দেখা করানোর জন্য। অজানা এক ভয়ে সারা রাস্তা রিশুর হাত শক্ত করে ধরে থাকে আর বারবার প্রশ্ন করে, ওর মা ওদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে ত? রিশু অভয় দেয়, ওর মা ভালোবাসা বোঝে শুধু একবার চন্দ্রিকার সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিকার সাথে দেখা হওয়ার পরে আম্বালিকার পছন্দ হয় ওকে, বেশ মিষ্টি মেয়ে একদম বাংলা বুঝতে পারে না, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই মায়ের সাথে বেশ মিশে রান্নাঘরে দুইজনে মিলে মাছ রান্নাতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। দিয়া সেই দেখে মুখ টিপে হেসে বলেছিল, এরপর ওদের নারকেল তেল দেওয়া রান্না খেতে হবে।

সেবার কোন এক কারনে তিনদিনের ছুটি পেয়েছিল রিশু। ঘরকুনে ছেলে, সকালেই কোলকাতার ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিয়েছিল ছিল তাই বিকেলে হসপিটাল থেকেই সোজা এয়ারপোরটে পৌঁছে গিয়েছিল। এর আগেও বেশ কয়েকবার বাড়িতে না জানিয়ে বাড়ির সবাইকে চমক দেবে বলে এইভাবে গেছে। আর প্রত্যেক বার রাতের ফ্লাইটে বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত, ওর মা ঘুমিয়ে পড়ত আর সেই জন্য খুব বকা খেত। তবে সেই বকুনির মধ্যে কতটা স্নেহ আর ভালোবাসা লুকিয়ে সেটা অনুধাবন করতে পারত রিশু। ছেলে বড় হয়ে গেলেও, রাতের বেলা পৌঁছালেই কান টেনে মৃদু বকুনি দেওয়া চাই, একবার বলতে পারতিস না? কি খাবি এই রাতে? দিপ আর দিয়া নাচানাচি শুরু করে দিত। রাতের বেলাতেই ওর মা প্রেসার কুকারে ডালে চালে বসিয়ে দিত আর সেই সাথে রাগে গজগজ করত যতক্ষণ না সেই ছোট বেলার মতন রিশু মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে, মাম্মা প্লিজ। বর্ষাকাল ছিল তখন, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামার ফলে ফ্লাইট একটু লেট। বিকেলে ফোনে কথা হয়েছিল মায়ের সাথে, দিপ দিয়ার সাথে কিন্তু ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি যে ও আসছে। তাই তখন ফোন দেখতে দেখতে মনে মনে হেসে ফেলছিল মাঝে মাঝে।
ঠিক সেই সময়ে চন্দ্রিকার ফোন পেয়ে বেশ ভালো লাগে রিশুর, “অফিস কেমন গেল?” জিজ্ঞেস করে চন্দ্রিকাকে।
চন্দ্রিকা উত্তর দেয়, “গেছে এই আর কি। খুব বৃষ্টি হচ্ছে জানো।”
হাসে রিশু, “হ্যাঁ মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, দেখো এই একটু খানি হবে আর থেমে যাবে…”
কথাটা টেনে নিয়েই চন্দ্রিকা হেসে বলে, “ব্যাস রাস্তা ঘটা গুলো সব ডুবে যাবে…”
রিশু ইয়ার্কি মেরে বলে, “তুমি নৌকা নিয়ে নেমে পড়বে।”
খিলখিল করে হেসে ফেলে চন্দ্রিকা, “তুমি দাঁড়ে বসবে আমি পাল তুলবো।” একটু থেমে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি বাড়ি কখন ফিরছ?” কেমন যেন একটু আনমনা ওর কন্ঠের স্বর, “এই আসব তোমার ফ্লাটে?”
নিচের ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে রিশু, “না গো আমি মানে বাড়ি যাচ্ছি।”
অবাক হয়ে যায় চন্দ্রিকা, “আরে হটাত করে, কি ব্যাপার?”
রিশু জানায় ওকে, “মাকে সারপ্রাইজ দেব তাই।” বলেই হেসে ফেলে।
চন্দ্রিকা হয়ত ভেবেছিল যে সেই রাতে রিশুর ফ্লাটে একত্রে কাটাবে। ভীষণ মা ভক্ত ঘরকুনে ছেলে, কথায় কথায় মায়ের রান্না ভালো, মা এই করে দেয়, মা ওই করে বলতে থাকে।
একটু মনক্ষুন্ন হয়ে রিশুকে বলে, “একবার এই ভাবে না গেলে কি এমন হত?”
কথাটা শুনে একটু আহত হয় রিশু তাও চন্দ্রিকাকে বলে, “আরে বাবা, তোমার সাথে ত রোজদিন দেখা হয়ে যায় মায়ের সাথে ত হয় না।” একটু থেমে হেসে বলে, “আমার রান্নার লোক একদম ডাল বানাতে জানে না তাই মাঝে মাঝে মায়ের হাতের ডাল খেতে খুব ইচ্ছে করে।”
আহত হলেও চন্দ্রিকা মুখে হাসি টেনে বলে, “আচ্ছা আমি এরপর তোমার মায়ের মতন ডাল রান্না করা শিখে নেব আর তোমাকে ডাল বানিয়ে খাওয়াব।”
মাথা নাড়ায় রিশু, মায়ের হাতের ডালের মধ্যে যে মিষ্টতা লুকিয়ে সেটা কারুর দ্বারা রান্না করা সম্ভব নয়। ওই ডালের মধ্যে মায়ের ভালোবাসা মায়ের স্নেহ মায়ের বকুনি মায়ের আশা ভরসা মিশে থাকে, অন্য কেউ সেই ডাল কি করে বানাবে?
একটু হেসে উত্তর দেয় রিশু, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
চন্দ্রিকা জিজ্ঞেস করে, “ফিরছ কবে?”
রিশু উত্তর দেয়, “তিন দিন পরে।”
চন্দ্রিকা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, “তিনদিন পরে? বাপরে, এই তিনদিন ছুটি ছিল ভেবেছিলাম এক সাথে কাটাবো। ধ্যাত তুমি না শুধু বাড়ি আর বাড়ি।”
শেষের কথাটা খুব খারাপ লাগে রিশুর, হ্যাঁ ওর কাছে ওর বাড়ি সব থেকে আগে। মাকে ছেড়ে দিল্লীতে একদম আসতে চায়নি, অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করেছিল কিন্তু ওর পড়াশুনার জন্যেই ওর মা ওকে এই দুরদেশে পাঠিয়েছে। ছোট বেলা থেকে ওকে ক্ষনিকের জন্য চোখের আড়াল হতে দেয়নি ওর মা, রিশু ভালো ভাবেই জানে বুকের ওপরে কত বড় পাথর রেখে ওর মা ওকে এতদুরে ডাক্তারি পড়াতে পাঠিয়েছে। চন্দ্রিকার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাই চলে যায় ওর।
ওকে কাটানর জন্য বলে মুখে হাসি টেনে বলে, “এই শোন, বোর্ডিং কল হচ্ছে। আমি কাল ফোন করব।”
চন্দ্রিকা মুখ ব্যাজার করে উত্তর দেয়, “বাড়ি গেলে তুমি কি আর আমাকে ফোন করবে নাকি? আচ্ছা কাল অপেক্ষা করব দেখি তুমি ফোন কর কি না।”
সারাটা রাস্তা চন্দ্রিকার কথা রোমন্থন করে “ধ্যাত শুধু বাড়ি আর বাড়ি” আর ভাবে, এখন থেকেই ওর বাড়ি যাওয়া নিয়ে মুখ গোমড়া করতে শুরু করে দিয়েছে, এরপরে কি করবে জানা নেই। রিশুর ইচ্ছে এমএস এর পরে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার, কিন্তু চন্দ্রিকার সাথে এখন পর্যন্ত সেই বিষয়ে কোন কথাবার্তা হয়নি ওর। শেষের কথা শুনে ওর মনে হল যে কোলকাতা গিয়ে ওদের বাড়ির সাথে হয়ত তেমন ভাবে মিশতে পারবে না চন্দ্রিকা। কোলকাতা পৌঁছে যথারীতি চন্দ্রিকা কে রাতেই ফোন করেছিল রিশু। রাতে অনেকক্ষণ দুজনে মিলে গল্প করেছিল। সেবার ওর মা বেশ কয়েকটা দামী সুতির জামা কিনে দিয়েছিল। রিশু কোনদিন নিজের জামা কাপড় কেনেনি, এমন কি ওর পরনের গেঞ্জি গুলো পর্যন্ত মা কিনে দেয়। প্রত্যেক বার এসে মায়ের কাছে বকুনি খায়, তোর এই গেঞ্জিটা এইভাবে বগল থেকে ছিঁড়ে গেছে একটা কিনতে পারিস নি? অপরাধীর মতন মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলত রিশু। রিশু মাঝে মাঝেই বাড়ির গল্প করত চন্দ্রিকার কাছে, রিশুর জামা কাপড় এমন কি গেঞ্জি পর্যন্ত ওর মা কিনে দেয় সেটা শুনে চন্দ্রিকা খুব হেসেছিল। রিশুর একটু খারাপ লেগেছিল বটে কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সেই কথা। পরে অবশ্য ওর মনে হয়েছিল তখন যদি চন্দ্রিকাকে ঠিক ভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারত ওদের বাড়ির সম্পর্ক তাহলে হয়ত রিশুকে সঠিক ভাবে চিনতে পারত চন্দ্রিকা।
কোলকাতা থেকে ফিরে আসার কয়েক মাস পার হয়ে যায়। সেইদিন কথা ছিল হসপিটাল শেষে কাছাকাছি কোন এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাওয়া সারবে। ওপিডিতে ডিউটি ছিল তখন, ছুটি হতে হতে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়।
বারেবারে চন্দ্রিকার ফোন আসাতে একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই বলে, “বললাম ত আসছি, এত বার করে ফোন করছ কেন?”
চন্দ্রিকা ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্রি নয়, হসপিটালের ওপিডি ব্লকেই প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে তাই একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “আধা ঘন্টা হয়ে গেল আমি দাঁড়িয়ে আছি, একবার বলতে পারতে যে সময় নেই তাহলে আসতাম না।”
কথাটা শুনে রিশু একটু রেগে যায়, চাপা গলায় ফোনে বলে, “দেখো আমি ডাক্তার ডিউটিতে আছি এখন। যতক্ষণ না আমার কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষন আমি আসতে পারব না।”
অন্যপাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “হ্যাঁ জানা আছে, এখন যদি তোমার মা এসে দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে তুমি দৌড়ে আসতে তাই না?”
কথাটা শুনতেই ওর মনে হল কেউ যেন ওর কানে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। হাত মুঠো করে ক্রোধ সংবরণ করে দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয় রিশু, “আমার মা হলে এইভাবে বার বার ফোন করে জ্বালাতন করত না আমাকে। আমার মা জানে আমি কোথায় আছি কি করছি আর কাজ শেষ হলেই যে আসব সেটা আমার মা বোঝেন।”
কথাটা যে ঠিক হয়নি সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না চন্দ্রিকার, তাই ক্ষমা চেয়ে নেয়, “না রিশু সরি আমি তেমন ভাবে বলতে চাইনি কথাটা।”
চোয়াল চেপে রিশু উত্তর দেয়, “দ্বিতীয় বার এই কথা একদম বলবে না যে মায়ের জন্য এটা করতে মায়ের জন্য ওটা করতে।”
সেদিন অবশ্য তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেড়িয়ে এসেছিল রিশু। সহজে রেগে যাওয়ার পাত্র নয় কিন্তু মায়ের নামে অথবা বাড়ির কারুর নামে কোন দ্বিরুক্তি শুনতে নারাজ। রিশুর শেষ বাক্য শুনে চন্দ্রিকা বুঝতে পারে ওর ওইভাবে কথাটা বলা একদম ঠিক হয়নি। চুপচাপ রিশুর অপেক্ষা করেই দাঁড়িয়েছিল ওপিডিতে। রিশু নিজের কাজ শেষ করে বেড়িয়ে এসে দেখে একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে চন্দ্রিকা। চন্দ্রিকার ওই অবস্থা দেখে রিশু মনে মনে হেসে ফেলেছিল, হয়ত ওই ভাবে চোয়াল চেপে কথাটা বলা ওর ঠিক হয়নি, কিন্তু বাড়ির কাউকে নিয়ে ওই ভাবে কোন তৃতীয় ব্যাক্তি যদি কিছু বলে তাহলে কি আর চুপ করে থাকা যায়। চন্দ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে গলা খ্যাঁকরে নিজের আসার জানান দেয় রিশু। চন্দ্রিকা অপরাধীর মতন এক হাসি দিয়ে ক্ষমা চায় রিশুর কাছে।
বাইকের পেছনে চেপে, চন্দ্রিকা ওকে পেছন থেকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, “রাগ করেছ আমার ওপরে?” কান ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, “এই দেখো কান ধরছি আর বলব না।”
পিঠের ওপরে চন্দ্রিকার নধর কোমল দেহবল্লরীর উষ্ণ চাপে মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায় রিশুর, মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলে শেষ পর্যন্ত, “তুমি না সত্যি। আচ্ছা বল কোথায় যাবে?”
চন্দ্রিকা ওর বাম কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “কোথায় নিয়ে চলেছ ডক্টর?”
হেলমেট পড়া ছিল তাই বাঁচোয়া না হলে চন্দ্রিকার উষ্ণ শ্বাসের ফিসফিসানিতে সেদিন নির্ঘাত একটা এক্সিডেন্ট করে বসত রিশু। “তোমায় একদিন কামড়ে খাবো বুঝলে।”
চন্দ্রিকার কোমল চাঁপার কলির মতন আঙ্গুল গুলো মেলে ধরে রিশুর প্রসস্থ বুকের ওপরে, জামা খামচে ধরে পেছন থেকে, নিজেকে ঢেলে উজাড় করে দেয় রিশুর পিঠের ওপরে, “খাও কে বারন করেছে।”
হেসে ফেলে রিশু, চন্দ্রিকা যেভাবে ওকে জড়িয়ে উত্তেজিত করে তুলছে ওর মাথা ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়েছে, শরীরের প্রত্যেকটা স্নায়ু যেন উন্মুখ হয়ে ওঠে প্রেয়সীর ত্বকের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওদের এলাকায় রিশুকে সবাই চেনে, বিশেষ করে নিচের তলার বুড়ো প্রমথেশ বাবু, উদ্ভিন্ন যৌবনা কোন মেয়েকে দেখতে পেলেই হল, ক্ষুধার্ত হায়নার মতন লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে সেই নারীর শ্লীলতা হানি করে শুধু মাত্র চোখ দিয়েই। চন্দ্রিকা যখনি ওর ফ্লাটে যেত তখনি কোন না কোন আছিলায় প্রমথেশ বাবুর ওর বাড়ি আসা চাই, আজকে জ্বর হয়েছে কোন ওষুধ আছে কি তোমার কাছে? ভীষণ পেট খারাপ একটা ট্যাবলেট পেলে বড় ভালো হত, অথবা একটু প্রেসার টা চেক করে দেবে ডাক্তার? এই প্রমথেশ বাবুর জ্বালায় চন্দ্রিকা ওর বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছিল, তাই আর সেই ভাবে চন্দ্রিকার সাথে একান্তে বসে কোনদিন প্রেমালাপ করা সম্ভব হয়নি ওর।
সেদিন একটা শপিং মলে গিয়ে দুজনে শুধু ঘুরেই বেড়িয়েছিল, অগত্যা ওই যে “খেতে কে বারন করেছে” সেই খাওয়া আর হয়নি ওদের। তবে রাতের দিকে দুজনে মিলে বেড়িয়ে পড়েছিল একটা হাইওয়ে ধরে। শহর ছাড়িয়ে বেশ অনেক দূরে একটা ধাবায় রাতের খাওয়া সেরেছিল। সেদিন দুজনের একদম ইচ্ছে ছিল না একে অপর কে ছাড়ে। কিন্তু পরের দিন রিশুর হসপিটাল ডিউটি ছিল আর চন্দ্রিকার অফিস, অগত্যা ফিরে আসতে হয় ওদের। সারাটা রাস্তা চুপ করে রিশুর পিঠের ওপরে মাথা রেখে গাল ঠেকিয়ে বসেছিল চন্দ্রিকা, এমন ভাবে পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছিল রিশুকে যেন কোন শক্তি ওদের বিচ্ছেদ করতে সক্ষম নয়। চন্দ্রিকা যেখানে পেয়িং গেস্ট থাকত, সেই বাড়ির সামনে পৌঁছে যখন বাইক দাঁড় করায়, তখন চন্দ্রিকার চোখে প্রেমের এই ক্ষনিকের বিচ্ছেদের জন্য একটু জল এসে গিয়েছিল। রিশুর একবার মনে হয়েছিল নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় চন্দ্রিকাকে, সারা রাত ধরে প্রেম আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় হৃদয় জুড়ে থাকা এই মিষ্টি মধুর প্রেমিকাকে। হাত ধরে আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বাইক নিয়ে ফিরে এসেছিল রিশু। সেই রাতে দুইজনের মধ্যে কারুর ঘুম হয়নি।

এমবিবিএস পড়ার সময় থেকেই ইন্দ্রজিতের সাথে ওর পরিচয়, এক ব্যাচের বন্ধু। ডাক্তারি পাশ করার পরে ইন্দ্রজিত এক জুনিয়ার ডাক্তার, শালিনীর প্রেমে পাগল। ইন্দ্রজিতের বাড়ি চণ্ডীগড়ে আর শালিনী হরিদ্বারের মেয়ে। শালিনী বেশ মিশুকে মেয়ে অনায়াসে সবার সাথে মিশে যেতে পারত, রিশুকে দাদা হিসাবে সন্মান করত শালিনী। তবে ইন্দ্রজিতের একটা বদ অভ্যেস ছিল, কোন মেয়ে যদি একটু ওর দিকে ঢলে পড়ত তাহলে ইন্দ্রজিত নিজেকে একদম সামলাতে পারত না, কোন না কোন আছিলায় সেই মেয়ের সাথে প্রেমের ঢলানিতে ঢলে যেত। শালিনীর সাথে প্রেম করার সময়েও ওর এই স্বভাব বদলায়নি, এই নিয়ে শালিনীর সাথে অনেকবার ঝগড়া মন কষাকষি হয়েছে, রিশুও ওকে অনেকবার এইসব করতে বারন করেছে, কয়েক মাসের জন্য সব কিছু বন্ধ থাকার পরে আবার সেই পুরানো স্বভাব ফিরে আসে ইন্দ্রজিতের। বারবার বারন করা সত্ত্বেও শালিনীর অবর্তমানে ইন্দ্রজিত বেশ কয়েক জন মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল, সেটা রিশুর অজানা ছিল না।
সেদিন ওপিডিতে ডিউটি ছিল রিশুর, দুপুরের দিকে হটাত ওর হসপিটালে শালিনী এসে উপস্থিত, বলে যে ওর বাড়ির চাবি চাই। রিশু বুঝে যায় যে নিশ্চয় আবার ইন্দ্রজিতের সাথে রাগারাগি হয়েছে। শালিনীকে বাড়ির চাবি দিয়ে বুঝায় যে হসপিটাল থেকে ফিরে সোজা ইন্দ্রজিতের সাথে দেখা করে একটা ফয়সলা করবে। শালিনী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে জল ভরা চোখে ওর হাত থেকে বাড়ির চাবি নিয়ে চলে যায়।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায় রিশুর, দরজায় নক করতেই দরজা খুলে যায়। বসার ঘরে পা রেখে শালিনীর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। সোফার ওপরে ওর একটা শারট গায়ে অর্ধ শায়িত শালিনীকে দেখেই রিশুর মনে দুশ্চিন্তা জেগে ওঠে। শালিনী ওর দিকে ভগ্ন হৃদয়ে তাকায়, দুই চোখের কোলে জল টলমল করছে, এক হাতে মদের গেলাস অন্য হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝে একটা আধা জ্বলা সিগারেট। ঘর ভর্তি সিগারেটের বোটকা গন্ধ যেটা রিশুর একদম সহ্য হয় না। শারটের সামনের দিকে বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা, অনায়াসে বুঝে যায় যে ওই শারটের নিচে কিছুই পরে নেই শালিনী। এলোমেলো মাথার চুল, চোখে চুড়ান্ত নেশার ঘোর, ঘাড়ে গালে লাল দাগ মনে হয় দাঁতের, সুগোল মোটা ঊরুর ওপরে নখের আঁচর। মেঝের ওপরে শালিনীর পরনের পোশাক এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, সোফার পাশেই একটা অর্ধেক শেষ হয়ে যাওয়া মদের বোতল। শালিনীর এই অবস্থা দেখে রিশুর চোয়াল কঠিন হয়ে যায়, কিন্তু ওর নিজের ঘরের এই অবস্থার কারণ খুঁজে পায় না।
রিশু ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই রিশুর কলার ধরে কেঁদে ফেলে শালিনী, “ইওর সিস্টার ইজ আর হোড় ডক্টর অম্বরীশ, তোমার বোন একজন বেশ্যা হয়ে গেছে।”
শালিনীর হাত থেকে মদের গেলাস কেড়ে নেয়, সিগারেট নিভিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি করেছ তুমি? তোমার এমন অবস্থা কেন?”
চোয়াল চেপে কাঁপা গলায় উত্তর দেয় শালিনী, “আই ফাকড আ গাই, আমি একজনের সাথে সেক্স করেছি, ভাইয়া।” ভাঙা বুক নিয়ে পাগলের মতন হেসে ওঠে শালিনী, “যদি ইন্দ্রজিত অন্য মেয়ের সাথে শুতে পারে তাহলে আমি কেন পারব না? আমিও তাই অন্য একজনের সাথে সেক্স করেছি।” বলেই ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে।
রিশু শালিনীর মুখ আঁজলা করে ধরে জিজ্ঞেস করে, “ইন্দ্রজিত কি করেছে?”
উলটো হাতে চোখ নাক মুছে সম্পূর্ণ বিবরন দেয় শালিনী, “আমি কয়েক দিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম, আমার আজকে ফেরার কথাও ছিল না। গতদিন যখন ইন্দ্রজিতের সাথে কথা হল তখন আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল, মনে হল কিছু একটা লুকাচ্ছে। আমিও রাতের বাস ধরে হরিদ্বার থেকে ওকে না বলেই রওনা দিলাম, সকালে এসে দিল্লী পৌঁছে সোজা বাড়ি গেলাম। আমাকে এই সময়ে বাড়ির দরজায় দেখতে পাবে সেটা একদম আশা করেনি। ভীষণ ভাবেই আশ্চর্য হয়ে যায় ইন্দ্রজিত, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ওর ইতস্তত ভাব দেখেই বুঝতে পারি কিছু একটা লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, সঠিক উত্তর দিতে পারল না। শোয়ার ঘরের দিকে যেতেই আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পরল, আমার মাথায় রক্ত চেপে গেল, বুঝে গেলাম কামুক স্বভাবের সেই পুরানো ইন্দ্রজিত ফিরে এসেছে। ওকে ঠেলে দিয়ে দরজা খুলতেই দেখি আমার বিছানায় এক অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে ঘুমিয়ে। আমার সারা শরীর ঘৃণায় রিরি করে জ্বলে উঠল, দিগ্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে সপাটে এক চড় কসিয়ে দিলাম। ঘুমন্ত মেয়েটা হটাত করে ওইভাবে চড় খেয়ে ধরমর করে উঠে বসে। ইন্দ্রজিত আমাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে, আমি ইন্দ্রজিতকে যথেচ্ছ গালিগালাজ করে জিনিস পত্র লন্ডভন্ড করে বেড়িয়ে এলাম বাড়ি থেকে। কি করব ভাইয়া, বলতে পার? আমি ত শুধুমাত্র ইন্দ্রজিতকেই মন থেকে ভালোবেসে ছিলাম ভাইয়া।”
কথা গুলো শুনতে শুনতে রিশুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রাগে। শালিনী তারপরে বলে, “বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবো, কারুর কাছে যেতে ইচ্ছে করল না। তারপরে ভাবলাম, আমার ভাইয়া আছে ওর বাড়িতে যাবো। তাই হসপিটাল গিয়ে তোমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে তোমার বাড়ি চলে এলাম। বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, কিন্তু মন কে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। আমিও ভাবলাম যে আমিও অন্যের সাথে শোব, ওকে দেখাব যে আমিও করতে পারি তখন হয়ত বুঝবে যে প্রেমে এইভাবে ভীষণ ধাক্কা খেলে কেমন লাগে। আমি ইন্টারনেট খুলে গিগোলো খুঁজলাম, খুঁজে পেলাম একটা ছেলেকে। বললাম যে টাকা দেব এসে আমার সাথে উদ্দম সেক্স করতে হবে। তোমরা ছেলেরা সব এক জাত, পায়ের মাঝের কুকুরটাকে সামলে রাখতে পার না। এক কথায় রাজি হয়ে গেল ছেলেটা, ওকে বললাম যে হুইস্কি আর সিগারেট নিয়ে এস। এল সে ছেলেটা, জানি না কে, নামটাও হয়ত ভুয়ো।” দুই চোখে অঝোর ধারায় বন্যা বয়ে চলেছে শালিনীর, রিশুর বুকের ওপর আছড়ে বলে, “আই হ্যাড আ অয়াইল্ড সেক্স, পাগলের মতন সেক্স করেছে আমার সাথে। আমি ছেলেটাকে খুব মেরেছি আর গালাগালি দিয়েছি, চুপ করে সব শুনে গেছে। আমি সেই ভিডিও ইন্দ্রজিত কে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
সব কিছু শোনার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিশু, ইন্দ্রজিতের ওপরে ভীষণ ক্রোধে সারা শরীর জ্বলে ওঠে। এই অচেনা দেশে কেউই কারুর হয় না, সবাই কোন মতলবে বন্ধুত্ত পাতায়, সেখানে ইন্দ্রজিতের সাথে একমাত্র ওর ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সুত্রে শালিনীর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় রিশুর। যতদিন শালিনীর সাথে ওর প্রেম হয়নি ততদিন রিশু ওকে বারন করত না। কিন্তু শালিনীর সাথে প্রেম করার পরে রিশু বারন করে অন্য মেয়েদের দিকে তাকাতে, অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে। হটাত ছেলেটার কি যে হয়ে গেল, এবারে শেষ বারের মতন একটা বোঝা পরা করতে হবে ওর সাথে।
ইন্দ্রজিতের সাথে এখুনি একবার কথা বলা দরকার, ফোন উঠাতেই শালিনী ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে, “না ভাইয়া আর নয় আর তুমি ওকে ফোন করবে না। ওর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।”
রিশু ওকে বুঝানোর শেষ চেষ্টা করে বলে, “তাও একবার ওর সাথে কথা বলতে দাও।”
শালিনীর চোখ জোড়া বুজে আসে, মাথা ধরে টলে পরে রিশুর দিকে, সেই সাথে হড়হড় করে বমি করে দেয়। রাগে দুঃখে এতক্ষন যত মদ খেয়েছিল সব রিশুর গায়ের ওপরে বমি করে দেয়। থরথর করে বার কয়েক সকেঁপে ওঠে শালিনীর দেহ, বমি করে চোখ বুজে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে রিশুর গায়ের ওপরে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, সারা জামায় বমির দুর্গন্ধে রিরি করে ওঠে ওর শরীর। তাও নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শালিনীর দেহ পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুয়েই দেয়। বমি করে এতটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল শালিনী যে চোখ খুলে দেখার মতন শক্তি টুকুও ছিল না ওর দেহে। শালিনীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এসে চোখ মুখ মুছিয়ে দেয়। শালিনী ততক্ষনে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শালিনীর দিকে তাকিয়ে দেখে, ঊরুর ভেতর দিকের নরম মাংসে, দুই পেলব বাজুতে নখের আঁচর, ঘাড়ে কাঁধে দাঁতের দাগ, মেয়েটাকে সেই ছেলেটা নরখাদক রাক্ষসের মতন সম্ভোগ করেছে। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার যোগার হয় ওর।
বাথরুমে ঢুকে জামা কাপড় খুলে স্নান সেরে বেড়িয়ে আসতেই আরো এক আশাতীত চমক ওর জন্যে ওর বসার ঘরে অপেক্ষা করেছিল, চন্দ্রিকা। ঘরে ঢুকে শালিনীর ওই অবস্থা দেখে হয়ত দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিল রিশু। চন্দ্রিকার চোখের দিকে তাকিয়ে রিশু বুঝে যায় যে ওর ঘরের এই দুরাবস্থা দেখে ওর মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের ঝড় উঠেছে।
চোয়াল চেপে কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রিশুকে, “এসবের মানে কি অম্বরীশ?”
রিশু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মুচকি হেসে বলে, “কেমন আছো?”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “এসবের মানে কি অম্বরীশ?”
চড়া গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে পরে রিশু, ওর দিকে হাত তুলে থামিয়ে বলে, “কিসের মানে জানতে চাইছ?”
মেঝের ওপরে ছড়ান শালিনীর জামাকাপড় আর মেঝেতে পড়া মদের বোতল দেখিয়ে বলে, “তুমি নাকি ড্রিঙ্ক কর না, তুমি নাকি সিগারেট খাও না? আর এই মেয়েদের পোশাক এইভাবে তোমার মেঝেতে ছড়িয়ে?” শোয়ার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে বিছানায় অর্ধ নগ্ন শালিনী রিশুর একটা জামা গায়ে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে। কাঁপা কন্ঠে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে রিশুর দিকে, “শেষ পর্যন্ত তুমি আমার সাথে…”
রিশু চোয়াল চেপে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “তুমি যা ভাবছ তার বিন্দুমাত্র কিছুই সত্য নয়। এইসব দেখে তুমি যা ধারনা করছ ……”
ছলছল চোখে চেঁচিয়ে ওঠে চন্দ্রিকা, “আমি যা দেখছি তা সব মিথ্যে? সেই দুপুর থেকে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি, এক বারের জন্যেও আমার ফোন রিসিভ করনি। তুমি ব্যাস্ত জানি তাই ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরলে একটু গল্প করব, কিন্তু তুমি যে এইভাবে এত ব্যাস্ত সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। তুমি কি না শেষ পর্যন্ত নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমিকার সাথে সেক্স করলে?”
ভীষণ রেগে যায় রিশু, চন্দ্রিকার দিকে আঙ্গুল তুলে গর্জে ওঠে, “চুপ, একদম চুপ, আগে আমার কথা ঠিক করে শোন তারপরে নিজের কথা বলবে।”
চন্দ্রিকা কিছুই শুনতে নারাজ, চেঁচিয়ে ওঠে রিশুর দিকে, “কি ভাবতে বলছ অম্বরীশ, তোমার বিছানায় তোমার জামা পরে শালিনী শুয়ে রয়েছে, দেখেই বোঝা যায় ওর গায়ে শারট ছাড়া আর কিছুই নেই। এইদিকে তুমি শুধু মাত্র একটা তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছ। শালিনীর জামা কাপড় থেকে পরনের অন্তর্বাস পর্যন্ত তোমার ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সিগারেট আর মদের গন্ধে ঘরে টেকা দায়। এইসব দেখার পরেও তুমি বলবে যে তুমি কিছু করনি? তুমি নাকি শালিনীকে বোন বলে ডাকো? ও নাকি তোমাকে রাখী পড়িয়েছে, এই তোমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক?”
শেষের কথাটা কানে যেতেই মাথায় রক্ত চেপে যায় রিশুর, চোয়াল চেপে চন্দ্রিকার দিকে আঙ্গুল তুলে দরজা দেখিয়ে বলে, “তোমার যখন আমার প্রতি কোন বিশ্বাস নেই, তুমি যখন আমার কথা কিছু শুনতে চাইছ না তখন বেড়িয়ে যাও বাড়ি থেকে। মিস চন্দ্রিকা পশুপতি, আমার মা ছাড়া অন্য কারুর কাছে আমি জবাবদিহি দিতে নারাজ। আমি আজ পর্যন্ত আমার মা ছাড়া অন্য কারুর সামনে মাথা নত করিনি, এমন কি পাপার সামনেও নয়। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে রাখো, ভুল আমি নই ভুল তুমি করছ।”
খোলা দরজা দিয়ে ভাঙা বুক নিয়ে সেদিন বেড়িয়ে যায় চন্দ্রিকা, সেদিনের পরে আর কোনদিন ওদের দেখা হয়নি, সেটাই ছিল ওদের শেষ দেখা। চন্দ্রিকা বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল রিশু, রাগে দুঃখে সারা শরীর জ্বলে উঠেছিল ওর, ভালোবাসার অপর নাম বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস যখন নেই তখন ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই চলে যায়। রিশু এটাও বুঝতে পেরেছিল যে চন্দ্রিকা কোনদিন হয়ত কোলকাতা যেত না, হয়ত ওকে জোর করত দিল্লীতেই থেকে যেতে, ওর বাড়ির সাথে যে মানিয়ে নিতে পারবে না সেটা অবশ্য অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল রিশু। সেদিন প্রতিজ্ঞা করে রিশু আর কাউকে প্রেম করবে না, কোন তৃতীয় ব্যাক্তিকে নিজের পরিবারের মধ্যে টেনে আনবে না।

প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন রাতে যখন মায়ের সাথে কথা হয়েছিল, মা ওর গলার আওয়াজ পেয়েই বুঝে গিয়েছিল কিছু একটা হয়েছে। মাকে সব কথা খুলে জানিয়েছিল রিশু, সাথে এটাও জানিয়ে দিয়েছিল জীবনে কাউকেই আর বিয়ে করবে না, কারণ ও চায়না কোন তৃতীয় ব্যাক্তি এসে ওদের পরিবারের মাঝে কোন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করুক। আম্বালিকা বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল রিশুকে বুঝাতে, কিন্তু রিশু চন্দ্রিকার কাছে জবাবদিহি দিতে নারাজ, ভুল সে করেনি সুতরাং কারুর সামনে ঝুঁকতে নারাজ, এক অহম বোধ সেদিন কাজ করেছিল ওর মধ্যে।
সেই রাতে ইন্দ্রজিত ওর বাড়িতে এসেছিল, রিশুর সাথে খুব ঝগড়া হয়েছিল, রাগের বশে রিশু ইন্দ্রজিতের কলার চেপে ধরে এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের পরে প্রায় দুই বছর, রিশুর সাথে ইন্দ্রজিতের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, শালিনীর সাথেও ইন্দ্রজিতের সম্পর্ক বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। দুই বছর পরে শালিনী আর ইন্দ্রজিতের মধ্যে আবার নতুন করে প্রেমের দানা বাঁধে। ততদিনে ইন্দ্রজিত অনেক শুধরে যায়। ওদের এমএস শেষ হওয়ার পরে ইন্দ্রজিত আর শালিনীর বিয়ে হয়।
মাঝে মাঝেই শালিনী আক্ষেপ করে রিশুকে বলে, “ভাইয়া, আমার জন্য তোমার ভালোবাসা তোমাকে হারাতে হল।”
ম্লান হাসে রিশু, “যে প্রেমে বিশ্বাস নেই সেটা প্রেম নয়, সেটা নিছক একটা রঙ্গিন ধোঁয়া।”
প্লেন এবারে নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিয়েছে, সিট বেল্ট বেঁধে নেওয়ার এনাউন্সমেন্ট হতেই জানালার বাইরে দেখে রিশু। ছোট ছোট আলো গুলো একটু একটু করে বড় হতে শুরু করে দিয়েছে। পারস খুলে একটা হাল্কা গোলাপি রঙের কাগজ বের করে দেখে, কি কারনে এই কাগজ রেখে দিয়েছিল সেটা আর মনে নেই তবে মনে হয়েছিল রেখে দেয়। একবছর আগে চন্দ্রিকার লেখা চার পাঁচ লাইনের একটা ছোট চিঠি।
“ডিয়ার ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, আমি জানি না কে ভুল কে ঠিক, তবে তুমি সেদিন যেভাবে আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছিলে তারপরে মানুষের ওপর থেকে ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। আমি দিল্লী ছেড়ে ফিরে যাই চেন্নাইয়ে। এক সপ্তাহ পরেই আমার বিয়ে। এই চিঠি এই কারনে লেখা কারণ তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা আর এত বছর পরেও আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। পারলে উত্তর খুঁজো নিজের কাছে, কেন তুমি আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করলে। ইতি তোমার চন্দ্রিকা।”
যে ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই সেই ভালোবাসার কোন অর্থ নেই। মা ওর জন্য মেয়ে দেখেছে, মায়ের কথা অমান্য করার সাধ্য ওর নেই। শেষ বারের মতন চিঠিটা পড়ে, ছিঁড়ে ফেলে রিশু। চন্দ্রিকা চলে যাওয়ার পরে একাকীত্ব কাটানোর জন্য পড়াশুনা নিয়েই পরে থাকত রিশু, ইতিমধ্যে ওর বেশ কয়েকটা পেপার দেশ বিদেশের বেশ কয়েকটা মেডিকেল জার্নালে ছাপা হয়েছে। মেধাবী ছাত্র আর ভালো সার্জেন হিসাবে অরথপেডিক বিভাগে ওর বেশ নাম হয়েছে।
প্লেন থেকে নেমে মোবাইল খুলে দেখে মায়ের আর বোনের প্রচুর মিসকল। মাকে ফোন করে জানতে পারে যে দিপ আর দিয়া এয়ারপোর্টে ওকে আনতে গেছে। ঘড়ি দেখল রিশু, রাত প্রায় তিনটে বাজে, এত রাতেও ওর ভাই বোনের চোখে ঘুম নেই ভাবতেই হাসি পায়। বুঝতে পেরে যায় যে ওদের আনন্দের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখে ওর জন্য অধীর অপেক্ষায় দিয়া আর দিপ। রিশুকে দেখতে পেয়েই দিপ দৌড়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরে, পেছনেই দিয়া তার সাথে অচেনা একটা মেয়ে।
ঝিলিক রিশুকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে, পার্থের সাথে ওর দিদি কয়েক বার দেখা করিয়েছিল, সত্যি বলতে পার্থকে একদম পছন্দ হত না ওর। কেমন যেন গায়ে পড়া ছেলেটা, শুধু ছুতো খুঁজত ওর গায়ে একটু হাত লাগানোর। এমনিতেই দিদি তখন প্রেমে বিভোর ছিল তাই পার্থের কোন দোষ দেখতে পেত না। দিয়ার দাদাকে দেখে মনে হল, ভদ্রলোক সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। বেশ লম্বা চাওড়া, প্রসস্থ কাঁধ, চোখে চশমা, চোখ দুটো ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত, চেহারা দেখলেই বোঝা যায় বেশ শান্ত প্রকৃতির ছেলে। পরনের পোশাক খুব সাধারন হাল্কা হলদে রঙের জামা আর একটা গাড় নীল রঙের জিন্স আর একটা মোটা জ্যাকেট। এ নাকি এইএমেস এর ডাক্তার, ভাবতেই কেমন যেন লাগে ওর। হয়ত যারা সত্যিকারের শিক্ষিত তাদের এই পোশাক আসাকে বিশেষ রুচিবোধ হয়ত থাকে না।
দিপ দাদার বাজু ধরে ঝুলে আবদার করে বলে, “এবারে কিন্তু দিদির মতন আমার একটা ট্যাব চাই।”
রিশু ভাইয়ের কান টেনে আদর করে উত্তর দেয়, “তোর হাত ভাঙা আমি বের করে দেব। আগামি সপ্তাহ থেকে ক্লাস টেস্ট শুরু, আজকে ত পড়াশুনা কিছুই করিস নি মনে হচ্ছে।”
দিপ উত্তরে বলে, “আরে বাবা একটা দিন ত, স্কুলের পরেই ত এই বাড়িতে এসেছি।”
দিয়া দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ফ্লাইটে ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে?” বলেই ঠোঁট চেপে হেসে ফেলে। প্রতিবার এই ধরনের প্রশ্ন দাদাভাইকে করে ওর মা।
বোনের কান ধরে টেনে আদর করে বলে, “তোদের জ্বালায় কি আর ঘুম হয়? বিকেলে তোর হোয়াটসাপে ফিসিক্সের প্রাক্টিকালের যে ডায়াগ্রামটা পাঠিয়েছিলাম সেটা কি খাতায় করেছিস?”
দিয়া আদুরে কন্ঠে উত্তর দেয়, “প্লিজ দাদাভাই এখন থেকেই তুমি আমার পড়াশুনা নিয়ে পড়বে?” বলে ঝিলিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এটা ঝিলিক, ঝিনুক দিদির বোন আর আমার প্রিয় বান্ধবী।”
আলতো মাথা নুইয়ে ঝিলিক রিশুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, রিশু হাত মিলিয়ে দিয়ার কানে কানে প্রশ্ন করে, “ব্যাপারটা একটু ঝেড়ে কাশ ত?”
হেসে ফেলে দিয়া, “ওদের বাড়ি চল মাম্মা তোমাকে সব বলবে।” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন নিয়ে তাকাতেই দিয়া দাদার হাত ধরে টেনে বলে, “চলত আগে, বাড়ি গিয়ে মাম্মার মুখে সব শুনতে পারবে।”
বোনের মাথায় আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “বলবি না ত, ঠিক আছে, এইত তোর দাদার প্রতি ভালোবাসা…” বলেই হেসে ফেলে।
দিয়া মুখ ব্যাজার করে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “তুমি না সত্যি ইমোশানাল ব্লাকমেল করতে ওস্তাদ।”
রিশু মুচকি হেসে বলে, “লিভাইসের জিন্স…”
দিয়া চোখ বড়বড় আদর আবদার করে, “প্লিজ দাদাভাই ওটা চাইইইই চাই।”
রিশু হেসে বলে, “আচ্ছা বাবা দেব বলেছি ত, তবে রেজাল্ট দেখে।”
গাড়িতে চেপে রওনা দেয় ওরা, এর মাঝে আরো একবার মায়ের ফোন আসে রিশুর কাছে। সামনের সিটে দিপ, পেছনের সিটে ঝিলিক আর রিশুর মাঝে দিয়া বসে। ঝিলিক পাশে বসে তিন ভাই বোনের এই নিবিড় সম্পর্ক দেখে আর মনে মনে হাসে। দিল্লীর এইএমএসের নাম কারুর অজানা নয়, বিখ্যাত সেই মেডিকেল কলেজ হসপিটালের অরথপেডিক সারজেন ওর বান্ধবীর দাদাভাই, নিশ্চয় ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ, কাজের সময়ে হয়ত নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। তাও ভাইয়ের কবে পরীক্ষা, বোনের প্রাক্টিকালের জন্য কোন ডায়াগ্রামের প্রয়োজন, ভাইয়ের কি চাই বোনের কি চাই সব মনে আছে। সব থেকে আশ্চর্য যেটা লাগে ওর যে ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনে সেই রাতেই দৌড়ে এসেছে দেশের অপর প্রান্ত থেকে।
বাড়ির দিকে যেতে যেতে, দিয়া মোবাইল খুলে নাম পরিচয় না জানিয়েই ঝিনুকের ছবি দেখিয়ে দাদাকে প্রশ্ন করে, “দাদাভাই একে কেমন দেখতে?”
ছবির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে রিশু, বেশ সুন্দরী, ফর্সা গায়ের রঙ, হাসিটা ভীষণ মিষ্টি। বাড়ন্ত দেহের গঠন হলেও চেহারায় সুমধুর কচি কচি ভাব। মুখ দেখে মেয়েটার বয়স আন্দাজ করতে চেষ্টা করে, ওর চেয়ে অনেক ছোট নিশ্চয় বয়সে।
মাথা দোলায় রিশু, ছোট্ট উত্তর দেয়, “মন্দ নয়।”
ভুরু কুঁচকে তাকায় দিয়া, “ব্যাস এইটুকু?”
রিশু হেসে প্রশ্ন করে, “তুই সামনা সামনি দেখেছিস?”
মাথা দোলায় দিয়া, “হ্যাঁ, আসলে কিন্তু এই ছবির চেয়েও ভীষণ সুন্দরী দেখতে।” বলেই ফিক করে হেসে ফেলে।
রিশু মাথা নাড়ায় আর হাসে, “আমাকে বলির পাঁঠা পেয়েছিস তোরা আর কি।”
দিয়া বড় হয়েছে, অনেক কিছু এখন বুঝতে শিখেছে, জানে চন্দ্রিকার কথা তাই দাদার হাত চেপে বলে, “আমি জানি এইভাবে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসা একদম উচিত হয়নি কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না দাদাভাই।”
হেসে ফেলে রিশু, ওর সেই ছোট বোন আর সেই ছোট নেই, চোখের সামনে দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সস্নেহে মাথায় চুমু খেয়ে বলে, “ওরে আমার ঠাকুমা রে, তুই যে দেখতে দেখতে এত বড় হয়ে গেলি সেটা টের পেলাম না।”
দিপ সামনের সিট থেকে দিদিকে চেঁচিয়ে বলে, “ও বাবা, তুই একা বড় হয়েছিস নাকি?”
রিশু ছোট্ট ভাইয়ের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে উত্তর দেয়, “না না, তুই ত একেবারে শাল গাছ হয়ে গেছিস।”

=============== পর্ব তিন সমাপ্ত =============

Leave a Comment